একসঙ্গে বেশ ভালোই আছি জাহিদ-মৌ

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২১, ০৪:০৬ পিএম

জাহিদ হাসান ও সাদিয়া ইসলাম মৌ

জাহিদ হাসান ও সাদিয়া ইসলাম মৌ

ছোট ও বড় পর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা জাহিদ হাসান এবং স্বনাম ধন্য মডেল, নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রী সাদিয়া ইসলাম মৌ দুই বছর একে অপরকে ভালোবেসে ১৯৯৪ সালে বিয়ে করেন। এই দম্পতির রয়েছে এক ছেলে পূর্ণ ও এক মেয়ে পুষ্পিতা। সুখী এই দম্পতি তাদের ক্যারিয়ার এবং ব্যক্তিগত নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন দেশকাল পত্রিকার মাহমুদ সালেহীন খানের সঙ্গে।

পারস্পরিক সম্মানবোধ থাকতে হবে দাম্পত্যজীবনে : জাহিদ হাসান 

জাহিদ হাসান। দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে মঞ্চ, ছোট ও বড় পর্দার অভিনয়শিল্পী। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। ১৯৬৭ সালে সিরাজগঞ্জ শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘ অভিনয় ক্যারিয়ারে অসংখ্য জনপ্রিয় কাজ উপহার দিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে মতি চরিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে অর্জন করেছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। 

অভিনয় জীবনের শুরু থেকেই ভিন্নধর্মী নাটক ও চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন জাহিদ হাসান। সেই নব্বই দশকেই হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত একটি টেলিফিল্মে মফিজ নামের পাগলের চরিত্রে অভিনয় করে বাজিমাত করেছিলেন। পরে একের পর এক হুমায়ূন আহমেদের টেলিফিল্ম নক্ষত্রের রাত, মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন, সমুদ্রবিলাস প্রাইভেট লিমিটেড, আজ রবিবার-এ অভিনয় তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে আসে। এখনো সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে অসংখ্য নাটক, টেলিফিল্মে অভিনয় করে চলেছেন। তার অভিনীত বিখ্যাত আরেকটি চরিত্রের নাম ‘আরমান ভাই’।

তবে শুধু নাটক-টেলিফিল্মেই নয়, চলচ্চিত্রেও সফল জাহিদ হাসান। ১৯৮৬ সালে আব্দুল লতিফ বাচ্চু পরিচালিত ‘বলবান’ সিনেমা দিয়ে তার অভিষেক ঘটে। এরপর কাজ করে প্রশংসা পেয়েছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর মেড ইন বাংলাদেশ, মোস্তফা কামাল রাজের প্রজাপতি, হুমায়ূন আহমেদের আমার আছে জল, শ্রাবণ মেঘের দিন, তৌকীর আহমেদের হালদা, গোলাম সোহরাব দোদুলের সাপলুডু ছবিতে।

কলকাতায় আশীষ রায়ের ‘সেঁতারা’ নামে একটি সিনেমায় রাইমা সেনের বিপরীতে কাজ করে ওপার বাংলার দর্শকের কাছেও প্রশংসিত হয়েছেন জাহিদ হাসান। শাহীন সুমন পরিচালিত ‘মাফিয়া’ নামের একটি ওয়েব সিরিজেও অভিনয় করেছেন তিনি। শুধু অভিনেতা নয়, জাহিদ হাসান খ্যাতি পেয়েছেন নির্মাতা হিসেবেও। অনেক ধারাবাহিক নাটক ও দর্শকনন্দিত খণ্ড নাটক বানিয়েছেন তিনি। পারিবারিক জীবনও বর্ণিল তার। মডেল অভিনেত্রী মৌ-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ জাহিদ হাসানের রয়েছে দুই সন্তান। 

দেশকাল পত্রিকার সঙ্গে আলাপকালে জাহিদ হাসান বলেছেন, একটি সাধারণ পরিবারের স্বপ্নবাজ এক তরুণের উজ্জ্বল তারকা হিসেবে উঠে আসার অসাধারণ এক গল্প। ডাক নাম পুলক। মা রেখেছিলেন পুলক নামটি। সিরাজগঞ্জের ছেলেবেলার বন্ধুরা এখনো পুলক নামেই ডাকেন তাকে। কাছের মানুষরাও কেউ কেউ পুলক নামে ডাকেন আজও। জাহিদ নামটি রেখেছিলেন তার দাদা। পুলক থেকে সবার ভালোবাসায় আজকের জাহিদ হাসান হয়েছেন। অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ছেলেবেলায় সিরাজগঞ্জে থাকতে প্রচুর নাটক দেখেছি। শীতের সময় যাত্রাপালা দেখার কথাও মনে পড়ে। সিরাজগঞ্জ শহরে মঞ্চ নাটকের দল ছিল। সেখানে নাটক দেখার কথাও মনে পড়ে। ওখানে টিকিট কেটে মঞ্চ নাটক দেখার প্রচলন ছিল। আমিও টিকিট কেটে মঞ্চ নাটক দেখতাম। যাত্রাপালা বেশি দেখা হতো না, মাঝে মাঝে যেতাম। তিনি আরও বললেন, একবার শুনলাম, সিরাজগঞ্জ শহরে ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’ যাত্রাপালা হবে। ঢাকা থেকে দল আসবে। আনোয়ার হোসেন নবাবের চরিত্রে অভিনয় করবেন। ওই যাত্রাপালা দেখার জন্য সে কী আগ্রহ আমার! টিকিটের দাম পাঁচশ, একশ, পঞ্চাশ ও বিশ টাকা। বড় বড় শিল্পীরা যাবেন বলেই টিকিটের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আব্বাকে বললাম, যাত্রা দেখব। বিশ টাকা দিয়ে আব্বা বলেছিলেন, ‘যাও’। আনোয়ার হোসেনকে দেখে এসো। মঞ্চের খুব কাছে মাটিতে বসে সেই রাতে ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’ যাত্রাপালা দেখেছিলাম। ওই প্রথম আনোয়ার হোসেনকে কাছ থেকে দেখা! কী যে উত্তেজনা কাজ করেছিল! স্কুল পাস করে সিরাজগঞ্জ শহরেই কলেজে ভর্তি হন। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নাটকের দিকে ঝুঁকে যান জাহিদ হাসান। ততদিনে অভিনয়ের নেশাটা পেয়ে বসেছিল তার। যেখানেই নাটক বা যাত্রাপালা হতো, দেখতে যেতেন। নাটকে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হবার প্রসঙ্গে তিনি জানালেন, কলেজে পড়ার সময়ে তরুণ সম্প্রদায় নাট্যদলে যোগ দেই। সেই দলের হয়ে কয়েকটি নাটকে অভিনয় করি। ‘সাত পুরুষের ঋণ’ নাটকটির কথা বলতেই হয়। নাটকটি ১৯৮৪ সালের ১০ আগস্ট বিটিভিতে সরাসরি প্রচারিত হয়েছিল। সেই সময়ে আমার জন্য বিষয়টি অনেক বড় ছিল। ইন্টারমিডিয়েট পাস করে আমার বেশিরভাগ বন্ধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। আমিতো নাটক করতে চাই, ঢাকায় আসতে হবে। ঢাকায় না এলে নাটক করতে পারব না। আমার আশা পূরণ হবে না। বাড়ি থেকে অবশ্য কেউ তা চাচ্ছিল না। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলাম। ভর্তিও হয়েছিলাম; কিন্তু, মনটা পড়ে থাকল ঢাকা শহরে। কিছুদিন সেখানে পড়ার পর চলে আসি ঢাকায়। কারণ, অভিনেতা হতে হবে। পড়ালেখা শুরু করি এই শহরে। আর ভেতরে ভেতরে স্বপ্ন দেখি-অভিনয় করব।

১৯৮৬ সালে ‘বলবান’ নামের একটি সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ পান জাহিদ হাসান। এটি ছিল বাংলাদেশ-শ্রীলংকা ও পাকিস্তান প্রযোজিত একটি সিনেমা। ১৯৮৯ সালে আরও একটি বড় সুযোগ আসে। বিটিভিতে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য অডিশন দেন এবং পাসও করেন। নাটকে অভিনয়ের সুযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আসলে এখনকার মতো ওই সময়ে টিভি নাটকে অভিনয় করাটা অত সহজ ছিল না। খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। কাজেই অডিশনে পাস করার পরপরই নাটকে অভিনয় করতে পারিনি। তারপরও তালিকাভুক্ত হতে পেরেছি- সেসময় এটাই ছিল আমার জন্য বড় ব্যাপার। ১৯৯০ সাল আমার জীবনে বড় একটি টার্নিংয়ের বছর। ঢাকায় তখন মঞ্চকর্মীদের বেশ ভালো অবস্থা। চিন্তা করি, আমিও মঞ্চ নাটকে অভিনয় করব। সে বছর মঞ্চ নাটক শুরু করি। যোগ দেই ‘নাট্যকেন্দ্রে’। এ ছাড়া একই বছর প্রথমবার টিভি নাটকে অভিনয় করার সুযোগ এসে যায়।

জাহিদ হাসান এর প্রথম অভিনীত টিভি নাটকটির নাম ছিল ‘জীবন যেমন’। নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন আলীমুজ্জামান দুলু। ভাগ্যপ্রসন্ন ছিল বলে প্রথম টিভি নাটকেই গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র পেয়েছিলেন তিনি। প্রথম টিভি নাটকে অভিনয় করে সম্মানি পেয়েছিলেন ১ হাজার ২০০ টাকা।

সেসময়ে আড্ডা দেওয়ার স্মৃতি কখনোই ভুলতে পারবেন না। শত কষ্টের মধ্যে থেকেও ঠিকই আড্ডা দিতেন। কখনো টিএসসিতে, কখনো বেইলি রোডে, কখনো রামপুরা টেলিভিশনের কাছে আড্ডা দেওয়া হতো তার। যেখানেই থাকতেন, মন পড়ে থাকত রামপুরা টেলিভিশন সেন্টারে। ভাবতেন কবে সুযোগ পাবো। জানালেন, আব্বা-আম্মা চাইতেন আমি ডাক্তার হই; কিন্তু, আমি চাইতাম অভিনেতা হবো। এ জন্য অভিমান করে অনেক দিন বাড়ি থেকে টাকাও নিইনি। অভিমান করার কারণে এক সময় অনেক কষ্ট হয়েছে আমার। তারপরও ঢাকায় পড়ালেখা ও নাটক দুটিই করে গেছি।

নাট্যকেন্দ্র ‘বিচ্ছু’ নামের একটি মঞ্চ নাটক করেছিল। তারিক আনাম খান নির্দেশক ছিলেন। ওই নাটকে বিচ্ছু চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জাহিদ হাসান। সেসময়ে ঢাকায় মঞ্চ নাটকের দর্শকদের কাছে নাটকটি বেশ সাড়া ফেলেছিল। বিচ্ছু চরিত্রে অভিনয় করে সবার ভালোবাসাও পান তিনি। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জাহিদ হাসানকে। বিচ্ছু নাটকটির পর টিভি নাটকেও ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। তবে সে সময়ে বিটিভিতে খুব বেশি নাটক করার সুযোগ সবার ছিল না। ‘জীবন যেমন’ নাটকটি বিটিভিতে করার বেশ পরে ‘সমাপ্তি’ নামে একটি নাটকে অভিনয় করেন। ‘সমাপ্তি’র পর অভিনয় করা হয় ‘সখী ভালোবাসা কারে কয়’, ‘কাশবনের কন্যা’, ‘ছবি শুধু ছবি নয়’ নাটকগুলোতে। আরও পরে এসে অভিনয় করেন হুমায়ূন আহমেদের ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘আজ রবিবার’, ‘সবুজ ছায়া’, ‘সবুজ ছাতা’ ধারাবাহিকগুলোতে। এভাবেই বদলে যায় জাহিদের অভিনয় জীবনের গল্প।

জাহিদ হাসান অকপটে বলেন, আসলে লেগে থাকার বা সাধনার কোনো বিকল্প নেই। সততা ও ভালোবাসা নিয়ে লেগেছিলাম বলেই অভিনেতা হতে পেরেছি। সারাজীবন অভিনেতা পরিচয় নিয়েই বাঁচতে চাই।

তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ১৯৯৯ সালে হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ এর জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে পেয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এরপর ২০১৭ সালে তৌকীর আহমেদ পরিচালিত ‘হালদা’ চলচ্চিত্রে নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করে অর্জন করেছিলেন ‘খল অভিনেতা’ হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এক বছর বিরতির পর গোলাম সোহরাব দোদুলের ‘সাপলুডু’র জন্য ‘খল অভিনেতা ‘হিসেবে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার।

এ প্রসঙ্গে জাহিদ বলেন, একজন অভিনেতার জন্য যে কোনো পুরস্কারই বড় আনন্দের, আর সেটা যদি হয় রাষ্ট্রীয় পুরস্কার তাহলে তো কথাই নেই! যে কোনো কাজে এক ধরনের পরিশ্রম থাকে, সেই কাজে যখন সাফল্য আসে তখন পরিশ্রমটা আর পরিশ্রম মনে হয় না। তখন মনে হয় কবে আবার আরেকটা কাজ শুরু করব। উদ্যম পাওয়া যায়। প্রথমবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে, পরের দুইবার শ্রেষ্ঠ খলঅভিনেতা হিসেবে। এরকম ভার্সেটাইল অভিনেতা হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি আরও আনন্দের। 

একজন নামকরা জনপ্রিয় অভিনেতা, একই সময়ে অন্যজন দেশসেরা মডেল। তবুও জাহিদ-মৌ পরস্পর পরিচিত ছিলেন না। সেটা করিয়ে দেন হানিফ সংকেত। ইত্যাদির একটা মিউজিক ভিডিও করতে গিয়ে প্রথম পরিচয় দু’জনের। এরপর সেটা রূপ নেয় প্রণয়ে। তবে তাদের মিলন এত সহজে ঘটেনি। মৌয়ের পরিবার থেকেই বেশি অসম্মতি ছিল। অতঃপর দু’জনের একক সিদ্ধান্তে বিয়ে। পরে একসময় অবশ্য পরিবারও মেনে নেয়। অসম্মতির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে জাহিদ হাসান বলেন, মৌয়ের মা হচ্ছেন আমাদের দেশের প্রথম মডেল। আর মৌ তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। অন্যদিকে আমি মফস্বল থেকে আসা। ঢাকা শহরে তখন আমার কিছুই ছিল না। সবকিছু মিলিয়ে আর কি দ্বিমতটি হয়েছিল। মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা যেমনটি হন আর কী। তাদের দুই যুগের সংসারে আছে এক ছেলে ও মেয়ে। সেই দিনের সেই সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না, তা প্রমাণ করে তাদের এই সুখের সংসার।

জাহিদ চেয়েছিলেন সুন্দর মনের একজন মানুষ। যার সহমর্মিতা তাকে ভালোবাসতে শেখাবে প্রতিনিয়ত। আমরা সবাই সুন্দরের পূজারি; কিন্তু জাহিদ কখনো সুন্দর বা অসুন্দর নিয়ে ভাবেননি। তিনি শুধু ভেবেছেন, যাকে ভালোবাসব তার মনটাই যদি সুন্দর না হয় তাহলে তার সুন্দর চেহারা দিয়ে কী হবে? ভাবনার ঠিক ওই সময় জাহিদের স্বপ্নের সমাধান দেয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’। মৌয়ের সঙ্গে জাহিদের প্রথম পরিচয় হয় ‘ইত্যাদি’তে প্রচারিত আমার ‘গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে’ গানটির মিউজিক ভিডিও শুটিংয়ে। প্রথম দেখাতেই মৌয়ের মাঝে অন্যরকম কিছু খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। আর তাই তিনি প্রথম দেখাতেই মৌকে বলেছিলেন, ‘আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আপনাকে আমি বিয়ে করতে চাই।’ প্রথম পরিচয়ে এমন কথা শুনে মৌ এত বেশি আশ্চর্য হয়েছিলেন যে, মুহূর্তের মধ্যেই তিনি জাহিদের সামনে থেকে হাওয়া। জাহিদ তখন কীভাবে এই কথাগুলো বলতে পেরেছিলেন মৌকে, সেই কথা আজ তিনি যখন ভাবেন, নীরবে শুধুই হাসেন। চোখের অভিব্যক্তি যেন মনের কথা বলে দেয়, এটা জাহিদ বুঝেছিলেন মৌয়ের প্রতি তার ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ। 

তাদের দু’বছরের প্রেমময় জীবন শেষে জাহিদ নিজেকে আত্মসমর্পণ করেন মৌয়ের কাছে জীবনসঙ্গীরূপে। এরপর রঙিন স্বপ্নে মৌয়ের ভালোবাসায় কেটে গেছে বেশ কয়েকটি বছর। এতদিনে দু’জনই বুঝতে পেরেছেন ভালোবাসার মাঝেই লুকিয়ে থাকে জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া। সংসারজীবনে এসে উপলব্ধি করেছেন অদৃশ্যের মতো কেউ তাদের পাশে থেকে কাজের অনুপ্রেরণা দিচ্ছে। জাহিদ হাসান মৌয়ের স্বভাব নিয়ে বলেন, মৌ অনেক গুণী নারী। ও যখন যে কাজটি করে ভালো করে করার চেষ্টা করে। মৌ যেমন একজন আদর্শ স্ত্রী, তেমনি আদর্শ মা। আমাদের যখন বিয়ে হয় তখন মডেলিংয়ে মৌ হার্টথ্রব ছিলেন। তুমুল জনপ্রিয়তায় থাকা সত্ত্বেও বিয়ের পর মডেলিং জগৎ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। 

সংসার করেছেন মনোযোগ দিয়ে। দুই ছেলে মেয়ের প্রতি অনেক যত্নবান মৌ। নিজেকে একটু গুছিয়ে আবার শো বিজে মনোযোগী হয়েছেন। নাচ, মডেলিং, অভিনয় সবকিছুতেই মৌ চেষ্টা করেন তার সেরাটা দিতে। মিডিয়ার এত অস্থির সময়ে প্রায় তারকাদের বিয়ে বিচ্ছেদ এর কথা শুনতে শুনতে দর্শকরা বিরক্ত। আপনাদের এই দীর্ঘ দাম্পত্যজীবন ধরে রাখার মূল রহস্য কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে জাহিদ হাসান বলেন, রহস্যর কিছু নেই। আমাদের ব্যক্তি জীবনে কিংবা কর্মক্ষেত্র নিয়ে কারো মধ্যে কোনো ইগো নেই। আমি মৌকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি সারাজীবন একসঙ্গে থাকার জন্য। বিচ্ছেদের জন্য নয়। আর একটি বিষয় হলো পারস্পরিক সম্মানবোধটা থাকতে হবে দাম্পত্যজীবনে। তাহলে আর কোনো সমস্যা হবে না। 

নারীর জীবনে প্রথম পরিচ্ছন্ন ভালো লাগার জায়গা হওয়া উচিত তার সংসার : সাদিয়া ইসলাম মৌ 

‘রূপসীর রেশমী চুলে, দোলে গো কেয়া দোলে। চুলের ওই মেঘ কাজলে, দোলে গো কেয়া দোলে!’

নব্বইয়ের দশকে বিজ্ঞাপনী দুনিয়ায় তিনি এমন রূপেই আবির্ভূত হয়ে বিমোহিত করতেন দর্শকদের। তরুণদের স্বপ্নের রাণী কিংবা তরুণীদের আদর্শ বললে যে কয়েকজন মিডিয়া তারকার নাম উঠে আসে, তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে শীর্ষে থাকবেন এই সুপার মডেল। তিনি মডেলিং জগতের অঘোষিত সম্রাজ্ঞী সাদিয়া ইসলাম মৌ।

ত্রিশ বছর আগে একটি শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনচিত্রের মাধ্যমে সাদিয়া ইসলাম মৌ মডেলিং জগতে পা রেখেছিলেন। তখন তিনি ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়েন। এত বছর পরেও এখনো মৌ সমান জনপ্রিয়। পরবর্তী যুগে প্রায় সব মডেলের আদর্শ হয়ে আছেন তিনি। সে সময় বিজ্ঞাপনচিত্রের জন্য রেকর্ড ১ লাখ টাকা পারিশ্রমিকে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। শুধু মডেলিংয়ে নয়, মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়স থেকে নাচের মঞ্চেও অভিষেক হয়েছিল তার। সে সময় নাচ করতে না চাইলেও পরবর্তীতে নাচ-ই হয়ে যায় মৌয়ের ধ্যান-জ্ঞান। সময়ের পরিক্রমায় ১৯৯৫ সালের ৩ জুলাই ‘অভিমানে অনুভবে’ নাটকের মাধ্যমে অভিনয় অঙ্গনেও যাত্রা শুরু হয় তার। 

মা মডেলিং জগতের পথিকৃৎ, সেই সুবাদে মডেলিংয়ের সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই পরিচিতি। নব্বইয়ের শুরুতে এসে যুক্ত হন এই পেশায়। পুরো নব্বই দশক তিনি বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় রাজত্ব করেছেন। চলচ্চিত্র বা নাটকের বাইরেও যে জুটি হতে পারে, সেটা দেখিয়েছিলেন তিনি। মৌ কেয়ার বিজ্ঞাপনগুলোকে নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য পর্যায়ে, লাক্সেরও মডেল হয়েছেন। এ ছাড়া পাকিজা প্রিন্ট শাড়ি, আপন জুয়েলার্স, মৌচাক জুয়েলার্সসহ আরও অনেক বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন। টিভি পর্দার বাইরে বিশ্বরঙসহ আরও কিছু দেশীয় সংস্থার মডেল হয়েছেন। ক্যারিয়ারে সেরা জুটি নোবেলের সঙ্গেই সর্বশেষ রবির বিজ্ঞাপনে হাজির হন তিনি।

মডেলিং জগতের বাইরে তার যে অন্য পরিচয়ে পরিচিতি, তা হচ্ছে দেশসেরা নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে তিনি একজন। মাত্র তিন বছর বয়সেই পায়ে ঘুঙ্গুর বেঁধে নাচ শিখেছেন। শ্যামা, চিত্রাঙ্গদাসহ অনেক নৃত্যনাট্যে তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন, এখনো টিভি পর্দায় বিশেষ আমন্ত্রণে নৃত্যের ঝলকে মুগ্ধ করেন সবাইকে। 

নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়টাতে অভিনয়েও যুক্ত হয়েছিলেন। প্রথম নাটক অনুভবে অভিমানে। এরপর হঠাৎ বৃষ্টি, কুসুম কাঁটা, কে সে থেকে হাল আমলের ফুলগুলো ভুলগুলো, সবুজ আলপথে একদিনসহ অনেক নাটকেই অভিনয় করেছেন। বিয়ের পর অভিনয় থেকে কিছুটা দূরে থাকতে চাইলেও বর্তমানে বিশেষ দিনগুলোতে অভিনয়ে বেশ ব্যস্ততা দেখা যায়।

বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন মৌ। নইলে বাংলা চলচ্চিত্র পেতো এক গ্ল্যামারাস নায়িকাকে। জাহিদ হাসানের সঙ্গে পরিচয় প্রসঙ্গে মৌ বলেন, ইত্যাদি সেটে জাহিদ যখন আমাকে বলল আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই; আমি দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। প্রথম দেখাতেই কী বলে! এরকম কিছু একটা ভেবেছি। জাহিদ তো তখন জনপ্রিয় অভিনেতা। লজ্জাও পেয়েছিলাম খুব। পরে যখন তার সঙ্গে কথা হলো, বন্ধুতো হলো বুঝলাম আমার জন্যই সেই সঠিক পুরুষ। দু’বছর প্রেম করলাম। বাসা থেকে রাজি হচ্ছিল না। আমরা পালিয়ে বিয়ে করি। আমি জাহিদের ওপর আস্থা রেখে পরিবারের সবাইকে ছেড়ে, তার হাত ধরেছিলাম। এত বছর পরে এসেও একদিনের জন্যও সে আমার সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা করেনি। দুই সন্তান নিয়ে বেশ সুখের সংসার মৌয়ের। 

মিডিয়া জগতের মতো ব্যক্তিজীবনেও কোনো কিছুর আঁচ লাগতে দেননি তিনি। তার কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, পরবর্তী প্রজন্মের অসংখ্য মডেলের অনুপ্রেরণা আপনি। তারা আপনাকে অনুসরণ করে হতে চায় আপনার মতো। আপনার কোনো অদেখা দিকটি আপনাকে আর সবার কাছে আইডল করে তুলেছে? একটু সময় নিয়ে তিনি উত্তর দিলেন, আমি যতটুকু বুঝি-আমার সময়জ্ঞান, সততা, দায়িত্ববোধ আমার কাজের জায়গাটাকে সুন্দর করে তুলেছে। এ কারণে পরের জেনারেশন আমাকে আদর্শ হিসেবে দেখে, তাদের ভালো লাগার জায়গা থেকেই। যদিও আমি আমার এ জায়গাটিকে নিজে বিশ্বাস করি না; কিন্তু এটা খুব ভালো লাগে, তারা আমাকে চেনে এবং আমার মতো হতে চায়। কাজের প্রতি ডেডিকেশন, সতর্কতাবোধ, কমিটমেন্ট- আমার কাছে মনে হয় এই বিষয়গুলো মেনটেইন করলেই আগামী প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা ভালো কিছু করতে পারবে। যে জায়গায় পৌঁছাতে চায়, পারবে। মৌ সম্পর্কে ভক্তরা জানেন না এমন তিনটি দিক তিনি বললেন, অনেক কিছুই আছে অদেখার। আমরা যতটুকু দেখাতে চাই, ঠিক ততটুকুই মানুষকে দেখাই। 

বিয়ের পরও সাদিয়া ইসলাম মৌকে মডেলিং করতে দেখা গেছে। অভিনয় করেছেন টিভি নাটকে। নৃত্য পরিবেশন করেছেন মঞ্চে ও টিভি-অনুষ্ঠানে। মিলেনিয়ামে পদার্পণের সময় থেকে একটু একটু করে নিজেকে গুটিয়ে নেন। একটা সময় চলে যান পুরোপুরি পর্দার অন্তরালে। এ সময় অবশ্য জাহিদ-মৌ দম্পতির কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে সন্তান পুষ্পিতা। বহু নাটক আর মডেলিংয়ের অফার থাকলেও প্রায় ৬/৭ বছর সাড়া দেননি মৌ; কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে মৌ বললেন, আমি যখন যা করি মনোযোগ দিয়ে করি। তখন আমার নতুন সংসার। আমি সংসারটি-ই করতে চেয়েছিলাম। যখন মা হলাম সন্তানের দেখাশোনাটিকেই গুরুত্ব দিয়েছি। একজন নারীর জীবনে প্রথম পরিচ্ছন্ন ভালো লাগার জায়গা হওয়া উচিত তার সংসার। কাজ অনেক করা যাবে। আমার সংসার, আমার সন্তানকে আমি যত্ন করে গড়ে তুলব। তাই মিডিয়া থেকে দূরে সরে ছিলাম দীর্ঘ সময়। 

একজন মৌ একদিনে তৈরি হয়নি। অনেক সংগ্রাম, শ্রম মিশে আছে এর পেছনে। এ প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, সত্যি বলতে আমার মৌ হওয়ার ইচ্ছেই ছিল না কখনো। তবে এই ইচ্ছেটা ছিল আমার মায়ের। মডেলিং, অভিনয়; এসব কোনো কিছুতেই আমার ইচ্ছে ছিল না। আমার মা অনেকটা জোর করেই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। মডেলিংয়ে প্রথম নিয়ে এসেছেন আমার বড় দুলাভাই ফারুক হাসান। ওনার মাধ্যমেই আমি প্রথম ফ্যাশন শো-তে অংশ নিই। পরিবারের সহযোগিতা ছাড়া আমি কিছুই না। তাদের সবার সহযোগিতাতেই আমি আজকের মৌ। মা চাইতো আমি যেন অনেক বড় কিছু হই। শুধু আমি না, আমাদের চার বোনকে নিয়েই অনেক স্বপ্ন দেখতেন মা। চাইতেন আমরা যেটাই করি না কেন, সেখানে যেন অবশ্যই সফল হই। এটাই ছিল আমার মায়ের চাওয়া। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মায়ের স্বপ্ন পূরণ করে যেতে চাই। আর আমার স্বপ্ন যদি বলি, সেটা আমার ছেলে- মেয়েকে ঘিরে।

সন্তানরা আপনাদের তারকাখ্যাতি কতটুকু উপভোগ করে জানতে চাইলে মৌ বলেন, অনেকের কাছে হয়তো আমি অনেক কিছু কিংবা তারকা; কিন্তু আমি নিজে সেটা কখনো মনে করি না। আমি সবসময়ই সাধারণ। আমি মা হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজেকে মা-বাবার সন্তান হিসেবে দেখেছি আর এখন একজন মা হিসেবে। আমার পরিচয় একজন স্ত্রী, একজন মা। আমি নিজেকে কখনো তারকা ভাবি না। যে কোনো কাজে গেলেও আমার মাথায় সারাক্ষণ এটি থাকে যে, আমি একজন মা। আর আমার সন্তানরা সেটি অনুভব করে কিনা জানি না, তবে তাদের মা হতে পেরে আমি গর্বিত। পুষ্পিতা ও পূর্ণ আমার দুটি সন্তানই অনেক লক্ষ্মী। এখনকার প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মতো এত ফাস্ট না তারা। একদম শান্তশিষ্ট, হুটহাট এখানে সেখানে যাওয়ার কোনো বায়না নেই তাদের। বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। যদিও অনেক দিন ধরে কোথাও বের হওয়া হচ্ছে না তাদের নিয়ে। তারপরও তাদের কোনো অভিযোগ নেই। জাহিদ শুটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আমি হয়তো একটু কম ব্যস্ত থাকি তারপরও আমরা একসঙ্গে বেশ ভালোই আছি। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh