খাদ্য, কৃষি উৎপাদন ও পরিসংখ্যান নিয়ে কিছু কথা

ফরিদা আখতার

প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২১, ০১:৪৭ পিএম | আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২১, ০১:৪৭ পিএম

ফরিদা আখতার

ফরিদা আখতার

‘বাংলাদেশের ৫০ বছর : কৃষির রূপান্তর ও অর্জন’ শীর্ষক একটি সম্মেলনে উপস্থিত মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীরা খাদ্য ও কৃষি উৎপাদন নিয়ে বেশ কিছু মন্তব্য করেছেন। তবে প্রধান অতিথি কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্যই বিশেষভাবে খবরের শিরোনাম হয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, কারণ তিনি যা বলেছেন, তা জনগণের ওপর নিষ্ঠুর মন্তব্য বলে সবাই মনে করছেন।

তিনি বলেছেন ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনপ্রতি প্রায় ২০০ গ্রাম চাল খেয়ে থাকেন; কিন্তু আমাদের দেশে চাল খাওয়ার পরিমাণ প্রায় ৪০০ গ্রাম। এটা কমিয়ে আনতে পারলে আমাদের যে চালের উৎপাদন, সেটাকে টেকসই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।’

পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে ‘আমরা দ্বিগুণ ভাত খাই, এটা কমাতে পারলেই সমাধান : কৃষিমন্ত্রী’। এই মন্তব্য সরাসরি মানুষকে ‘খাওয়ার খোটা দেওয়ার মতো’।

এদেশের মানুষ ভাত খায়, এটা নতুন কিছু নয়। তিনি যা পরিসংখ্যান দিয়েছেন তাও ভুল নয়; কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের জন্য ভাতের পাশাপাশি অন্য খাবার যথেষ্ট থাকে। সেটাই তাদের খাদ্যের ধরন; কিন্তু আমাদের দেশে যারা ভাত বেশি খায় বলে তিনি মনে করছেন, তাদের আসলে অন্যান্য খাবার কেনার সুযোগ নেই। তারা মাছ, মাংস খাওয়ার কথাও ভাবতে পারেন না। ভাত দিয়ে সামান্য সবজি, ডাল খেতে পারলেই বর্তে যান। দেশের মানুষ ভাত কম খেলে দেশের খাদ্যের সমাধান হবে, এমন বক্তব্য নিয়ে বিভ্রান্তি হবে, এতে অবাক হবার কিছু নেই। হয়েছেও তাই। অন্য দেশের পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতার মিল নেই। 

কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক একজন কৃষি বিজ্ঞানী, পুষ্টি বিজ্ঞানী নন। কৃষি ফসল ফলানোর ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পরামর্শ দিতে পারেন এবং কৃষিমন্ত্রী হিসেবে কৃষকদের স্বার্থে কাজ করবেন- এটাই আমাদের প্রত্যাশা; কিন্তু তাঁর দেওয়া খাদ্য উৎপাদনের পরিসংখ্যান ও সমাধান নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি হচ্ছে।

বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রাক্কালে ১৫ অক্টোবর, ২০২১ এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন ‘করোনা মহামারি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। বোরো ধানের উৎপাদন ২ কোটি টন ছাড়িয়ে গেছে। তাছাড়া সবজি, গম, ভুট্টা, আলু, পেঁয়াজ উৎপাদনও অনেক বেড়েছে’। এই খবর ইউএনবি প্রকাশ করেছে ১৫ অক্টোবর। তাহলে ভাত বেশি খাচ্ছে বলে এত আক্ষেপ কেন? চাল তো যথেষ্ট আছে; কিন্তু পরদিন বিশ্ব খাদ্য দিবস পালনের অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী এটাও বলেছেন- ‘দেশে পুষ্টিকর খাবারের অভাব নেই; কিন্তু সমস্যা হলো বেশিরভাগ মানুষ তা কিনতে পারে না। কারণ মানুষের আয় সীমিত।’ 

আমরা এতদিন শুনে আসছি দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে গেছে। তাহলে এখন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ভাত খাওয়া কমানোকে একটি উপায় হিসেবে বেছে নিচ্ছেন কেন? তাহলে কি পরিসংখ্যান মিথ্যা? হ্যাঁ, কৃষি পরিসংখ্যানের যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রশ্ন তুলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সম্মেলনে তিনি বলেছেন ‘আমাদের পরিসংখ্যানে ঝামেলা আছে। গত বছর বলা হলো, দেশে ১ কোটি ৬ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছিল। আমাদের চাহিদার কথা বলা হয়, ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন। এ হিসাবে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টন আলু বাড়তি থাকার কথা। সে সময়ে রফতানি বন্ধ ছিল। তারপরও আমাদের ঝামেলা হয়েছিল। তখন আমরা বুঝতে পারিনি প্রকৃতপক্ষে আমাদের উৎপাদন কম হয়েছে না চাহিদা বেশি ছিল। এ হিসাবটা আমাদের সঠিকভাবে আসেনি।’ খবরটি প্রথম আলোর, ২৪ অক্টোবর ২০২১।

পরিসংখ্যান যাই থাকুক ইতিমধ্যে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২১-এর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা গেছে বাংলাদেশ এই সূচকে এক ধাপ এগিয়েছে। ২০২০-২১ সালে ক্ষুধার মাত্রা বিবেচনায় বাংলাদেশ ‘মারাত্মক’ থেকে ‘সহনীয়’ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে; ১১৬টি দেশের মধ্যে ৭৬তম হয়েছে। তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশ থেকে ক্ষুধা চলে গেছে; সুচকের হিসাবে ‘সহনীয়’ হয়েছে মাত্র। তবুও পত্র-পত্রিকায় অনেক বাহবা সুচক শিরোনাম দেখেছি, বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ সুচকে এগিয়ে ছিল বলেই এত বাহবা দেওয়া হচ্ছিল, যেন বা ক্রিকেট খেলা। 

তবে বিশ্ব খাদ্য দিবসের অনুষ্ঠানেও কৃষিমন্ত্রী যা বলেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি বলছেন ‘দেশে পুষ্টিকর খাবারের অভাব নেই; কিন্তু সমস্যা হলো বেশিরভাগ মানুষ তা কিনতে পারে না। কারণ মানুষের আয় সীমিত’। তাহলে কৃষিমন্ত্রী জানেন মানুষের অভাব আছে, তাই ক্ষুধা নিবারণের জন্য ভাতের ওপরই নির্ভর করতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পরিমাণ ও পুষ্টিগুণ বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত ‘স্বাস্থ্যকর’ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পায় না দেশের ৪৩ শতাংশ মানুষ। অর্থাৎ শক্তিবর্ধক, পুষ্টিকর ও ভিটামিনসমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারছে না তারা। বাজারে থাকা পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্যগুলো দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালে নেই। 

দেখা যাচ্ছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নানা কারণে কমে যাচ্ছে, তাই ক্ষুধার সূচক সহনীয় হলেও পুষ্টির দিক থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে। মানুষ এখন পেট ভরার চিন্তা করে, পুষ্টির চিন্তা করতে পারছে না ৪৩ শতাংশ মানুষ, তাদের নাগালেই নেই। পুষ্টিজ্ঞান ক্ষুধার পেটে মাথায় ঢুকবে না। আর ভাতের পরিবর্তে আলু খেলে তো একই কথা হলো। অন্য পুষ্টিকর খাদ্য তাদের ভাগ্যে নেই।  

দুঃখজনক হচ্ছে কৃষিমন্ত্রী মানুষের আয় বাড়াতে চাচ্ছেন কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন সভায় তিনি কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রস্তাব দিয়েছেন এবং সে কাজ শুরু হয়ে গেছে। ফলে লাখ লাখ কৃষি শ্রমিক কাজ হারাচ্ছে। পাশাপাশি কীটনাশক ও সারের ব্যবহারও বাড়ছে। এতে ফসলের পুষ্টিগুণ নষ্ট হচ্ছে, রোগ বালাই ইতিমধ্যে যা বেড়েছে তার সঙ্গে আরও যুক্ত হচ্ছে। যান্ত্রিকীকরণ কৃষিতে ফসিল ফুয়েলের ব্যবহারের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এই কি আমরা চাইছি?

কৃষিমন্ত্রীর কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমের কথায়। সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কৃষিতে বৈচিত্রায়ণ হয়েছে, বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে। আমরা অনেক দূর এগিয়েছি; কিন্তু এ কথা ঠিক এখনো আমরা আমাদের সমমানের দেশগুলো যেমন ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ বেশ কিছু দেশের তুলনায় একরপ্রতি খাদ্য উৎপাদনে অনেক পিছিয়ে আছি। আমরা যখন হেক্টরপ্রতি ২ দশমিক ৪৪ টন চাল উৎপাদন করছি, সেখানে একই পরিমাণ জমিতে ভিয়েতনাম ৫ দশমিক ৯ টন চাল উৎপাদন করছে। অর্থাৎ আমরা প্রযুক্তিগতভাবে অনেক পিছিয়ে আছি। যেটা পেঁয়াজ-রসুনের আকার দেখলেই বোঝা যায়।’ পেঁয়াজ-রসুনের সাইজ ছোটবড় হওয়া প্রযুক্তির বিষয় পুরোটা নয়, এটা পেঁয়াজ-রসুনের ভিন্ন জাতের প্রশ্ন। ছোট সাইজের পেঁয়াজ-রসুনের স্বাদ অনেক ভালো এবং বাংলাদেশের এই পেঁয়াজ-রসুনের চাহিদা অনেক বেশি। এগুলো উৎপাদনে সার-কীটনাশকের ব্যবহার খুব কম। এই কথা ঢাকার কাওরান বাজারের পাইকারি বিক্রেতারাও স্বীকার করেন।

তারা বলেন, আমদানি করা বড় সাইজের পেঁয়াজ হোটেল বা বাণিজ্যিক খাদ্য ব্যবসায়ীরা কেনেন তাদের সুবিধার জন্য; কিন্তু এই পেঁয়াজ বেশিদিন রাখা যায় না। সাইজে বড় হলেই তা ভালো হবে, এমন কোনো কথা নেই। আমাদের দেশে মধুপুরের আনারস সাইজে বড় করতে গিয়ে হরমোন ও কীটনাশক দিয়ে বিষাক্ত করে ফেলা হয়েছে। বাণিজ্যিক চাষের মাধ্যমে শাক-সবজিও বিষাক্ত হয়ে গেছে। অতিরিক্ত কীটনাশক ও সার প্রয়োগের কারণে নানা রোগ ব্যাধি বেড়ে গেছে। ঘরে ঘরে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ নানা অসংক্রামক রোগের কারণে মোট মৃত্যুপ্রায় ৬৭ শতাংশ। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের উৎপাদনের তুলনা করতে গেলে এসব বিষয় ভাবা উচিত। 

বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ং সম্পূর্ণ বলে দাবি করা হচ্ছে অনেক দিন থেকে; কিন্তু সেটা হচ্ছে ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা; কিন্তু ধান উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে সবজি, ডাল, তেল, মাছ, মাংস ইত্যাদি উৎপাদনে যথেষ্ট নজর দেওয়া হয়নি। ফলে জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য ঘাটতির শিকার, তার সঙ্গে রয়েছে নারী-পুরুষ, শহর-গ্রাম এবং বয়স ভেদে খাদ্য পাওয়ার অসমতা। 

বাংলাদেশের কোটি কোটি কৃষক খাদ্য উৎপাদন করে তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না। সে দিকে নীতি নির্ধারণী কোনো বক্তব্য শোনা যায় না। কৃষিমন্ত্রী কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য কথা বলবেন আমরা এটাই আশা করি। আমরা আশা করি, যে সঠিক পরিসংখ্যান দিয়ে দেশের মানুষের পুষ্টিকর খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা হবে। যান্ত্রিকীকরণের মোহে নয়, জলবায়ু পরিবর্তন সহনশীল ও টেকসই কৃষি ব্যবস্থা আমাদের দরকার। আমাদের সামনে রয়েছে ক্ষুধার জ্বালা, পুষ্টিহীনতার অসহনীয় চিত্র এবং কৃষকের বঞ্চিত হবার দৃশ্য। সেদিকে নজর দিন।


লেখক- নির্বাহী পরিচালক
উবিনীগ

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh