স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২১, ০২:৩০ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর লক্ষ্যে আগামী ৩১ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত স্কটল্যান্ডে কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, গত বছর করোনা মহামারির কারণে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। প্রাক-শিল্পযুগের তুলনায় বর্তমানে বিশ্ব ১ দশমিক ১ ডিগ্রি বেশি উষ্ণ।
২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর এটিই সবচেয়ে বড় জলবায়ু সম্মেলন। বিশ্বজুড়ে কার্বন নিঃসরণের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ আলোচনাকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। তবে এ নিয়ে আশাবাদী নন অনেক বিশেষজ্ঞ ও অ্যাক্টিভিস্ট। কার্যত ধনী দেশগুলোর কারণে হুমকিতে পড়েছে জলবায়ু ও জনস্বাস্থ্য।
সম্প্রতি ১৬টি গবেষণা সংস্থা ও পরিবেশগত গোষ্ঠীর তথ্যের ভিত্তিতে ‘দ্য ক্লাইমেট ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্ট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ধনী ও উন্নত দেশগুলোর জোট জি-২০-এর সদস্যদের মধ্যে এ বছর কার্বনডাই-অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন ৪ শতাংশ বাড়বে। গত বছর করোনা মহামারির কারণে এই হার ৬ শতাংশ কমেছিল। ওই প্রতিবেদনে জি-২০ দেশগুলোতে কয়লার ব্যবহার এ বছর ৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। চীন, ভারত ও আর্জেন্টিনা তাদের ২০১৯ সালের কার্বন নির্গমন মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে। এ ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য দায়ী থাকবে চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতেও কয়লার ব্যবহার বাড়ছে। বেড়েছে কয়লার দামও। গত বছরের তুলনায় যা ২০০ শতাংশ বেড়েছে। ক্লাইমেট ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জি-২০ দেশগুলোতে গ্যাসের ব্যবহার ১২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
করোনাকালের ধাক্কা সামলে উঠতে সবুজ অর্থনীতির (গ্রিন ইকোনমি) দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিশ্বনেতারা; কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে তার উল্টো। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যে ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ৩০০ বিলিয়ন ডলার সবুজ প্রকল্পের জন্য রাখা হয়েছে।
এ দিকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বের করতে জাতিসংঘের একদল বিজ্ঞানী একটি প্রতিবেদন তৈরি করছেন। সরকার, কোম্পানি এবং অন্য আগ্রহী অংশীদাররা এসব নথি জাতিসংঘের একটি বৈজ্ঞানিক প্যানেলের কাছে উপস্থাপন করেছে। জাতিসংঘ গঠিত ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) প্রতি ছয় থেকে সাত বছরে একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদন ব্যবহার করেই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার নীতি নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার।
ওই প্রতিবেদনটি পরিবর্তনে তদবির করছে ধনী দেশগুলো। ওই তদবিরের ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা গেছে, সৌদি আরব, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো বিভিন্ন দেশ জাতিসংঘকে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে দ্রুত সরে যেতে লবি নিয়োগ করেছে। বেশ কয়েকটি দেশ এবং সংস্থা যুক্তি দিচ্ছে, ওই গবেষণা প্রতিবেদনের বর্তমান খসড়ায় যত দ্রুত কার্বন নিঃসরণ কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে, তত দ্রুত বিশ্বের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর প্রয়োজন নেই।
এবারের জলবায়ু সম্মেলনের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করা। ফাঁস হওয়া নথি থেকে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়া সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা প্রয়োজন- এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভারতের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব মাইনিং অ্যান্ড ফুয়েল রিসার্চের একজন জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, কয়লা কয়েক দশক ধরে জ্বালানি উৎপাদনের প্রধান ভিত্তি হিসেবে থাকতে পারে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা আমদানিকারক দেশ ভারত।
খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমা খাদ্যের তুলনায় উদ্ভিদভিত্তিক খাদ্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকে ৫০ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে। ব্রাজিল বলছে, এটা ভুল। ব্রাজিলের সঙ্গে আর্জেন্টিনাও ‘উদ্ভিদভিত্তিক খাদ্য’ বাক্যটিতে পরিবর্তন আনতে বলেছে। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা বিশ্বে গরুর মাংসের পণ্য এবং পশুখাদ্য ফসলের সবচেয়ে বড় উৎপাদক। উন্নয়নশীল দেশগুলোর কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য ধনী দেশগুলোর সহায়তার বিষয়টিতে আপত্তি তুলেছে সুইজারল্যান্ড।
হুমকিতে জনস্বাস্থ্য : জনস্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বছরমেয়াদি একটি গবেষণা চালিয়েছে ‘ল্যানসেট কাউন্টডাউন’। সেখানে দেখা যায়, ২০২০ সালে বিশ্বের ১৯ শতাংশ এলাকা তীব্র খরার সম্মুখীন হয়েছে। বিশ্বের ২০০ কোটির বেশি মানুষ ক্ষতির মুখে পড়েছে। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বিশ্বের ১৩৪টি দেশের বাসিন্দারা দাবানলের হুমকিতে রয়েছে। বিরূপ আবহাওয়া যেমন আর্থিক ক্ষতি করছে, তেমনি নানা সংক্রামক রোগ বিস্তারের ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। গত কয়েক দশকের তুলনায় ডেঙ্গু, জিকা ভাইরাস, কলেরা ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগ ব্যাপকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে বাদ পড়ছে না ইউরোপের উন্নত দেশগুলোও।
ল্যানসেট কাউন্টডাউনের নির্বাহী পরিচালক অ্যান্থনি কস্তেলো বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি এখন দৃশ্যমান। আমরা এরই মধ্যে দেখতে পাচ্ছি, এটা বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। করোনা সংকটের পাশাপাশি প্রতিটি দেশকে জলবায়ু সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।’
তিনি আরও জানান, ১৫ বছর আগের তুলনায় সাম্প্রতিককালে সাগরের প্রায় ৭০ শতাংশ অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে ৩৩০ কোটি মানুষ। এসব মানুষ সাগর থেকে আহরণ করা খাদ্যের ওপর কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল।
এ বিষয়ে গবেষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মারিয়া রোমানেলো বলেন, ‘চলতি বছরে তীব্র দাবদাহ, ভয়াবহ বন্যা ও দাবানলের শিকার হয়েছে মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ব্যবস্থা নিতে যত দেরি হবে, পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে।’
এ দিকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কিডনি রোগ সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ক্ষেত্রেও কিডনি রোগ দেখা যায়। তবে এল সালভাদর বা নিকারাগুয়ার অধিক উষ্ণ অঞ্চলে ইতিমধ্যে ক্রনিক কিডনি ডিজিজ অব আনসার্টেইন কজ (সিকেডিইউ) মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। সেখানে অনেক কৃষকের কিডনি বিকল হয়ে মৃত্যুর হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। উত্তর ও মধ্য আরেমিকার কিছু অঞ্চলে উচ্চ তাপমাত্রায় ভারী কাজ করেন, এমন শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও সিকেডিইউ রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার রেকর্ড আকারে বাড়তে শুরু করেছে। এ ছাড়া দক্ষিণ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ভারতেও এ রোগের হার বাড়ছে।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু ও স্বাস্থ্যশিক্ষার বৈশ্বিক কনসোর্টিয়ামের পরিচালক সিসিলিয়া সোরেনসেন বলেন, ‘কিডনিতে এ ধরনের রোগে সাধারণত কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। অনেক শ্রমিক শেষ ধাপে যাওয়ার আগপর্যন্ত অসুস্থ হওয়ার বিষয়টি বুঝতেও পারেন না।’
তিনি আরও জানান, এ ছাড়া এ সময়ে শ্বাসকষ্ট ও ক্যান্সারের মাত্রাও ভয়ংকরভাবে বেড়ে গেছে, যার পেছনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।
সম্মেলনে নেই আশাবাদ : গ্লাসগোতে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৬) ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছেন না সুইডেনের পরিবেশবাদী অ্যাক্টিভিস্ট গ্রেটা থুনবার্গ। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে না এ সম্মেলনে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে। অনবরত আমাদেরকে চাপ দিয়ে যেতে হবে। আমার আশা, অবশ্যই এক দিন বুঝতে পারব যে আমরা অস্তিত্ব সংকটের মুখে আছি এবং এরপর ব্যবস্থা নিব।’
থুনবার্গ মনে করেন, সত্যিকার অর্থে গ্রহকে বাঁচাতে চাইলে নিয়ম মানার ক্ষেত্রে ফাঁক-ফোকর সৃষ্টির প্রবণতা থেকে সরে এসে মূল জায়গায় মনোনিবেশ করতে হবে।
জাতিসংঘের জলবায়ু প্রধান প্যাট্রিকা এসপিনোসা বলেছেন, প্যারিস চুক্তি পূরণের অঙ্গীকার ‘সহজ’ নয়। তবে সংকট নিরসনে এই চুক্তি বাস্তবায়ন করা ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’। ছয় বছর আগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তারা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। অঙ্গীকারে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নিচে রাখার কথা ছিল। তার বিপরীতে বর্তমানে উষ্ণতা ৩০ লাখ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ হারে বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সদিচ্ছা, অর্থায়ন, প্রশমন, অভিযোজন ও সহনশীলতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করতে হবে। ২০০৯ সালে প্রতিশ্রুত বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি গ্লাসগোতে আলোচনা করা হবে।
জাতিসংঘের মতে, প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি অবশ্যই ১.৫ সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে হবে এবং কার্বন নিঃসরণের মাত্রা অবশ্যই বছরে ৭ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমে গেলেও চলতি বছর আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আরও বেশি মাত্রায় কার্বন নিঃসরণ করছে দেশগুলো। কাজেই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ মাত্রার মধ্যে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।