থেসার ভালেজো

জীবন-মৃত্যুর ওপারে

সা. আ. শিহাব

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২১, ০৩:২১ পিএম | আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২১, ০৩:২৩ পিএম

ছবি- সংগৃহীত

ছবি- সংগৃহীত

আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের অসামান্য এক কবি থেসার ভালেজোর জন্ম ১৮৯২ সালে স্যান্টিয়াগোতে। স্পেনের ধ্রুপদী কাব্যরীতিকে ভেঙে, পেরুভিয়ান সাহিত্যে তিনিই প্রথম মদানিসমো বা ‘আধুনিকতা’র এক নতুন জোয়ার নিয়ে আসেন এবং অনেকটা র্যাঁবোর ভঙ্গিতে একক বৈপ্লবিক দ্যোতনায় তাকে সুপ্রতিষ্ঠিতও করেন। চিরকাল নিজের জীবন, জীবিকা ও চেতনার সঙ্গে আপোষহীন সংগ্রামী এই অনন্য প্রতিভার মৃত্যু ঘটে ১৯৩৮ সালে, পারিতে, মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে। কবিতা ছাড়া উপন্যাস নাটক ও স্মৃতিকথা লিখেছেন। সম্ভবত, এটিই তাঁর একমাত্র প্রকাশিত গল্প। 

জুলাইয়ের নিথর নিষ্কম্প কাঁটাঝোপ। বাতাস বন্দী হয়ে আছে অতিরিক্ত ফলের বোঝায় অবনত হয়ে থাকা তাদের অসহায় বৃন্তগুলোতে। উত্তরায়ণের পর্বতমালায় কেন্দ্রবিন্দুর মতো জেগে থাকা টিলাগুলোতে ছড়িয়ে আছে অনেক প্রাণহীন মৃত আকাঙ্ক্ষিত।... দাঁড়াও, এ সমস্ত এখন নয়। এসব অন্য কোনো সময়ে হবে। এখন... আহা, কি সুন্দর সে স্বপ্ন!

ওই দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল আমার ঘোড়া। এগারো বছর অনুপস্থিত থাকার পর অবশেষে আমি আমার জন্মস্থান স্যান্টিয়াগোর প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি তখন। হতভাগা বেচারা পশুটা এগুচ্ছে আর আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শুরু করে শীর্ণ আঙুলগুলো পর্যন্ত কান্নায় আকুল হয়ে উঠছে। হয়তো সেই কান্না আমার হাতে ধরে রাখা লাগামের ভেতর দিয়ে ঘোড়াটার ঔদ্ধত কান দুটিতেও ছড়িয়ে পড়ছিল, তারপর নেমে গিয়ে আবার ফিরে আসছিল ওর খুরের ধাতব ধ্বনির মাধ্যমে। মনে হচ্ছিল ঘোড়াটা যেন একই জায়গায় নেচে চলেছে ক্রমাগত- এক বিচিত্র নাচের পদবিন্যাসে যাচাই করে নিচ্ছে আমাদের পথ আর সামনের অজানাকে। আমি কাঁদছিলাম আমার মা, দু’বছর আগে মরে যাওয়া আমার মায়ের জন্যে- যাকে আর কোনোদিনও তাঁর স্বাধীন পুত্রটির ফিরে আসার প্রতীক্ষায় থাকতে হবে না। এই গোটা অঞ্চল, এর সুন্দর আবহাওয়া, পাকা ফসলের মতো লেবুরঙা বিকেল, এখানে-সেখানে পরিচিত দু-একটা বসতবাড়ি সমেত কিছু ভূসম্পত্তি- সমস্ত কিছু একসঙ্গে মিলে আমার মনের গভীরে ঘরে ফেরার জন্য এক আকুল উচ্ছ্বাসময় আর্তি জাগিয়ে তুলতে শুরু করল। আমার ঠোঁট দুটি প্রায় কুঁচকে উঠল, যেন তারা সদা-সর্বদা দুধে-ভরে-থাকা আমার মায়ের অবিনশ্বর স্তন দুটিতে মুখ গুঁজে দেবে। হ্যাঁ, মৃত্যুর ওপারেও।

শিশুকালে মায়ের সঙ্গে আমি নিশ্চয়ই ওই পথ দিয়ে গেছি। কিন্তু না, মা আমার সঙ্গে ওই গ্রামাঞ্চলে যায়নি- আমি তখন বড্ড ছোট। বাবার সঙ্গে গিয়েছিল। তা নিশ্চয়ই অনেক বছর আগেকার কথা। সেটাও ছিল জুলাই মাস, স্যান্টিয়াগোর উৎসবের কাছাকাছি সময়। ঘোড়ার পিঠে বাবা আর মা। বাবা আগে আগে। হঠাৎ, একটা নাগফণী গাছের সঙ্গে ধাক্কা এড়িয়েই, মোড় ঘুরতে ঘুরতে বাবা চিৎকার করে উঠলেন, ‘সাবধান!’

কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে, জিন থেকে পথের পাথরে ছিটকে পড়ল আমার মা। সবাই তাঁকে স্ট্রেচারে করে শহরে বয়ে নিয়ে এলো। মায়ের জন্যে আমি কত্ত কাঁদলাম, অথচ কি হয়েছিল তা কেউ আমাকে বলল না; কিন্তু মা ভাল হয়ে উঠল। উৎসবের আগের রাতেই মা আবার হাসি আর আনন্দে ভরা। তখন মা আর বিছানায় বন্দি হয়ে নেই। সমস্ত কিছুই তখন সুন্দর।

অথচ মায়ের সেই অসুস্থ শয্যাশায়ী অবস্থা- যখন মা আমার প্রতি আরও বেশি করে ভালোবাসা প্রকাশ করত, আমার জন্য অকারণে ব্যস্ত হয়ে উঠত, বালিশের তলা আর রাত- টেবিলের দেরাজ থেকে আমাকে বেশি বেশি করে মিষ্টি খেতে দিত- সেই অবস্থার কথা মনে করে তখন আমি আরও বেশি করে কাঁদছিলাম। কাঁদছিলাম স্যান্টিয়াগোর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে- যেখানে গিয়ে আমি দেখব, মা মরে গেছে... একটা অনাদৃত কবরের গভীরে চিরদিনের মত ঘুমিয়ে আছে আমার মা... আর সেই সমাধির ওপরে ফিসফিস করে কানাকানি করছে পাকা সরষের ঝাড়।

দু-বছরও হয়নি আমার মা মারা গেছে। লিমাতেই আমি প্রথম আমার মায়ের মৃত্যুসংবাদ পাই। সেখানেই আরও জানতে পারি, ভয়ংকর ওই শোকের যন্ত্রণাকে যথাসম্ভব লাঘব করে নেওয়ার আশায় আমার বাবা আর দাদা অনেক দূরে আমার এক কাকার বাড়িতে রওনা হয়ে গেছেন। জায়গাটা ম্যারানন নদীর ওপারে, অরণ্যের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। স্যান্টিয়াগো থেকে আমিও সেদিকে যাব- মাঝখানের উত্তুঙ্গ পাহাড়ি অঞ্চল আর অপরিচিত তাপদগ্ধ অরণ্যের ভেতর দিয়ে আমাকে পেরিয়ে যেতে হবে ক্ষুধাপেটা পথ। আচমকা আমার ঘোড়াটা চিৎকার করে উঠল। হালকা বাতাসে রাশ রাশ ভূষি উড়ে প্রায় অন্ধ করে দিল আমাকে। একগাদা যবের স্তূপ। তারপরেই স্যান্টিয়াগো আমার দৃশ্যপটে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল। অস্তগামী সূর্যের আরক্ত প্রভায় মনে হলো, যেন আগুন লেগেছে ওখানকার বাড়িগুলোর ছাদে ছাদে। পুবদিকে একটা লালচে-হলুদ শৈল-অন্তরীণের শেষপ্রান্তে অপরাহ্নের কমলা রঙে রাঙানো সমাধি-ক্ষেত্রটা তখনও আমি দেখতে পাচ্ছি। এতটা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। সান্ত্বনার অতীত এক সীমাহীন বেদনা আমার সমস্ত অস্তিত্বকে যেন অসাড় করে তুলল। গ্রামে যখন পৌঁছলাম তখন রাত নেমেছে। যে রাস্তায় আমার বাড়ি শেষবারের মত মোড় ঘুরে সেখানে ঢুকতেই দেখি, দরজার কাছে পাথরের বেঞ্চটিতে কে যেন বসে রয়েছে একা, একেবারে একা। এত বেশি একা যে সেই ভয়ংকর একাকীত্ব আমাকে আতঙ্কিত করে তুলল, বিস্মরণে ডুবিয়ে দিল আমার নিবিড় বেদনাবোধকে। আতঙ্কের এক আশ্চর্য আক্রমণে আমার অশ্রু শুকিয়ে গেল। আমি সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। তারপরেই আমার বড় ভাই অ্যানজেল বেঞ্চ থেকে লাফিয়ে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরল। মাত্র কয়েকদিন আগেই কি একটা কাজে ও কাকার বাড়ি থেকে এখানে এসেছে।

সামান্য কিছু খাওয়া-দাওয়ার পর সারাটা রাত-ভোরঅব্দি আমরা জেগে জেগে কাটিয়ে দিলাম। বাড়ির প্রতিটি ঘর, প্রতিটি বারান্দা আর আস্তাবলগুলো আমি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এলোমেলোভাবে গড়ে ওঠা এই পুরনো বাড়িটিকে কি ভালোই না আমরা বাসতাম! বাড়িটি এমন করে দেখার ব্যাপারে আমার তীব্র আগ্রহকে অ্যানজেল স্পষ্টতই এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছিল; কিন্তু জীবনের গভীরতম অতীতের অলৌকিক সাম্রাজ্যে এভাবে ঘুরে বেড়াবার আত্মনিগ্রহকে সে নিজেও রীতিমতো উপভোগ করছে বলে মনে হয়েছিল আমার। স্যান্টিয়াগোতে থাকাকালীন সামান্য দিন কয়টা অ্যানজেল একা একা ওই বাড়িতেই বাস করেছে। সে বলেছিল, মায়ের মৃত্যুর সময় বাড়ির সমস্ত কিছু যে অবস্থায় ছিল, এখনো ঠিক তেমনিভাবেই আছে। মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে সুস্থ অবস্থায় মায়ের শেষ ক’টা দিন আর তাঁর শেষ মুহূর্তগুলোর বর্ণনাও অ্যানজেল আমাকে দিয়েছিল। ভ্রাতৃত্বের নিবিড় আলিঙ্গন ওই সময় কতবার যে আমাদের হৃদয় বিদ্ধ করেছে!

‘এই সেই ভাঁড়ার ঘর! এখানে মিথ্যে করে চোখে জল এনে আমি মায়ের কাছে রুটি চাইতাম।’ বলতে বলতে আমি ছোট্ট একটা জীর্ণ দরজা খুলে দিলাম।

এইমাত্র যে সদর দরজাটা আমি পেরিয়ে এলাম, পেরুর পার্বত্য গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ বাড়ির মতো সেখানে একটা শান বাঁধানো বেঞ্চ আছে। পেছন দিকে হেলে পড়া ওই বেঞ্চটি নিঃসন্দেহে আমার শিশুকালের সেই বেঞ্চটিকে ইতিমধ্যে অসংখ্যবার মেরামতি আর পলেস্তারা করানো হয়েছে। জীর্ণ দরজাটা খোলা অবস্থায় রেখে আমরা দুজনে ওই বেঞ্চটিতে গিয়ে বসলাম। সঙ্গে নিয়ে আসা ম্লান লণ্ঠনটাকেও রাখলাম সেখানে। লণ্ঠনের আলো তির্যকভাবে অ্যানজেলের মুখে ছড়িয়ে পড়ছিল। রাত গড়িয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে অ্যানজেলের মুখটা প্রতি মুহূর্তেই আরও বেশি করে ফ্যাকাশে হয়ে উঠছিল। শেষ পর্যন্ত মুখটা একেবারে স্বচ্ছ, যেন আলোকভেদ্য হয়ে উঠেছে বলে মনে হলো আমার। ওকে ওই অবস্থায় দেখে একবার আমি ওর গম্ভীর, দাড়িভরা গালে চুমু দিলাম।

সেই মুহূর্তে হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। গ্রীষ্মকালে পার্বত্য অঞ্চলে যেমন বজ্রপাত হয়, তেমনি হয়েছে অনেক দূরে কোথাও- কিন্তু ইতিমধ্যে শব্দটা গেছে হারিয়ে। চোখ রগড়ে আমি অ্যানজেলের মুখোমুখি হলাম। অথচ সেখানে কেউ নেই, কিছু নেই। না অ্যানজেল, না লণ্ঠনটা, না সেই বেঞ্চ। অথচ আমি কিছুই শুনতে পাইনি। মনে হলো আমি যেন একটা কবরের মধ্যে রয়েছি... তারপর ফের আমি আমার ভাই, লণ্ঠন আর বেঞ্চটিকে দেখতে পেলাম। মনে হলো, অ্যানজেলের মুখটা যেন আগের চাইতে অনেক সতেজ আর শান্ত দেখাচ্ছে। মনে হলো- আমার ভুলও হতে পারে- যেন আগেকার দুঃখ-কষ্ট আর দুর্বলতা সে কাটিয়ে উঠেছে; কিন্তু হয়ত এ আমার ভুল, হয়ত আমার চোখ দুটিই আমার সঙ্গে ছলনা করছে... কারণ অ্যানজেলের এমনধারা পরিবর্তন একেবারে অবিশ্বাস্য।

‘এখনো আমি মাকে দেখতে পাই,’ আমি বলতে থাকি। ‘আমাকে মিঠাই দেবে না বকবে, তা বেচারি কিছুতেই ঠিক করতে পারত না। বলত, ‘এবারে আমি তোকে ধরে ফেলেছি, শয়তান। তুই কাঁদার ভান করছিস, কিন্তু আসলে তুই হাসছিস’। তারপর তোমাদের সবার চাইতে মা আমাকেই বেশি করে চুমু দিত, কারণ আমি যে সবার ছোট!’

সেদিন সেই দুঃখময় রাত্রি-জাগরণের পর অ্যানজেলকে আবার সেই আগেকার মত বিধ্বস্ত আর আশ্চর্য রকমের শীর্ণ বলে মনে হয়েছিল আমার- বিদ্যুৎ চমকের আগে যেমনটি লাগছিল, ঠিক তেমনি। বিদ্যুতের ওই আকস্মিক ঝলকানি লেগে নিঃসন্দেহে আমার দৃষ্টিশক্তির কোনো গোলমাল হয়ে গিয়েছিল, তাই ওর মুখে আমি অমন সতেজতা আর উচ্ছ্বাসের প্রাচুর্য দেখতে পেয়েছিলাম- যা আদৌ তখন ছিল না, থাকতে পারে না।

পরের দিন অ্যানজেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি যখন ঘোড়ায় চেপে কাকার বাড়ির দিকে রওনা হলাম, তখনও ভালো করে ভোর হয়নি। অ্যানজেল যে কাজের জন্যে এসেছিল সেটা সেরে নেবার জন্যে আরও কয়েকটা দিন স্যান্টিয়াগোতেই থাকবে।

প্রথম দিনের পথযাত্রা শেষ হবার পর একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। সরাইখানার বাইরে একটা শান বাঁধানো বেঞ্চে হেলান দিয়ে বসে আমি বিশ্রাম নিচ্ছি, হঠাৎ ওখানকার এক বৃদ্ধা আতঙ্কিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে সহানুভূতির সুরে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার মুখে কি হয়েছে গো, সাহেব? দেখে মনে হচ্ছে সারা মুখে রক্ত...’

আমি এক লাফে উঠে পড়লাম এবং সত্যি বলতে কি আয়নায় দেখলাম, আমার সারা মুখে রক্তের শুকিয়ে যাওয়া প্রলেপের দাগ। সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরের ভেতর দিয়ে যেন একটা শিহরণ বয়ে গেল, ইচ্ছে হলো নিজের কাছ থেকে ছুটে পালাই। রক্ত? কোত্থেকে এলো? অ্যানজেল যখন কাঁদছিল, আমি ওর মুখে নিজের মুখ চেপে ধরেছিলাম; কিন্তু... না না! কোত্থেকে এলো এ রক্ত? আমার বুকের মধ্যে আতঙ্ক আর আকস্মিকতার আঘাত দলা পাকিয়ে উঠল। মনের সেই অদ্ভুত বিহ্বলতা আমি আর কোনো দিনও অনুভব করিনি। ভাষায় তা প্রকাশ করা যাবে না- আজ না, কোনো দিনও না। এমন কি আজও- এই নির্জন ঘরে বসে লেখার সময়ও- আমার মনে পড়ে যাচ্ছে, আমার মুখে সেই বাসি রক্তের প্রলেপ, সরাইখানার সেই বৃদ্ধ, সেদিনের সেই দিন আর কান্নায়মুখর হয়ে ওঠা আমার ভাই- আমার মৃতা মা যাকে চুমু দিইনি...

...ওই শেষ লাইনগুলো লেখার পর ঠান্ডা ঘামে নেয়ে উঠে আমি হাফাতে হাফাতে বারান্দায় ছুটে গিয়েছিলাম, এমনই বীভৎস সেই রক্তের স্মৃতি। অবিস্মরণীয় সেই কুটিরে দুঃস্বপ্নের সেই রাত- এক অর্থহীন যুক্তির কলহে আমার মৃত মায়ের স্মৃতির প্রতিমা সেখানে বারবার অ্যানজেলের সঙ্গে বদলে যাচ্ছিল আর তার অশ্রুতে ঝরে পড়ছিল অজস্র চুনীর রক্তিমতা।

আমি আমার যাত্রাপথে এগিয়ে চললাম এবং শেষঅব্দি পাহাড় পর্বত আর তপ্ত অরণ্য ছাড়িয়ে, ম্যারানন পার হয়ে এক সপ্তাহ বাদে একদিন সকাল বেলায় কাকার বাড়ির উপকণ্ঠে এসে পৌঁছলাম। দূরের বজ্রপাতের আওয়াজে থেকে থেকে প্রতি-ধ্বনিত হয়ে ওঠে সেখানকার মেঘলা আকাশ আর মাঝে মাঝে তারই ফাঁক দিয়ে ফুটে বেরোয় সোনা রোদের ঝিলিমিলি।

সদর দরজায় ঘোড়া বেঁধে রাখার খুঁটিটার কাছেই আমি ঘোড়া থেকে নামলাম। পাহাড়ী কুয়াশার বিষণ্ণ নৈঃশব্দ্যের মধ্যে কয়েকটা কুকুর ডেকে উঠল। এবারে আমি ফিরে এসেছি, কতো বছর বাদে ফিরে এসেছি অরণ্যের গভীরে দাঁড়িয়ে থাকা এই নির্জন প্রাসাদে!

মুরগিগুলোর সাবধানী-সংকেতের মতো চিৎকার চেঁচামেচিকে ছাড়িয়ে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো...পাহারাদার কুকুরগুলোকে কে যেন ভেতরে সামনে রাখছে। যতো আশ্চর্য বলেই মনে হোক, আমার কেঁপে কেঁপে ওঠা ক্লান্ত ঘোড়াটা যেন সেই কণ্ঠস্বরটাকে শুঁকছে বলে মনে হলো। তারপরেই সে তার কান দুটোকে প্রায় সোজাসুজি সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে বারবার চিৎকার করতে শুরু করলো... পেছনের পা দুটোকে ওপরে দিকে তুলে আমার হাত থেকে লাগাম ছিনিয়ে পালাবার চেষ্টা করতে লাগলো অবিরাম। সদরের বিশাল দরজাটা তখন বন্ধ হয়ে গেছে। আমি নিশ্চয়ই যন্ত্রচালিতের মতো দরজাটাতে আঘাত করেছিলাম, তাই ভেতর থেকে ফের সেই কণ্ঠস্বর বেজে উঠল এবং পরমুহূর্তে মেরুদণ্ড ঠাণ্ডা করানো শব্দ তুলে সেই বিশাল দরজা খুলে যেতেই আমার ছাব্বিশ বছর বয়সের কাছে সেই বেজে ওঠা কণ্ঠস্বর চিরদিনের মতো থেমে গেল- আমি পড়ে রইলাম অনন্তকালের দিকে তাকিয়ে। দরজার পাল্লা দুটো বন্ধ হয়ে গেল আবার। সমস্ত সম্ভাবনাকে ছাপিয়ে যাওয়া, জীবন-মৃত্যুর সমস্ত নিয়ম-কানুন ভেঙে দেওয়া এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটার কথা মুহূর্তের জন্যে ভেবে দেখুন। অবিশ্বাস্য আর অনন্তের মধ্যে আশা আর বিশ্বাসের কথা, স্থানকালের অনস্বীকার্য বিচ্ছিন্নতা- সবই সুরহীন অচেনা ঐকতানে গড়া এক মেঘলা নীহারিকা, যা মানুষকে বিস্মিত করে তোলে।

মা আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল।

‘বাছা, তুই বেঁচে আছিস?’ আমাকে দেখে মা অবাক বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলো, ‘তুই প্রাণ ফিরে পেয়েছিস?... ওগো আল্লাহ, এ কি দেখছি আমি?’

মা! আমার মা! দেহ আর আত্মা নিয়ে মা এখনও বেঁচে আছে! এত ভীষণভাবে বেঁচে আছে যে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো, আচমকা আমি যেন নাকের সামনে দু’টি শিলাখ- দেখতে পেলাম। ধ্বংসস্তূপ থেকে খসে পড়া ওই শিলা দুটো ক্রমশ আমার বুকের ওপরে নেমে আসতে লাগল... তাদের চাপে আমি একটা বুড়ো মানুষের মতো কুঁজো হয়ে গেলাম। মনে হলো ভাগ্যের এক আশ্চর্য খেলায় আমার মা যেন এইমাত্র জন্ম নিলো আর আমি যেন অনেক দূর অতীতের দিন থেকে ঠিক সেই সময়টিতেই ফিরে এলাম, যার ফলে মায়ের প্রতি আমি এখন পিতার বাৎসল্য অনুভব করছি।

হ্যাঁ, আমায় মা-ই ছিল সেখানে। পরনে পুরোপুরি কালো পোশাক। জীবন্ত। আদৌ মৃত নয়। কিন্তু তা কি সম্ভব ছিল? না। কি করে তা হতে পারে? অসম্ভব! ওই মহিলা আমার মা নন। হতে পারেন না। আমাকে দেখে উনি কি বলেছিলেন? উনি কি মনে করেছিলেন আমি মরে গেছি?

‘সোনা মানিক আমার!’... চিরদিনই আমার আসার বা যাবার সময় যে আনন্দময় কান্নার উন্মাদনা নিয়ে মা আমার সামনে এসে দাঁড়াত, ঠিক তেমনিভাবেই আমাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরার জন্যে দু’চোখে উদ্গত অশ্রু নিয়ে উনি আমার দিকে ছুটে এলেন। আমি পাথর হয়ে গেলাম। দেখলাম, উনি দুই স্নেহমঃয় বাহু মেলে আমার গলা জড়িয়ে ধরে ক্ষুধিতের মতো আমাকে চুমু দিচ্ছেন, যেন আমাকে খেয়ে ফেলতে চাইছেন... ফোঁপাতে ফোঁপাতে আমাকে কত সোহাগের কথা বলছেন, যা আর কোনোদিনও আমার অস্তিত্বের গভীরে বৃত্ত হয়ে নামবে না।...আচমকা আমার অভিব্যক্তিহীন মুখটা নিজের করপুটে তুলে নিয়ে উনি আমার মুখোমুখি তাকালেন, প্রশ্নের দাপটে শ্বাসরোধ করে তুললেন আমার। কয়েক মুহূর্ত পরে আমিও কাঁদতে শুরু করলাম, কিন্তু আমার অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন হলো না- এমন কি আমি একটু নড়াচড়াও করলাম না। আমার অশ্রু যেন শিলামূর্তির চোখ থেকে চুইয়ে আসা সুবিশুদ্ধ জল।

শেষ পর্যন্ত কোনোক্রমে আমি আমার আত্মার সমস্ত বিকিরিত আলোগুলোকে একত্রিত করলাম। কয়েক পা ফিরে গেলাম পেছনের দিকে। তারপর, হে আল্লাহ, আমি আমার মাকে চোখের সামনে ফুটে উঠতে দেখলাম- যে মাকে আমার মন কিছুতেই মেনে নিতে রাজি নয়, যাকে সে অস্বীকার করে, যাকে সে ভয় পায়। আল্লাহ জানেন কোন পবিত্র লগ্নে আমি তাঁর আবির্ভাব ঘটিয়েছিলাম, কিন্তু সেই মুহূর্ত পর্যন্ত আমার কাছে তা অজানা ছিল। নেহায়েৎতে আছড়ে পড়া হাতুড়ির মতো, জরায়ুর বন্ধন ছিন্ন করে জন্মের মুহূর্তে শিশুর প্রথম কান্নার মতো- যে কান্নার মাধ্যমে শিশু মাকে জানিয়ে দেয় সে জীবন্ত অবস্থায় বাইরের পৃথিবীতে যাচ্ছে, যে কান্নার মাধ্যমে সে মায়ের কাছে এক সঙ্কেত-ধ্বনি রেখে যায়; যার সাহায্যে ভবিষ্যতে তারা পরস্পর পরস্পরকে চিনে নিতে পারবে চিরদিন-ঠিক তেমনি করে মায়ের পরিপূর্ণ উপস্থিতিতে আমি এক নিঃশব্দ চিৎকারে মুখর হয়ে উঠলাম। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমি গুঙিয়ে কেঁদে উঠলাম।

‘কক্ষনো না! কিছুতেই না! আমার মা বহুদিন অগে মরে গেছে। এ হতে পারে না...’

আমার কথায় উনি ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। যেন ওঁর সন্দেহ হলো, আমি সত্যিসত্যিই আমি কি না। তারপর ফের উনি আমাকে নিজের বুকে টেনে নিলেন। আমরা দুজনে মিলে এতো কান্না কাঁদলাম যা কোনো জীবিত প্রাণী আজঅব্দি কাঁদেনি- কাঁদবেও না কোনোদিন। ঠিক সেই মুহূর্তে রক্তের যে দাগ আমি আমার মুখে দেখেছিলাম, তার স্মৃতি অন্য এক পৃথিবী থেকে ভেসে আসা সঙ্কেতের মত আমার মনের মধ্যে জেগে উঠল।

‘বাছা আমার!’ মহিলা ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘তুই কি আমার সেই মরা-ছেলে যাকে আমি নিজের চোখে কফিনের মধ্যে শুয়ে থাকতে দেখেছিলাম? হ্যাঁ, তুই-ই তো! তুই তো সে! আমি ভগবানে বিশ্বাসী। আয়, আমার বুকে আয়! ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখ! আমাকে ছুঁয়ে দ্যাখ, বাছা! তুই বিশ্বাস করছিল না, আমি তোর মা- এও কি সম্ভব?’

ফের আমি মহিলাকে ভালো করে দেখলাম। সাদা চুলে ঢাকা ওঁর প্রাচীন মাথাটা স্পর্শ করলাম। কিন্তু না, আমি কিছু বিশ্বাস করলাম না।

‘হ্যা, আমি আপনাকে দেখেছি... আপনাকে ছুঁয়েছি।’ আমি জবাব দিলাম, ‘কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না। এতোগুলো অসম্ভব ঘটনা কিছুতেই ঘটতে পারে না!’

তারপর অট্টহাসিতে আমি মুখর হয়ে উঠলাম।

ভাষান্তর : সা. আ. শিহাব 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh