চুল কাটার মাস্টার এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নমান সংস্কৃতি

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২১, ০১:৩০ পিএম

আমীন আল রশীদ

আমীন আল রশীদ

বালিশের নিচে পিস্তল নিয়ে ঘুমানোর কথা বলে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহারের বিতর্কিত হওয়ার রেশ কাটতে না কাটতেই এবার ১৪ শিক্ষার্থীর চুল কেটে আলোচনায় এসেছেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিন। 

সোশ্যাল মিডিয়ায় রসিকতা করে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, এই দুই শিক্ষক পরস্পরের আত্মীয় কি-না? তবে আত্মীয় হোন বা না হোন, প্রধানত যে প্রশ্নটির সুরাহা করা জরুরি, তা হলো, এরকম লোকেরা কী করে শিক্ষকতার মতো একটি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পেশায় এলেন? কী করে তাদের চাকরি হলো? নাকি যোগ্যতা বিবেচনার বদলে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থের প্রভাবে চাকরি হয়েছে? এ কারণে তারা টেলিফোনের অপর প্রান্তের লোককে এ কথা বলতে পারেন, তিনি বালিশের নিচে পিস্তল নিয়ে ঘুমাতেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা বা অর্থের প্রভাবে চাকরি হয়েছে বলেই তিনি সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের মাথার চুল কেটে দেওয়ার মতো অমানবিক আচরণ করতে পারছেন?

গণমাধ্যমের খবর মতে, গত ২৬ সেপ্টেম্বর দুপুরের দিকে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের প্রথম বর্ষের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরিচিতি বিষয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষা শুরুর আগেই শিক্ষক ফারহানা ইয়াসমিন কাঁচি নিয়ে হলের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন। হলের ভেতরে ঢোকার সময় চুল বড় থাকায় ১৪ জনের চুল কেটে দেন তিনি। লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে নাজমুল হাসান নামের একজন ছাত্র আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন। এ ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অভিযুক্ত শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়। 

চুল কাটার পরে আলোচনায় আসা এই শিক্ষক সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য বেরিয়ে আসছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার চরম অশোভন আচরণ ও মাস্তানি সম্পর্কে যেসব খবর আসছে, সেটি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে স্থাপিত এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শুধু নয় বরং পুরো শিক্ষক সমাজের জন্যই লজ্জার। 

দেশের কয়েকটি শীর্ষ সংবাদপত্রের খবরে বলা হচ্ছে, তিনি কথায় কথায় নিজেকে বড় আর্মি অফিসারের মেয়ে দাবি করে ডিজিএফআই ও এনএসআইর ভয় দেখিয়ে ছাত্রদের নানাভাবে মানসিক নির্যাতন করতেন। তার এই নির্যাতনের হাত থেকে ক্লিনার ও আয়াও রক্ষা পাননি। 

শিক্ষক ফারহানা শুধু তার বিভাগেই নয় বরং পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। তিনি সামান্যতেই রেগে যান এবং সবাইকে গালিগালাজ করেন। অনেক শিক্ষার্থীর উদ্দেশে নাকি তিনি বলতেন, ‘আমি যাকে যা বলব, তাকে তাই করতে হবে। তা না হলে কপালে অনেক দুঃখ আছে। তোরা আমার কথা না শুনলে ১০ বছরেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হতে পারবি না। পরীক্ষা দিবি, খাতা ছিঁড়ে ফেলে দেব। তোর বাবা-মা ভাত পায় না, তোরা এখানে এসে ভাব দেখাস। লাথি মেরে চারতলা থেকে ফেলে দেবো।’ তার এসব আক্রোশের শিকার হয়ে বহু শিক্ষার্থী ও কর্মচারী মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

ফারহানা ইয়াসমিন খোদ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক। প্রশ্ন হলো, শিক্ষার্থীদের মাথায় চুল কেটে দেওয়া যায় বাংলাদেশের কোনো ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির রিপ্রেজেন্ট করে? 

‘লাথি মেরে চারতলা থেকে ফেলে দেব’ একজন শিক্ষকের মুখের ভাষা কী করে এমন হতে পারে! না-কি তিনি যে শিক্ষক হবার যোগ্য নন, এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে নিজেই সেটি প্রমাণ করলেন? সুতরাং তার মতো একজন মানুষ কী করে শিক্ষকতার মতো একটি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পেশায় এলেন বা আসতে পারলেন, সেই প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলা দরকার। সেই প্রশ্নের উত্তরও অবশ্য অনেকে এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়েছেন। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকের নিয়োগ হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং অর্থের বিনিময়ে। এই কথার সত্যাসত্য প্রমাণ করা কঠিন। তবে আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কারা শিক্ষক হন, কোন প্রক্রিয়ায় শিক্ষক হন এবং শিক্ষক হওয়ার পরে তারা কী করেন বা তাদের কী কী করতে হয়- তা এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। নয় বলেই তারা গবেষণা ও একাডেমিক কাজের বদলে শিক্ষার্থীদের চুল কাটায় ব্যস্ত থাকেন। 

একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যখন ছাত্রদের চুল কেটে দেন, তখন একজন নরসুন্দরের সঙ্গে তার কোনো পার্থক্য থাকে না। একজন শিক্ষক যখন শিক্ষার্থীদের চুল কেটে দেন, তখন প্রশ্ন জাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? 

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হচ্ছে, পুরনো জ্ঞান ও ধ্যান-ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। একাডেমিক পড়াশোনার চেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ একজন শিক্ষার্থীকে নৈতিক মানসম্পন্ন এবং উন্নত রুচির এমন একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা, যিনি ভবিষ্যতে দেশকে গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। তিনি গবেষণার কোনো একটি জায়গায় নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন। অথচ যে বিশ্ববিদ্যালয়ে খোদ অধ্যাপক কাঁচি নিয়ে পরীক্ষার হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন ছাত্রদের চুল কাটবেন বলেন, তখন এটা বোঝাই যায় যে, তার চুল কাটা ছাড়া আসলে কোনো কাজ নেই। যিনি একসময় বালিশের নিচে পিস্তল নিয়ে ঘুমাতেন তিনি যখন শিক্ষক, এমনকি অধ্যক্ষ হয়ে যান, তখন তিনি শ্রেণিকক্ষে কী পড়াবেন আর প্রতিষ্ঠানই বা কী চালাবেন, তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। যে শিক্ষকদের কাছ থেকে মানুষ সর্বোচ্চ নীতি-নৈতিকতা প্রত্যাশা করে, সেই শিক্ষকরাই যখন চুল কাটা, মাস্তানি করা, বাপের পরিচয় দিয়ে সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের গোয়েন্দা বাহিনীর ভয় দেখান, তখন শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হওয়া ছাড়া উপায় কী?

প্রশ্ন হলো, একজন ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কোনো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেয়েছেন বলেই কি তিনি শিক্ষক হয়ে যান? তিনি নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত হন এবং ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষায় পাসের জন্য পরামর্শ দেন, এ কারণেই কি তিনি শিক্ষক? তিনি প্রত্যেক দিন ঘড়ি ধরে আসেন, ঘড়ি ধরে ক্লাস নেন এবং ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে যান বলেই কি তিনি শিক্ষক?

না, তিনি শিক্ষক এ কারণে যে, তিনি যতক্ষণ তার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকেন, ততক্ষণ তিনি আলোর পথ দেখান। ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি জানিয়ে দেন আলোর মাঝেও বিদঘুটে অন্ধকার বিরাজ করে। শিক্ষক সেই আলো-অন্ধকারের ভেদ বুঝিয়ে দেন। তাকে সত্যের পথ দেখান এবং মিথ্যাকে চেনান। তিনি তার সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করেন না। এ কারণে তিনি শিক্ষক। এখন আমরা যদি আমাদের চারপাশে তাকাই, সেই শিক্ষকের সংখ্যা কত!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বলেছিলেন, ‘স্কুলে পড়ানো হয়; কলেজে লোকে পড়ে; আর বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান তৈরি করে। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ পুরনো জ্ঞান বিশুদ্ধ করা এবং নতুন জ্ঞান তৈরি করা।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ মুহূর্তে আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কী জ্ঞান তৈরি করছে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি বড় কাজ মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটানো। এখন যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এগুলো না করে, যদি তারা পুরনো জ্ঞান বিশুদ্ধ করতে ব্যর্থ হয় এবং সেই চেষ্টাটাও না করে, যদি সেখানে মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটানোর কোনো আয়োজন না থাকে, বরং উল্টো মুক্তচিন্তার পথ রুদ্ধ করার আয়োজন খোদ শিক্ষকরাই করেন, তাহলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওই ব্যক্তিদের আদৌ শিক্ষক বলা যাবে কি-না, সে প্রশ্ন তোলাই সঙ্গত।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh