‘ছবিটিকে আমাদের তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে যুক্ত করতে সচেষ্ট ছিলাম’: এন রাশেদ চৌধুরী

এহসান হায়দার

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২১, ০৩:৫১ পিএম | আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২১, ০৩:৫৩ পিএম

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

চলচ্চিত্র নির্মাতা এন রাশেদ চৌধুরীর পরিচালনায় বহুল প্রতীক্ষিত ‘চন্দ্রাবতী কথা’ চলচ্চিত্রটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে স্ক্রিনিং শেষে এখন পক্ষকালব্যাপী দেশের বড় প্রেক্ষাগৃহগুলোতে প্রদর্শিত হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশও যেন মুখ থুবড়ে পড়ার মতোই, এখন একটু একটু করে সেই অচলায়তন ভেঙে পৃথিবী জেগে উঠছে, মানুষ সিনেমা হলে আসছে। বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি বলা হয় চন্দ্রাবতীকে। মলুয়া, দস্যু কেনারামের পালা এবং রামায়ণ তাঁর অন্যতম সৃষ্টি। তবে তাঁর সৃষ্টির চেয়ে ঢের বেশি নাটকীয় এবং একইসঙ্গে বিয়োগান্তুক তাঁর নিজের জীবন। ষোড়শ শতকের অসম্ভব প্রতিভাবান ও সংগ্রামী এই নারীকে নিয়ে নির্মিত হওয়া পূর্ণদৈর্ঘ্য এই ছবিটি, দর্শকনন্দিত এবং সমালোচকদের নিকটও প্রশংসা কুড়িয়েছে। সম্প্রতি ‘চন্দ্রাবতী কথা’ চলচ্চিত্র বিষয়ে নির্মাতা এন রাশেদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন -এহসান হায়দার।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম বাঙালি নারী কবি চন্দ্রাবতী। তাঁর জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘চন্দ্রাবতী কথা’- গবেষণা, শুটিং-পূর্ব প্রস্তুতি, শুটিং, পোস্ট প্রোডাকশন- সব মিলিয়ে পাঁচ বছরের মতো সময় লেগেছে। এই দীর্ঘ সময়ে ছবিকেন্দ্রিক আপনার যে অভিজ্ঞতা-অনুভূতি তা নিয়ে কিছু বলবেন?

অভিজ্ঞতা পুরোটাই! যখন প্রথমবার ছবিটা অনুদানে জমা দিই, তার মাত্র কয়েক বছর আগেই বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ ‘ময়মনসিংহ গীতিকার’ সন্ধান লাভ ও নিবিড় পাঠপর্ব চলে আমাদের কয়েক বন্ধুর। এর ভেতরেই নয়ান চাঁদ ঘোষ রচিত একটি পালায় প্রথম খুঁজে পাই- ষোড়শ শতকের মহীয়সী এই গীতি কবিকে। কিছুদিন পরেই পাঠ করি নবনীতা দেব সেনসহ অনেকের লেখা- যেসবে তিনি চিহ্নিত হয়ে আছেন বাংলা সাহিত্য তথা-সমগ্র উপমহাদেশেরই প্রথম নারীবাদী কবি হিসেবে। তখন থেকেই মনে ইচ্ছা জাগে চন্দ্রাবতীকে নিয়ে একটা ছবি করার; কিন্তু শুধু মনে হলেই তো হবে না, কীভাবে নির্মাণ করব, এত পুরনো এক প্রেক্ষাপট। প্রায় চারশ’ বছর পেছনে যার পটভূমি! কয়েকজন তরণ সুহৃদ সাহচর্যে এগিয়ে এলেন। তারা আশ্বাস দিলেন, আমি চাইলে তারা এর সঙ্গে যুক্ত হবেন। এক সিনিয়র বন্ধু (এখানে নাম প্রকাশ পেলে হয়তো তিনি ব্যথিত হবেন) সার্বিক প্রস্তুতি ও প্রপোজাল তৈরি করে অনুদানে জমা দেবার জন্য ৫০ হাজার টাকা ঋণ দিলেন (সেই ঋণ এখনো শোধ হয়নি)। এভাবে স্ক্রিপ্ট লেখা ও প্রপোজাল তৈরির কাজ এগিয়ে চলল। প্রায় দুই মাস চেষ্টার পর লেখা হলো ‘চন্দ্রাবতী কথা’র প্রথম ড্রাফট স্ক্রিপ্ট। তখন যে প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ১৬ বছর কাজ করছিলাম- এক কথায় চাকরিটা ছেড়ে চলে এলাম বেঙ্গল ক্রিয়েশন্সে।

বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন- শ্রদ্ধেয় আবুল খায়ের লিটু সাহেবের উৎসাহে তাঁর সিনেমা তৈরির প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল ক্রিয়েশন্সে ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দিই ও এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার হিসেবে প্রথমেই কাজ শুরু করি-জাহিদুর রহিম অঞ্জনের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা-সদ্য অনুদানপ্রাপ্ত- ‘মেঘমল্লার’ ছবিতে। এমন সময়ই খবর পাই ‘চন্দ্রাবতী কথা’ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জাতীয় চলচ্চিত্র অনুদান পেয়েছে। আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে এক বিপন্নতাও কাজ করতে শুরু করে ঠিক এরপর থেকেই। মাঝে মাঝে আমার প্যানিক অ্যাটাক হতে থাকে-কীভাবে সামাল দিব এই মহাসমুদ্র পাড়ি, আমার যে কেবলই এক ভাঙা তরী সম্বল! বিশ্বাস না হারিয়ে এগিয়ে চলে চূড়ান্ত চিত্রনাট্য রচনার কাজ। এ কাজেও সহযোগী হিসেবে যুক্ত হন দুই নবীন চলচ্চিত্র অনুরাগী বন্ধু। একসময় আমি বিশ্বাস করতে শুরু করি- আমার চেয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ একদল সহকারী আমাকে ঘিরে রেখেছে-কারণ ততদিনে আমি ওদের মাঝেও আমার বিশ্বাস ও ভাবনাকে সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছি। 

এ ছবি নির্মাণ করতে গিয়ে-আমি যে যে প্রক্রিয়া ও গবেষণার মধ্য দিয়ে গিয়েছি -আমার এই কোর ক্রু-গ্রুপও আমার সঙ্গেই চলেছে। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বলতে চাই-আমাদের দলে যেমন ছিলেন তরুণ ঘোষ, নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর মতো গুরুস্থানীয় ব্যক্তিরা, বন্ধু চিত্রগ্রাহক- সাইয়ীদ কাশেফ শাহবাজি, গাজী মাহাতাব হাসান (লোকেশন), তেমনি রাজীব রাফি (স্ক্রিপ্ট ও পরিচালনা), শাহিনুর আলম, মুরাদ খান, সাদ্দাম খন্দকার জয় (আর্ট, প্রপস), নিলয় প্রধান (প্রোডাকশন ও পোস্ট), প্রডাকশন ডিজাইনার মাজাহারুল রাজুর মতো একঝাঁক তরুণ তুর্কি ছিলেন! এরা প্রত্যেকেই আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন। 

আমাদের গবেষণার পর্বটিও ছিল অবিশ্বাস্য রকমের দীর্ঘ ও জটিল! একদিকে সেই সময়ের নানা উপাদানের যোগসাজশ ঘটানো, পাশাপাশি চলতে থাকে সে সময়ের প্রেক্ষাপট, বিলুপ্তপ্রায় ময়মনসিংহ গীতিকার বিল, ঝিল, হাওরের বর্ণনানুযায়ী এদের উৎস-সন্ধান, সে সময়ের মানুষের আচরণ, তাদের প্রতিবেশ-পরিবেশ ও হাওরের গান-বিশেষত চন্দ্রাবতী রচিত গীতিকাব্যের অনুসন্ধান-যা তখন প্রায় লুপ্ত হবার পথে। এক ভাদ্রের সন্ধ্যায় এক বন্ধুর দেওয়া তথ্যানুযায়ী নেত্রকোনার এক প্রত্যন্ত গ্রামে, মনসা পূজার ক্ষণে সন্ধান মেলে-চন্দ্রাবতীর বাবা দ্বিজবংশী দাসের মনসা মঙ্গলের হাতে কপি করা প্রায় দুইশত বছরের পুরনো পুঁথিটি। পাশাপাশি শত শত বছরের প্রবাহিত স্মৃতি-পরম্পরায় আশপাশের ঘরগুলো থেকে অলস দুপুরে ভেসে আসতে থাকে চন্দ্রাবতী রচিত রামায়নের শ্লোক। বাড়ির মেয়েরা-একাকী পাঠ করছেন সেই গীতল রামায়ণ-যার সুবাসে চারদিক মুহূর্তে ম ম করে উঠল। আমি নিজেই সাক্ষী হলাম এ সত্যের-চন্দ্রাবতী তাদের মাঝেই বেঁচে আছেন, এই মাটিতেই, এই বাতাসেই! 

ধীরে ধীরে এ ছবির প্রেক্ষাপট, এর বাতাবরণ, পাত্র-পাত্রীদের পোশাক-পরিচ্ছদ ও জীবনাচরণ, রীতি, নানা প্রচলিত গল্পগাঁথা-গান এক এক করে মিলিয়ে দিতে থাকে এ ছবির সম্ভাবনার মাত্রা। 

চন্দ্রাবতী আমাদের শেকড়ের গল্প, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের হাওর, প্রকৃতি, সভ্যতা, সংগীত সবটাই। এ গল্প নিয়ে কাজ করার কথা ঠিক কবে থেকে ভাবছিলেন এবং আপনার কোথাও কি মনে হয়েছিল কখনো এটা পুরনো ধাঁচের, এটাকে আধুনিকতার ছোঁয়া দিতে হবে?

আপনার প্রশ্নের মাঝেই এর একাংশের উত্তর আছে। আপনি বলেছেন এটি আমাদের শেকড়ের গল্প। শেকড় হয়তো মাটির গভীরে লুকিয়ে আছে; কিন্তু আজকের যেই মহীরুহ বৃক্ষ- যাকে আমরা বাঙালি সংস্কৃতি বলে চিহ্নিত করতে সচেষ্ট হই- তার পরম্পরা অনুসন্ধান করলেই মিলবে এর রহস্য ভেদ! এ সময়কাল বাঙালির ইতিহাসের এমনই এক ক্ল্যাসিক স্বর্ণযুগে, ঠিক সেই সময়-যখন ইংল্যান্ডেও ব্যালাড রচনা চলছে-লিখছেন সেখানকার গীতিকবিরা। একাদশ-দ্বাদশ শতকের থেকে শুরু হয়ে যে মৌখিকভাবে প্রচলিত ধারা বহমান ছিল এইতো- মুদ্রণ শিল্প আসবার আগমুহূর্ত অবধি। এ সময়ের কবিরা তাঁদের নিজেদের রচনাতেই রেখে গেছেন তাঁদের সেই পরিপার্শ্বের বিবরণ, নিজস্ব সুখ-দুঃখের স্মৃতি, তাঁদের মনুষ্য পৃথিবীর বিষাদময়তার কাব্যগাঁথা, আত্মত্যাগ ও বীরত্বগাঁথাসমূহ।

গবেষণা বলছে, চন্দ্রাবতীর মৃত্যুরও প্রায় পঞ্চাশ বছর পর নয়ানচাঁদ ঘোষ প্রচলিত স্মৃতিগাঁথার ভিত্তিতে লিখেছিলেন ‘চন্দ্রাবতী’ গীতিকবিতাটি। আমৃত্যু তাঁর স্বেচ্ছা নির্বাসিত জীবনের স্মৃতিবিজড়িত সেই শিব মন্দিরটি; কিন্তু এখনো সগৌরবে দণ্ডায়মান! আর হাওরের পানি, বাতাস, মাটি বহন করে চলেছে এই দুঃখ-গাঁথাগুলো। একটু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলেই মিলবে এদের লুকিয়ে পড়া রূপ, রস, গন্ধ। এগুলো মিশে আছে আবহমান বাঙালির অস্তিত্বে! প্রবাহিত হয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষের রক্তস্রোতে! একে অস্বীকার করবার উপায় কি! 

আমরা যারা এসব কাব্যগাঁথা ছুঁয়ে দেখিনি, তারা বলতেও পারবো না- কি অনন্য এদের রূপ ও স্বভাব। তবে হয়তো আত্মম্ভরিতায় ব্যস্ত, তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত্বের ড্রইংরুম থেকে এর চিরপ্রস্থান ঘটেছে। ব্রাত্যজনের রসের আখ্যান, আমাদের হাজার বছরের নাট্যরীতি মর্মে স্বীকৃত- পালাগানের রসদ এসব গীতিকবিতা এখন আর তাদের পরিশীলনের বিষয় নয়। তাই হয়তো আমরা এর সঠিক মর্ম অনুধাবনে ব্যর্থ। তবে বিদ্ব্যৎজনরা মনে করেন এসব গীতিকবিতা তাদের নিজ নিজ শিল্প-সৌকর্যে পরিপূর্ণ। পূর্ববঙ্গের বাংলা ভাষার এমন মধুময় রূপ কে কবে দেখেছে! নারীপ্রধান চরিত্রায়ণে, মাতৃ-আর্কিটাইপ চরিত্রের সমাহারে, জাদু বাস্তবতায় পূর্ণ অথচ ঈশ্বর-দেবতা বিবর্জিত এ সকল কাব্যে -মানুষেরই জয়জয়কার! তাই ছবিটি নির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা এক প্রকার পোস্ট মডার্ন অ্যাপ্রোচ অ্যাপ্লাই করি। যেখানে পালাগানের ফর্ম, গীতি কাব্যসমূহের শুষমা- সেই সব চরিত্রগাঁথা-জয়ানন্দ, চন্দ্রাবতী, দ্বিজবংশী দাসের পাশাপাশি পালাগানের চরিত্ররাও জীবন্ত হয়ে ওঠে যেন আমাদের চন্দ্রাবতী কথা ছবিটিতে-অংশগ্রহণ করে এ ছবির প্রেক্ষাপট বিনির্মাণে। 

চলচ্চিত্রটির সেট ডিজাইন এবং প্রপসের ক্ষেত্রে আপনার ভাবনা এবং সংগীত ভাবনার সামঞ্জস্যতা, ভাষার ব্যবহার কতটা জনমুখী হয়েছে বলে মনে করছেন?

আমরা ছবিটিকে যথা সম্ভব তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে যুক্ত করতে সচেষ্ট ছিলাম, আমার মনে হয় আজ তা অনেকাংশেই ঘটেছে। অসংখ্য তরুণ ছবিটি দেখেছেন, নিজেদের মাঝে ষোড়শ শতকের কবি চন্দ্রাবতীকে ও ছবিটিকে ধারণ করতে চাইছেন- এই বা কম কিসে! তবে প্রদর্শনের দ্বিতীয় ধাপে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে ছবিটিকে নিয়ে বিভিন্ন জেলা পরিভ্রমণ ও প্রদর্শনী আয়োজনের। তাছাড়া বাংলাদেশে সিনেমার ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়েছে। এটি একটি ভিসিয়াস সার্কেলে কোনোরকমে টিকে আছে। এখানে শিক্ষিত, রুচিবান ও ক্ষুধার্ত অডিয়েন্সের কোনো পরিমাপক নেই... কেবলই কিছু ভ্রান্ত ধারণা প্রসূত হয়ে চলমান ক্ষয়িষ্ণু এই পরিবেশনা ব্যবস্থা। এই অতিমারিকালে বিভিন্ন জেলায় চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে আরও গোটা পঞ্চাশেক সিনেমা হল। যেখানে পাকিস্তানের মতো দেশেও রয়েছে সহস্রাধিক সিনেপ্লেক্স- আর আমাদের হলের বেহাল ব্যবস্থা নিয়ে আমরা কল্পিত এক ডিস্ট্রিবিউশন সার্কিটের স্বকল্পিত রূপে বিভোর হয়ে আছি- ততধিক ইমাজেনারি এক ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নামক এক কনফিউজড চক্রে। এ অবস্থায় আমরা ভেবেছি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির অন্তত ৪০টি জেলায় যে শিল্প ভবন আছে-যেখানে সিনেমাও একটি প্রশিক্ষণ ও চর্চার অনুশাখা- সেসব অডিটোরিয়ামে ‘চন্দ্রাবতী কথা’ প্রদর্শনের মাধ্যমে নানা জেলার মানুষদের মাঝেও ছবিটিকে নিয়ে যাবার। আশা করি শিগগিরই এই প্রদর্শনীর আয়োজন সম্ভব হবে। 

একদল পরিচালক রয়েছেন যাদের সিনেমা মুক্তি পায়; কিন্তু দর্শক হলে আসে না- মানুষ সিনেমা দেখে না, সেই ক্ষেত্রে আপনার ‘চন্দ্রাবতী কথা’ কতটা দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে বলে মনে করছেন কিংবা এ বিষয়ে আপনার ভাবনা কী?

‘চন্দ্রাবতী কথা’র বিষয়- বৈচিত্র্য ও উপস্থাপন রীতি সম্পূর্ণই আমাদের নিজস্ব ধারার সমন্বয়। আবহমান পূর্ব-বাংলার হাওর অঞ্চলের রঙ, রূপ, চেহারা যেমন ‘চন্দ্রাবতী কথা’য় দৃশ্যমান- তেমনি ছবির ফর্ম হিসেবে এতে আমরা পালাগানের ফর্মকে যুক্ত করতে সচেষ্ট থেকেছি। তাতে একদিকে যেমন ইতিহাসনির্ভর চরিত্ররা পেয়েছে তাদের জমিন পাশাপাশি পালাগানের গল্প থেকে নানা চরিত্ররা বেরিয়ে এসে সিনেমার প্রেক্ষাপট বিনির্মাণেও অংশ নিচ্ছে- এ ছবিতে। একদল পালাকারের বন্দনাগীতের মাধ্যমে চলচ্চিত্রটি শুরু হয়ে কবি চন্দ্রাবতী ও তাঁর বিশ্বকে যেন উপস্থাপন করছেন এখানে। তাদের উপস্থাপিত পালাটির রচয়িতাও কবি চন্দ্রাবতী আর তাঁর লেখা বন্দনাটি দিয়েই ছবিটি শুরু হয়- যেখানে সোনাই প্রধান নারী চরিত্র- যে একইভাবে চন্দ্রাবতীর নিজের বা তাঁর রচিত রামায়নের সীতার মতোই স্বামী বা প্রেমিক কর্তৃক প্রতারিত হয়ে অপমানে আত্মদগ্ধ। সেখান থেকেই চন্দ্রাবতী খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর রচিত রামায়নের সীতার শক্তি। আমাদের সিনেমায় এই তিনটি নারী চরিত্র- সোনাই, চন্দ্রাবতী ও সীতা শেষে সেই একই সুতোয় এসে মিলিত হয়েছে- হয়ে উঠতে চাইছে চিরন্তন সেই বাঙালি আর্কিটাইপ নারী প্রতিকৃতি। 

আন্তর্জাতিক উৎসবে স্ক্রিনিং হওয়া এ চলচ্চিত্রটি নিয়ে সমালোচকরা বলছেন ইউরোপীয় ঘরানার বাইরে এসে নির্মিত হয়েছে এদেশীয় ভাব-ধারায়, বিষয়টি যদি পাঠকদের জন্য বলতেন আপনি...

বাংলাদেশে ইতিহাসনির্ভর- বিশেষ করে এমন আইকনিক চরিত্রনির্ভর কাজ খুব বেশি হয় না। এর কারণ মূলত আমাদের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা! এই যে চন্দ্রাবতীর মতো এমন আইকনিক চরিত্র, যিনি অনায়াসেই আমাদের এই প্রজন্মের তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন নিজস্ব সংস্কৃতির জয়ধ্বজা। তাদের যোগাতে পারেন অমোঘ শক্তি- যার সুবাস ও শক্তি অনুপ্রাণিত করতে পারে শত তরুণকে উজ্জিবিত হতে- আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির শক্তিময়তার অনুভব উদযাপনে। অপর কারণটি অনেকেরই বোধগম্য- যথেষ্ট প্রস্তুতি, সেই অনুযায়ী বাজেট সংস্থান ও পরিকল্পনা। এসবের ঘাটতি মূলত ইতিহাস-ঐতিহ্য নির্ভর সিনেমার প্রধান প্রতিবন্ধক। তবে এসব কিছুর ঊর্ধ্বে প্রয়োজন সেই অনুসন্ধান- যা আপন শক্তিতেই প্রজ্‌বলিত প্রদীপ শিখার মতো! একে উপলব্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh