রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থা: দুরবস্থার জন্য দায়ী কে?

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২১, ০৭:৩৫ পিএম

 ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা

ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা

ঢাকার রাস্তায় পুলিশী হয়রানির প্রতিবাদ জানিয়ে এক ব্যক্তির নিজের মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনায় নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিষয় আবার আলোচনায় এসেছে। নগরীতে অসহনীয় যানজটের কারণে রাইড শেয়ারিং অ্যাপে মোটরসাইকেলের ব্যবহার ব্যাপকহারে বেড়েছে। কিন্তু রাস্তার পরিস্থিতি আরো বিশৃঙ্খল হয়ে উঠেছে।

একদিকে, পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অদক্ষতাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে যানবাহনের চালকদের অদক্ষতার এবং মানুষের আইন ভাঙার প্রবণতার। কোনটা আসলে দায়ী সড়কের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্য- এসব নানা প্রশ্ন নিয়ে এখন আলোচনা চলছে।

ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত শাহবাগ মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, সেই মোড়ের সবকটি রাস্তার মুখেই রাইড শেয়ারিং এর অসংখ্য মোটরসাইকেল দাঁড়িয়ে আছে যাত্রীর অপেক্ষায়। কিন্তু রাস্তাগুলোতে যানবাহনের ব্যাপক চাপে সৃষ্টি হয়েছে যানজট। 

রাস্তায় মোটরসাইকেল চালকদের কয়েকজনের সাথে কথা হয়। তারা যে আইন অমান্য করে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, এমন প্রশ্নে তারা মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা কোন জায়গা বা স্ট্যান্ড না থাকাসহ নানা অভিযোগ তোলেন।

তাদের মধ্যে একজন মোটরসাইকেল চালক আকতার হোসেন খান বলেন, আমাদের বাইক রাখার কোনো স্ট্যান্ড নাই। আমরা যাত্রী নেব কোথা থেকে-সেজন্য আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়েছি।

তিনি আরো বলেন, আমরা যখন রাস্তায় দাঁড়াই দেখা যায়, পুলিশ আইসা দৌড়ানি দেয়, কেউ পালায়া যাইতে পারে আবার কেউ যাইতে পারে না। তখন পুলিশ চাবি নিয়া কাগজপত্র চাইবে। আর কাগজপত্র দিলেই মেশিন টিইপা মামলা দিয়া ফালায়।

রাইড শেয়ারিংয়ের আরেকজন মোটরসাইকেল চালক সাব্বির হোসেন তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, আমাদের ধরলেই পুলিশ কাগজপত্র নিয়া আমাদের এক ঘণ্টা সময় নষ্ট করবে। কাগজপত্র চাইলেই বলবে মামলা দেবো। আর মামলা না দেয়ার অনুরোধ করলেই বলবে, পাঁচশো টাকা দেও-না হলে মামলা হবে। নানা ভোগান্তি হয়।

এসপ্তাহেই গত সোমবার পুলিশের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ তুলে শওকত আলী নামের এক ব্যক্তির ঢাকার বাড্ডা লিংক রোডে নিজের মোটরসাইকেল আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনা ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে।

অফিস শুরু সময় পিক আওয়ারে যখন শাহবাগ মোড়ে তীব্র যানজটের মধ্যে যাত্রীর অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেল চালকদের কয়েকজনের সাথে কথা বলি, তারা পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং চালকদের হয়রানি করার বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন।

শাহবাগ থেকে নগরীর আরেকটি ব্যস্ত মোড় কারওয়ান বাজারে গিয়েও সবকটি রাস্তায় অসহনীয় যানজট চোখে পড়ে। বাইক চালকদের অভিযোগ নিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা পুলিশ ইন্সপেক্টর আনোয়ার কবির বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ ঠিক নয়।

তিনি বাইকসহ যানবাহনের চালকদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করেন আইন অমান্য করার। তিনি বলেন, বাস-ট্রাক এবং প্রাইভেট কার থেকে মোটরসাইকেল পর্যন্ত সব ধরনের গাড়ির চালকরা একটু অসচেতন।

ট্রাফিক পুলিশের মাঠের এই কর্মকর্তা কবিরের বক্তব্য হচ্ছে, রাইড শেয়ারিংয়ের সাথে এখন যারা আছে, তারা কিন্তু আগে কোনো না কোনো পেশায় ছিলো। যেকোনো কারণেই হোক-তারা আগের পেশা ছেড়ে রাইড শেয়ারিংয়ে এসেছে। ফলে অদক্ষ চালক যেমন আছে, একইসাথে তারা অনেক সময় ট্রাফিক আইনকে অমান্য করে। তাদের ব্যাপারে আমরা যখন ব্যবস্থা নিতে যাই, তখনই এই অভিযোগগুলো আসে।

কারওয়ান বাজার মোড় থেকে পান্থপথের দিকে যাওয়ার রাস্তায় দেখা যায় তীব্র যানজটের মধ্যে একটি রিকশা উল্টোদিক থেকে আসতে গিয়ে সেখানে পরিস্থিতি আরো জটিল করে ফেলেছে। উল্টোপথে আসার ব্যাপারে জানতে চাইলে সেই রিকশা চালক তার অবস্থানের পক্ষেই যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করেন।

চালক বলেন, যাইতেছিলাম ঐদিকেই। যাত্রীতো উল্টোদিকে যাবেতো। রাস্তাতো আর নাই। এই জন্য মনে করলাম ডান সাইড দিয়া কোনভাবে পার হইয়া সিগ্যানাল পার হইলেই চইলা যাব।

ব্যস্ত রাস্তাগুলোতে বিভিন্ন সময়ই প্রাইভেট কারসহ যন্ত্র চালিত ছোট অন্য যানবাহনেরও উল্টোপথে চলার অভিযোগ পাওয়া যায়। যানজট এড়িয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে মোটরসাইকেল ফুটপাতে উঠিয়ে দেয়ার ঘটনাতো অহরহ ঘটে থাকে। সিগন্যাল না পড়লেও মানুষেরও চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে দৌড়িয়ে রাস্তা পার হওয়ার দৃশ্য নতুন কিছু নয়।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের শিক্ষক অন্বেষা এনাম ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলেন, রাস্তায় নিয়ম না মানার সংস্কৃতি যেমন তৈরি হয়েছে। একই সাথে অল্পগতি থেকে দ্রুত গতির - সব ধরনের যানবাহন একই রাস্তায় চলার কারণে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কাজ করছে না বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, রাস্তাগুলোর ডিজাইন খুব সরল। এর মানে একই রাস্তায় রিকশা থেকে শুরু করে সব গাড়ি, বাস-সব ধরনের যানবাহন চলছে। সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে মানুষের নিয়ম ভাঙা প্রবণতা বেড়েছে। যানবাহানের চালকরাও ভাবে নিয়ম মেনে কী লাভ - আর সমাজের অস্থিরতাও রাস্তায় প্রকাশ পাচ্ছে।

রাস্তা ব্যবহারকারীদের আইন অমান্য করার প্রবণতা, অন্যদিকে পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ- শুধু এই দুই পক্ষের আচরণই কী রাস্তায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কারণ- এই প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের।

তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যথাযথ পরিকল্পনা না নেয়ায় রাস্তায় পুলিশের হয়রানি এবং চালকদের নিয়ম না মানার প্রবণতা বেড়েই চলেছে।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের অধ্যাপক শামসুল আলম বলছেন, ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া রাস্তায় শৃঙ্খলা আসবে না। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানের কোনো ছোঁয়া নাই। আমাদের রাস্তার ধারণ ক্ষমতা কতটা আছে, কত সংখ্যক যানবাহন চলতে পারবে অথবা ভারি যানবাহন চালানোর মতো চালক আছে কীনা, এসব না দেখেই সব অনুমতি দেয়া হচ্ছে। যার ফলে সিস্টেমটা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে এবং এখানে অরাজকতা বা নৈরাজ্য এমন পর্যায়ে চলে গেছে, যা আর ম্যানেজ করা সম্ভব হচ্ছে না।

তাঁর গবেষণা থেকে তিনি জানান, যানজটের জন্য গত কয়েক বছরে মানুষ মোটরসাইকেলের দিকে ঝুঁকেছে। এখন নগরীতে যানবাহনে ৫৬ শতাংশই মোটরসাইকেল। একারণে শুধু শাসন করে, চাপ দিয়ে বা বড় আইন করে রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না।

ঢাকার রাস্তাগুলোতে ডিজিটাল সিগন্যাল বসানো হয়েছিল ২০১৩ সালে। কিন্তু সেগুলো কোন কাজে আসেনি। পুলিশ ম্যানুয়ালি সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করছে। অধ্যাপক আলম জানান, ঢাকার রাস্তার বাস্তবতা অনুযায়ী সেই উদ্যোগ ছিলো না। সেকারণে তা ব্যর্থ হয়েছে।

ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মুনিবুর রহমানও গণমাধ্যমকে বলেন, ঢাকার রাস্তার চরিত্র পর্যবেক্ষণ করে ট্রাফিক সিগনালের ব্যবস্থা করা উচিত। ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিকের চরিত্র একেক জায়গায় একেক রকম। গাড়ীর ধরন একেক জায়গায় একেক রকম। কোথাও যন্ত্র ছাড়া আবার কোথাও যন্ত্র ছালিত গাড়ি চলে। ফলে এক অঞ্চলের স্যিগনাল সিস্টেম আরেক অঞ্চলে কাজ করবে না। সেজন্য ওই পদ্ধতিটা ইউনিক ছিলো না। এখন সমন্বয় করে রাস্তার চরিত্র বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারীরা মনে করেন, শুধু সিগনালই নয়, ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সবকিছুই চলছে। সেজন্য সেখানে পুলিশের হয়রানি করার সুযোগ যেমন থাকে, তেমনি আইন ভাঙার প্রশ্নও আসে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকারীদের মধ্যে অন্যতম ফারিহা ফতেহ বলেন, রাস্তার নিয়ন্ত্রণ ডিজিটাল সিস্টেমে আনা প্রয়োজন। আইন ঠিকভাবে প্রয়োগ না হলে সাধারণ মানুষ আসলে অসহায় হয়ে পড়ে। এখানে রাস্তায় শৃঙ্খলা রাখার জন্য সব বিষয়ে মানুষের ওপর নির্ভরর করতে হয়। আমাদের কিছুই মেকানিক নয়। সেকারণে মানুষের সীমাবদ্ধতা থাকে এবং সমস্যা হয়।

অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মুনিবুর রহমান দাবি করেন, রাস্তা কম থাকা, পার্কিং সুবিধা না থাকাসহ সব সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করেই পুলিশ রাস্তায় ব্যবস্থা নেয়। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে তাও তদন্ত করা হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, আমরা যানবাহনের চালকদের আর্থিক বিষয়ও বিবেচনা করি ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে। কারণ তারা বেশির ভাগই সচ্ছল নয়। ফলে উদ্দেশ্যমূলক অপরাধ না হলে বা গুরুতর না হলে তাদের শুধু সতর্ক করা হয়।

রাস্তায় গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা না থাকাসহ অব্যবস্থাপনার নানা অভিযোগ নিয়ে বিভিন্ন সময়ই আলোচনা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, ঢাকার বাসটার্মিনালগুলো সরিয়ে নিয়ে সেখানে নগরীর ভেতরের যানবাহনের জন্য ব্যবহারের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। মেট্রোরেল হলে সমস্যা থাকবে না। আর এলিভেটেট রেলের কাজ শুরু হয়েছে।

মেয়র বলেন, নগরীর দুই সিটি করপোরেশন মিলে মহাখালির বাস টার্মিনাল সরিয়ে নিয়ে আব্দুল্লাহপুরে ৪০ একর জমি নেয়া হচ্ছে। গাবতলীর বাসটার্মিনাল সরানো হচ্ছে হেমায়েতপুরে। এগুলো হলে অনেক সুবিধা হবে।

তবে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে কবে-তার কোন সময়সীমা কর্তৃপক্ষ বলতে পারছেন না। অন্যদিকে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ব্যাপক নাড়া দিয়েছিল। তখন কর্তৃপক্ষ অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সেসব প্রতিশ্রুতির মধ্যে আইনের সংশোধনী ছাড়া অন্য কিছুই দৃশ্যমান হয়নি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh