উন্নয়ন প্রকল্পে করোনার থাবা

এম এইচ রশিদ

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:৩৮ এএম

ছবি- সংগৃহীত

ছবি- সংগৃহীত

দেশের জন্য সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প এবং বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুর কাজ গত ৩০ জুন শেষ হবার কথা ছিল; কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে কাজ এগোনো সম্ভব হয়নি। এ জন্য আরও দুই বছর এই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

শুধু পদ্মা সেতু নয়, অধিকাংশ বড় প্রকল্প যেগুলো গত অর্থবছরে শেষ হওয়ার কথা ছিল, তা শেষ করা সম্ভব হয়নি। গত অর্থবছর এবং আগের অর্থবছর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের অদক্ষতা বরাবরই ছিল। এখন যুক্ত হয়েছে করোনাভাইরাসের সংকট। এ জন্য অনেক প্রকল্পই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। 

বাংলাদেশে প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই এই মহামারিতে বাংলাদেশেও সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ঘিরে বিভিন্ন মাত্রায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তাই পর পর দুই অর্থবছর করোনার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। 

দেশের জন্য আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্প। গত জুনে যা শেষ হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু করোনা মহামারির কারণে এই সময়ের মধ্যে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হবে না। এমন বাস্তবতায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে পঞ্চম দফায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ল। সে অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুনের মধ্যে যানবাহন চলাচলের জন্য সেতুটি খুলে দেওয়া হবে। পরের এক বছর রাখা হয়েছে ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড (ডিএলপি) হিসেবে। এই এক বছরে সেতুতে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে তা ঠিকাদার নিজ টাকায় ঠিক করে দেবে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘সেতু বিভাগ আমাদের বলেছে, করোনা মহামারি ও গত বছরের বন্যার কারণে কাজের গতি ব্যাহত হয়েছিল। পদ্মা সেতু প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে তারা। আমরা প্রস্তাবটিকে যৌক্তিক ভেবে অনুমোদন করেছি। তবে এ জন্য পদ্মা সেতু প্রকল্পের খরচ বাড়েনি।

এ দিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে উৎকণ্ঠাজনক পরিস্থিতির মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরের এডিপিতে এই ৩৫৬ প্রকল্প সমাপ্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে একটি তালিকা যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প রয়েছে ৩২৪টি, কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ২৭টি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নের ৫টি প্রকল্প রয়েছে। এ দিকে গত অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে আবশ্যিকভাবে সমাপ্ত করার জন্য ৪৪২টি প্রকল্প নির্ধারণ করা হয়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৩৮৫টি প্রকল্প শেষ হয়। যে ৫৭টি শেষ হয়নি, এর মধ্যে আবার ১৭টি প্রকল্প ২০১৯-২০ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতেও ছিল।

এ দিকে আইএমইডির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০৫টি প্রকল্প সমাপ্ত করার লক্ষ্য ছিল; কিন্তু এগুলোর মধ্যে মাত্র ১৪১টি প্রকল্প সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া সমাপ্তের জন্য নির্ধারিত নয় এমন ৪১টি প্রকল্পও সমাপ্ত করা হয়। এতে মোট সমাপ্ত প্রকল্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮২টি; কিন্তু এগুলোর মধ্যেও আবার শতভাগ কাজ শেষ করে সমাপ্ত করা হয় ৯০টি প্রকল্প। বাকি ৯২টি প্রকল্প শতভাগ কাজ না করেই শেষ করা হয়। এ ছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাস্তবায়ন করার লক্ষ্য ছিল ৩৪৬টি উন্নয়ন প্রকল্প; কিন্তু সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় ২৪৫টি প্রকল্প। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের লক্ষ্য ছিল ২৯২টি, আর শেষ হয়েছে ১৮৮টি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে সমাপ্তের লক্ষ্য ছিল ৩১৫টি, শেষ হয়েছে ২৪৩টি প্রকল্প।

পরিসংখ্যান বলছে, মন্ত্রণালয় এবং অধীনস্থ আমলাতান্ত্রিক বিভাগের পেছনে খরচ বাড়লেও তাদেরই নেওয়া প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রকল্পের টাকা খরচে অহেতুক জটিলতা এড়াতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা বাতিল করা হলেও, প্রশাসন তার সুফল নিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিপরীতে বিভিন্ন অজুহাতে সময়ক্ষেপণের পর অর্থবছরের শেষে তড়িঘড়ি করে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। এতে ঠিকাদার ও সরবরাহকারীরা অল্প সময়ে যেনতেনভাবে কাজ শেষ করায় এর গুণগত মানও নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না অনেক সময়। তাছাড়া অব্যবস্থাপনার ক্ষতিও বহুমাত্রিক। এমন সব প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, যা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আবার ওইসব বরাদ্দ দিতে গিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শিল্প খাতে বরাদ্দ কমে যায়। এক্ষেত্রে যে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর বাস্তবায়ন সক্ষমতার অভাব রয়েছে, সেগুলোকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি সমস্যার মূল দিকগুলো খুঁজে বের করা প্রয়োজন। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ধরে ধরে সক্ষমতার ঘাটতি মোকাবেলায় পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো যাচাই-বাছাই করেই প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধিকাংশ প্রকল্পই যথাসময়ে বাস্তবায়িত হয় না। বারবার সময় ও খরচ বাড়ানো হয়। বর্তমানে করোনা মহামারি নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি করেছে। এটিকে অন্যতম প্রধান বাধাও ধরা যায়। তবে কেন প্রকল্প শেষ হয় না, এর প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এছাড়া যাদের গাফিলতির কারণে এসব প্রকল্প শেষ হয় না, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। 

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাকালীন অর্থনীতির দুটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। একটি হলো ভোগব্যয় চাঙা করা, অন্যটি রাজস্ব আদায় বাড়ানো। মানুষ কাজ হারিয়েছে, চাকরি মিলছে না, আয়ও কমে গেছে। ফলে যে মাত্রায় অর্থনীতি গতিশীল হওয়া দরকার, সেটি হচ্ছে না। অভ্যন্তরীণ ভোগব্যয় না বাড়লে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আসবে না। এ জন্য বেসরকারি বিনিয়োগের দিকে না তাকিয়ে কর্মসৃজনমূলক প্রকল্প নিতে হবে সরকারকে। চাহিদা দু’ভাবে বাড়ানো যেতে পারে। প্রথমত, মানুষের হাতে, বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের হাতে সরাসরি কিছু টাকা পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। গৃহীতা এ টাকা ভোগ্যপণ্যের ওপর সরাসরি খরচ করে পণ্যের চাহিদা বাড়াবেন। দ্বিতীয়ত, সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে দেশে যে শুধু পণ্যের চাহিদা বাড়বে তা নয়, ফলে দেশের পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটবে। এতে বেসরকারি বিনিয়োগও খানিকটা বাড়তে পারে। 

করোনার কারণে সৃষ্ট সংকটে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। উন্নয়ন কাজে খরচ করা হয় ১ লাখ ৭২ হাজার ৫০ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে ৮২ দশমিক ২১ শতাংশ। তার আগের বছরে বাস্তবায়ন হয় ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ করোনার কারণে পর পর দুই বছর ১৮ ও ২০ শতাংশ হারে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি; কিন্তু প্রয়োজন ছিল সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে অর্থনীতির গতি বাড়ানো। এক্ষেত্রে যেসব প্রকল্পে কাজের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে, সেগুলো অগ্রাধিকার দিয়ে যথাসময়ে বাস্তবায়ন করতে হবে; কিন্তু এখানে বড় দুর্বলতা আছে। দেখা যায়, অনেক বড় প্রকল্পে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হলেও, তা ঠিকমতো খরচ করতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। টাকা ফেরত যাচ্ছে। অর্থবছরের শুরুতে কাজের দিকে সতর্ক দৃষ্টি দিলে এ অবস্থা হতো না। 

আগের বছরের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত দুই অর্থবছরের আগে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এত কম হয়নি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের উন্নয়ন বাস্তবায়নের হার ছিল ৯৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তার আগের দুই বছর ছিল যথাক্রমে ৯৪ এবং ৮৯ শতাংশ। 

কিন্তু করোনার কারণে অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে চলতি বছরও বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির। বেসরকারি বিনিয়োগ শ্লথ। ব্যক্তি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যয়সংকোচন বা কৃচ্ছসাধনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিপুলসংখ্যক লোক বেকার ও দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। গত বছর অঘোষিত লকডাউনে অনেক মানুষ কাজ ও আয় হারিয়েছেন। তাদের অনেকেই পুনরায় কাজে যোগ দিতে পারেননি। এর মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। যদিও কিছুটা কমে আসতে শুরু করেছে। দীর্ঘ সময়ের অচলাবস্থায় বিপুল শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর আয়-উপার্জন নেই। ফলে ভোগব্যয়েও মন্থরতা বিরাজ করছে। বলা চলে, নানা দিক থেকে বর্তমানে অর্থনীতি সংকুচিত। 

চলতি মহামারি আমাদের সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। তার মধ্যে প্রধান দুটি চ্যালেঞ্জ হলো- দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থান। গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে, আগের জনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশ বা সাড়ে তিন কোটির সঙ্গে নতুন করে প্রায় আড়াই কোটি দরিদ্র যোগ হয়েছে। সেই হিসাবে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এখন প্রায় ছয় কোটি। অন্যদিকে আগে থেকেই দেশে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি হতাশাজনক, বিশেষ করে তরুণ বেকারত্ব খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিগত বছরগুলোয় জোরালো প্রবৃদ্ধি হলেও কর্মসংস্থান ছিল সীমিত, যাকে অনেকেই কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি বলছেন। করোনাকালে আনুষ্ঠানিক খাতের অনেক কর্মী কাজ হারিয়েছেন। পাশাপাশি বিরাট অনানুষ্ঠানিক খাত তো রয়েছেই। ফলে কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও ঊর্ধ্বমুখী। এ দুটি চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি ন্যূনতম গুণমান বজায় রেখে এডিপি বাস্তবায়ন করা জরুরি। অর্থনীতি ও জননীতিবিদদের অনেকের মতে, বাজেট ব্যয় মানেই রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। এতে দেশের অভ্যন্তরে অর্থপ্রবাহ বাড়ে, সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থানের সুযোগ।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh