কার্ডে ভার্চুয়াল টাকা

ব্যাংক লেনদেনে স্বস্তির পাশাপাশি আছে শঙ্কাও

এম এইচ রশিদ

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৩:২১ পিএম | আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৩:২৫ পিএম

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের সংকটকালে সহজে মানুষের অর্থের প্রয়োজন মিটিয়েছে ব্যাংকের কার্ড। ঘরে বসেই ব্যাংকের ডেবিড ও ক্রেডিট ব্যবহার করে অনলাইনে কেনাকাটার কাজ করতে পেরেছে। এটিএম বুথের মাধ্যমে নিজে সময়মতো তুলতে পেরেছে নগদ টাকাও। এ জন্য করোনাভাইরাসের সংকটের সময়ও ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে ভার্চুয়াল লেনদেন বেড়েছে। 

লেনদেন প্রক্রিয়াকে সহজ করলেও কার্ড ব্যবহারে রয়েছে কিছু ভোগান্তি। পিনচুরি, নকল কার্ড (ক্লোনিং) তৈরি করে টাকা খোয়া যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। পাশাপাশি ব্যাংকের উচ্চ সুদ ও বাহারি সার্ভিস চার্জ কার্ডসেবা মাঝে মধ্যে তিক্ত করে তুলছে। 

করোনাকালে কেনাকাটায় দেশে ব্যাপকভাবে কার্ডের ব্যবহার বেড়েছে। করোনার আগে কার্ডে যে পরিমাণ লেনদেন হতো, এখন তার চেয়ে দেড়গুণ বেশি লেনদেন হচ্ছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের জুনে ব্যাংকগুলোর ইস্যু করা কার্ডের সংখ্যা ছিল- ২ কোটি ৬০ লাখ ৭১ হাজার ৯৪৮টি। এর মধ্যে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৬৩ হাজার ৭০২টি ডেবিট কার্ড, ১৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৯৬টি ক্রেডিট কার্ড আর প্রিপেইড কার্ডের সংখ্যা ৯ লাখ ৩৪ হাজার ২৫০টি। করোনা শুরু হবার আগে ২০২০ সালের মার্চে ব্যাংকগুলোর ইস্যুকৃত কার্ডের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ১৩ লাখ ৯৫ হাজার ৪৭টি। করোনাকালীন সময়েও কার্ডের গ্রাহক বেড়েছে প্রায় ৪৭ লাখ। 

ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে অনেক গ্রাহকই কার্ড নিতে চাইতো না। এখন অনেকেই কার্ডে ঝুঁকছে। করোনার সময়ে ব্যাংকগুলো প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকদের উৎসাহিত করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের সব ব্যাংকই এখন প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। ওসব সেবায় যোগ হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম, অনলাইন সিআইবি রিপোর্ট, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, প্রি-পেইড কার্ড, ভিসা কার্ড এবং বিভিন্ন প্রযুক্তির এটিএম। ওসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন ও জমা, রেমিট্যান্স বিতরণ, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ ও বেতন-ভাতা প্রদান সবই সম্ভব। তাছাড়া করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই গ্রাহকদের অনলাইন ব্যাংকিংয়ে উৎসাহিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলে আগের চেয়ে ডিজিটাল লেনদেনে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। করোনার সময়ে ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকদের নতুন নতুন সেবা দেওয়া হয়েছে। যাতে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ে। অনলাইন সেবাও বেড়েছে। ফলে এখন মানুষ ঘরে বসেই সব ধরনের সুবিধা নিতে পারছে। সব মিলিয়ে করোনায় ডিজিটাল লেনদেনে গতি বেড়েছে। যার সার্বিক প্রভাব কার্ডের ব্যবহার ও লেনদেনে পড়েছে।

এ দিকে এ প্রসঙ্গে দেশীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে কার্ড সেবায় শীর্ষে বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন জানান, করোনার ভয়ে এখনো অনেকে ব্যাংক শাখায় গিয়ে সেবা নিতে চাইছে না। ফলে বিকল্প সেবার মাধ্যমে ব্যবহার বাড়ছে। সে জন্যই আগের চেয়ে কার্ডের ব্যবহার বাড়ছে। তাছাড়া বিদেশে যাওয়া বন্ধ, আবার বিদেশিরাও আসছে কম। সে জন্য কার্ডে বিদেশি মুদ্রার লেনদেন কমেছে। তবে বিমান যোগাযোগ পুরোদমে চালু হলে বিদেশি লেনদেন স্বাভাবিক হবে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় ক্রেডিট কার্ড আভিজাত্যের প্রতীক হলেও, বর্তমানে এটি জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। চলে এসেছে সাধারণের নাগালের মধ্যে। সাধারণ মানুষের মধ্যে কার্ডকে জনপ্রিয় করতে নানা রকমের সুযোগ-সুবিধা ও ছাড় দেওয়া হয়। ফলে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে চাকরি ও পেশাজীবীরা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। হঠাৎ জরুরি টাকার প্রয়োজনে ক্রেডিট কার্ড বড় সমাধান নিয়ে এসেছে। তা ছাড়া ইলেকট্রনিক, আসবাব, পোশাক, গাড়ি, ভোগ্যপণ্যসহ অনেক কিছু বর্তমানে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কেনা যাচ্ছে। দামি পণ্যের ক্ষেত্রে কিস্তির সুবিধাও মিলছে। হাসপাতালে বিলও দেওয়া যাচ্ছে ক্রেডিট কার্ডে। পকেটে টাকা না থাকলেও সমস্যা নেই, একটি ক্রেডিট থাকলেই খাওয়া-দাওয়া কিংবা বাস-ট্রেন-বিমানের টিকিট কেনাও সহজ হয়ে যায়।

বিল পরিশোধে ছাড় প্রত্যাহার : করোনাভাইরাসের কারণে বিধিনিষেধের সময় ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। সেটি এবার বাতিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে ক্রেডিট কার্ডে নির্ধারিত সময়ের পর বিল পরিশোধে জরিমানা গুনতে হবে গ্রাহকদের। নির্দেশনায় আরও বলা হয়, কোনো গ্রাহক যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ না করেন, তাহলে অপরিশোধিত বিলের ওপর সুদ বা মুনাফা আরোপ হবে নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর দিন থেকেই। এ ক্ষেত্রে কোনোভাবেই লেনদেনের তারিখ থেকে সুদ আরোপ করা যাবে না। বিলম্বে পরিশোধিত কোনো বিলের বিপরীতে বিলম্ব ফি একবারের বেশি আদায় করা যাবে না।

করোনার কারণে সরকারের আরোপ করা বিধিনিষেধের সময় ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ না করলেও বিলম্ব মাশুল আরোপে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় বিল পরিশোধের মেয়াদ, বিলম্ব মাশুল ও সুদসংক্রান্ত বিশেষ সুবিধার নির্দেশনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

ঘটছে জালিয়াতি : নানা সুবিধার পাশাপাশি থামছে না ক্রেডিট কার্ড ও ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে পুরো ব্যাংকিং খাতে এক ভয়াবহ চক্র গড়ে উঠেছে। তারা গ্রাহকদের ভিসা, ডেবিট, ক্রেডিট কার্ড বিভিন্নভাবে হ্যাক করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। গ্রাহকদের কার্ড নম্বর চুরি করে নতুন কার্ড তৈরি করে কেনাকাটাসহ এটিএম মেশিন থেকে টাকা উত্তোলন করে নিচ্ছে। এমনকি বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিসের পিন নম্বর জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তারও যোগসাজশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে এসব জালিয়াতিতে। এই চক্রটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক হ্যাকারদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। কিছু কিছু ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি ঠেকাতে নির্দিষ্ট সময় বন্ধ রাখছে এটিএম বুথের কার্যক্রম। ফলে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন সাধারণ গ্রাহকরা। বাংলাদেশে বড় ধরনের হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি থাকা সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিক বার সতর্ক করে চিঠি দিয়েছে ব্যাংকগুলোকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটিএম বুথ বন্ধ রেখে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি ঠেকানো যাবে না। আইটি দিয়েই আইটি সমস্যার সমাধান করতে হবে। 

ক্রেডিট কার্ডে ট্যাক্স : ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহকদের পকেট থেকে কর কাটা শুরু করেছে সরকার। সর্বনিম্ন ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত কর আদায় করা হচ্ছে। ২০২০ সাল থেকে এটি কার্যকর করা হয়েছে। চলতি মাসের শুরু থেকে বিভিন্ন ব্যাংক করের টাকা কেটে রাখছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্রেডিট কার্ডের ব্যালান্স গ্রাহকের ঋণ। এই ঋণের ওপর সবচেয়ে বেশি হারে সুদ আদায় করে ব্যাংকগুলো। এখন উচ্চ সুদের পাশাপাশি ট্যাক্স কাটছে সরকার। 

বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্রেডিট ও প্রিপেইড কার্ডের ঋণস্থিতি বা ব্যালান্সের ভিত্তিতে সম্পূরক শুল্ক হিসেবে এই কর কাটা হবে। এ জন্য ৪টি স্তরে ভাগ করে পৃথক পৃথক পরিমাণ কর কাটা হবে। ক্রেটিড কার্ডের ব্যালান্স ১ থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত হলে কোনো কর কাটা হবে না। তবে ১ লাখ ১ টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ হলে সম্পূরক শুল্ক হবে ১৫০ টাকা। ৫ লাখ ১ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যালান্স হলে ৫০০ টাকা কর কাটা হবে। আর ১০ লাখ ১ টাকা থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ক্রেডিট কার্ডের ঋণস্থিতি হলে কর আদায় করা হবে ৩ হাজার টাকা। বাৎসরিকভিত্তিতে এই কর আদায় করা হবে। 

ভোক্তা স্বার্থরক্ষণে গঠিত কনসাস কনজিউমারস সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, ক্রেডিট কার্ড ছোট অংকের ভোক্তা ঋণ; কিন্তু এর বিপরীতে সুদ হার অনেক বেশি। আবার রয়েছে নানা রকমের চার্জ। এখন সরকার আবার কর আদায় শুরু করেছে। এটি ভোক্তাদের ওপর জুলুম। আমরা দাবি করছি, এই ঋণের ওপর আরোপিত সম্পূরক শুল্ক অতি দ্রুত প্রত্যাহার করা হোক।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh