আসমা চৌধুরী
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২১, ০৬:০৬ পিএম | আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২১, ১২:৩২ এএম
প্রতীকী ছবি
‘বনলতা সেন’ আর ‘সুরঞ্জনা’র আকুতি, সৌন্দর্য আর গভীরতার পাশে আমি কখনো চেষ্টাই করিনি দাঁড়াতে। ‘কুড়ি বছর পরে’ হৃদয়ের সব বাঁধন আলগা করে কেউ আমাকে আকাঙ্ক্ষা করেনি, কেউ আমাকে ডাকেনি মাঝরাতে কুয়াশায় শিশির মেখে চোখে, মুখে। কেউ ডাকেনি। আজ আমাকে কত কথাই না বলে গ্রন্থকার, পাঠক, আলোচক। কিন্তু আমিও বাসর রাতে আমার সুশিক্ষিত কবি স্বামীকে মন খুলে রবীন্দ্রসংগীত শুনিয়েছিলাম। ব্রাহ্ম সমাজের নিয়ম মেনে স্বামীর সাথে বাস করতে শুরু করেছি। দু’টি সন্তানের মা হয়েছি। আমার প্রথম সন্তান মঞ্জুশ্রী অসুস্থ হলে আমি অসহায় বোধ করি। তখন আমার স্বামীর চাকরি নেই। হাতে টাকা নেই- মন খুলে কথাও বলতে পারি না। কারো মুখের দিকে তাকাতে পারি না। একজন এম. এ পাশ করা যুবক, তার কি-না বিষয় ইংরেজি, সে চাকরি পায় না, পেলে নিষ্ঠার অভাব দেখা দেয়, চাকরি চলে যায়।
‘উনি যে চাকরি পেতেন না তা নয়। উনি চাকরি করতে চাইতেন না। বারবার বলতেন, বলো তো, কি নিদারুণ সময়ের অপচয়।’ (মানুষ জীবনানন্দ, লাবণ্য দাশ)
এটা কেমন কথা? আমার স্বপ্ন ভাঙার দিন সেই তখন থেকে শুরু। কর্তব্যনিষ্ঠ মা, পিসি আর জ্যাঠাইমার সারিতে কেউ যদি আমাকেও ভাবতে চায়, একই দাড়িপাল্লায় মাপতে চায় সে-কি সম্ভব? আমার স্বপ্ন, আমার সাধ আমার ভিন্ন রকম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমি প্রতিদিন একটু একটু করে মরে যেতে থাকি। আমি তো কবি নই তাই কবির মতো করে লিখতে পারিনি-
‘দেহ ঝরে তারও আগে আমাদের ঝরে যায় মন।’
গোলপাতায় ছাওয়া মাটির ঘর, শিক্ষক শ্বশুর, কবি শাশুড়ি আমাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। আমি চেয়েছিলাম ঝলমলে জীবন। রূপকথার জীবন কে না চায়? আমি লেখাপড়া শিখেছি, বিয়ের পরে স্নাতক পাশ করেছি।
‘‘আমি যেবারে বি.এ. পরীক্ষা দিলাম, সেবারে কবি সেই কলেজেই (বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ) ইংরেজির অধ্যাপক পদে ছিলেন। ইতিহাস পরীক্ষার দিন শরীর খুব খারাপ বোধ হওয়াতে আমি পরীক্ষা দেব না স্থির করে বাড়ি যাচ্ছিলাম। কিন্তু একজন অধ্যাপক আমাকে বাধা দেন। এমনকি আমাকে পরীক্ষা দিতে বাধ্য করার জন্য কবিকে ডেকে নিয়ে এলেন। তাঁর সামনেই আমি বললাম, ‘আমি পরীক্ষা দেব না, বাড়ি যাব।’ তিনি আমার মুখের দিকে ব্যথিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘ইচ্ছে না থাকলে পরীক্ষা দিও না। শরীর বেশি খারাপ লাগলে বাড়ি চলে যাওয়াই উচিত। কথাটা বলেই মুহূর্তমাত্র সেখানে অপেক্ষা না করে নিজের কাজে চলে গেলেন। কিন্তু শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক হেমচন্দ্র ঘোষ কবির উপর ভীষণ চটে গিয়ে বলেই ফেললেন, ‘বাড়ি যাবার অনুমতি তুমি দিতে পার, কিন্তু আমি কিছুতেই দেব না।’ তাঁরই ব্যবস্থায় আমি পরীক্ষা দিতে বাধ্য হলাম। তিনি যদি সেদিন আমার জন্য অতখানি কষ্ট স্বীকার করতে এগিয়ে না আসতেন তাহলে হয়ত নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ আর পেতামই না।”
(‘মানুষ জীবনানন্দ’, লাবণ্য দাশ)
আমার বাবা-মা নেই, অন্যের বাড়িতে মানুষ হয়েছি। আমি যদি এই জীবন এই শ্রেণি থেকে মুক্ত হয়ে একটু স্বাচ্ছন্দ পেতে চাই সে-কি খুব অন্যায়?
দেশ বিভাগের পর আমরা কলকাতায় চলে এলাম। তাঁর চাকরি কখনো থাকে, কখনো থাকে না। যারা তাঁকে কলকাতায় এসে লেখালেখি করায় উৎসাহ দিয়েছিলো তারা কোন কাজে এলো না। টাকার অভাবে বাড়ির একটা অংশ আবার সাবলেট দিতে হয়েছে।
আমার স্বামীর চাকরি নেই। ‘ক্যাম্পে’ কবিতায় যৌনতা আনার অভিযোগ। সজনীকান্তের আক্রমণ, অর্থকষ্টে বিপর্যস্ত জীবন। আমার কাপড় ছিন্ন প্রায়। ফেরিওয়ালাকে ডাকলাম। তাকেও ডাকলাম শাড়ি পছন্দ করতে। তিনি সবচেয়ে কম দামী, সবচেয়ে খারাপ শাড়িটা পছন্দ করলেন। একবারও ভেবে দেখলেন না আমার পছন্দ কী?
আমাদের সংসারে সামান্য কিছু জিনিসপত্র ছিলো। বাড়িতে চোর এলো। চুরি হয়ে গেলো অনেক কিছু। চুরির তদন্ত করতে দারোগা এলেন আমি তাকে ডাকলাম। তিনি লেখার টেবিলে কবিতা নিয়ে আছেন। বললেন, দেখছো না আমি লিখছি। দারোগা বাবুর সাথে কথাই বললেন না।
বোন সুচরিতার কাছে তার সব কথা বলা যায়। আমাকে বলা যায় না। কারণ তিনি আমাকে পছন্দ করেন না। আমি স্কুলে চাকরি করি, সংসারের খরচ বহন করি তবু আমি তার কেউ নই। যাকে আমি ভালোবাসি না, যে আমাকে ভালোবাসে না তার পাশে শুয়ে থাকা যায়? সমাজ আমার স্বামী ভক্তির পরীক্ষার উত্তরপত্র তৈরি করেছে। পাঠকেরাও করেছে। কিন্তু তিনি কী একবারও স্ত্রী ভক্তি, স্ত্রী প্রেমের কোন পরীক্ষার নাম উচ্চারণ করেছেন? নাকি তার শিষ্যরাও করেছেন? তাঁর উপন্যাসে পশুর সাথে মিলিয়ে নারী চরিত্রের রূপায়ন হয়েছে। সেখানেও আমি। আমার কোন ছুটি নেই আমি প্রেতিনী। বিরাম মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘শুনেছি শ্রীমতি জীবনানন্দ নাকি প্রায়ই বাড়ি ফিরতেন বেশি রাত করে।’ এখানে নাকি শব্দটির দ্বারা অন্যের কাছ থেকে শোনা এটিই বোঝায়। মিনু সরকারকে তো আমি বলেছি, মা বাবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, ভাই-বোনদের জন্য নিবিড় স্নেহপ্রীতি, ছেলেমেয়েদের জন্য ভালোবাসা আর উৎকণ্ঠা সবই ছিল তার। শুধু আমার প্রতি তার আচরণে ছিল নিঃশব্দ উদাসীনতা। সুখ যেমন তার ছিল না, আমারও কি ছিল?
৩১ আগস্ট, ১৯৩৪ তারিখের ডায়েরিতে তিনি আমার প্রসঙ্গে লিখেছেন L-terrible অবস্থা for 3-4 days- দরজা বন্ধ, নাওয়া না, খাওয়া না, শুধু মুড়ি- দিনের পর দিন- কোন অনুনয় বিনয় কিছু না- will starve to death ... এ বাড়ির সবাই তার পর ...... ওকে ভূতে পায় নাকি?’
এখানে will starve to death এবং এ বাড়ির সবাই তার পর .... বাক্য দুটি অনেক কথা বলে দেয়। কেন আমি নিজের মৃত্যু চেয়েছি?
তিনি ভালো লিখতেন। লিখতেই ভালোবাসতেন। তবু সময় তাকে বুঝতে পারেনি। তাঁর কবিতার বিরূপ সমালোচনা হতে থাকে। কেউ তাঁর সংকটের মুহূর্তে অর্থ সাহায্য নিয়ে আসেনি। অথচ তাঁর মৃত্যুর পরে অচিন্ত্য বাবু, বুদ্ধদেব বসু, সজনীকান্ত সবাই এলেন। আমি তার প্রিয় শিষ্য ভূমেন্দ্রগুহ কে প্রশ্ন করলাম, ‘তোমাদের দাদা নিশ্চয়ই বড় মাপের সাহিত্যিক ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের জন্য তিনি অনেক কিছু রেখে গেলেন হয়তো। আমার জন্য কী রেখে গেলেন বলো তো?’ সবাই খুব কষ্ট পেলেন, ক্ষুণ্ণ হলেন আমার ওপর।
আমি তো কবি নই, কবিতার পাঠক নই। আমি চেয়েছি একটি শিক্ষিত পরিবারে বধূর মর্যাদা, সন্তানদের সুস্বাস্থ্য আর স্বামীর ভালোবাসা। পেয়েছি? আমি চেয়েছি ছোট্ট ছিমছাম সাজানো একটি বাড়ি, গাড়ি, পেয়েছি?
আমি কেন তার মৃত্যু শয্যায় শেষের দিকে হাসপাতালে যাইনি, এ নিয়ে আজও সবাই বিদ্রুপ করে। কিন্তু আমি তো অন্য অনেকের মতো অনিচ্ছের দাস হতে পারিনি। প্রতারণা করিনি নিজের সাথে না কবির সাথে। অভিনয় দিয়ে লোকজনের বাহবা পাবারও চেষ্টা করিনি। আমি যা, আমি তা-ই রয়ে গেলাম।
আমার শ্বশুরমশাই ছিলেন জ্ঞানযোগী। সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোর্তিবিজ্ঞানে আগ্রহ ছিলো। চর্চা করতেন এইসব। প্রায় প্রতি মাসেই সন্তানদের বই কিনে দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সন্তান পালন ব্যতীত নারীদের অন্য কিছু করার আছে। শাশুড়িমা নারীদের জেগে ওঠার কথা লিখেছেন ডায়েরিতে। যা সত্য এবং সঠিক বলে ভেবেছেন নিষ্ঠার সাথে নীরবে পালন করেছেন। এমনকি পুত্রের অসুস্থতায় ডাক্তারবাবুর পরামর্শে অন্যের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে বায়ু পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ ধরনের অতি উন্নত মানুষদের ভিড়ে আমার ব্যক্তিত্বের বিকাশ অসম্ভব ছিলো, তার আরো কারণ ছিলো আমার বেকার স্বামী এবং তার আমার প্রতি উদাসীনতা। শাশুড়ি মা আমার সব কাজে নিজস্ব মতামত প্রদান করতেন, রাগ করতেন, ঝগড়া করতেন, আবার আমার জন্য পিঠা তৈরি করতেন। আমি কখন বেড়াতে যাব, কতদিন থাকব, কয়টি শাড়ি নিব সব কিছুতেই তার উপস্থিতি আমার আকাঙ্ক্ষাকে ব্রাকেটবন্দি করে দেয়। আপনাদের কবি জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে তার বোন সুচরিতা দাশ লিখেছেন, ‘ইজি চেয়ারে বসে দাদা লিখছেন, প্রগাঢ় তন্ময়তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন তিনি। সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছে হাজার রক্তিম পুষ্প স্তাবক, লাল আগুন জ্বলছে, গাছের তলায় সবুজ মাটিতে অশেষ সবুজ ঘাসের তরতরে প্রাণ স্পন্দনের মখমল তার ওপর আলো-আঁধারের সচল ছায়া-ছবি, নিপুণ আলপনা। এই ত লিখছিলেন, কখন যেন আনমনা হয়ে গেছেন রৌদ্র ছায়ায় সেই ছন্দোভঙ্গি দেখে, ঘাসের নিবিড়ে, ঘাস ফড়িংয়ের নৃত্য পরায়নতায় অভিনিবিষ্ট হয়ে গিয়ে।’ (কাছের জীবনানন্দ, সুচরিতা দাশ)
মঞ্জুশ্রীর বাবা আপনাদের জীবনানন্দকে আরো খুঁজে পাওয়া যায় তার নানা কাহিনির ভিতরে। আকাঙ্ক্ষার জগৎ নামে তার একটি ছোট গল্প আছে। যেখানে তিনি যেন নিজের কথাই লিখছেন। ‘বিভূতির চোখ মুখ করুণ হইয়া উঠিল। খাট তো দূরের কথা, একখানা কাপড় বা এক জোড়া জুতা, নিজের কিনিবার সামর্থ নাই তার, এমনকি কাপড় কাচা সাবান পর্যন্ত।’
আকাঙ্ক্ষার গল্পে বিভূতির এই অবস্থা যেন ঘুরে ফিরে ফিরে আসে আমাদের সংসারে। ৪-৮-৩৩ তারিখে তিনি ডায়েরিতে লিখেছেন, What to do? Tea shop? Sweet shop? Bakery? poultry? Fish farming? Opium selling? Wine shop? Shoe making? Plaster from roof fell on my head early morning.’ (অমিতানন্দ দাশ সম্পাদিত জীবনানন্দের ডায়েরি থেকে)
আসলে আমাদের অতি সাধারণ জীবনের অসাধারণ ভাঙনের গল্প ১৯৩৩ - ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের জীবন বাবুর ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলোতেই স্পষ্ট। ‘তাঁর প্রথম সন্তান মঞ্জুশ্রী জন্মগ্রহণ করেছে; এক মঞ্জুশ্রী ছাড়া আর কাউকে আশ্রয় করার কথা ভাবছেন না এখন; স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কটা তেমন উৎসাহব্যঞ্জক হয়ে উঠতে পারছে না। এদিকে কলকাতার পথে ঘাটে কচিৎ দু’একটি মেয়ে তাদের বিশিষ্ট রূপ চরিত্র নিয়ে তাঁর চোখে আটকে যাচ্ছে, তাঁর কোনো এক অনেককাল আগের পরিচিত গ্রাম্য কিশোরীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।’ (‘জীবনানন্দদাশের দিনলিপি’ সম্পাদক: ভূমেন্দ্রগুহ) আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেন কেন বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসুর মত হলাম না? আচ্ছা বুদ্ধদেব, প্রতিভাবসুর কি খাওয়া-পরার সঙ্কট ছিলো?
বিশ্ব যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কবি তো নিজেই দেখেছেন নানা অন্যায় অনটন। লঘু মুহূর্ত কবিতায়ও তো লিখেছেন- ‘ভিখিরীকে একটি পয়সা দিতে ভাসুর ভাদ্রবৌ সকলেই নারাজ।’ এই রকম এক টালমাটাল সময়ে আমি লাবণ্য যদি নানা ভাবে দু-পয়সা রোজগারের কথা ভাবি তা কেন প্রশ্নবিদ্ধ হবে? তিনি কবি। মহৎ কবি। আমি কবি নই, কবিতার পাঠক নই এটা কি আমার অপরাধ? যে সমস্ত মেয়েরা Y কিংবা শোভনা তার হৃদয়ের ভেতরে ঢুকে চুপচাপ পড়ে থাকবে আমি তা জেনে বুঝে কবির আদর্শ স্ত্রী হয়ে থাকব? ১৮ আগস্ট ১৯৩৩ তারিখে ডায়রিতে তিনি লিখেছেন, “All along while seeing চণ্ডীদাস, I thought of Y who had seen it previously. Did she understand all the points? Did she ever think of me? or, poet’s or poetry? ...... my mind is now clear of that passion of the obsession that she was the only woman and her love the only love for my soul ......”
এতসব যন্ত্রণার ভেতরেও আমি তাকে ছেড়ে যাইনি। তিনি তো কবেই আমাকে ছেড়েছেন। আমি লাবণ্য দাশ সামান্য নারী। অন্যদিকে আমার বাবা রোহিনীকুমার গুপ্ত খুলনার সেনহাটির কুলীন বৈদ্য পরিবারের সন্তান। মাতা সরযূবালা দেবী যশোর জেলার ইতিনা গ্রামের তারা প্রসন্নসেনের একমাত্র কন্যা। বাবা, মায়ের কুসংস্কারমুক্ত জীবন আমাকে প্রভাবিত করেছে। ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন আমাকে আকৃষ্ট করে, আমি বিয়ের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তবু কাকার ইচ্ছায় আমার বিয়ে হয়ে যায়।
‘আমার মা ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু পরিবারের মেয়ে। গল্প শুনেছি- তিনি মুরগীর মাংস খাওয়া তো দূরের কথা, বাড়িতে আনতেও দিতেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালিনী এবং স্বভাবটি ছিল কঠোর ও কোমলের অপূর্ব সমন্বয়।’
আমার বাবা যেমনি ছিলেন স্ফূর্তিবাজ, তেমনি ছিল তাঁর দরাজ মন। হিন্দু সন্তান কোন রকম কুসংস্কারের ধার দিয়েও তিনি যেতেন না।’ (মানুষ জীবনানন্দ)
তিনি কবি জীবনানন্দ দাশ। পরোপকারী, সামাজিক কাজে, ধর্মীয় কাজে নিবেদিত কুসুমকুমারী দাশের সন্তান। তা সত্ত্বেও তিনি তো কোন সামাজিক দায়িত্ব পালন করেননি। কারো উপকারে আসেননি বরং নিজের চেহারা নিয়ে নিরন্তর বিব্রত থাকায় কারো সাথে মিশতেও চাননি। কোন দায়িত্ব কি তিনি আমার পালন করেছেন? জৈবিক, আর্থিক, সাংসারিক সবদিক থেকে দূরে থেকে ঘৃণা করে নিজেও নিঃস্ব হয়েছেন আমাকেও নিঃস্ব করেছেন। কবির সমাজ আমাকে দুবেলা গালমন্দ করে অভিশাপ দেয়। আমি অভিশাপ দেব কাকে?
২.
কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ঋতুর বৈশিষ্ট্য এবং মানুষের নানা স্বভাব চরিত্র সরাসরি না এসে কবির চৈতন্য থেকে বেরিয়ে এসে খণ্ড খণ্ডভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। শুধুমাত্র ধূসর পাণ্ডুলিপির ‘নির্জন স্বাক্ষরে’ তার অভিমান এবং জীবনের রূঢ় বাস্তবতা অনেকটাই সরাসরি প্রকাশিত। জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রনাথের প্রভাবমুক্ত থাকতে নজরুল এবং সত্যেন্দ্রনাথের প্রতি ঝুঁকেছিলেন এ সত্য আমরা সবাই অবগত। নজরুলের অভিমান সমৃদ্ধ বিখ্যাত কবিতা ‘অভিশাপ’ এর অসামান্য লাইন ‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে। অস্তপারের সন্ধ্যা তারায় আমার খবর পুছবে/ বুঝবে সেদিন বুঝবে/ এর ভেতরে যে অভিমান কাতরতা লক্ষ্য করা যায় জীবনানন্দের ‘নির্জন স্বাক্ষর’-ও তাই। তবে প্রকাশভঙ্গি একেবারেই ভিন্ন। এক ধরনের মৃদু ভাবনার তাড়নায় হৃদয়ের গভীরে ধাক্কা দেয়ার যে রেওয়াজ কবির কবিতায় এখানে তা দারুণভাবে বেদনাসিক্ত। ‘অনন্ত বিরহ, ইপ্সিতাকে না পাওয়ার বেদনা আর দুঃখের পৌনঃপুনিক উল্লেখ সত্বেও’ কবি আলোচ্য কবিতায় অনেকটাই খোলামেলা। কবিতার মূল বক্তব্য হচ্ছে কবি যখন এই পৃথিবীর আলো-হাওয়া থেকে এমনকি প্রিয় নারীর কাছ থেকে দূরে চলে যাবেন, তখন ঈপ্সিতা উপলব্ধি করবেন তিনি কী হারিয়েছেন?
‘যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে-
পথের পাতার মতো তুমিও তখন,
আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে?
হয়তো বেদনার ভারে সে আচ্ছন্ন হয়ে হয়ে পড়বে-
‘অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার!’
এখানে কবির যে অভিমান এবং বেদনাবোধ সেক্ষেত্রেও নজরুলের একই কবিতার ব্যঞ্জনা সমার্থক।
‘আসবে আবার শীতের রাত, আসবে নাক’ আর সে
তোমার সুখে প’ড়ত বাধা থাকলে যে-জন পার্শ্বে
আসবে নাক’ আর সে।’
(অভিশাপ, কাজী নজরুল ইসলাম)
যার কাছ থেকে ছুটি নিয়ে দূরে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন অথচ অন্তর জুড়ে রয়েছে সে-ই একমাত্র। নানান উপেক্ষায় উভয় কবিরই মনে হচ্ছে তারা চলে যাবার পরে নতুন কেউ এসে প্রিয়ার আনন্দের শরিক হবেন।
আবার গাঙে আসবে জোয়ার, দুলবে তরী রঙ্গে
সেই তরীতে হয়তো কেহ থাকবে তোমার সঙ্গে
দুলবে তরী রঙ্গে
(অভিশাপ, কাজী নজরুল ইসলাম)
আবার জীবনানন্দের নির্জন স্বাক্ষরে-
আমি ঝরে যাবো- তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধ’রে সেদিন পৃথিবীর পরে।
জীবনানন্দ বিশ্বাস করতেন সময় পরিবর্তনশীল। জীবনের থলি একে একে পূর্ণ হয়ে যায়।
নতুন আকাঙ্ক্ষা আসে- চলে আসে নতুন সময়
পুরোনো সে নক্ষত্রের দিন শেষ হয়
নতুনেরা আসিতেছে বলে;
তাই নায়কের বিপরীতে নায়িকা-
যে আকাশ জ্বলিতেছে, তার মতো মনের আবেগে জেগে আছো।
জীবনবাদী কবি জানতেন ইপ্সিত প্রেমিকা একমাত্র কবিকে ছাড়া আর সবকিছুতে প্রাণময়। জাগতিক সমস্ত কিছুর অধিশ্বর। এক উদ্দাম নারী শুধুই সামনের দিকে ধাবমান। তার কোন অতীত নেই। যেন ঝড়, সবকিছু তছনছ করে দিয়ে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছার তাড়া। শুধুই ব্যক্তিগত সুখ। ব্যক্তিগত আহ্লাদ। কবি তাই লেখেন-
‘যে পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস-আকাশ তোমার।’
পৃথিবীর সবটুকু নিয়ে যিনি বাস করেন সে কখনো স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। কবিকে চরম উপেক্ষা অনাদরের মাধ্যমে সে যেন আরো বেপরোয়া। বেদনাহত কবি তাই উচ্চারণ করেন-
জীবনের স্বাদ লয়ে জেগে আছো, তবুও মৃত্যুর
ব্যথা দিতে পারো তুমি;
এ যেন আকাশলীনা কবিতার সুরঞ্জনা। জীবনের সম্ভাবনা নিয়ে বসে আছে। আতঙ্কিত প্রেমিক তাই বিপন্ন সুরে প্রশ্ন করছে, ‘কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে?’ কিন্তু যে নারী জীবনের সমস্ত আনন্দ আয়োজনের কেন্দ্রে রয়েছে। পৃথিবীর যাবতীয় রূপ-সুধা গ্রহণ করছে তার বিপরীতে যিনি রয়েছেন তিনি তো ততখানিই দুর্বল, প্রেম হারিয়ে ভঙ্গুর এবং সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ‘বাহিরের আকাশের শীতে’- অর্থাৎ যারা বাইরের মানুষ তাদের নানান প্রশ্নবানে-
‘নক্ষত্রের হইতেছে ক্ষয়
নক্ষত্রের মতন হৃদয়
পড়িতেছে ঝরে-।’
ভেতরে ভেতরে একা হয়ে যাওয়া বিবর্ণ, রক্তাক্ত হয়ে যাওয়া কবি নতুন উপকরণ নিয়ে নতুন আশা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন আরোধ্যকে জয় করতে কিন্তু গভীর দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছেন-
‘কতোবার বর্তমান হ’য়ে গেছে ব্যথিত অতীত’
কিন্তু এতসব কিছুর পরেও জীবনানন্দ দাশ এবং কাজী নজরুল ইসলাম উভয় কবিই বিশ্বাস করতেন যেহেতু তাদের প্রেম অসামান্য সেহেতু প্রার্থিত নারী তাদের বিচ্ছেদজনিত বেদনায় বুঝতে পারবে সত্যিকারের হৃদয়কে। নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘বুঝবে যেদিন বুঝবে।’ আর জীবনানন্দ বুঝেছেন হেমন্তের ঝরা পাতার মত হয়তো তার প্রেমিকা তার বুকের ওপর লুটিয়ে পড়বে নিজের ভুল বুঝতে পেরে। যদিও একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন এখানে সন্দেহ এবং বিশ্বাস উভয়কেই প্রাধান্য দিয়েছে। তবে কবি ‘নির্জন স্বাক্ষরের’ উপসংহার হিসেবে কবিতার শেষ লাইনটিকে যুক্ত করেছেন, যা কিছু ঘটুক না কেন, ‘আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।’ যিনি ভালোবাসতে পারেন তিনি এভাবেই রাধার মত ভাবসম্মিলনে এসে পৌঁছান, ‘জনমে জনমে যুগে যুগে প্রাণনাথ হইয়ো তুমি।’
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক