আফসার আহমদ

স্মৃতির ভেতর ঘুমিয়ে পড়া নক্ষত্র

এহসান হায়দার

প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২১, ০৭:১৭ পিএম | আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২১, ০৭:১৮ পিএম

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

এ লেখা স্মৃতিকথা নয়, কবির সঙ্গে কবিতার, কবিতার সঙ্গে পাঠকের, শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর, বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর যে সম্পর্ক ও সংশ্লেষণ তৈরি করে, ঠিক তেমন-ই পিতার সঙ্গে সন্তানের- নাটকের সঙ্গে দর্শকের যে সম্পর্ক ও সংশ্লেষণ তৈরি করেছে, তার অন্তরঙ্গ অনুভবের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে। কোনো অভ্যস্ত আলোচনার ছুরি-কাঁচি তত্ত্ব-তালাশের কাছ থেকে সচেতনভাবেই এ লেখাকে দূরে রাখা হয়েছে। অনন্ত রহস্য ঋতুর হয় না শেষ। শীতের কুয়াশার কঠিন শরীরে ঝুলে থাকে বসন্তের ছবি। বৃষ্টি বলে যাকে পৃথিবীতে ঝরে যেতে দেখেছে সকলেই, তার স্মৃতির ভেতর ঘুমিয়ে পড়েছে মৃত্যু; আর জাগে না! যেমনটি জাগবেন না- প্রিয় আফসার আহমদ।

১.
অক্টোবরের নিথর নিষ্কম্প কাঁটাঝোপ। বাতাস বন্দি হয়ে আছে। ভ্যাপসা গরম, অতিরিক্ত রোদে বোঝা দায়- এটা যে এখন আশ্বিনের শেষ হতে চলল- আর অসহায় বৃক্ষরা ফুলহীন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। মহামারি থেকে ত্রাহি ত্রাহি করে সারাপৃথিবীর মতো বেরোনোর চেষ্টা ক’রে যাচ্ছে চারপাশের মানুষগুলো; নতুন স্বপ্ন নিয়ে আবার কাজে ছুটছে তারা, ছোট ছোট দোকানিরা তাদের দোকানগুলোকে সাজিয়ে নিচ্ছে ফের, পায়ে হাঁটা রাস্তার পাশ ঘিরে অস্থায়ী কাপড় ব্যবসায়ীরা সারি বেঁধে হাঁকছে—দুইশ’, দুইশ’...

হঠাৎ হাতফোনে ওয়াদুদের রিং বেজে উঠল, জাকির হোসেনের তবলা সুর করে বেজে চলেছে রিংয়ে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর বলে উঠল—

‘ভাই, তুমি কোথায়?’ 
‘আমি টাঙ্গাইলে এসেছি, মির্জাপুরে ভারতেশ্বরী হোমস্-এ, কেন রে?’
‘একটা দুঃসংবাদ আছে;’
‘বল্।’
‘আফসার স্যার নেই।’
‘আবোল তাবোল কথা বলিস নে তো...’
‘হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল উনার’
‘আচ্ছা আমি খোঁজ নিই, দেখছি!’

গত ২৪ আশ্বিন দুপুরে স্নেহাষ্পদ ওয়াদুদ ফোন করে বাংলা নাটকের আরেক নক্ষত্র পতনের খবর দিল, যেমনটি সে দিয়েছিল গত বছরের ২১ নভেম্বর ভোররাতে হিমেল ভাইয়ের (কবি ও অধ্যাপক হিমেল বরকত) চলে যাওয়ার খবর। চুপচাপ ভাবছিলাম, মানুষ কত সহজে চলে যায়, সব কিছু ছেড়ে। কোনো বন্ধন কিংবা বন্ধনী সে চলে যাওয়াকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। অধ্যাপক আফসার আহমদ, এ দেশের নাটকের জগতের কিংবদন্তিতুল্য শিক্ষক; তিনি একজন নাট্য সংস্কারকও। ‘শিল্পের সুধা পান করে হও শিল্পী, আর নাটকের জন্য ঘোরো গ্রামে গ্রামে, মানুষে মানুষে মেশো, প্রত্যন্ত থেকে মিশে যাও প্রত্যন্তরে- দেখ মানুষ, দেখ প্রকৃতি। দেখবে তুমি যা চাইছ, তা পাবে।’ কথাগুলো একদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরান কলা ভবনের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলেন আফসার স্যার। 

২.
হুট করে পালিয়ে গেলেন তিনি, ভুলে গেলেন শৈশব—কৈশোরের একান্ত বন্ধু কালিগঙ্গা নদী, জামশা গ্রামের সবুজ প্রকৃতি। মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর গ্রামের দুরন্ত শৈশব-কৈশোর, যেখান থেকে তিনি পেয়েছিলেন তাঁর যাপনের জন্য নানান অনুষঙ্গ; গ্রামের মেঠোপথ, খোলা আকাশ, ধানক্ষেতের আলপথ, সবুজ ফড়িং, ঝিঁঝিপোকাদের ডাক, জ্যোৎস্নাস্নাত রাত- এবং এ অঞ্চলের বাউল সুর। যা তিনি ঢেলে দেন পরবর্তীকালে তাঁর স্বপ্নময় নাট্যজীবনের মঞ্চে। 

মানুষের যাপন বড় অদ্ভুত তা বুঝতে পারি আফসার স্যারের চলে যাওয়া, হঠাৎই সুনামীর মত চলে গেলেন যেন- নেই কোনো পিছুটান, মায়া ও মমতার বালাই। যেন ‘উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে’ নিয়ে গেছে তারে। আমাদের মতোই তিনি ছিলেন— একটু বেশি মিশুক এবং নিরঅহংকারী, সাধারণত এমনটি দেখা যায় খুব কম জনে। গত দেড় বছরে প্রায়শই ফোন করে বলতেন- ‘ওহ্ কবি-সম্পাদক, কি করো- ঠিকঠাক আছ তো মহামারিকালে? আমি তো বের হই না, পড়ছি লিখছি ঘরে বসে। ভালোই হলো, তোমাকে এখন নিয়মিত লেখা দেব।’ কথার মধ্যে উদাহরণ হিসেবে রবি ঠাকুর এসে হাজির থাকতেন বরাবরই, আর ঠিক তেমনি করে হাজির থাকতেন তাঁর পরমপ্রিয় শিক্ষক সৈয়দ আলী আহসান, মুস্তফা নূর-উল ইসলাম, সেলিম আল দীনসহ প্রিয় বন্ধুরাও। বলতেন, ‘আমি একজন মানুষ যে রবি প্রেমে মশগুল, আর বাংলার কাদা-মাটির সন্তান।’ 

৩.
 ‘হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান-রং-এর সূর্যের নরম শরীরে
 শাদা থাবা বুলিয়ে-বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে;
 তারপর অন্ধকারকে ছোটো-ছোটো বলের মতো 
থাবা দিয়ে লুফে আনলো সে,
 সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিলো।’ 
                                        (বিড়াল, জীবনানন্দ দাশ)

হেমন্ত এসে গেছে, কোনো এক হেমন্তেই সবুজ গালিচার মতো ঘাসের ওপর পা ফেলে পৌঁছেছিলাম তাঁর কক্ষে, সেই যে দেখা তারপর অবিরাম জানা-অজানার দৌড় ছিল স্যারের সঙ্গে। যিনি সৈয়দ আলী আহসানের শ্রেণিকক্ষে আধুনিক কবিতার ঘেরাটোপ পেরিয়ে গেলেন, তিনিই ফের বাংলা পালা গানের প্রেমে পড়েন; আর ছাত্রজীবন থেকে নাটক দেখতেন তাই হয়তো নাট্যপ্রেমও গাঢ় হয়েছিল; বিজ্ঞান ছেড়ে বাংলা আর বাংলা ছেড়ে নাটকের মানুষ এ জন্যই বোধ হয়। রবীন্দ্রোত্তর কালের সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী নাট্যকার, শিক্ষক, সহকর্মী নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন ভালোবাসতেন তাঁকে। প্রিয় শিক্ষার্থী হয়ে ওঠেন তাই তাঁর বন্ধু। সেলিম আল দীন নাটক লিখতেন আর তা নিয়ে তুলনামূলক সমালোচনা, তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, আর্টিকেল রচনা করতেন আফসার আহমদ; মঞ্চ সজ্জা, নাটকের গানের সুর করা, নাট্য নির্দেশনা সব কিছুতেই তিনি ছিলেন দক্ষ। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটকের বিভাগ গড়বার অংশিদারিত্বও তাঁর। সম্ভবত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেলিম আল দীন মুক্ত মঞ্চ’-এর মত এমন চমৎকার মুক্ত মঞ্চ আর কোথাও নেই, যা সেলিম আল দীন-আফসার আহমদ করে দেখিয়েছেন। কালের নিরিখে আজ সে মঞ্চ একা, মূল গ্রিকের সেই মঞ্চকে যেভাবে সাজানো হয়েছিল তেমনটিই এ মঞ্চ। বাংলা নাটক লেবেদেফ সাহেবরা শুরু করেছিলেন, কিন্তু স্বতন্ত্র দিক তৈরি হয়েছে রবির হাত ধরে আর পূর্ণতা পেল সেলিম আল দীন-আফসার আহমদ দ্বারা। 

৪. 
শিল্পীর গুণ আর শিক্ষকের গুণ মিলে একটি এমন দিক তৈরি হয়েছিল আফসার স্যারের মধ্যে যা আর কোথাও কারও মাঝে দেখিনি, আমি তাঁর সরাসরি শিক্ষার্থী নই; কিন্তু আবার শিক্ষার্থীও; তাঁর লেখার প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল বরাবরই, কারণ তাঁর লেখার মধ্যে সরল বাক্য থাকত, যা পাঠককে ভোগায় না। একটি ছোট্ট বিষয়কে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা তাঁর একটি গদ্য সাম্প্রতিক দেশকাল পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলাম আমি। গদ্যের বিষয়বস্তু ছিল ‘জামশা গ্রামে বঙ্গবন্ধু একবার হঠাৎ হেলিক্যাপ্টারে করে গিয়েছিলেন ঝড়ের পরে সেখানে মানুষদের ক্ষয়-ক্ষতি দেখতে’। এই বিষয়টি আফসার আহমদ তাঁর লেখনী শৈলী দিয়ে চমৎকার একটি সাবলীল গদ্যে পরিণত করেন। তিনি লেখার এত বিষয় নিয়ে কথা বলতেন যে, তা মনে রাখা কষ্টকর হতো। রসিকতা করে বলতেন- ‘আমাকে তো তুমি ছাড়া কেউ লেখার নজরানা দেয় না, লিখলে সম্মানী পেলে ভালো লাগে। লেখক তার মর্যাদা বুঝতে পারে।’ আফসার আহমদ কবি, প্রবন্ধকার, লেখক, নাট্যকার, নাট্য-নির্দেশক, অনুবাদক, নাট্য সমালোচক, নাট্য তাত্ত্বিক, মঞ্চ পরিকল্পক, গীতিকার, সুরকার এবং উপস্থাপক। লিখেছেন প্রচুর; কিন্তু সেই অনুযায়ী গ্রন্থ প্রকাশে আগ্রহী ছিলেন না তিনি। জানতেন মূল গ্রিক ভাষা, অনুবাদ করতেন মূল গ্রিক থেকে। গবেষণা করেছেন বিচিত্র বিষয়ে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নাট্য, সংগীত, জীবনযাপন নিয়ে। তাঁর রচিত বেশ কয়েকটি নাটক মঞ্চসফল। এগুলোর মধ্যে ‘মনসার কথা’, ‘চন্দ্রাবতী’, ‘ঘুমকুমারী’, ‘মীমাংচিনা’, ‘প্রেমপুরাণ’ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া লিখেছেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন অবলম্বনে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, মৈমনসিংহ গীতিকার কাহিনি অবলম্বনে ‘কাজলরেখা’ ও মহাকবি আলাওলের পদ্মাবতী অবলম্বনে ‘পদ্মাবতী’। লিখেছেন বেশ কিছু টেলিভিশন নাটক। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর অসংখ্য গবেষণা প্রবন্ধ। তিনি ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার স্টাডিজ জার্নালের সম্পাদক।

এদেশে যেমন শহীদুল জহিরকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়নি তেমনি আফসার আহমদকেও না; কিন্তু যারা এ পুরস্কার দিয়ে থাকেন তারা ঠিক কারা, কোন মান নিয়ে তারা পুরস্কার দিয়ে থাকেন? এ সকল বিষয় জানা দরকার। লেখক অঁতোয়ান দ্য স্যাঁৎ এক্সুপেরির লেখা ‘ছোট্ট রাজপুত্র’ কাহিনিতে লোকালয় থেকে হাজার মাইল দূরে দুর্ঘটনায় পড়েছে একটি বিমান, বাধ্য হয়ে অবতরণ করে সাহারা মরুভূমিতে। এতে বিমানটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হলো। ইঞ্জিন ঠিক করতে করতে বৈমানিক খেয়াল করলেন তার কাছে শুধু অল্প কিছু খাবার আর পানি আছে। এমন সময় ছোট্ট এক ছেলে এসে বলল, ‘একটা ভেড়া এঁকে দেবে?’

‘বৈমানিক অনেক চেষ্টা করলেন ভেড়া আঁকতে, হলো না। শেষ পর্যন্ত আঁকলেন একটা বাক্স। আর তা-ই রাজপুত্রকে দিয়ে বললেন- ‘বাক্সের ভেতর ভেড়া আছে’। অদ্ভুত এ ছবি পেয়ে রাজপুত্র উচ্ছ্বসিত হলো, হয়ে গেল তাদের বন্ধুত্ব। আর তা থেকেই জানা যায় ছোট্ট রাজপুত্রের পৃথিবীতে আগমনের কাহিনি। আমি বলতে চাইছি- যোগ্য ব্যক্তিকে পুরস্কার দেওয়ার রীতি-রেওয়াজ এদেশে এখন আর নেই। ফলে ছোট্ট রাজপুত্রকে যেমন বাক্স ধরিয়ে দেওয়া হলো ভেড়ার বদলে অমনটিই চলে আসছে পুরস্কার নিয়ে।

গত বছর দেড়েক হলো- তিনি একটি উপন্যাস লিখছিলেন, যা একটি তাঁতী পরিবারের গল্প। মসলিন শাড়ি যারা বানাত তাদের বেদনার গল্প। গবেষণামূলক এ উপন্যাসটি পড়া হয়েছিল আমার। কিছু সম্পাদনার কাজ বাকি ছিল, তারপর আড্ডাপ্রিয় হলে যা হয় ভুলে ভুলে সময় পেরিয়ে গেল- আর আফসার স্যার ‘অস্তপারের সন্ধ্যা তারায়।’ 

কত কত কথা, কত কত গল্প সব যেন তেড়ে আসছে এই হেমন্তের মাঠে। স্মৃতিগুলো বহন করে যেতে হবে আমাকেও আজীবন। যেন এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে গেল বড়ু চন্ডীদাস- দিগন্তে দিগন্তে তা রচিল বিজন অশ্রু, ঝাউশাঁখে বাজিল শোকসুর। 

লেখক : সাহিত্য সম্পাদক, সাম্প্রতিক দেশকাল

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh