ওমর আলী

প্রেম নৈঃশব্দ্যের মায়াবী উচ্ছ্বাস

চঞ্চল নাঈম

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২১, ১২:৫৩ পিএম

কবিতা লেখার শুরুর দিকে বিভিন্ন সময়ে, কবিতার নানান আড্ডায় কারও-কারও নিকট শুনি, কবিতা হয়ে ওঠার বিষয়। এক-একজন কবির কাছে কবিতা উপস্থিত হয় এক-এক রকমের কল্পনাশক্তির বিন্যাসে। কবিতা কি সমসাময়িক পরিস্থিতির নতুন আঙ্গিক বা বিচিত্র বিষয়ের উদ্ভব? এমনকি সময়ের অভিজ্ঞতার গতিশীল সত্তাকে জিজ্ঞাসায়, প্রশ্ন আর প্রশ্নোত্তরে সাজানোর প্রকরণও? না-কি সময়ের দর্শনে, সামষ্টিক ব্যাঞ্জনায় নতুন কবিতা? শব্দের গন্তব্য চেতনায় কবিতা কি দাবি করে? কবিতার শরীরে কি কবির চৈতন্যের বিষণ্ণতা থাকে? যাকে কবিতার মেদ বলা যায়, যা কবিতাকে ভারি করে তোলে আর কবিতা চিন্তার উপলব্ধিতে প্রভাব বিস্তার করে বা কবিতার শব্দে, বিষয় প্রকরণে, নানা বোধে নানান ভাব-বৈচিত্র্যে কবির জার্নিতে সঙ্গ দেয়। কবিতা কি সেই রকম কিছু? সময়ে সময়ে এ রকম নানা ধরনের বিতর্ক উসকে ওঠে।

এ সব প্রশ্নের উত্তরপত্র খুঁজি কবিতার ইতিহাস থেকে। আর দেখতে থাকি কবিতা পরিমিতিবোধে সক্রিয় অন্তর্ভুক্ত দৃশ্যপট। এত সব খোঁজ-খবর শেষে বুঝি কবিতার শেষ কথা কিম্বা স্বতঃস্ফূর্ত বিবেচনায় সীমারেখা নির্দিষ্ট করে কিছু নেই; কিন্তু কালপরম্পরায় কবিতার ঢঙ পাল্টায়। কবিতায় নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হয়। ৪৭-পরবর্তী বাঙালির কবিতায় দেশভাগের অভিঘাত, পীড়া, বিষাদ সবকিছুই যেন সময়ে সময়ে এসেছে। তার সঙ্গেও কবিতার নানান প্রাসঙ্গিক আঙ্গিকের পরিবর্তন ঘটেছে। এ গদ্যে আলোচ্য কবি- ওমর আলী, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এতসব জিজ্ঞাসা কবি ওমর আলীর কবিতায় কি আছে? কেনবা ওমর আলীকে নিয়ে লিখতে বসলাম? তাঁর কবিতা কী এই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ? এই প্রশ্ন করা যেতে পারে। কবিতায় ওমর আলী এখনো নিজস্ব স্ফূর্তিতে প্রকৃতি-সৌন্দর্য, নারী, প্রেম ও গ্রামীণ পটভূমি সম্প্রসারণে স্বমহিমায় কিছুটা প্রোজ্বল।

ওমর আলী ষাটের দশকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি ও সাহিত্যিক। তিনি ১৯৩৯ সালের ২০ অক্টোবর, পাবনা শহরের দক্ষিণের দুর্গম চরশিবরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর, প্রাণ ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত পাবনায় বসবাস করতেন। গ্রামীণ প্রকৃতি, নারীর রূপ ও সৌন্দর্যের কবিতাসমূহের জন্য সবার নিকট অধিক পরিচিত। তাঁর ৪১টি গ্রন্থের মধ্যে ৩৮টি কাব্য গ্রন্থ, একটি ছড়ার বই ও দুটি উপন্যাস। ওমর আলীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পর পাঠকের কাছে খুব পরিচিতি পায়। এই বইয়ের তথ্য ছাড়া আর অন্য কোনো বইয়ের তথ্য পাঠকের নিকট খুব কমই আছে। এ ছাড়াও তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে- ‘আত্মার দিকে’, ‘সোনালি বিকেল’, ‘নদী’, ‘নরকে বা স্বর্গে’, ‘বিয়েতে অনিচ্ছুক একজন’, ‘প্রস্তর যুগ তাম্র যুগ’, ‘স্থায়ী দুর্ভিক্ষ সম্ভাব্য প্লাবন’, ‘তেমাথার শেষে নদী’, ‘নিঃশব্দ বাড়ি’, ‘কিছু দিন’, ‘ডাকছে সংসার’, ‘যে তুমি আড়ালে’, ‘ফুল পাখিদের দেশ’, ‘ফেরার সময়’ ইত্যাদি কবিতার বইসমূহ ও বিস্তৃত অভিজ্ঞতার অনুভূতিতে দৃশ্যমান। প্রচলিত প্রকরণের রূপকল্প পেরিয়ে অতিচেনা সাধারণ মানুষের জীবনের সমীকরণে প্রেম ও প্রকৃতি-সৌন্দর্যকে চোখ ও মনের অদ্ভুত দৃষ্টিতে বাস্তবতার রূপ স্থিরচিত্রে কবিতায় প্রকাশ করেন। শূন্যতার বিস্তারে নানান বিষয় বৈশিষ্ট্যে তার কবিতার শব্দ-নিঃশব্দে আলো আঁধারে চলাচল করে। যেন কবিতাই তার মনোজগতের সহজ আরাধনা। শব্দযোগে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া চিরন্তন নিদ্রাহীন কবিতাচিন্তা। অবলীলায় গভীরভাবে লেখেন গ্রামীণ পটভূমিতে কবিতার প্রায়োগিক হৃদ সংযোগ এবং তাঁর কবিতার আত্মায় ব্যবহারিক প্রশ্ন-উপমা সম্প্রসারণে নানা মাত্রিক দৃশ্যকল্প আলোড়িত করে। কবিতা হয়ে ওঠে অনুভবে নম্র রূপ-রস ও প্রকৃতিময়।

তাই খুব স্বভাবসুলভভাবে প্রকৃতির নিকটে যাওয়ার কথা বলেন- ‘আমাকেও ফিরে যেতে হবে বহুদূরে/ যেখানে ফেরার গান নেই। এই নীল/ আঁধার রাত্রির দীপ নিভে যাবে। সুরে/ আসবে অনন্ত যতি। এই অনাবিল/বিচিত্র ফুলের মাঠ, স্নিগ্ধ নদীতীর,/ ঝুমকোলতার বন, পিয়ালের শাখা,/ আমের নতুন পাতা, মুখের পাখির/শত কন্ঠ, আর এই প্রিয় দেশ আঁকা’ (দূরের গান)। ওমর আলীর কবিতায় জীবনের বাস্তবতা দেখা যায়। জীবনের সব ঘটনা প্রবাহ মেনে নিয়ে অবলীলায় মৃত্যুর গান সহজেই গাইতে পারেন। তার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় অনন্তকাল সুদূর। সেই সুদূর থেকে ফেরার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। না থাকে কোনো মায়াবিনী সুর। অনুক্ষণে, স্মৃতিতে আসে অন্ধকারে মানুষের জীবনের পরস্পর। আর যে জীবন দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। তবে সেটাও স্বচ্ছ না, আবেগ তাড়িত এক ধরনের সুদূর মগ্নতা, দূর। তাই যেন মৃত্যু।

ওমর আলীর চিন্তার মধ্যে সময়ের আবরণে মৃত্যুর যন্ত্রণা প্রকটভাবে দেখা দেয়। সব কিছুর সীমাবদ্ধতা ভেঙে যায়। আর চুপচাপ মৃত্যুর রহস্যে ধাবিত হতে চান। সরল বাক্যে নিজের জীবনের আর্তকথাগুলো চেতনায় তুলে ধরেন-‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি/ আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা;/ সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে,/ রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা।/ সে শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে হরিণীর মতো/ মায়াবী উচ্ছ্বাস দুটি চোখ, তার সমস্ত শরীরে/ এদেশেরই কোনো এক নদীর জোয়ার বাঁধভাঙা;/ হালকা লতার মতো শাড়ি তার দেহ থাকে ঘিরে। ’ (এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি); ওমর আলীর কবিতা পড়ে অবাক হয়ে বহুমাত্রিক চরিত্রে তাকে দেখি। তার কবিতায় প্রেম ও রোমান্টিকতার প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ হয়, কখনো বা প্রকৃতির রূপ দর্শনের মধ্যেই নিজেকে বিনিময় করেন। আবার কখনো বা রমণীর স্নান দেখে হরিণ শিকারির মতো, লাজ-লজ্জা খেয়ে বন্দুকের নলের বেশে দু’চোখ তাক করে চেয়ে থাকেন নারীর শরীরের দিকে, ভিজে চুলের দিকে। এভাবে ওমর আলী চেতনার চতুর্পাশে কামনার উপহার প্রকাশ পেতে থাকে।

গোপন ভালোবাসার প্রণালিতে পছন্দের উনুনের স্বাদ নিতে নিজের চারিত্রিক অবয়র খুলে ধরেন। জীবনকে নানান আশ্রয়ে ধাবিত করেন নিজের সক্রিয় দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা। তাই তার কবিতার অনুষঙ্গে নারী বারবার আসে। ওমর আলী বলেই সরলভাবে বলতে পারেন- ‘তুমি মোর ভালোবাসা তুলে নাও, নারী,/তোমার শরীরে, মনে, অকাতরে;’ নারীর ভালোবাসার অনুভবের কাছে নিজেকে সহজেই সমর্পণ করেন। প্রিয়তমার শরীরের ইন্দ্রিয়ের সমস্ত মধুর অনুভূতি গ্রহণের জন্য নিজের হৃদয়ে ধ্যান-জ্ঞান করেন। বস্তুত, মনে হয় প্রকৃতি ও নারীকে ছাড়া যেন তিনি চলতেই পারেন না।

ভালোবাসার অভিজ্ঞান ওমর আলীকে যেন পিছু ছাড়েনি। তাই তো ছোট ছোট ঠাট্টাও যেন তার অভিমানের কারণ হয়ে ওঠে। আর সাহসের সঙ্গে দুঃখকে পরস্পর আহ্বান করেন। চিরায়ত জীবনযাপন ভেঙে ফেলেন। আনন্দে হুঙ্কার ছেড়ে। আর নীরবে নিজের ভেতর কাঁদেন। এটাই হলো ওমর আলীর স্বভাবজাত কবিতা। সহজেই কবিতার বিষয়কে নানা রূপ দিতে পারেন। বলা যেতে পারে, শামসুর রাহমান, সিকদার আমিনুল হক বা আরও অনেকেই হয়তো কবিতার বিষয়বস্তুকে নিজের মতো করে ভেঙে ভেঙে তৈরি করতে পেরেছেন। তবে কবিকে তার সমকাল ধরে চলতে হয় কিম্বা ভবিষ্যতের কবিতার প্রতিচ্ছবি আঁকতে হয়, পুরোপুরি প্রকাশিত না হলেও নিজের লেখার মধ্যে দিয়ে, বিভিন্ন আঙ্গিকে অদৃশ্য থাকলেও পাঠককে কিছুটা হলেও আভাস দিতে হয়। ওমর আলী তার কবিতায় সহজ-সরলভাবে সেই রকম কিছু দৃষ্টান্ত দিয়েছেন- ‘এখন পালাও দেখি! বন্ধ করে দিয়েছি দরোজা!/এ রাত্রিতে, আমার দু’হাত থেকে পারো না পালাতে।/ বরং সেটাই মেনে নেওয়া ভালো, যা নির্ঘাত সোজা।/ আমার আলিঙ্গনে বেঁধে থাক এ সুন্দর রাতে।’ (এখন পালাও দেখি); ওমর আলী জীবন বাস্তবতা মেনে নিয়ে প্রত্যাশার কথা বলেন।

বারবার যৌনতা, নিবিড় সম্পর্ক কবিতার উপকরণ করে নিজের সক্রিয়তার পরিচয় দেন। যৌনতার আকাক্সক্ষার বীজ নিজ প্রত্যাশায় বপন করেন। মুহূর্তে বাক্যে-বাক্যে শোনা যায় আলিঙ্গন আকুতির আর্তচিৎকার। কবিতা নিয়ে ওমর আলীর দম্ভও কম ছিলনা, তার প্রকৃত উদাহরণ হলো নিম্নের কবিতার পঙক্তিসমূহ- ‘কবিতা ঝর ঝর করে ঝরে, সাদা নুড়ির মতো ঝর্ণা/ টিএস এলিয়ট, মালার্মে, রবীন্দ্রাথ, ওমর আলীর হাতের ওপরে কবিতা ঝরে বৃষ্টি ঝরে/ কবিতা মনের মধ্যে এক খণ্ড সীমানা চৌহদ্দির জমির ওপরে/ ঝরে যায় বহুক্ষণ ঝরে যায় বৃষ্টি’। (কবিতা ঝরে বৃষ্টি ঝরে);

ওমর আলী নিকটে যেন নানা বিষয়ের কবিতাসমূহ ঝর ঝর ঝরে। মনে হয় তিনি ইতিহাস সচেতন হয়ে ওঠেন। তার কবিতা পড়ে প্রাচীন ট্রয় নগরীতে চলে যায়, সুন্দরী হেলেনের জন্য সমগ্র ট্রয় যুদ্ধে পরিণত, ট্রয় যুদ্ধে বাঁচতে হেক্টরের মৃত্যু, হেলেনের জন্য বীর যোদ্ধা অ্যাকিলিসের মৃত্যু, রক্তে একাকার ট্রয় নগরী। প্রসঙ্গত, কবি এই সব উপলব্ধির ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণে ইতিহাসের সময়কে গতিশীল করেন। ওমর আলী তার কবিতার দাম্ভিকতা কালিদাসের মেঘদূত প্রেরন করেন। খুবই দম্ভের সঙ্গে নিজেকে উপস্থাপন করেন, যেন রবীন্দ্রনাথের পরে একমাত্র তিনিই কবি। সমসাময়িক কেউ হয়তো তার চিন্তার আশপাশে নেই। এমনকি নজরুল কিম্বা জীবনানন্দকেও স্মরনে রাখেননি; কিন্তু কালের বিচারে নজরুল কিম্বা জীবনানন্দও এখনো উজ্জ্বল। তাইতো এমন অনুভূতির মৌন নিঃসঙ্গতায় কবিতা লিখেন একাকী দৃঢ় হৃদয়ে। ওমর আলীর অধিকাংশ কবিতা আত্ম-প্রেম চিত্রিত জীবনের নিঃসঙ্গতার যোগসূত্রে দেখা যায়।

কবিতায় অন্তর্লীন ভালোবাসার প্রবণতা, স্বতঃস্ফূর্ত বাক্য গঠন- প্রকৃতির সক্রিয় পরিচয়ের বর্ণনার পাশাপাশি পাঠককে নিরন্তর আকর্ষণ করে। তাই, তাঁর কবিতা এমনভাবেই সম্পর্ক-সৌন্দর্যে মননচিন্তাকে প্রোজ্বল করে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh