‘সবলোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’

আফসার আহমদ

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২১, ০৩:৩৯ পিএম | আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২১, ০৬:৪৯ পিএম

আফসার আহমদ

আফসার আহমদ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সহ–উপাচার্য এবং নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আফসার আহমেদ (৬২) মারা গেছেন। শনিবার দুপুরে রাজধানী ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি সাম্প্রতিক দেশকালের একজন নিয়মিত লেখক এবং শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তার স্মরণে ‘সবলোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’ লেখাটা পুনরায় প্রকাশ করা হলো-

লালন ফকিরকে এখন আর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, তিনি বাঙালির সংগীত জগৎ, ভাববাদী আধ্যাত্মিক সাধনার জগৎ, সম্প্রীতির সংস্কৃতিসহ সামগ্রিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে অনিবার্যরূপে বিরাজমান। শুধু যে ভাববাদী প্রবীণদের কাছে তিনি জনপ্রিয় তা নয়, তিনি সাম্প্রতিককালের সংগীতপিপাসু তরুণ প্রজন্মের নিকটও সমানভাবে সমাদৃত। সবচেয়ে বড় কথা হলো লালনসংগীত সাম্প্রতিক বিশ্বের বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রেম ও দ্রোহের মানবিক প্রকাশ বলে গণ্য। তাই লালন এখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত এবং জনপ্রিয় নাম হিসেবে নন্দিত। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পাশাপাশি স্বতন্ত্র সংগীতকাররূপেও তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত। লালনের সংগীত প্রধানত সাধনসংগীত হলেও চিত্তবিনোদন রূপে সমানভাবে আদরণীয়।

কারণ লালন গানকে সাধনার মাধ্যম হিসেবে অবলম্বন করেছেন। গানকে সাধনার অবলম্বন এই ভূখণ্ডে লালনের আগেও হয়েছে। ঈশ্বরের নিকট নিজেকে নিবেদনের উপায় হিসেবে সংগীতের ব্যবহারের পাশাপাশি বাঙালি জাতি হাজার বছর ধরে যে কোনো দুর্যোগে, বিপন্নতায়, ব্যাধিতে, ব্যক্তিগত অসহায়তা ও দুর্বিপাকে স্রষ্টার কাছে সাহায্য প্রার্থনার একটি অন্যতম মাধ্যম হিসেবে গানকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে। এখনো আমাদের দেশে মানুষের কল্যাণ কামনার উদ্দেশ্যে গাজীর গান, মনসার গান, চণ্ডীর গান, মুর্শিদী গান ও নানা প্রকার মঙ্গল গানের আয়োজন করা হয়। আউল বাউলের এই দেশে এ সকল গান আমাদের আধ্যাত্মিক ও মানসিক শক্তিকে সুদৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে। তাই লালনের গান যেমন আমাদের আধ্যাত্মিক সাধনার সুবর্ণ সঞ্চয় তেমনি মানসিক শক্তি লাভের উৎস বলেও গণ্য হয়েছে।

লালনের ‘ইলাহি আলমিন গো আল্লাহ বাদশাহ আলমপানাহ তুমি/ ডুবায়ে ভাসাইতে পারো ভাসায়ে কিনার দাও কারো/ রাখো মারো হাত তোমারও তাইতে তোমায় ডাকি আমি’ গানটি অসীম নির্ভরতায় আমাদের মনকে স্রষ্টার কাছে সমর্পণ করে। তখন ভক্তের কাছে গান আর গান থাকে না, গান হয়ে ওঠে পরম সত্তার কাছে আত্মনিবেদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। লালনের গান আজ শুধু বাংলাদেশে নয়, বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে নয়, পৃথিবীর বহু দেশের পণ্ডিত, সাধক, সংগীত শিল্পী ও সাধারণ শ্রোতার নিকট ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মানুষের কাছে লালন হয়ে উঠেছেন প্রাণের মানুষ। বাংলাদেশের হাটে-মাঠে-বাটে, পথে-প্রান্তরে, মারফতি-মুর্শিদী গানের আসরে লালনের গীতকথা সুরে সুরে আমাদের প্রাণমন আবিষ্ট করে রাখে। লালনের গান বাঙালির চিত্তের অফুরান ঐশ্বর্যের অন্যতম উদাহরণ। তার বাউল ধর্মে মিশেছে হিন্দু, মুসলমান, বৈষ্ণব, জৈন, বৌদ্ধ প্রভৃতি ধর্মমতের লোকায়ত উপাদান-উপকরণ ও নানাবিধ কৃত্য। বাউলেরা সকল ধর্মের উপরে মানবধর্মকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সকল প্রকার সংকীর্ণতাকে তারা পরিহার করেছেন। মানুষের সঙ্গে মিশে, মানুষের মহিমান্বিত রূপটিকে তারা গানে গানে তুলে ধরেছেন।

লালনের জীবন ও গানের আলোচনায় যাওয়ার আগে কীভাবে লালনের গানের সঙ্গে আমার আত্মিক যোগাযোগ তৈরি হয়েছে তা নিবেদন করছি। লালনের গানের অসাম্প্রদায়িক বার্তা আমাকে বাংলাদেশের মানুষের অন্তরাত্মাকে চিনতে সাহায্য করেছে। বাল্যকালে, আমাদের গ্রাম থেকে দূরের এক আখড়া থেকে আসত বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী আমাদের বাড়িতে। একদিন দুপুরে একতারা বাজাতে বাজাতে এল শশী বৈষ্ণবী। আমাদের বাড়ির উঠোনে বড়ুই গাছের ছায়ায় বসে আমার বাবাকে শুনিয়েছিলেন গান। গ্রামের মানুষের কাছে এরা বৈরাগী বলে পরিচিত। কপালে, নাকে, হাতে তিলক কাটা। মাথায় লম্বা চুল। বৈষ্ণবী সাদা পাড়হীন শাড়ি পরে মাথায় উল্টো খোঁপা বেঁধেছে। আমার বালক-চোখে কৌতূহল। একতারার টুংটাং আওয়াজ আমার চোখে স্বপ্ন এনে দিতো। আমি চোখের সামনে ভাসতে দেখতাম কত প্রান্তর পেরিয়ে বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী এসেছে আমাদের বাড়ি। তারা নেচে নেচে গান গেয়েছিল সেদিন। প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগের কথা কিন্তু ভাবলেই সেই বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীকে চোখের সামনে দেখতে পাই। আমার সামনে বাল্যকাল তখন স্মৃতি ঝলমলে হয়ে ওঠে। আমার মনে আছে শুধু গলায় নয়, সমস্ত শরীর দিয়ে তারা গাইছিল। গানের ফাঁকে ফাঁকে বাবার সঙ্গে নানা তত্ত্ব আলোচনা করেছিল যার কিছুই আমি বুঝিনি; কিন্তু একটি নাম মনের মধ্যে গেঁথেছিল, সে নামটি লালনের। বাউলেরা গান গাইতে গিয়ে লালন ফকিরের নাম আসলেই একতারাসহ যুক্ত করে ঊর্ধ্বে কার উদ্দেশ্যে যেন প্রণাম জানাতো। বড় হয়ে বুঝেছি তারা তাদের আলেখ সাঁইকে প্রণাম জানায়। আমার মায়ের কাছ থেকে ঝোলা ভর্তি করে চাল-ডাল নিয়ে বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী চলে গেল। এই বড় বেলায় এসে চোখ বুজলেই গ্রামের আঁকবাকা পথে তাদের চলে যাওয়ার দৃশ্য ভেসে ওঠে। সেই বাল্যকালে লালনের নাম এবং একটি গানের কলি মুদ্রিত হলো আমার মনে ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’। আমি দেখেছি এরা কোন জাত মানে না। সবার বাড়ি যায়, কারও ছোঁয়ায় তাদের জাত যায় না।

এই বিষয়টি সেই পাকিস্তান আমলের হিন্দু-মুসলমান বিভেদের সময় আমাকে অবাক করেছিল। জাতহীন এই বাউলেরা যে ‘ব্রাত্য এবং মন্ত্রহীন’ তা জেনেছি অনেক পরে। তবে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টি উন্মোচনের সূঁতিকাগার বলতে পারি আমার জীবনে প্রথম শোনা বাউলের কণ্ঠে লালনের সেই গান ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’। কালিগঙ্গা নদীর পাড় ঘেঁষে আমাদের জামশা গ্রামে ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। সন্ধ্যায় মাগরিবের আজান এবং মন্দিরের কাঁসর ঘণ্টার কোনো বিরোধ ছিল না। সন্ধ্যা হলেই বসতো মারফতি মুর্শিদী গানের আসর। বাঁশের আড়ে হারিকেন ঝুলিয়ে মাঝরাত্রি অবধি প্রলম্বিত ছিল সেই গানের আসর। আমাদের বাড়ির বাইরে বাংলা ঘরে মাঝে মাঝেই বসতো গানের আসর। গানের মধ্যমণি থাকতেন শিষ্যদের নিয়ে আমার দাদা বলাই মুনশী। ততদিনে আমি উচ্চবিদ্যালয়ে উঠে গেছি। আমি বেড়ে উঠছি লালন-হাসন রাজার গানের আবহে। লালনের ‘জাত গেল জাত গেল বলে/ একি আজব কারখানা’, ‘বাড়ির কাছে আরশীনগর/ সেখানে এক পড়শী বসত করে/ আমি একদিনও না দেখিলাম তারে’, হাসন রাজার ‘লোকে বলে বলে রে/ ঘর বাড়ি ভালা নাই আমার’ প্রভৃতি গান শুনতে শুনতে বেড়ে উঠছি। লালনের গান এবং মারফতি-মুর্শিদী গান আমার অসাম্প্রদায়িক মনোজগত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমার শিক্ষক বাবা জোসনা রাতে উঠোনে বসে লালনের কষ্টকরুণ বহুবর্ণিল জীবনকাহিনী শোনাতেন আমাদের। লালনের গল্প শুনতে শুনতে আমিও ভেসে চলতাম নাম না জানা নদীর স্রোতে কিংবা প্রান্তরের পথ ধরে হাঁটতাম, কেবলি হেঁটে চলে যেতাম বহু দূরে। হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন লালন। বাবার নাম ছিল মাধব কর। শৈশবে তার বাবা মারা যান। বিধবা মা কষ্ট করে পুত্র লালনকে বড় করেন। যৌবনে লালন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। দারিদ্র্য থাকলেও মা ও স্ত্রীকে নিয়ে সুখেই কাটছিল লালনের জীবন। একবার গ্রামের লোকদের সঙ্গে তীর্থে যান লালন।

তীর্থশেষে ফিরে আসবার পথে তার মারাত্মক গুটিবসন্ত রোগ হয়। অসুস্থ ও অচৈতন্য লালনকে মৃত ভেবে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয় সঙ্গীরা। শুধু তাই নয়, শাস্ত্রীয় আচার মেনে তার মুখাগ্নিও করা হয়। গ্রামে ফিরে এসে তীর্থযাত্রীরা লালনের মায়ের কাছে পুত্রের মৃত্যু সংবাদ জানায়। এও জানায়, সে অনেক ভাগ্যগুণে গঙ্গায় দেহ রাখতে পেরেছে। কয়জনের এমন ভাগ্য হয়! পুত্রহীনা মা পুত্রশোক বুকে নিয়ে জীবনধারণ করেন। বৈধব্য ধারণ করেন যুবতী স্ত্রী। অন্যদিকে কলার ভেলায় ভাসতে ভাসতে মৃতপ্রায় লালন এসে ঠেকেন এক নদীর ঘাটে। লালনকে নদীর ঘাটে মৃতপ্রায় দেখে এক মুসলমান নারী তাকে ঘরে নিয়ে পুত্রস্নেহে সেবাযত্ন করে সুস্থ করে তোলেন। গুটি বসন্তে লালনের একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এইখানেই তিনি বিখ্যাত সিদ্ধ পুরুষ সিরাজ সাঁইয়ের শিষ্য হয়ে ফকিরি গ্রহণ করেন। এভাবে তার বেশ কয়েক বছর কেটে যায়। লালনের ফকিরি সাধনাও চলতে থাকে। কিন্তু তার ফেলে আসা গ্রাম, মা ও স্ত্রীর স্মৃতি কিছুতেই মনের আড়াল হয় না। তাকে কেবলি টানতে থাকে। অবশেষে গুরুর নিষেধ না মেনে অনেকদিন পর, লালন পূর্বজীবনের টানে ফিরে যান নিজের গ্রামে। কিন্তু মুসলমানের ঘরে বসবাস করে মুসলমানের ছোঁয়া অন্ন গ্রহণ করেছিলেন বলে তিনি নিজের গ্রামে আশ্রয় পেলেন না। সমাজপতিরা কোনোভাবেই তাকে নিজের পরিবারের সঙ্গে থাকতে দিল না। এমনকি তার মা জাত যাওয়ার ভয়ে পুত্রকে আশ্রয় দেননি। জাত হারানোর ভয়ে নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীও তার সঙ্গে চলে আসতে পারেননি। তীব্র হতাশা ও প্রবল অভিমানে তিনি ফিরে আসেন তার উদ্ধারকর্তা মলম শাহ ও তার স্ত্রী মতিজান বিবির আশ্রয়ে। এরপর লালন আর পেছন পানে ফিরে তাকাননি। গুরু সিরাজ সাঁইয়ের নির্দেশনায় সম্পূর্ণভাবে ডুবে যান ফকিরি সাধনায়।

কুষ্টিয়া জেলার ছেউরিয়া নামক স্থানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতার জমিদারী এলাকায় আখড়া বানিয়ে শিষ্যদের নিয়ে বসবাস করতে থাকেন। কালে কালে সহস্র সহস্র মানুষ তার নিকট বাউল ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে। এক জীবনে দুই জনম অর্থাৎ মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া লালনের জীবনকথা, তার মধুর কণ্ঠের গান এবং নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে সাধক হিসেবে তার এই ক্রমোত্থান তাকে অলৌকিক মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। তাকে নিয়ে তৈরি হয় নানা রকম গল্পগাথা। লালন ফকির কোন প্রচলিত ধর্মমতে বিশ্বাস করতেন না। যে জাতিভেদ প্রথা লালনকে গৃহে থাকতে দেয়নি সেই প্রথার বিরুদ্ধে সারাটা জীবন সোচ্চার ছিলেন। তবে নিজের অতীত পরিচয় সম্পর্কে লালন নির্বিকার, উদাসীন ও নিশ্চুপ ছিলেন বিধায় তার জীবনী নিয়ে রহস্য ঘনীভূত হয়েছে। নানা জনে নানা ভাবে লালন সাঁইয়ের জীবনী লিখেছেন; কিন্তু তার সঠিক জন্ম তারিখ কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। তবে পণ্ডিতরা প্রায় সকলেই ধারণা করেন যে লালন সাঁই ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর মৃত্যুবরণ করেন আজ থেকে একশত তিরিশ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে। সেই হিসেবে তিনি বেঁচেছিলেন একশত ষোলো বছর। কীর্তি তাকে ছাড়িয়ে গেছে বলেই সময়ের দীর্ঘ অন্ধকার পার হয়ে লালন আজ এই সময়েও বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতিতে প্রাসঙ্গিক ও অপরিহার্য।

একথা ঠিক যে একজন মানুষ যখন নিজের কীর্তিতে ঐ আকাশের সমান হয়ে ওঠেন তখন তাকে নিয়ে নানা কিংবদন্তি, গল্পগাথা তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মিথের আড়ালে মানুষটি হারিয়ে গিয়ে ক্রমে ক্রমে মিথের সত্য হয়ে ওঠেন। মিথের আড়াল থেকে আর সেই মানুষটির জীবন-সত্যকে বের করে আনা সহজ হয় না। এমনটিই ঘটেছে লালন সাঁইয়ের জীবনে। সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি হয়েছে তার জাত নিয়ে অর্থাৎ তিনি হিন্দু না মুসলমান ছিলেন এই বিতর্ক এখনো চলছে এবং আরও কত কাল যে চলবে তা কে বলতে পারবে? যদিও লালন নিজেই এই জাতপাতের বিতর্কের বিষয়টি তার সংগীতমালার অমর সব পঙক্তিমালায় মীমাংসা করে দিয়ে গেছেন। কারণ তার জীবদ্দশায়ই তাকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল তিনি হিন্দু না মুসলমান এই বিতর্ক। কট্টর হিন্দুরা স্বীকার করতো না যে লালন হিন্দু এবং মুসলমান কাঠমোল্লারা বিশ্বাস করতো লালন হিন্দু। লালন লিখেছেন-

সব লোকে কয় লালন ফকির হিন্দু কি যবন।
লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান ॥
একই ঘাটে আসা-যাওয়া
একই পাটনি দিচ্ছে খেওয়া
কেউ খায় না কারও ছোঁয়া
ভিন্ন জল কে কোথা পান।

কত সহজ করে নিজের সম্পর্কে, নিজের ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে এমন নির্ভেজাল সত্য উচ্চারণ করেছেন লালন সাঁই। তবে তার জীবন সম্পর্কে একটি গ্রহণযোগ্য চিত্র তুলে ধরেছেন লালন গবেষকরা। লালনকে নিয়ে তৈরি সিনেমা, উপন্যাস, গল্প, নাটক ও কবিতায় তার জীবন কাহিনী নানাভাবে উঠে এসেছে। কেউ বলেন লালন বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার হারিশপুর গ্রামে জন্মেছিলেন। কেউ বা বলেন, লালন জন্মেছিলেন কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ভাড়ারা গ্রামের এক হিন্দু কায়স্থ পরিবারে। (শ্রীবসন্তকুমার পাল, মহাত্মা লালন ফকির) কারও কারও অভিমত তিনি জন্মেছিলেন যশোর জেলার ফুলবাড়ী গ্রামে। এই সব মত লালনের জন্মস্থান নিয়ে নানারকম বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। লালনকে নিয়ে বিতর্ক বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার পেছনে নানা রকম গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল। লালনের শুরুর কালটা, অর্থাৎ তার বাউল সাধক হয়ে ওঠার সময়টায় তাকে মোল্লা-মৌলবিরা এবং হিন্দু পুরোহিতরা সব সময়ে বাধার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ লোকেরা। কারণ তার প্রবল উত্থান ঘটার পেছনে কাজ করেছে সাধারণ মানুষের সমর্থন ও তার গানের বিপুল জনপ্রিয়তা।

এছাড়াও লালনের প্রতি সেই সময়ের শিলাইদহের জমিদার মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুনজর ছিল। তবে ধারণা করা হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সরাসরি দেখা কিংবা কথাবার্তা হয়নি লালন ফকিরের। লালনের সঙ্গে কথা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের এবং তিনি লালনের একটি স্কেচ এঁকেছিলেন। তবে ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে লালনের গানের যে একটি আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তা রবীন্দ্রনাথের লেখায় অনেকভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে। যাই হোক, লালন আগে হিন্দু পরে মুসলমান কিংবা জন্মসূত্রে মুসলমান ইত্যাদি বিতর্কে কার লাভ? লালনের গান পাঠ করে, তার জীবনের নানা বাকবাকান্তর জেনে আমার কাছে কেবলি বোধ হয় এই বিতর্ক একটি সাম্প্রদায়িক মানসিকতার ফসল। যে লালন একেবারেই প্রচলিত ধর্মমতের বাইরে ছিলেন অথচ পাকিস্তান আমলে তার সমাধিসৌধ নির্মাণেও ঘটে গেছে ইসলামীকরণ। লালন জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন কিন্তু কর্ম ও সাধনসূত্রে হিন্দু-মুসলমানের প্রচলিত ধর্মমতকে বিসর্জন দিয়ে বাউল মতবাদ আশ্রয় করে মানবধর্মের অন্বেষণ করেছেন। সতেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে বাউল মতবাদের উন্মেষ ঘটেছিল তা-ই ‘উনিশ শতকে লালন ফকিরের সাধনা ও সৃষ্টির মাধ্যমে’ (ডক্টর আহমদ শরীফ, লালন শাহ) পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছিল।

জাতপাতের বিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তার শক্ত অবস্থানের কারণ ছিল তার উপরে সমাজের নিষ্ঠুর আচরণ। মানবিক সম্পর্ককে উপেক্ষা করে ধর্মীয় অনাচারের বাড়াবাড়ি লালনের কাছে কখনই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। এ ছাড়া তিনি দেখেছেন জন্মদাত্রী মা সমাজের ভয়ে, জাত নষ্ট হওয়ার ভয়ে তাকে ঘরে তুলতে পারেননি। মায়ের ওপর ছিল তার প্রবল অভিমান। নিজের স্ত্রীকে তার প্রবর্তিত বাউল মতবাদে দীক্ষিত করে সাধনসঙ্গী বানাতে চেয়েছিলেন, পারেননি। এই কষ্ট তার ঘোচেনি। তাই জাতপাতের বিরুদ্ধে তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত উচ্চকিত ছিলেন। তার আখড়ায় শিষ্যরা পছন্দমতো সাধনার পদ্ধতি বেছে নিতে পারতো। কোন নিষেধাজ্ঞার বেড়া তুলে লালন তার শিষ্যদের সাধনার আনন্দকে বিঘ্নিত করেননি। তবে আত্ম-অনুসন্ধানের পথ খোঁজার জন্য সৎ ও নির্লোভ জীবনের শ্রেয়তর বার্তা তিনি শিষ্যদের অন্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। লালন আপন অন্তঃকরণকে আয়ত্ব করার সাধনায় গুরুত্ব দিয়েছেন। মনকে শাসন করতে পারলে সকল সর্বনাশ থেকে মানুষ মুক্তি পাবে।

মন সাধনার কথা লালনের গানে নানাভাবে উঠে এসেছে-
সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন।
সত্য সুপথ না চিনিলে পাবি নে মানুষের দরশন॥
কিংবা
মন সহজে কি সই হবা।
ডাবার পর মুগুর পলে তুমি সেইদিন গা টের পাবা;
চিরদিন ইচ্ছা মনে আইল ডিঙ্গায়ে ঘাস খাবা॥

বাল্যকাল থেকেই লালনের ভেতর সংগীতের সহজাত প্রতিভা ছিল। দীর্ঘ জীবনে রচনা করেছিলেন অজস্র গান। তার মনে সংগীতের ভাব আসলে তিনি বলতেন- ‘আমার পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে’ তখন শিষ্যরা কাগজ কলম নিয়ে তার গানের বাণী লিখে রাখতেন। তার গানের সংখ্যা নিয়েও রয়েছে নানা বিভ্রান্তি। লালনের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা দেখে অনেকেই নিজের লেখা গান লালনের ভনিতায় চালিয়েছেন। সে হিসেবে অনেকেই বলেন, লালন প্রায় দশ সহস্রাধিক গান লিখেছিলেন। এভাবেই তার গানের সংখ্যা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা বিভ্রান্তি। তাই লালনের নামে প্রচলিত সব গানই যে লালনের রচনা তা নয়। লালনের গানের ভাষা, বাক্যগঠন, জনজীবনের নানা প্রসঙ্গের উল্লেখ, দর্শন বিচার, কাল বিচার এবং পুরনো লিখিত নথি বিবেচনা করে আবুল আহসান চৌধুরী তার লালনসমগ্র গ্রন্থে ৬৪২টি গান অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তবে অনেকেই লালনকে সহস্রাধিক গানের রচয়িতা বলে বিশ্বাস করেন। এভাবে লালন ও তার গানের সংখ্যা নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে তাতে লালনকে বড় করে দেখার প্রয়াস হয়তো রয়েছে কিন্তু একজন ইতিহাসনির্ভর মানুষের বাস্তবানুগ জীবনচিত্রের পরিচয় তাতে ধরা পড়ে না। লালন কোনো অলৌকিক উপায়ে এমন মহান মানুষ হয়ে ওঠেননি। সাধনা ও সংগ্রামের ভেতর দিয়েই তিনি মানুষের অন্তর আত্মার অসীম মাধুর্যকে ধরতে পেরেছেন। খুঁজে পেয়েছেন জীবনের আধ্যাত্মিক সত্য। সবার উপরে মানুষ সত্য-এই মতকেই সারাটা জীবন তুলে ধরেছেন তার গানে। জাতপাতের বাইরে এসে মানুষকে ভালোবাসার মধ্যদিয়ে মানুষের ঈশ্বরকে খুঁজে ফিরেছেন জনমভর। ঈশ্বর সব সময়ে চান তার সৃষ্টি মানুষ সাধনার মধ্যদিয়ে মানবজন্মকে সার্থক করবে এবং সেই অরূপ রতনকে লাভ করবে। লালনের একটি গানে মানুষের এই শ্রেষ্ঠত্বের কথা উল্লেখ রয়েছে-

এমন মানব জনম আর কি হবে
মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।
অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই
শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই,
দেব দেবতাগণ, করে আরাধন, জন্ম নিতে মানবে।
কত ভাগ্যের ফলে না জানি
মন রে পেয়েছো এই মানব তরণী
বেয়ে যাও ত্বরায় তরী
সুধারায় যেন ভরা না ডোবে।
এই মানুষই হবে মাধুর্য্য ভজন
তাইতো মানবরূপ গঠলেন নিরঞ্জন
এবার ঠেকলে না আর দেখি কিনার
অধীন লালন তাই ভাবে।

লালনের এই গানটির সঙ্গে আমরা লালনের জন্মেরও প্রায় আড়াইশ’ বছর আগে বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাসের একটি পদাবলি গানের মিল পাই। চণ্ডীদাস লিখেছেন-

শুন হে মানুষ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।

মানুষের প্রতি প্রেম ভালোবাসার ভেতর দিয়ে এই বঙ্গীয় ভূখণ্ডে মানবাত্মার যে জয়গান ধ্বনিত হয়েছিল তারই সহজিয়া রূপটি প্রকাশিত লালনের গানে। চণ্ডীদাস যেখানে বলেছেন- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ সেখানে লালন বলেছেন একই কথা অন্য ভাবে ‘অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই/ শুনি মানবের উত্তম কিছুই নাই’। মানুষ সাধনার মধ্যদিয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে, অরূপের সন্ধান পায়। এই যে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এবং মানুষের সঙ্গে স্রষ্টার অদ্বৈত সম্পর্ক তারই একটি অপরূপ রূপ দেখি রবীন্দ্রনাথের গানে। গানটিতে আছে, মানুষ না থাকলে ঈশ্বরের প্রেম মিছে হয়ে যেত। তাই মানুষের কাছে ঈশ্বর নেমে আসেন। আশিক (মানুষ) এবং মাশুক (ঈশ্বর) এক হয়ে যায় আনন্দিত ভুবনে। রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের এই গানে মানুষের অন্তরাত্মার কান্নার সুর এবং মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষিত হয় এভাবে-

তাই তোমার আনন্দ আমার পর তুমি তাই এসেছো নিচে
আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে। 

অর্থাৎ মানুষ না থাকলে ঈশ্বরের সকল প্রেম মিছে হয়ে যেত। আমাদের দেশের আউল বাউল মারেফতি মুর্শিদী গানে এমন করেই মানুষ ভজনার কথা সুরে-বাণীতে ঘোষিত হয়েছে। লালন সাঁই বিশ্বাস করতেন, জন্মালেই মানুষ হয় না, মানুষ হয়ে উঠতে হয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ভেতর দিয়েই মানুষের স্বরূপ অন্বেষণ করতে হয়। সারাটা জীবন লালন মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হওয়ার কথাই বলেছেন। লালনের গানের এই আকুতি ঝরে পড়ে-

মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
দ্বিদলে মৃণালে সোনার মানুষ উজলে
মানুষ গুরুর নিষ্ঠা হলে জানতে পারবি॥
মানুষে মানুষ গাঁথা গাছে যেমন আলেকলতা।
জেনে শুনে মুড়াও মাথা জাতে উঠবি॥
মানুষ ছাড়া মন রে আমার দেখনা সব শূন্যাকার।
লালন বলে মানুষ আকার ভজলে পাবি॥

বাউলের গানে এই মানুষ হওয়ার আকুতি এবং এ জন্যই তারা মানুষ ভজনা করে। প্রচলিত যে ধর্মমত মানুষে মানুষে ভেদাভেদ তৈরি করে রেখেছে, উচ্চ-নিচের পার্থক্য তৈরি করেছে, জাতপাত ছোঁয়াছুয়ির অসুস্থ প্রথার মধ্যে মানুষের আত্মাকে বন্দি করে রেখেছে সেখান থেকে মানুষের জয়গান গেয়ে বাউলেরা বেরিয়ে এসেছে মুক্ত প্রান্তরে খোলা আকাশের নিচে। প্রচলিত ধর্মের ছায়ার নিচে তারা আশ্রয় নেননি। অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী মানুষ হয়ে ওঠার এই সাধনায় যিনি সিদ্ধি লাভ করেন তিনিই প্রকৃত বাউল হতে পারেন। বাউলরা মনে করে মানুষের দেহে যে আত্মার অবস্থান সেই আত্মার প্রকৃত পরিচয় জানতেই তারা সাধনা করে। তারা বিশ্বাস করে মানুষের দেহেই ঈশ্বরের বসবাস। তাই ঈশ্বর এবং মানুষ স্বতন্ত্র কোনো সত্তা নয়, একই মানব শরীরে যুগল সত্তার অদ্বৈত বসবাস। আত্মাকে খুঁজতে গিয়ে বাউল নিজেকে জানতে চায় এবং নিজেকে জানার মধ্য দিয়ে পরম আরাধ্য সত্যসত্তা, সেই স্রষ্টাকে জানতে চায়। তাই লালন মানুষ ছাড়া সবকিছুকেই শূন্য বলে মনে করেছেন। এই যে নিজেকে জানা তার সঙ্গে আড়াই হাজার বছর আগের গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের অমর বাণী ‘know thyself’এর মিল খুঁজে পাই। মিল পাই গীতার বাণী ‘আত্মানাং বিদ্ধি’ অর্থাৎ নিজেকে চেনার সঙ্গে। হাদিসেও এমন কথার প্রমাণ রয়েছে-‘মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু’ অর্থাৎ যে নিজেকে চিনেছে সে তার আল্লাহকে চিনেছে। মানুষের দেহের ভেতরেই বিরাজমান ঈশ্বর। আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে রচিত উপনিষদে প্রাচীন বৈদিক ঋষিরা বহুবার নিজেকে জানার কথা বলেছেন। নিজেকে চেনার সাধনার পথকে তারা নানাভাবে মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন ঋকমন্ত্রে। উপনিষদে এই ভাবনাটি এভাবে এসেছে- ‘যে তেজময় অমৃতময় পুরুষ জলে, তিনি অগ্নিতে, বায়ুতে, বিদ্যুতে, মেঘগর্জনে, তিনি ধর্মে, তিনি সত্যে, তিনি জ্যোতিতে, তিনিই রয়েছেন দেহের ভেতরে, তিনি আত্মা, তিনি ব্রহ্ম।’ মানুষের নিজের দেহের ভেতরে সত্য অন্বেষণের সেই চিরকালীন আকুতি ধ্বনিত হয়েছে মধ্যযুগের আরেক সাধক কবি কবীরের সাধন-সংগীতে। কবীর তার দোহায় বলেছেন-

মো কো কাঁহা ঢুঁড়ো বন্দে মৈঁ তো তেরে পাস মে
না মৈঁ দেবল, না মৈঁ মসজিদ, না কাবে কৈলাস মেঁ।

অর্থাৎ ঈশ্বরকে মসজিদে, মন্দিরে, দেবতার দেউলে, কৈলাসে, কাবায় না খুঁজে মানুষের ভেতরে খুঁজতে হবে। লালনের গানেও আমরা শুনি মানুষের দেহের মধ্যে লীলাময়ের অন্বেষণের কথা-

ডুবে দেখ দেখি মন কী রূপ লীলাময়।
আকাশ-পাতাল খুঁজিস যারে এই দেহে সে রয়॥
লামে আলেফ লুকায় যেমন, মানুষে সাঁই আছে তেমন
তা নইলে কি সব নূরিতন, আদম-তনে সেজদা জানায়॥
আহাদে আহম্মদ হ’ল, মানুষে সাঁই জন্ম নিল
লালন মহা ফ্যারে প’লো, সিরাজ সাইর অন্ত না পাওয়ায়॥

ভারতের বাউল-সন্তদের মূল উদ্দেশ্য ছিল মানবদেহে সেই অপার লীলাময়ের সন্ধান। লালনও ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধক ও দার্শনিকদের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সাম্য ও প্রেমের বাণী শুনিয়েছেন। তিনি রুমী, জামী ও হাফেজের সগোত্র এবং কবীর, দাদু ও রজবের উত্তরসাধক।’ (ডক্টর আহমদ শরীফ, লালন শাহ) বাউলেরা বিশ্বাস করেন যা নাই দেহভাণ্ডে তা নাই ব্রহ্মাণ্ডে। আর এ জন্যই দেহবাদী সাধন-পদ্ধতির বিকাশ ঘটেছে লোকায়ত ধর্ম চর্চায়। ‘আদিকাল থেকেই যে-কোন ধর্মে দৈহিক শুচিতাকে সহায়ক বলে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ জন্য উপাসনাকালে দৈহিক পবিত্রতা আবশ্যক হয়। মনে হয়, এ বোধেরই পরিণতি ঘটেছে দেহাত্মবাদে ও দেহতত্ত্বে। যোগে, সাংখ্যে, বৌদ্ধদর্শনে ও সুফীসাধনতত্ত্বে দেহকে বিশেষ মূল্য দেওয়া হয়েছে। দেহের আধারে যে-চৈতন্য, সেই তো আত্মা। এ নিরূপ নিরাকার আত্মার স্বরূপ-জিজ্ঞাসা শরীর তত্ত্বে মানুষকে করেছে কৌতূহলী।’ (ডক্টর আহমদ শরীফ, লালন শাহ) আত্ম অন্বেষণের ভেতর দিয়েই বাউলেরা পরমাত্মার খোঁজ করেছে। তাদের মতে আত্মাই হচ্ছে সব। যার লোকায়ত ও সহজিয়া রূপটির প্রকাশ ঘটেছে লালনের গানে। ‘লালনের জীবনে বিভিন্ন ধর্মের মতবাদ তথা সাধনার ধারাকে সমন্বয় করার সাধনা দেখা যায়। ইসলামের সৃষ্টিতত্ত্বে, হিন্দুদের ব্রহ্মতত্ত্ব, অবতারবাদ ও জন্মান্তরবাদ সম্বন্ধে নির্বাক বৌদ্ধদের দেহতত্ত্ব সম্বন্ধেও তার জ্ঞান ছিল। তার চিন্তাধারার অনুসরণ করলে দেখা যায়, এগুলোর মধ্যে তিনি সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছিলেন।’ (দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, লালন শাহ ও আত্মদর্শন) বিভিন্ন ধর্মীয় ‘কালট’ এর মিশ্রণে গঠিত লোকায়ত এই বাউল মতবাদের সারসত্য মানবপ্রেম মিশে গেল ঔপনিষদিক ভাবধারাপুষ্ট রবীন্দ্র চিন্তা-চেতনায় এবং এই ভাবকে আত্মস্থ করেই তিনি শ্রেয়ের সন্ধান করেছেন ‘মানুষের মধ্যে, জগতের আনন্দযজ্ঞে’। রবীন্দ্রনাথের বহু গানে তারই ধ্রুপদী প্রকাশ দেখি। ‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে তাই হেরি তাই সকল খানে’ এবং সেই প্রাণের মানুষকে খোঁজার জন্য ‘কাঙাল বেশে দ্বারে দ্বারে’ ঘোরার প্রয়োজন নেই। কারণ সে যে আছে ‘মানুষের নয়নতারায়’, ‘আলোকধারায়’, ‘যেথায় সেথায়’, সবখানেই সেই প্রাণের মানুষের অবস্থান। আর এজন্যই তিনি বলেন-

জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।
ধন্য হলো, ধন্য হলো মানবজীবন॥ 

এ যেন বাউল জীবনধারার সহজিয়া কিন্তু ধ্রুপদী প্রকাশ। তবে বাউলরা যেখানে নিরন্তর দেহ সাধনায় জোর দিয়েছেন সেখানে রবীন্দ্রনাথ ‘অবিমিশ্র মানসিক সাধনাকেই আশ্রয় করেছেন। অর্থাৎ লক্ষ্য উভয়ের অভিন্ন, পার্থক্য দেখা গেছে অবলম্বিত পথে। বাউল সাধনায় সুফি, বৌদ্ধ, এমনকি বৈষ্ণব প্রভাব দুর্নিরীক্ষ নয়; কিন্তু রবীন্দ্রদর্শনে অবিমিশ্রভাবে ভারতীয় উপনিষদের প্রভাবের সুস্পষ্ট প্রতিফলন।’ (বরুণকুমার চক্রবর্তী, রবীন্দ্রনাথের মানবধর্ম ও বাউলের মানবভাবনা) আমার বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথের গানে বাউল মতবাদের সঙ্গে ঔপনিষদিক ভাবনা মিলে মিশে পরমাত্মা অনুসন্ধানের ধ্রুপদী প্রকাশ ঘটেছে। তবু রবীন্দ্রনাথের গানে যে দেহবাদী কিংবা দেহকে পরমাত্মার সঙ্গে লীন করার বাসনার প্রকাশ ঘটেনি তা নয়। পূজা পর্যায়ের বহু গানে এর নিদর্শন রয়েছে। নিজেকে সমর্পণ করার একটি স্নিগ্ধ প্রয়াস আগুনের পরশমণি গানটি। কবি বলেন-

আমার এই দেহখানি তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো-
নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে ॥

লালনের বাউল দর্শন রবীন্দ্রনাথের জীবনে যে গভীর প্রভাব ফেলেছিল তার প্রতিফলন ঘটেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৩০ সনে দেওয়া তার হিবার্ট বক্তৃতায়। বক্তৃতার শিরোনাম ছিল ‘দি রিলিজিয়ন অব ম্যান’। এই বক্তৃতায় তিনি স্পষ্টভাবে বাউল দর্শন ও পূর্ববঙ্গের বাউলদের প্রভাবের কথা উচ্চারণ করেছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন-

আমার মধ্যে যে আত্মা আছেন, যিনি জ্বরা-মৃত্যু-শোক-ক্ষুধা-তৃষ্ণার অতীত, যিনি সত্যকাম, সত্য সংকল্প, তাকে অন্বেষণ করতে হবে, তাকে জানতে হবে। ‘মনের মানুষ মনের মাঝে করো অন্বেষণ।’ এই যে তাকে সন্ধান করা, তাকে জানা, এ তো বাইরে জানা, বাইরে পাওয়া নয়; এ যে আপন অন্তরে আপনি হওয়ার দ্বারা জানা, হওয়ার দ্বারা পাওয়া।

লালনের গানেও এরই প্রতিধ্বনি শুনি। প্রচলিত ধর্মকে গ্রহণ না করে আত্ম-অন্বেষণের যে অবিরাম পথচলা সে কথা রয়েছে লালনের গানে-

আপনার আপনি চেনা যদি যায়।
তবে তারে চিনতে পারি সেই পরিচয়॥
ওপর-আলা সদর-বারি, আত্মারূপে অবতারি
মনের ঘোরে চিনতে নারি কিসে কী হয়॥
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের গানে আছে-
আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।
এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা॥
কত জনম-মরণেতে তোমারি ওই চরণেতে
আপনাকে যে দেব, তবু বাড়বে দেনা॥

রবীন্দ্রনাথও সকল ধর্মের ঊর্ধ্বে মানব ধর্মকেই খুঁজেছেন মানুষের মধ্যে। তবে লালনকে যে বিরোধের মধ্যদিয়ে, অস্তিত্ব রক্ষার সুকঠিন লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে যেতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। লালন সমাজধর্মের মূলে কুঠারাঘাত করে মানুষের ভেতরের মানুষকেই খুঁজেছেন। ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, চামার, মুচি, হিন্দু, মুসলমান বলে কোন ভেদ করেননি লালন। সবাইকে মানুষ ভেবে, বন্ধু ভেবে, পরম জ্ঞান করে আলিঙ্গন করেছেন। মানুষের মন আর বিশ্বমন এক ভেবে যে সত্য সাধনা লালন করেছেন তাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘সোহহম’। লালন মানুষের সৃষ্ট এই সব জাতপাতের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য গান। জাতপাতের ভেদকে ‘সাধবাজারে’ ডুবিয়ে দিয়েছেন লালন। লালনের একটি গানে আছে-

সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।
লালন কয় জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে॥
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারী লোকের কী হয় বিধান
বামুন চিনি পৈতে প্রমাণ, বামনী চিনি কীসে রে॥
কেউ মালা কেউ তসবি গলে, তাই তে কি জাত ভিন্ন বলে
আসা কিংবা যাওয়ার কালে, জেতের চিহ্ণ রয় কারে॥
জগৎ বেড়ে জেতের কথা, লোকে গল্প করে যথাতথা
লালন বলে জেতের ফাতা, ডুবাইছি সাধবাজারে॥

রবীন্দ্রনাথের প্রাণের মানুষ অন্বেষণের মধ্যে আত্মার স্বরূপ অন্বেষণের প্রতিফলন। তিনি স্পষ্টই বলেছেন বাউলদের মনের মানুষই তার কাব্যের ‘জীবনদেবতা’। এই জীবনদেবতা সর্বমানুষের। ধর্মীয় পরিচয়ের গণ্ডীতে তাকে আবদ্ধ রাখা যায় না। সোহহমের শক্তিতে সংস্কারগত শক্তিকে অতিক্রম করলেই প্রকৃত মানবাত্মার প্রকাশ ঘটে। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-

একদিন ব্রাহ্মণ রামানন্দ তার শিষ্যদের কাছ থেকে চলে গিয়ে আলিঙ্গন করলেন নাভা চণ্ডালকে, মুসলমান জোলা কবীরকে, রবিদাস চামারকে। সেদিনকার সমাজ তাকে জাতিচ্যুত করে। কিন্তু, তিনি একলাই সেদিন সকলের চেয়ে বড়ো জাতিতে উঠেছিলেন যে জাতি নিখিল মানুষের। সেদিন ব্রাহ্মণমণ্ডলীর ধিক্কারের মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে রামানন্দই বলেছিলেন সোহহম; সেই সত্যের শক্তিতেই তিনি পার হয়ে গিয়েছিলেন সেই ক্ষুদ্র সংস্কারগত ঘৃণাকে যা নিষ্ঠুর হয়ে মানুষে মানুষে ভেদ ঘটিয়ে সমাজস্থিতির নামে সমাজধর্মের মূলে আঘাত করে।

লালনের গানে এই ব্রাহ্মণ-চণ্ডালের ভেদ ঘুচিয়ে প্রকৃত মানুষকে অন্বেষণ করার আকুতি ধ্বনিত হয়েছে। লালনের একটি গানে পাই-

জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ না রাজি সব দেখি তা না না না॥

... ... 

ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল চামার-মুচি একই জলে সব হয় গো শুচি
দেখে শুনে না হয় রুচি যমে তা কাউকে ছাড়বে না॥

ঈশ্বর মানুষসহ বিশ্বপ্রকৃতি সৃজন করেছেন। তাহলে মানুষ কেন মানুষে মানুষে ভেদ তৈরি করে রাখে? স্রষ্টা মানুষের ভেতরে অবস্থান করে যদি তবে মানুষকে ঘৃণা করাঈশ্বরকে ঘৃণা করার সামিল। সুফিরা এভাবেই প্রেমের ভেতর দিয়ে ঈশ্বরকে পেতে চেয়েছেন। ঈশ্বরের সঙ্গে তৈরি হয়েছে প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা ভক্ত ও সাঁইয়ের সম্পর্ক। ভক্তের ভেতরে যখন ঈশ্বর প্রকাশিত হন তখন ভক্ত ‘ফানাফিল্লাহ’ হয়ে যান। তখর স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির কিংবা ভক্তের সঙ্গে মুর্শিদের অভেদ সম্পর্ক তৈরি হয়। কোরানেও এমন একটি আয়াত রয়েছে যেখানে আল্লাহ বলছেন, তুমি যখন মুর্শিদের হাতে হাত রেখে বাইয়্যাত (শিষ্যত্ব বা অনুগত্যের শপথ) হও তখন সে হাত তার নয়, সে হাত আল্লাহর। কারণ তাদের হাতের উপর রয়েছে আল্লাহর পবিত্র হাত। (ইন্নাল্ লাযীনা ইয়ুবা-য়ি‘ঊনাকা ইন্নামা ইউবা-য়ি‘ঊনা ল্লা-হ্; ইয়াদুল্লা-হি ফাওক্ব আইদীহিম্ ফামান্ নাকাছা-ফাইন্নামা-ইয়ান্কুছু ‘আলা নাফ্সিহী অমান্ আওফা-বিমা-‘আহা-দা ‘আলাইহুল্লা-হা ফাসাইয়ুতীহি আজ্ব রন্ ‘আজীমা-। (আল কুরআন, সুরা আল ফাত্হ, আয়াত-১০, কুরআন রিসার্স ফাউন্ডেশন) এভাবেই হয়তো ভক্ত ও সাঁইয়ের সঙ্গে কিংবা মানুষ ও ঈশ্বরের সঙ্গে একটি অভেদ সম্পর্ক তৈরি করেছেন বাউল সাধকেরা। ভক্ত এবং সাঁইয়ের অভেদাত্মক সম্পর্ক অন্বেষণ করতে গিয়ে লালন তার পূর্বসূরী সাধক রামদাস ও কবীরের প্রসঙ্গ এনেছেন। তার গানে উঠে এসেছে ভক্তের দ্বারে তার সাঁই সব সময় বাঁধা থাকেন। কারণ ভক্ত আছেন বলেই সাঁই বিরাজমান। লালন তার একটি গানে এমন করে বলেছেন-

ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই।
হিন্দু কি যবন বলে জাতের বিচার নাই ॥
ভক্ত কবির জেতে জোলা প্রেমভক্তিতে মাতোয়ালা
ধরেছে সে-ই ব্রজের কালা দিয়ে সর্বস্ব ধন তাই ॥
রামদাস মুচি ভবের পরে ভক্তির বল সদাই করে
সেবায় স্বর্গে ঘণ্টা পরে সাধুর মুখে শুনতে পাই ॥
এক চাঁদে জগৎ আলো এক বীজে সব জন্ম হলো
ফকির লালন বলে মিছে কল’ আমি ভবে দেখতে পাই॥

রবীন্দ্রনাথের গানে দেখি মানুষের সঙ্গে থাকাই ঈশ্বরের আনন্দ। কারণ মানুষ না থাকলে ত্রিভুবনেশ্বরের প্রেম ও অস্তিত্ব মিছে হয়ে যেত। রবীন্দ্রনাথ বলেন-

তাই তোমার আনন্দ আমার ’পর
তুমি তাই এসেছ নিচে-
আমায় নইলে, ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হতো যে মিছে॥

... ...

তাই তো, প্রভু, যেথায় এল নেমে
তোমারি প্রেম ভক্তপ্রাণের প্রেমে
মূর্তি তোমার যুগলসম্মিলনে সেথায় পূর্ণ প্রকাশিছে॥

কবির এই দীপ্ত উচ্চারণ ঈশ্বর ও মানুষের পরস্পরের অনিবার্য ও অভেদাত্মক সম্পর্ককেই তুলে ধরে। বাংলাদেশের মারফতি, মুর্শিদী, বিচ্ছেদ ও গুরুবাদী নানা বাংলা গানে স্রষ্টার সঙ্গে ভক্তের অচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা তুলে ধরা হয়েছে। একটি ভাববাদী লোকগানে অন্তরের গভীর বিশ্বাস, আস্থা ও ভালোবাসার স্পর্ধায় গীতিকবি শাহ সুফী হাসান উচ্চারণ করেছেন মানুষ ভজনার কথা। একজন সাধক কবি, সাধনার অঙ্গ হিসেবে জ্ঞানের বাইরে হৃদয়ের প্রবল শক্তিতে মানুষের সঙ্গে আল্লাহর অদ্বৈত সম্পর্ককে উচ্চারণ করেছেন এভাবে ‘যে কোরআনের আছে জবান সেইখানে বিরাজে সাঁই’। এই বাক্যে মানুষের ভেতরেই যে খোদা অস্তিমান সেই কথাটি আবেগ, ভক্তি ও গভীর খোদাপ্রেমের তন্ময়তায় উচ্চারিত হয়েছে। তত্ত্বের আড়ালে মানুষের মহিমান্বিত রূপটি চাপা পড়েনি। সুফি হাসান বলেন-

আয়াত কোরআন পড়ে শুধু নাম ঠিকানা জানতে পাই-
মানুষ ছাড়া আল্লার কোনো দলিল নাই।
খোদ কায়া তার আদম ছুরাত- ছুরাত গেলেও থাকে সিরাত,
পড়িয়া কোরানের আয়াত নাম ঠিকানা জানতে পাই,
ধর মানুষ পড় কোরআন- মিলে যাবে খোদার সন্ধান,
যে কোরআনের আছে জবান সেই খানে বিরাজে সাঁই,
মানুষ ছাড়া আল্লার কোনো দলিল নাই।
মানুষ খোদার বড় কুদরত- তার ভিতরে চল্লিশ আয়াত
পঞ্চ আত্মার পঁচিশ খেতাব- এই খানেতে পঁচিশ পাই,
পাঁচ জাত আর সাত সেফাতে- সাঁইত্রিশ হইল যোগেতে
বার যোগ হয় পঁচিশেতে- আরো তিনের খবর চাই,
মানুষ ছাড়া আল্লার কোনো দলিল নাই।
গঞ্জ মুখফির গোপন ঘরে- একটা আয়াত তার ভিতরে
আহাদ নাম জপনা করে- দিবানিশি বিরাম নাই,
এক আয়াত আহাম্মদ মিয়া- আদম ছুরাত বানাইয়া
আহাদে আহাম্মদ হইয়া- প্রেম সাগরে খেলছেন সাঁই,
মানুষ ছাড়া আল্লার কোনো দলিল নাই।
আহাদ আর আহাম্মদ গেলো ঊনচল্লিশ আয়াত হইল,
মোহাম্মদ এক আয়াত হইল- একের ঘরে দিয়া ঠাঁই,
ইসরাইল শাহ্ কয় মানুষ বড় হাছান তুমি লক্ষ্য করো 
ত্রিশ পারা যতই পড় তার ভিতরে আল্লাহ নাই,
মানুষ ছাড়া আল্লার কোন দলিল নাই।

এই গানে সাধক সংগীতকার মানুষকে গুরুত্ব দিয়ে মানুষ ভজনার মাধ্যমে ঈশ্বরের সন্ধান করেছেন। এই কথার সঙ্গে লালনের কিংবা রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণের মধ্যে কাব্যপ্রকৌশলগত প্রভেদ থাকলেও মর্মগত কোনো পার্থক্য নেই।

লালন তার সাধনায় মানুষকেই প্রধান দেখেছেন, মানুষকে মর্যাদা দিয়েছেন এবং মানুষের প্রতি বিশ্বাস রেখেছেন। তার কাছে জগতের সকল মানুষ ‘মানুষনিধি’। একটি গানে তিনি বলেছেন, ‘মানুষ অবিশ্বাসে পাই না রে সে মানুষনিধি/ এই মানুষে মিলতো মানুষ চিনতাম যদি।’ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ লালনের জীবনের মূলমন্ত্র ছিল মনের মানুষকে খোঁজা। লালন তার গানে সাধনার কথা বলেছেন- তত্ত্বকথা এনেছেন, জাতপাতের মিথ্যে বড়াইকে এনেছেন, এনেছেন মানব দেহের আগাম-নিগমের নানা কথা; কিন্তু কোনোভাবেই তার গান তত্ত্বকথার শুকনো কচকচানিতে রূপান্তরিত হয়নি। বাংলাদেশের মানুষের নানা রকম কৃত্য, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ, জনজীবনের আটপৌরে নানা প্রসঙ্গ তার গানে উঠে এসেছে। ফলে বাংলাদেশের নদী-নালা, ময়ূর, কলুর বলদ, কবিরাজ, রাধা-কৃষ্ণ, নবী-রাসুল, আল্লাহ-খোদা-ভগমান, রওয়াজা, রংমহাল, কুলের বউ, মাছ ধরার দোহাড়ী, মেঘ, বিজলি, বেহেস্ত-দোজখ, সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা, কৃষকের হালচাষের কথা, বস্ত্রবয়ন ও মৎস্যজীবীদের নানা প্রসঙ্গ এমনভাবে গানে উঠে এসেছে যে শুনতে শুতে শ্রোতার চোখের সামনে নিজের দেখা জগতের ভেতর দিয়ে আরেকটি অদেখা জগতের চিত্র মূর্ত হয়ে ওঠে। লালনের গানে আমরা যে প্রসঙ্গ কিংবা শব্দের প্রয়োগ দেখি তা আমাদের চেনা জগৎ থেকে নেওয়া হয়েছে। শরীরের নিগূঢ় তত্ত্বের যে সকল প্রসঙ্গ আছে তাও পরিচিত শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। পরমাত্মাকে নানা নামে ডেকেছেন লালন। যেমন মনের মানুষ, অচিন পাখি, মানুষ রতন, মনমনুরা, আলখ সাঁই, অধরচাঁদ, অলিয়েম মুর্শিদ, আলেক-মানুষ, রাম-নারায়ণ, হামেশ ঘড়ি ইত্যাদি। এই নামগুলোও আমাদের গ্রামীণ জনপদের মানুষের কাছে অপরিচিত নয়। কারণ গ্রামের মানুষেরা দীর্ঘকাল ধরে মুর্শিদী গানের ভেতর দিয়ে আধ্যাত্মিক নানা প্রসঙ্গের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছে। আবার কখনো গানের আসরে গায়েনেরা গানের ব্যাখ্যা করে কোন শব্দের কি মানে তা বুঝিয়ে দেন। এভাবে এসকল গান কানের ভেতর দিয়ে মর্মে প্রবেশ করে আমাদের প্রাণ আকুল করে তোলে। লালনের একটি গানে এমনি করে পড়শির কথার আড়ালে নিজের দেহের ভেতরের আত্মাকে কিংবা বিশ্ববিধাতাকে আমাদের অনুভব ও উপলব্ধির সমীপ্যে নিয়ে আসে। এই গানে পল্লীবাংলার চিরচেনা একটি রূপকেই মূর্ত করেছেন লালন। যে সময়ে গান লিখেছেন হয়তো সেই সময়ে বর্ষার অগাধ জলে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাতায়াতের পথ বন্ধ ছিল। অথৈ জলের পাথার পেরিয়ে অন্য গ্রামে, পড়শীর কাছে যেতে হলে যে নৌকার প্রয়োজন সেই নৌকাটাও ঘাটে নেই। ব্যাকুল কবি তার অন্তরের তীব্র বেদনাকে বাংলাদেশের চিরচেনা দৃশ্যের অনুষঙ্গে তুলে ধরেছেন বলেই গানটি তত্ত্বের কণ্টকে ঢাকা পড়েনি। লালন এভাবে বলেন-

বাড়ির কাছে আরশীনগর, সেথায় এক পড়শী বসত করে
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে ॥
গেরাম বেড়ে অগাধ পানি, ও তার নাই কিনারা নাই তরণী পারে।
মনে বাঞ্ছা করি দেখবো তারে-আমি কেমনে সে গাঁয় যাই রে॥

লালনের জীবন ও গান নিয়ে এই আলোচনার সব শেষে এ কথা বলতে পারি যে লালনের গানে বাঙালির হাজার বছরের দেহবাদী অধ্যাত্ম ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে। বাঙালির যে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছিল এই ভূখণ্ডে তারই অন্তর্গত সত্যটি উঠে এসেছে তার গানে। লালন জ্ঞানের পথে নয়, ভক্তি, ভালোবাসা ও হৃদয়ের পথে পরমাত্মা বা ঈশ্বরকে পেতে চেয়েছেন। তার গানে বাউলধর্মের আত্মিক সৌন্দর্য মূর্ত হয়ে উঠেছে। লালন ছিলেন ‘মানবমুখীন, অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, কল্যাণকামী, যুক্তিবাদী, উদার মত ও মনের অধিকারী’ (ড. আবুল আহসান চৌধুরী, লালনসমগ্র, ভূমিকা) একজন কবি ও সাধক। তার জীবনকাহিনি নিয়ে জটিলতা থাকতেই পারে, তিনি হিন্দু কি মুসলমান তা না জানলেও তার গানের রসগ্রহণে রসিকজনের কোন সমস্যা হয় না। লালনের গানের একজন ভক্ত হিসেবে তার গানের রস আস্বাদন করতে চাই। তাই আমার বিবেচনায় লালন নিজেই যখন তার জাত কিংবা জন্মস্থান সম্পর্কে কোনো কথা বলে যাননি তাই এ নিয়ে তার গানের ভক্ত রসিকজনের কিছু আসে যায় না। আমরা লালনের গানের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের যে উদার ধর্মীয় রূপটি দেখি, গানের মধ্যে মানবিক জীবনচর্যার যে রূপটির সাক্ষাৎ পাই তাতেই নিমগ্ন থাকি। পণ্ডিতরা খুঁজে বের করবেন তার জন্মস্থান ও জন্মের সঠিক তারিখ। আর আমরা না হয় রসমুগ্ধ থাকি লালন সাঁইজীর গানের ভেতরে। 

লালনের গানের একজন রসমুগ্ধ ভক্ত হিসেবে আমি এই কথাই বলি- লালনকে পাঠ করতে করতে আমি সমস্ত মানবের মধ্যে যে চিরন্তন সত্য রয়েছে তারই ডাক যেন শুনতে পাই। নিজেকে খুঁজে বেড়ানোর যে কঠিন কিন্তু আনন্দময় সাধনা করে বাউলেরা তার রূপটি ধরা পড়েছে লালনের গানে। লালনের গানে বাঙালির অন্তরাত্মার বিপুল ঐশ্বর্যের প্রতিফলন ঘটেছে। সাম্প্রতিকবিশ্ব যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও বর্ণবাদের তীক্ষ্ম নখরে ক্ষত-বিক্ষত তখন লালনের গান সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। লালনকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের লেখা একটি কবিতা রয়েছে। তিনি তার ‘লালনের গান’ শীর্ষক কবিতায় লিখেছেন-

সে গানের ধ্বনি স্তব্ধ সায়রে
ফোটায় নিবিড় অজস্র শতদল।
ধুলোয় উধাও সে গানের কলি
গ্রামছাড়া পথে মনের মানুষের খোঁজে।
শৈশব গাঁথা জামতলা আর
কনক দুপুরে শ্রাবণ দীঘির ডুব,
ঘোরলাগা ভোর, অভিজ্ঞ সাঁঝ-
সবি আছে বুঝি স্মৃতির অভ্রে ডুবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh