রবিউল আউয়ালের বার্তা

মাওলানা লিয়াকত আলী

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২১, ১১:২৭ এএম

মাওলানা লিয়াকত আলী

মাওলানা লিয়াকত আলী

হিজরি সালের রবিউল আউয়াল মাস চলছে। এখন থেকে চাঁদের হিসাবে ১৪৯৬ বছর আগে ধূলির ধরায় তাশরিফ এনেছিলেন আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠ হাবীব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)। মানবজাতিকে ইহ ও পরকালীন জীবনের সার্বিক কল্যাণ ও সাফল্যের চূড়ান্ত নির্দেশিকা দিয়ে তাকে পাঠিয়েছিলেন মহান রব্বুল আলামিন। আর এ ছিল তাঁর প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন।

মহানবীর (সা.) আগমন ঘটেছিল মরু আরবে মক্কার এক জীর্ণ কুটিরে; কিন্তু তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন গোটা বিশ্বজগতের রহমতস্বরূপ। যুগ যুগ ধরে যে মানবতা শোষিত, বঞ্চিত ও নিগৃহিত হচ্ছিল, শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তারা জাহান্নামের কিনারে গিয়ে উপনীত হয়েছিল, তাদের সুপথে ফিরিয়ে এনে পৃথিবীর শান্তিময় জীবন আর আখেরাতের চিরশান্তির নিবাস জান্নাতের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ধূলির ধরায় তাশরিফ এনেছিলেন মা আমেনার আদরের দুলাল হজরত মুহাম্মদ (সা.)। মহান আল্লাহ তাঁকে পাঠিয়েছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী করে।

কোরআন মজিদে মহানবীকে (সা.) উদ্দেশ করে বলা হয়েছে ‘নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’। আল্লাহ তায়ালার এ ঘোষণার তাৎপর্য হলো জগতের মানুষের সামনে তিনি তাঁর প্রিয় হাবীবকে সর্বোত্তম মডেল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। একজন মানুষের মধ্যে মহত্ব ও উন্নত ব্যক্তিত্বের যত দিক ও উপাদান থাকা সম্ভব হযরত নবী করীম (সা.) -এর মধ্যে পুরোমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। সে জন্যই আল্লাহ পাক তাকে মানবজাতির জন্য উসওয়াতুন হাসানা বা মহত্তম আদর্শ বলে বর্ণনা করেছেন। সুতরাং বনি আদম যদি কল্যাণ হাসিল করতে চায়, তাহলে তার একমাত্র পন্থা হলো মহানবীর (সা.) অনুসরণ। তাঁকে ছেড়ে অন্য যে কোনো মত, পথ বা প্রতিষ্ঠানের আশ্রয় নেওয়ার পরিণতি হবে অসার ও ব্যর্থ। মহানবী (সা.) শেষ নবী। তাই জাগতিক ও আধ্যাত্মিক সকল ক্ষেত্রে তিনিই হবেন সকল কিছুর মানদণ্ড। তাঁর সুন্নাহ হতে হবে জীবনধারার একমাত্র নির্দেশিকা।

মহানবীর (সা.) মাধ্যমে নবুওয়াতের ধারায় পরিসমাপ্তি হয়েছে। সাইয়িদুল মুরসালিনের আগমনের পরে আর কোন নবী রাসূল আগমনের অবকাশ নেই। মানব জাতির প্রতি আল্লাহ তাআলার হিদায়াতের নিয়ামত পরিপূর্ণ করা হয়েছে মহানবীর (সা.) প্রেরণ ও তাঁর প্রতি কোরআন মজিদ নাযিলের মাধ্যমে। মহানবীর (সা.) বিদায় হজের সময় আরাফার দিনে সূরা মায়েদার ৩নং আয়াতটি নাযিল হয়। তাতেও এই ঘোষণা দেওয়া হয়। আল্লাহপাক বলেন, আজ আমি তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামতের পূর্ণতা সাধন করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দীন হিসাবে মনোনীত করলাম।’

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মানবতার নবী, মানব প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন ধারাই তিনি জগতবাসীকে দেখিয়ে গেছেন। শুধু তিনি নন, তাঁর পূর্বে যত নবী রাসূল দুনিয়াতে মানব জাতির মুক্তির বাণী নিয়ে আগমন করেছিলেন, তারা কেউই মানব স্বভাবের চাহিদা ও প্রয়োজনকে উপেক্ষা করতে বলেননি। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাদের প্রতি বড়ই মেহেরবান। আম্বিয়ায়ে কেরামের সহজ-সরল স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে দেখে অবিশ্বাসীরা অনেক সময় প্রশ্ন তুলেছিল। তারা এই বলে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল যে, তিনি কেমন করে নবী হতে পারেন? তিনি তো আমাদের মতোই আহার পানীয় গ্রহণ করেন, পরিবার প্রতিপালন করেন, জীবিকা নির্বাহের জন্য হাট-বাজারেও গমন করেন। অর্থাৎ আমাদের সঙ্গে তাঁর জীবনযাত্রার তো কোনো স্বাতন্ত্র্য নেই। তাহলে তিনি নবী হলেন কি করে?

আল্লাহ তায়ালা তাদের এ বক্তব্যের অত্যন্ত জোরালো ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেন, দুনিয়াতে যদি ফেরেশতা বাস করত, তাহলে আমি ফেরেশতাদের মধ্যে থেকে একজনকে রাসূল করে পাঠাতাম। অর্থাৎ যেহেতু মানুষদের কাছেই আল্লাহর দীন উপস্থাপন করতে হবে, তাই মানুষের অকৃত্রিম জীবনযাত্রার সঙ্গে একাত্ম কোনো ব্যক্তি ব্যতীত নবী-রাসূল হওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। মহানবী (সা.) তাঁর গোটা জীবনে এমন নজির ও আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, যা অনুসরণ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব।

মহানবী (সা.) যখন দুনিয়াতে আগমন করেন, তখন আরবসহ গোটা পৃথিবী ডুবে ছিল অসভ্যতা ও অনৈতিকতার ঘোর অমানিশায়। আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হয়েও তারা নিজেদের সবচেয়ে সম্মানিত অঙ্গ তথা মাথাকে অবনমিত করত জড় পদার্থের সামনে। যে মহান স্রষ্টা মানুষসহ পৃথিবীর সব কিছুর মালিক, দিশেহারা মানব সমাজ তাঁর কথা ভুলে আশ্রয় প্রার্থনা করত নশ্বর কোন বস্তুর নিকট। মানবাধিকার বলতে কিছুই ছিল না। জোর যার, মুল্লুক তার এই ছিল সাধারণ রীতি। বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার রাজ্যে বাস করছিল মানুষরা। আর এর ফলে দেখা দেয় অনির্দেশ যাত্রার পালা। আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম (আ.) যে দীন নিয়ে এসেছিলেন, তারই আওলাদ কুরাইশ বংশ গ্রহণ করেছিল পৌত্তলিক ধর্মের রীতিনীতি। মহানবী (সা.) দুনিয়াতে এলেন মানব জাতিকে সকল প্রকার পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত করার জন্য।

মহানবী (সা.) সকল নবীর নেতা। তথাপি তিনি তাশরিফ এনেছেন সকলের শেষে। তাঁর আগমনের পূর্বে যে নবীই এসেছেন, তিনি নিজ উম্মতকে শেষ নবী সম্পর্কে সুসংবাদ দিয়ে গিয়েছেন। যাবুর, তাওরাত, ইনজিল- সব আসমানি কিতাবেও তাঁর আগমনের বার্তা ঘোষিত হয়েছে। বর্তমানকালের তাওরাত ও ইনজিলে অসংখ্য রদবদল ও বিকৃতি সাধনের ফলে তা বিশ্বাসযোগ্য থাকেনি; কিন্তু তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত তাতে এমন সব বাক্য ও বর্ণনা রয়েছে, যাতে মহানবী (সা.) সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (সা.) যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য পৌত্তলিক কুসংস্কারকে কেন্দ্র করে ভয়াবহ গোত্র বিরোধ, দলাদলি, প্রতিহিংসা, খুন-খারাবি, রক্তারক্তি ও যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত ছিল। মধ্যপ্রাচ্য ঘোর অমানিশায় আচ্ছন্ন ছিল। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (সা.) ওহীপ্রাপ্ত হয়ে সত্য ধর্ম প্রচার শুরু করেন। আরবের পৌত্তলিক কাফেররা মহানবীর (সা.) আহ্বানে সাড়া তো দিলোই না, বরং তাঁর ওপর নির্যাতন শুরু করে দিল। অবশেষে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি নিজ দেশ ত্যাগ করে মদিনায় চলে যেতে বাধ্য হন; কিন্তু তাই বলে তিনি কুরাইশদের ওপর প্রতিশোধ নেননি। মদিনায় গিয়েও যখন তিনি বারবার কাফেরদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছিলেন, তখন তিনি কেবল প্রতিরোধই করে যাচ্ছিলেন। তিনি সকল প্রকার সংকীর্ণতা দূরীভূত করে বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্ব মৈত্রী ও বন্ধুত্ব স্থাপন করেছেন। এই ভ্রাতৃত্ব দেশ, কাল, বর্ণ, বংশ, ভাষা ও গোত্রীয় সংকীর্ণতার অনেক ঊর্ধ্বে।

মহানবী (সা.) যে মাসে দুনিয়াতে তাশরিফ এনেছিলেন সেই রবিউল আউয়াল মাসে আমাদের করণীয় হবে নবী করীমের (সা.) জীবনাদর্শ সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং সে মোতাবেক জীবন গঠন ও জীবন পরিচালনার অঙ্গীকার করা। মহানবী (সা.) বলেন, আমি যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তির নিকট তার পিতা, সন্তান ও সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় না হব, ততক্ষণ পর্যন্ত সে পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে পারবে না। সাহাবায়ে কেরাম মহানবীর (সা.) প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন। তাঁরা নবী করীমের (সা.) জন্য জীবন উৎসর্গ করতে কখনো কুণ্ঠিত ছিলেন না। মহানবী (সা.) তাঁর প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার অর্থ নিজেই বলে দিয়েছেন। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করিম (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে ভালোবাসল, সে আমাকেই ভালোবাসল। আর যে আমাকে ভালোবাসল সে জান্নাতে আমার সঙ্গে থাকবে। (তিরমিজি শরিফ)

সুতরাং নবী করীমের (সা.) সুন্নাত অনুসরণই হবে তার প্রতি অনুরাগের প্রকৃষ্ট প্রমাণ। যে নবী সারা জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ আগমন করেছেন, ধ্বংসের পাদপ্রান্তে উপনীত মানব জাতির মুক্তির পথনির্দেশ দিয়ে গেছেন, আমরা যদি সেই শ্রেষ্ঠ নবীর শাফায়াতে ধন্য হওয়ার লক্ষ্যে তাঁর জীবনাদর্শ কঠোরভাবে মেনে চলতে পারি, তাহলেই দোজাহানের অশেষ কল্যাণ ও অনাবিল শান্তি আমাদের জন্য অবধারিত। শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত হয়ে আমরা যে সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছি, মাহে রবিউল আউয়ালে সে সৌভাগ্য অক্ষুণ্ণ রাখার প্রতিজ্ঞা করা সমীচীন।

লেখক- ইসলামি চিন্তাবিদ

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh