আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের ভবিষ্যৎ কী?

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২১, ০৫:০৪ পিএম

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

গত ৪ অক্টোবর ‘ইন্টারন্যাশনাল মনেটারি ফান্ড’ বা আইএমএফের এক্সিকিউটিভ বোর্ডের সঙ্গে ‘উইলমার হেইল’ নামের এক আইনব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়। ‘উইলমার হেইল’-এর ১৭ সেপ্টেম্বরের এক তদন্ত রিপোর্টে বেরিয়ে এসেছে যে, আইএমএফের প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা যখন বিশ্বব্যাংকের প্রধান ছিলেন, তখন সংস্থার ‘ডুইং বিজনেস ইনডেক্স’- এর র‌্যাংকিংয়ে চীনের অবস্থানকে পরিবর্তন করা হয়। এই ইনডেক্সের অর্থ হলো, একটা রাষ্ট্র প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগকে কতটা সহায়তা দেয়। 

প্রতিবেদনে বলা হয় যে, এক বছরে চীনের অবস্থান ৭৮ নম্বরে ছিল; যার পরের বছর ৮৫ নম্বরে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখে চীনারা ক্ষুব্ধ ছিল। জর্জিয়েভা এবং সংস্থার অন্যান্য কর্মকর্তারা সে সময় ইনডেক্সের হিসেবকে পরিবর্তন করে চীনের অবস্থানকে আগের বছরের, অর্থাৎ ৭৮ নম্বরে নামিয়ে আনেন। 

প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে, জর্জিয়েভা ইনডেক্স হিসেবের পদ্ধতিতেও পরিবর্তন এনেছিলেন চীনের অবস্থানকে পরিবর্তন করার জন্য। 

‘ফ্রান্স টুয়েন্টিফোর’ জর্জিয়েভা এবং তার সমর্থকদের বরাত দিয়ে বলছে যে, সংস্থার ভেতর জর্জিয়েভার বিরোধীরা অভ্যুত্থান করতে চেয়েছিল; যারা জর্জিয়েভার ‘প্রগ্রেসিভ’ লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে একমত নয়। তবে কেউ কেউ এ ধরনের বক্তব্যের পুরোপুরি বিরোধী। ‘নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি’র প্রফেসর এবং অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী পল রোমার কিছু দিন আগেও বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং রিসার্চ ডিভিশনের প্রধান ছিলেন। সেই হিসেবে তিনি সংস্থার ‘ডুইং বিজনেস ইনডেক্স’- এর উপর যে কাজ হতো, তার মূল ব্যক্তি ছিলেন।

তিনি ‘ব্লুমবার্গ’- এর সঙ্গে এক সাক্ষাতে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, এই ইনডেক্সে ভালো অবস্থানে থাকার জন্যে আন্তর্জাতিকভাবে অনেক দেশের মাঝে প্রতিযোগিতা রয়েছে। ফলশ্রুতিতে অনেক দেশই ইনডেক্সে তাদের স্কোরকে কিছুটা ভালো অবস্থানে দেখার জন্য চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করে। 

রোমার বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের মাঝে একটা সংস্কৃতি রয়েছে যে, ইনডেক্সের সংখ্যাগুলিকে রিভিউ করা এবং কিছু দেশকে অধিক সুবিধা দিয়ে তাদের স্কোরকে অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে রাখা। 

তিনি বলেছেন, সংস্থার নেতৃত্ব চীনকে ভালো স্কোর দিয়ে হয়তো তাদের কাছ থেকে কিছু সুবিধা আদায় করতে চাইছিলেন। তবে সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন। তবে রোমারের অভিযোগ হলো, যেসব দেশ ইনডেক্সে তাদের অবস্থানকে পরিবর্তন করতে চাপ সৃষ্টি করে, তারা স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য দেশের সঙ্গে নিজেদের একটা পার্থক্য করে ফেলছে এবং শেষ পর্যন্ত কিছু দেশকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে ইনডেক্স প্রকাশ করা হচ্ছে। এভাবে বিশ্বব্যাংক একদিকে একটা বৈজ্ঞানিক তথ্যের উৎস, আবার একইসঙ্গে কূটনৈতিক সংস্থা। কারণ তারা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক দেনদরবার চালায়; কিন্তু বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রকাশে যে বিশ্বাসযোগ্যতা দরকার, তা কূটনৈতিক আলোচনায় ছাড় দেবার মাধ্যমে তথ্যের উৎসের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কঠোর নিয়মে ঘাটতি পড়ে যায়। এটা পুরো সংস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। 

‘সিএনবিসি’এর এক প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, ১৯৪৪ সালে ‘ব্রেটন উডস কনফারেন্স’- এর মাধ্যমে তৈরি করা আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাংকের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য রয়েছে। আইএমএফ সাধারণত এর সদস্য দেশগুলিকে স্বল্প মেয়াদে ঋণ দেয়, যাতে সেসব দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলা করা যায়। সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রেও আইএমএফএর বহুবিধ লক্ষ্য রয়েছে। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের কাজ হলো বিভিন্ন দেশে উন্নয়নমূলক প্রকল্পে অর্থায়ন করা এবং দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করা।

বিশ্বব্যাংকের বেশিরভাগ কাজ উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। উভয় সংস্থারই ১৮৯টা সদস্য। আইএমএফএর মূল অর্থায়ন হয় কোটা ব্যবস্থায়। এর মাধ্যমে সংস্থার মোট অর্থায়ন প্রায় ৬৭৫ বিলিয়ন ডলারের মত। কোটা পদ্ধতিতে সংস্থার প্রায় ৩৬ শতাংশ ভোট চারটা দেশের হাতে; যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন ও জার্মানি। ফ্রান্স, ব্রিটেন ও ইতালির হাতে রয়েছে আরও প্রায় ১২ শতাংশ ভোট। অর্থাৎ মাত্র সাতটা দেশের হাতেই সংস্থার প্রায় অর্ধেক ভোট। সংস্থার সবচাইতে বড় ঋণগ্রহীতা দেশ হলো গ্রিস, ইউক্রেন, পর্তুগাল এবং পাকিস্তান। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন আসে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীদের মাঝে বন্ড ইস্যু করে ঋণ নেবার মাধ্যমে। 

পল রোমার বলেছেন, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক একসময় বিশ্বের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ সে সময় একটা দেশের পক্ষে খুব বেশি উৎস থেকে ঋণ পাওয়া সম্ভব ছিল না। কাজেই দুই সংস্থাই সে সময় আন্তর্জাতিক পুঁজির জোগানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল; কিন্তু বর্তমানে এই সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক পুঁজির বাজারের তুলনায় অনেক ছোট হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় উভয় সংস্থাই তাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে নতুন কিছু করতে চাইছে। 

রোমার বলেছেন, ১৯৫০ এর দশকে এই সংস্থাগুলোর উদ্দেশ্য যা ছিল, বর্তমান দুনিয়ার সঙ্গে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়; কাজেই এখন সময় এসেছে এই সংস্থাগুলোর উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার। তিনি মনে করেন, এই সংস্থার এখন সবচাইতে বড় কাজ হলো বিভিন্ন দেশের মাঝে কূটনৈতিক আলোচনা সচল রাখা। 

আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার অতি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করছে; কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ব ব্যবস্থায় সংস্থা দু’টির উদ্দেশ্য নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠছে, তখন সংস্থার কর্মকান্ডের মাঝে স্বচ্ছতার অভাব বিশ্বব্যাপী এর বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। শক্তিশালী দেশগুলি যদি সংস্থার ‘ডুইং বিজনেস ইনডেক্স’- এর হিসাবের প্রতিবাদ করে র‌্যাঙ্কিংয়ে পরিবর্তন আনতে পারে, তাহলে বাকি দেশগুলোর সদস্যপদের গুরুত্ব যতটুকু ছিল, তা অর্থহীন হয়ে যায়।

তদুপরি অনেকেই অভিযোগ করছেন যে, জর্জিয়েভা মূলত সংস্থার অর্থায়ন বৃদ্ধি করতে চীনের কাছ থেকে আরও বেশি বিনিয়োগ যোগাড় করতেই ইনডেক্সে চীনের অবস্থানকে পরিবর্তন করিয়েছেন। তবে এতেও যে ব্যাপারটা এড়ানো যায় না তা হলো, সংস্থা দুটি এতকাল মূলত তাদের যেসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে পশ্চিমা উদ্দেশ্যকেই বাস্তবায়ন করেছে, সেগুলির ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh