বাজার নিয়ন্ত্রণে সুষ্ঠু কোনো ব্যবস্থাপনা কি দেশে আছে?

হাসান হামিদ

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২১, ০১:৫১ পিএম

হাসান হামিদ

হাসান হামিদ

কয়েক দিন আগে বাজার করতে গিয়ে দেখি সব জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণের সুষ্ঠু কোনো ব্যবস্থাপনা আমাদের দেশে নেই। তাই অকারণেই হঠাৎ করে বেড়ে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। আবার একবার কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে সহজে কমে না। ফলে কারণ ছাড়াই কিংবা কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর অধিক মুনাফা লাভের কৌশলে সাধারণ মানুষের জীবন দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।

করোনার সময় অনেকের আয় কমে গিয়েছিল, কারও কারও রোজগার বন্ধ হয়েছিল। এখন অবস্থা স্বাভাবিকের দিকে গেলেও পুরোপুরি স্বস্তি আসেনি। সাধারণ মানুষ যেখানে হিমশিম খাচ্ছে খরচ চালাতে, সেখানে বাজারের এই অস্থিরতা ভোগান্তি আরও বাড়িয়েছে। করোনাকালে বিধিনিষেধের ফলে একদিকে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, দিনমজুর ও গরিব মানুষের বড় একটি অংশ কাজ হারিয়েছে। অন্যদিকে চাল, ভোজ্যতেল, গ্যাসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে; যা এখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দামে জনজীবন বলা চলে অতিষ্ঠ। অথচ বাজারের এই অস্থিরতা দেখার যেন কেউ নেই!

মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত প্রয়োজন হয় বিভিন্ন প্রকার দ্রব্যের। সেই সব দ্রব্য সমাজ অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে ক্রয় করতে হয়। যে মূল্যের বিনিময়ে দ্রব্য ক্রয় করে, তা মানুষকে আপন যোগ্যতায় অর্জন করতে হয়। মোটামুটি সব যুগেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান। সমাজে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ভুঁইফোড় কোনো নতুন সমস্যা নয়। ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে আমরা দেখতে পাব, মোটামুটি সব যুগেই বিভিন্ন কারণে দ্রব্যের দাম ওঠা-নামা করেছে এবং এমত পরিস্থিতি সামলানোর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসন গ্রহণ করেছে উপযোগী ব্যবস্থা।

যতদূর জানা যায়, বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকারের। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনও আছে; কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা হয়ে পড়ছেন নিয়ন্ত্রণহীন। এমন পরিস্থিতিতে ট্রেডিং করপোরেশন বা টিসিবির মাধ্যমে পণ্য আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। না হলে অচিরেই এসব অসাধু ব্যবসায়ীর হাতে মানুষ জিম্মি হয়ে পড়বে। বর্তমান অবস্থায় মনে হচ্ছে, সরকারসংশ্লিষ্ট মহলগুলো জিনিসপত্রের দাম পর্যবেক্ষণ করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা এ ব্যাপারে কাজ করলেও তা তেমন কার্যকর ভূমিকা না রাখায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না। কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নামে একটি সংস্থা রয়েছে; কিন্তু তাদের কার্যক্রমও তেমন লক্ষণীয় নয়।

সমাজে মানুষ দৈনন্দিন জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে। মনে রাখা দরকার যে মানুষের আয়ের উৎস তথা উপার্জনের মাত্রা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সবসময় বাড়ে না এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সীমিত থাকে। সে কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য লাগামহীনভাবে বাড়লে সেগুলো অচিরেই সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। ফলে কয়েক দিনের মধ্যেই সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সার্বিক মানে বিশেষ অবনতি দেখা যেতে পারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাবে মানুষের জীবনে নেমে আসতে পারে অনাহার, অপুষ্টি, ইত্যাদি নানা প্রকার জটিল ব্যাধির প্রকোপ। ফলে সার্বিকভাবে এর প্রভাব পড়ে কোনো একটি দেশের জাতীয় ভাবমূর্তিতে। সুতরাং এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, লাগামছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় জীবনকেও সমানভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

আমাদের দেশে অতি মুনাফা লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই গড়ে তুলেন মজুদ। আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের, বিশেষত আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে না উঠলেও স্থানীয় বাজারে এ পরিবর্তনকে আগাম সতর্ক সংকেত হিসেবেই দেখতে হয়। কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠলে খুচরা ব্যবসায়ীদের পাইকারি ব্যবসায়ীরা দায়ী করেন। আবার খুচরা ব্যবসায়ীরা দায়ী করেন পাইকারি ব্যবসায়ীদের। অনেকে আবার আমদানিকারকদেরও অভিযুক্ত করেন। এভাবে নানা অজুহাতে দাম বাড়ার কাজ চলে। তাছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয়ে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার কাজটি করতে হয়। এ কারণে অধিকাংশ সময় সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে ওয়ান স্টপ সেবা চালু করার চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে।

বিশ্বজুড়ে লাগামহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশের জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ভারতবর্ষে মধ্যযুগে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী দ্বারা গৃহীত বাজার নিয়ন্ত্রণ উদ্যোগ ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে। এ ছাড়া প্রতিটি দেশের সরকারই নিজের দেশে দ্রব্যের দাম যাতে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে না চলে যায় তার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ তথা আইন প্রণয়ণ করে থাকে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও কালোবাজারি বন্ধ করার উদ্দেশ্যে দেশীয়, মহাদেশীয় এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তৈরি হয়েছে। এইসব সংস্থাগুলো কালোবাজারিকে প্রতিহত করে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তাছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন দেশের সচেতন ক্রেতা এবং ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তরের যৌথ উদ্যোগেও দ্রব্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে।

করোনাকালে যেমন জনগণের বৃহৎ অংশ কর্মহীন হয়েছে, তেমনি দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন জাঁতাকলে পড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে লুটেরা ধনিক শ্রেণির বল্গাহীন মুনাফা শ্রেণিবৈষম্যকে তীব্রতর করেছে। এ অবস্থাকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও স্বার্থবাদী মহল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে এবং সরকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এর পরিপূর্ণ সুযোগ নিয়ে আঁধারের শক্তিগুলো বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত হবে। দেশ যাতে অস্থিতিশীল না হয়, সে জন্য চাল, তেল, গ্যাসসহ নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারের দায়িত্ব।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে কোথাও যাতে ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজির শিকার না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি তেল-ডাল-চিনি, যা মূলত বিদেশ থেকে আমদানিনির্ভর পণ্যের বাজারে যাতে মুনাফালোভী সিন্ডিকেট কালো হাত বাড়াতে না পারে সে দিকে সতর্ক থাকতে হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের হাতে অনেক উপাদান তথা টুলস আছে, যেগুলোর অধিকাংশই প্রয়োগ করা হয় না অথবা দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর মধ্যে অন্যতম। সরকারের এসব অস্ত্র পুরনো হয়ে গেছে। এর বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে।

পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এক্ষেত্রে কী ধরনের নীতি অবলম্বন করছে, তাও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য সাধারণে মানুষের নাগালের বাইরে গেলে তা সরকারের ওপর মানুষের অসন্তুষ্টি তৈরি করে এটা খুব জানা কথা। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে সাধ্য অনুযায়ী সব উদ্যোগ নিতে হবে। বর্তমানে সবজি-পেঁয়াজ-কাঁচামরিচসহ নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যে সীমিত আয়ের মানুষ দিশাহারা। এ অবস্থা যাতে দীর্ঘায়িত না হয়, সেদিকে সরকারের সংশ্লিষ্টরা একটু বিশেষ নজর দেবেন কি?


হাসান হামিদ
লেখক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh