রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

এক দশকে ১৭ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

রাইহান বাপ্পী, রাবি

প্রকাশ: ২৩ অক্টোবর ২০২১, ০৩:১৫ পিএম

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইমরুল কায়েসের বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছায়। দুই বছর আগে থেকে তার মধ্যে বিষণ্ণতার ছাপ দেখতে পান একই বিভাগের শিক্ষক সাজ্জাদ বকুল। এ অবস্থায় গত বছরের শুরুর দিকে রাজশাহীতে মনোবিদ ডা. মামুন হুসাইনের কাছে ওই শিক্ষার্থীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন সাজ্জাদ বকুল। সেই থেকেই ইমরুল কায়েস ডা. মামুন হুসাইনের তত্ত্বাবধানে ছিলেন।

করোনা মহামারিতে ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ায় গ্রামের বাড়িতে চলে যান ইমরুল। এর মধ্যে গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে থেমে যায় তার জীবন প্রদীপ। ঘটনার পর শিক্ষক সাজ্জাদ বকুল ওই শিক্ষার্থীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, ক্যামেরা কিনতে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেছিল। এর আগে তার চাপাচাপিতে মোটরসাইকেল কিনে দিতে বাধ্য হন মা-বাবা। মোটরসাইকেলের জন্যও আত্মহননের হুমকি দিতেন। জেদ ও না পাওয়ার হতাশায় নিজের জীবন নিজেই থামিয়ে দিলেন। শুধু ইমরুল কায়েস নন, গত পাঁচ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ছয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১০ বছরে ১৭ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তার মধ্যে ২০১১ সালেই ৮ জন আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন অন্তত ২৮ শিক্ষার্থী। সম্প্রতি ‘আত্মহত্যার প্রিসিপিটেটিং উপাদান’ শীর্ষক গবেষণায় উঠে এসেছে ২৩টি কারণে আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর পথে জড়িয়ে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বৃহৎ শিক্ষাঙ্গনে একের পর এক আত্মহননের ঘটনা ঘটলেও, এটি প্রতিরোধে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। এ ছাড়াও আত্মহত্যার পেছনের প্রকৃত কারণ জানতে একটিও সঠিক তদন্ত হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মনোবিজ্ঞানীরা। তারা শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং করার ওপর জোর দিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আনওয়ারুল হাসান সুফি বলেন, বর্তমানে ৬৫০ শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের মধ্যে ২১৭ জন একাধিকবার আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। প্রতিদিন গড়ে ৯ শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিতে আসেন।

তিনি আরও জানান, রাবির মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাত্র চারজন মনোচিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা চলছে, যার মধ্যে সবাই অবৈতনিক দায়িত্ব পালন করছেন।

রাবি মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র সূত্র মতে, গত দশ বছরে বিভিন্ন বিভাগের আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া ১৭ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭ ছেলে এবং ১০ জন মেয়ে। তাদের মধ্যে প্রথম বর্ষের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীও ছিলেন। এ ছাড়াও ২০১৭ সালে মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেখানে এখন পর্যন্ত আত্মহত্যা ঝুঁকিপ্রবণ ২১১ শিক্ষার্থী এবং মানসিক সমস্যায় ভোগা ৬৬৩ শিক্ষার্থী চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাচ্ছেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আত্মহত্যার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১১ সালে গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী আমানুর রহমান ইলিয়াস, লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী সাহাকুল ইসলাম ওরফে সোহাগ, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষর্থী কবিতা রানী রায়, হিসাব বিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস কেয়া ও শরীফুল, চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী নিশাত ফরহাদ টুম্পা, মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা মিমি, ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী সামছাদ শারমিন অনু আত্মহত্যা করেন; ২০১৩ সালে এমবিএ’র শিক্ষার্থী নাজমুন নাহার, ২০১৫ সালে ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী ইসরাত আরেফিন, ২০১৬ সালে একই বিভাগের শিক্ষার্থী সুব্রত কুমার প্রামানিক এবং এগ্রোনমি এন্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের শিক্ষার্থী ফারজানা আফরোজ আত্মহত্যা করেন; ২০১৯ সালে ফলিত গণিত বিভাগের ফিরোজ কবির, নাট্যকলা বিভাগের প্রিয়াঙ্কা সাহা; ২০২০ সালে নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী দেবজৌতি বসাক পার্থ এবং চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মুবাশ্বিরা তাহসিন ইরা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। 

মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানজির আহম্মদ তুষারের তত্ত্বাবধানে গবেষণাটি সম্পন্ন হয়। সেখানে বিষণ্ণতা, বেকারত্ব, মানসিক চাপ, প্রেমঘটিত অভিমান, হতাশা ও পারিবারিক সমস্যা থেকে প্রধানত আত্মহননের পথ বেছে নেন শিক্ষার্থীরা। 

এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠার কারণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, অবৈধ সম্পর্ক, পারিবারিক সমস্যায় জর্জরিত হওয়া, মানসিক চাপ ও অবসাদ, সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত, ক্ষতিকারক নেশার প্রভাব, উচ্চাকাক্সক্ষা ও সন্তোষজনক ফল না হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়েন। 

এ প্রসঙ্গে রাবির মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিচালক আনওয়ারুল হাসান সুফি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনের সঠিক কারণ জানা কঠিন। প্রত্যেকের আত্মহত্যার ভিন্ন ভিন্ন কারণ রয়েছে। পারিবারিক সমস্যা, পরীক্ষা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা, মানসিক চাপ থেকে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠছে। এ ছাড়াও শিক্ষার্থীরা নিজের মনের কথা কারও সঙ্গে শেয়ার না করার কারণে আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপিত হওয়ার পর থেকে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছে, এরকম শিক্ষার্থীদের দেওয়া অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতি সোমবার বিকেলে শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং করা হয়। আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকা শিক্ষার্থীদের একই ধরনের লক্ষণ যাদের রয়েছে, তাদের একসঙ্গে গ্রুপ থেরাপি দেওয়া হয়, যেখানে সর্বোচ্চ ২০ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে তাদের সমস্যার কথা শোনা হয় এবং তাদের চিন্তার মাঝে যে ভুল আছে, সেটা ধরিয়ে দেওয়া হয়।’ 

এ ছাড়াও ২০১৩ সালের ওই গবেষণায় আত্মহত্যার পূর্ব লক্ষণ, প্রকারভেদ, বিভিন্ন ধরন, আত্মহত্যা সংগঠন এবং আত্মহত্যার বিভিন্ন পদ্ধতিও উল্লেখ করা হয়। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে উঠে আসে শিক্ষার্থীদের তীব্র হতাশায় ভোগা, আত্মসম্মান কম অনুভব করা, মানসিক চাপ, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, রাগ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতা, সম্পর্কে জটিলতা, দাম্পত্য কলহ, বেকারত্ব, বিষণ্ণতা, মানসিক চাপ, প্রেমঘটিত অভিমান প্রমুখ। 

প্রতিবেদনে আত্মহত্যা প্রচেষ্টা রোধে বিভিন্ন আইনগত পদক্ষেপের কথাও উল্লেখ করা হয়। গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, যে পরিমাণ মানুষ আত্মহত্যা করে, তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আত্মহত্যা করার প্রবণতার সংখ্যা আরও ১০ গুণ বেশি। আর আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি নিজেই হীনম্মন্যতায় ভোগেন।

রাবির প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. সুলতান-উল-ইসলাম জানান, মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করা একটা মহাসুযোগ। মানুষের জীবনে সমস্যা থাকবে। সেটিরও সমাধানের পথ রয়েছে। শুধু একটু ধৈর্য্যশীল হতে হবে। অনেক সময় শিক্ষার্থীরা কোনো সমস্যায় পড়লে কাউকে না জানিয়েই ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তখন কারও কিছু করার থাকে না। শিক্ষার্থীদের বলব, যতই প্রতিকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক কেন, একক কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। 

মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসাকে অত্যাবশ্যকীয় উল্লেখ করে বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. মেহতাব খানম বলেন, বাংলাদেশে পর্যাপ্ত মনোবিদ এবং মনোচিকিৎসক নেই। দেশে প্রায় ৩০০ মনোচিকিৎসক এবং ৫০০ জনের কম মনোবিদ রয়েছেন। সরকারের অবশ্যই মানসিক সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষার্থীদের সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সম্ভাবনা হারাতে বসবে।

তিনি আরও বলেন, অভিভাবকদের নজরদারি বাড়াতে হবে। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তানসেন রোজ বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর আরও গুরুত্ব দিয়ে নাগরিকের বেঁচে থাকার পরিবেশ তৈরি করা রাষ্ট্র ও পরিবারের দায়িত্ব। তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে হারে আত্মহত্যা বাড়ছে, সে হারে সচেতনতা বাড়ছে না। আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে একা না রাখা, ক্রাইসিস সেন্টার ও হটলাইন চালু করা, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সিলর নিয়োগ করার ওপর জোর দেন তিনি।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh