ইরানের যাত্রা

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২১, ০৩:২৫ পিএম | আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২১, ০৫:৪৩ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

গ্রানাইট পাথরে গড়া টেলোথ শহরে একলা একলা ঘুরে বেড়ায় সেই তরুণ। তার মাথায় লতার উষ্ণীষ, সোনালি চুলে রজনের ঝলমলে ছোঁয়া। আদ্যিকালের পাথরের সেতুর ওধারে যে পাহাড়ি অরণ্য, তার ঘন কাঁটালতা ও সিদ্রাকদের আঘাতে বেগুনি পোশাক শতছিন্ন। টেলোথের মানুষজনের চেহারা কঠোর। তাদের চামড়ার রঙ গাঢ়। তাদের বাড়িগুলো চৌকো গড়নের। ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে তারা বলে, কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ? কী কর? 

জবাবে তরুণ বলে, ‘আমি ইরানন। অনেক দূরের শহর ‘আইরা’তে আমার বাড়ি। সে শহর এত দূরে যে, আমার আর এখন ভালোভাবে মনেও পড়ে না। তবে একদিন আমি হয়তো আবার সে-শহরকে খুঁজে বের করব। সে শহরে যে গান আমি শিখেছিলাম, সেই গান গেয়ে বেড়ানোতেই আমার আনন্দ। শৈশবের যে স্মৃতিরা আমার সঙ্গে আছে, তাদের দিয়ে সুন্দরকে গড়াই আমার কাজ। সেই স্মৃতি আর স্বপ্নরা আমার পুঁজি। যখন চাঁদ সুন্দর হয়, পশ্চিমা বাতাস যখন পদ্মকুঁড়িদের নাড়া দিয়ে যায়, তখন কোনো বাগিচার পথে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে যাই আমি। সে গানে যে আশার খবর শোনায়, সেই আশাই আমার একমাত্র সম্পদ।’ 

তার কথা শুনে টেলোথের কঠোর মানুষরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকায়। টেলোথ শহরে হাসি নেই। গানও নেই; কিন্তু তবু, বসন্তের দিনে কখনো কখনো এ শহরের সেই গম্ভীর মানুষগুলো কারথিয়ান পাহাড়ের দিকে চোখ রেখে সুদূর উনাই দেশের বাঁশির সুরের কথা ভাবে। দূরদেশের পথিকরা তাদের সেই বাঁশির সুরের কথা বলে গেছে বহুবার। 

ইরাননের সুরেলা গলার যৌবন তাদের ভালো লাগেনি। ভালো লাগেনি তার লতার মুকুট, চুলের রজন, ছেঁড়াখোঁড়া বেগুনি পোশাক। তবু, তার মুখে গান, সুর আর আনন্দের কথা শুনে তারা তাকে নিজেদের শহরে থাকতে দিল। বলল, সন্ধ্যাবেলা মিলনের মিনারের সামনের মাঠে গান শোনাতে হবে তাকে। 

সেদিন সন্ধ্যাবেলা মিলনের মাঠে ইরানন তার গান ধরল। সেই সুর শুনে এক বুড়ো বসল প্রার্থনায়। এক অন্ধ বলল, ইরাননের মাথা ঘিরে সে দেখেছে একটা জ্যোতি; কিন্তু টেলোথের বেশির ভাগ মানুষই সে-গান শুনে ঘন ঘন হাই তুলে, খানিক হেসে ঘুমোতে চলে গেল। বলে গেল, ইরানন তো কাজের কোনো কথা বলেনি! সে তো শুধুই তার স্মৃতি, স্বপ্ন আর আশার কথা বলে গেছে সুরে সুরে। 

‘মনে পড়ে সেই গোধূলি, সেই চাঁদ, সেই সুরেলা গুনগুন, আর যে ঘরে দোলনায় শুয়ে থাকতাম আমি তার জানালাটা। সে-জানালা বেয়ে পথ থেকে সোনালি আলোর আভা চুঁইয়ে আসত। সে পথের ধারে ধারে মর্মর পাথরের বাড়িদের গায়ে রৌদ্রছায়ার দল খেলা করত। আমার ঘরের মেঝেতে একটুকরো চৌকো চাঁদের আলোর কথা মনে পড়ে আমার। সে আলোর সঙ্গে জগৎসংসারের আর কোনো আলোর মিল নেই। মনে পড়ে মা যখন আমার গান গেয়ে ঘুম পাড়াত, তখন জানালা বেয়ে আসা চাঁদের আলোর রেখায় ধুলোপরীদের নাচ। গ্রীষ্মের উজ্জ্বল সকালে নানারঙের পাহাড়ের গায়ে রোদের ছোঁয়া মনে পড়ে আমার। দখিনা বাতাসে গান গেয়ে ওঠা গাছের ফুলদের থেকে ভেসে আসা গন্ধ, সে-ও তো ভুলিনি। 

‘শে্‌বতপাথরের আইরা, তোমার মতো রূপ আর কার! হায়ালিন নিথরার স্রত পেরিয়ে সেই সুগন্ধী ফলবাগিচার দল, সবুজ প্রান্তর চিরে বয়ে যাওয়া ক্রা নদীর ছোট ছোট প্রপাত-সেইসব বাগিচায়, সেই প্রপাতের কুলে কুলে আমরা একে অন্যের জন্য মালা গাঁথতাম। তারপর সন্ধ্যা যখন নামত, তখন পাহাড়ের ঢালে ইয়াথ গাছের নিচে শুয়ে অনেক দূরে আমার শহরের ঝিকিমিকি দেখতে দেখতে কত না বিচিত্র স্বপ্নে বুঁদ হয়ে যেতাম আমি! তখন এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া নিথরার বুকে তারাদের ছবি পড়ত। 

‘শহরজুড়ে কত না মর্মরের প্রাসাদ। তাদের মাথায় সোনালি ডোম, তাদের দেয়ালে কত না রঙের ছবি। শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিল সবুজ বাগান, ঝিল আর স্ফটিকের ফোয়ারার দল। সেইসব বাগানে খেলে বেড়াতাম আমি। সেইসব ঝিলে জলে পা ডোবাতাম। শুয়ে থাকতাম সেইসব ফুলেদের নরম বিছানায়। কখনো বা সূর্যাস্তের সময় খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠে যেতাম ওপরের মন্দির আর তার খোলা চত্বরে। সেখানে থেকে সূর্যাস্তের সোনালি অগ্নিশিখায় অপরূপ দেখাত মর্মর পাথরে গড়া আমার আইরা শহরকে। 

‘কতদিন দেখি না তোমায় আইরা। বড় কাঁচা বয়সে আমাকে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল তোমাকে ছেড়ে। তবু, জেনে রেখো, আমার বাবা তোমার রাজা ছিলেন। ফিরে আমি একদিন আসবই। সেটি নিয়তির বিধান। সাত মহাদেশজুড়ে আমি খুঁজেছি তোমায়। একদিন, ঠিক তোমার রাজত্ব ফিরিয়ে নিতে আসব। সেদিন সেখানকার মানুষ আমার গান শুনে মাথা নেড়ে ফিরে যাবে না। সে গানের মর্ম তারা বুঝবে। বুঝবেই! আমি যে ইরানন! আইরার রাজকুমার!’ 

সেই রাতে গানের শেষে টেলোতের এক আস্তাবলে ঠাঁই মিলল তার। পরদিন সকালে শহরের এক কর্তা তাকে বলল, আথোক নামে এক মুচির বাড়িতে কাজ শিখতে যেতে হবে তাকে। ওই হবে তার কাজ। 

‘কিন্তু আমি যে ইরানন! আইরার রাজকুমার। মুচির কাজে আমার মন লাগবে না তো!’ বলল ইরানন।

কর্তা জবাব দিল, ‘টেলোথে থাকতে গেলে খাটাখাটনি করতে হবে। সেটাই নিয়ম।’ 

শুনে ইরানন মাথা নেড়ে বলল, ‘আনন্দে বেঁচে থাকবার জন্যই তো খাটাখাটনি। তাহলে যে খাটুনিতে আনন্দ নেই তেমন কাজ আমি করব কেন? আমি যে গান গাই। গান তোমাদের আনন্দ দেয় না বুঝি? ভেবে দেখ, সারাটা দিন খেটেখুটে এসে আনন্দ পাবার জন্য গান শোনাবার লোক তো একটা চাই! গান নইলে কারও খাটতে ভালো লাগে নাকি? তেমন বেঁচে থাকবার চাইতে তো মরে যাওয়াও অনেক ভালো!’

কর্তা কিন্তু তার কথার কিচ্ছু বুঝল না। শুধু মুখ অন্ধকার করে ধমকে উঠল, ‘আজব ছেলে দেখছি! তোর গান আমার একদম ভালো লাগেনি। আর যে কথাগুলো বললি, সে হল অনাচারের কথা। আমাদের টেলোথের ভগবান বলেছেন খাটুনিই আসল কাজ। যে ভালো করে খাটবে, মরবার পরে সে আলোর ভুবনে যেতে পারবে। সেখানে আরামই আরাম। হিরেপান্নায় গড়া সেই আরামের স্বর্গের রূপে তার মন ভরবে, চোখ জুড়াবে। তাই বলছি, হয় তুই আথকের কাছে এখুনি কাজ শিখতে যাবি, আর তা না হলে সূর্য ডোবার আগে চলে যাবি এই টেলোথ ছেড়ে। আমাদের এই কেজো শহরে ওসব গানটান আমি একেবারেই মেনে নেব না।’ 

ইরানন আর কী করে! আস্তাবল ছেড়ে বের হয়ে এলো। তারপর শহরের সরু সরু পাথরের গলিতে এলোমেলো ঘুরে বেড়াতে লাগল। একটু সবুজ খুঁজছিল সে। একটু বসন্তের বাতাস; কিন্তু টেলেথ যে কেজো লোকের শহর! সেখানে শুধুই পাথর। কোনো সবুজ নেই। তার মানুষজনের ভুরু সবসময় কুঁচকেই থাকে। 

হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে, শহরের একটেরেতে জুরো নদীর পাড়ের পাথরে বাঁধানো রাস্তায় উঠে এসে ইরানন দেখতে পেলো সেখানে নদীর অলস স্রোতের পাশে একটা ছোট্ট ছেলে চুপচাপ বসে আছে একলা একলা। চোখ তার জলের মধ্যে দিয়ে ভেসে চলা পাহাড় থেকে বয়ে আসা গাছগাছালির সবুজ ডালপালার দিকে। তাকে দেখে ছেলেটা বলল, ‘কর্তারা একটা ছেলের কথা বলছিল যে নাকি দূরদেশের কোনো এক সুন্দর শহরের খোঁজে আছে। তুমিই বুঝি সেই ছেলে? আমার নাম রমনড। জন্ম আমার টেলোথ শহরেই; কিন্তু আমি ওদের মতন নই। দূরদেশের গান আর ফলবাগিচাদের দেখতে খুব ইচ্ছে আমার। কার্থিয়ান পাহাড় ছাড়িয়ে উনাই-এর সবুজ দেশ। সে দেশের বাঁশির সুর আর নাচ নাকি যেমন সুন্দর তেমনই ভয়ংকর। আমি যদি আরেকটু বড় হতাম, আর রাস্তাঘাটের খবর রাখতাম তাহলে সেই দেশে চলে যেতাম। তুমি সেই দেশে যাবে? ওখানে মানুষ তোমার গানের মর্ম বুঝবে ঠিক। 

‘চলো না আমরা দু’জন মিলেই সেই ঝর্ণা ভরা পাহাড়ের দেশে চলে যাই! দিনের বেলা তুমি আমায় পথ দেখাবে, আর সন্ধ্যাবেলা যখন তারাগুলো একে একে উঁকি মেরে মানুষের চোখে স্বপ্ন আনবে তখন আমি তোমার গান শুনব। এমনও তো হতে পারে, নাচেগানে ভরপুর সেই উনাই শহরটাই আসলে তোমার সেই ছেলেবেলার আইরা! তুমি তো সেই কোন ছেলেবেলায় আইরা ছেড়েছ! তারপর হয়ত এতদিনে শহরের নামটাই বদলে গেছে! হতেও তো পারে! ও সোনালি চুলের ইরানন, চলো না, আমরা উনাই শহরে যাই। সেখানে মানুষ আমাদের বুঝবে। আমাদের আপন বলে কাছে টেনে নেবে ঠিক, তুমি দেখে নিও! সেখানে কেউ আমাদের দিকে ভুরু কুঁচকে চাইবে না। কেউ আমাদের নিয়ে ঠাট্টা করবে না। 

শুনে ইরানন জবাব দিল, ‘তাই চল রে খুদে! এই পাথুরে রাজ্যের একজন মানুষও যদি সুন্দরকে খোঁজে, তবে তাকে পাহাড় উজিয়ে ওপারে তো যেতেই হবে! আমি তোকে এইখানে, এই জুরো নদীর ধারে পড়ে পড়ে কাঁদবার জন্য ছেড়ে যাব না; কিন্তু মনে রাখবি, কাথরিয়ন পাহাড় পেরোলেই যে শুধুই গান আর আনন্দ তেমনটা নাও হতে পারে। এই শহর থেকে একদিনের পথ পেরিয়ে, কিংবা এক বছরের, কিংবা পাঁচ বছরের পথ পেরিয়েও তেমন জায়গার খবর তুই নাও পেতে পারিস। আমি যখন তোর মতন ছোট্টটি, তখন আমি থাকতাম বরফজমা ‘জারি’র পাড়ে নার্থস নামের এক জায়গায়। সেখানে কেউ আমার স্বপ্নগুলোর কথা শুনতেই চাইত না। আমি তখন মনে মনে ভাবতাম একটু বড় হলেই আমি পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালে সিনারাতে চলে যাব। সেখানে রঙ্গিলা উটওয়ালাদের প্রাণ ভরে গান শোনাব তাদের বাজারে বসে বসে; কিন্তু তারপর, বড় হয়ে যখন সিনারাতে গেলাম, দেখি উটওয়ালাগুলো আসলে সব নেশাখোর আর মূর্খ। দেখলাম ওরা যে গান গায়, সে আমার গান নয় একেবারে। আমি তখন জারি নদীর বুকে একটা নৌকো চেপে চলে গেলাম ওনিমস পাথরের দেয়ালঘেরা ইয়ারেন শহরে। সেখানকার সেপাইরা আমায় নিয়ে খানিক হাসাহাসি করে সিধে তাড়িয়ে দিল। তারপর এ শহর, ওশহর করে অনেক ঘুরেছি। মহাপ্রপাতের নিচে স্টেথলোস শহর দেখেছি আমি। এদিন যেখানে সারনাথ শহর ছিল সেই জলাটাও দেখেছি। ‘আই’ নদীর বাঁক ধরে ধরে থ্রা, কাডাথেরন, লার্নেক কত জায়গায় গিয়েছি তার লেখাজোখা নেই। লোমারের দেশের ওলাথো। সেখানেও থেকেছি আমি বছরকয়েক। এতসব জায়গায়, গান শোনাবার মতো মানুষ কিন্তু আমি পেয়েছি মাত্রই গুটিকয়েক। না রে! একটা কথা আমি জানি, আমার গান শুনে খুশি হবে এমন শহর বলতে এক ওই আইরাই আছে দুনিয়াতে-একদিন যে শহরের রাজা ছিল আমার বাবা। 

‘তাই খুঁজতে হলে আমি ওই আইরাকেই খুঁজে যাব। সে শহরে খোঁজার পথে কারথিয়ান পাহাড় পেরিয়ে অনেক দূরের ওই উনাই শহরে যেতে আমি রাজি। হয়তো, তুই যা বলেছিস, ওইটেই আমার আইরা; কিন্তু আমার তা বিশ্বাস হয় না। কেন জানিস? আইরার যা রূপ, তাকে একবার যে দেখেছে সে তার কথা বলতে গেলে মুগ্ধ হয়ে যাবেই। অথচ এখানকার উটওয়ালাগুলোকে দ্যাখ, উনাইয়ের নাম বলতেই কেমন মুখ বাঁকায়। উনাই যদি আইরা হতো তাহলে ওরা অমন কথা বলতে পারতই না!’ 

সেদিন সূর্য ডুবলে ইরানন আর রমনড টালোথ ছেড়ে রওনা হয়ে গেল। তারপর সবুজ পাহাড় আর ঠান্ডা অরণ্য দিয়ে অনেক রাস্তা পেরিয়ে গেল তারা। রাস্তাটা বড় উঁচুনিচু। পথের দিশাও পাওয়া যায় না ঠিকঠাক। অনেকদিন ঘুরে ঘুরেও তারা উনাই শহরের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারল না; কিন্তু যখন চলতে চলতে সন্ধ্যা নামত, আকাশজুড়ে তারারা উঁকি দিত, ইরানন তখন আধো অন্ধকারে তারার আলোর নিচে বসে আইরার গান গাইত আর রমনড চুপচাপ বসে শুনত। তাতেই পথ চলবার সব দুঃখকষ্ট ভুলে যেত তারা। খাবার অভাব তাদের ছিল না। বনের মধ্যে ঠান্ডা, মিষ্টি জল আর ফলফুলুরির অভাব তো নেই! সময়ের কোনো হিসেব রাখত না তারা। কত বছর যে এইভাবে হেঁটে হেঁটেই পার হয়ে গিয়েছে সে নিয়ে কোনো খেয়ালই ছিল না তাদের! ছোট্ট রমনড ততদিনে আর তত ছোট্টটি নেই। গলার আওয়াজ ভারী হয়েছে। মাথায় বেড়েছে অনেকখানি। ইরানন কিন্তু এতটুকু বদলায়নি এই এতটা সময়ে। আগের মতই তরুণ রয়ে গেছে তার শরীর। তেমনই সুন্দর রয়ে গেছে গানের গলা। বনের সোনালি লতায় সে তার উষ্ণীষ বানায়। চুলে লাগায় সুগন্ধী রজন।

তারপর একদিন দেখা গেল, রমনডকে ইরাননের চাইতে বয়সে বড় দেখাচ্ছে। অথচ প্রথম যেদিন তাদের সেই টেলোথ শহরে দেখা হয়েছিল, তখন কত ছোট্টটিই না ছিল সে! 

তারপর এক পূর্ণিমার রাত্রে দু’জন হাঁটতে হাঁটতে একটা পাহাড়চূড়ায় এসে পৌঁছে, অন্যদিকের উপত্যকার দিকে তাকিয়ে দেখল সেখানে একটা শহরের আলো জ্‌বলছে। কাছাকাছি চাষাভুষোদের জিজ্ঞাসা করে জানা গেল ওই হল উনাই। আর বেশি দুরে নেই তা। শহরটার দিকে একঝলক দেখেই ইরানন বুঝল এ তার আইরা হতে পারে না। এ-শহরের আলোরা অন্যরকম। অনেক বেশি চোখ ধাঁধানো। চড়া। আইরার আলো বড় মায়াবি। চাঁদের আলোর মতো মিষ্টি সেই জাদুকরি আলো ইরাননদের ঘরের মেঝেতে এসে পড়ত। মায়ের কোলে ঘুমোতে ঘুমোতে সেই আলো ইরানন দেখেছে। একবার সে আলো দেখলে কেউ তা ভোলে না। 

তবে আইরা না হলেও উনাই তো নাচগানেরই শহর। ইরানন আর রমনড তাই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বেয়ে নেমে গেল সেই শহরের দিকে। পৌঁছে দেখে সেখানে গোলাপফুলের মালা জড়ানো ফূর্তিবাজ লোকজন আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে পথজুড়ে, উঁকি মারছে ঘরের জানালা আর ব্যালকনি দিয়ে। ইরাননের গান শুনে তারা তাকে ফুল ছুড়ে অনেক আদর জানাল। তখন একটুক্ষণের জন্য ইরাননের মনে হলো, এইবার হয়ত সত্যিসত্যিই সে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে মানুষ তাকে ভালোবাসবে। তার গানকে ভালোবাসবে। 

কিন্তু তারপর যখন সকাল হল, ইরানন দেখল, সূর্যের আলোয় উনাইয়ের ডোমগুলোয় সোনালি ঝিলিক নেই আইরার মতো। ভারি ফ্যাকাশে রঙ ধরেছে তারা। দেখল, উনাইয়ের লোকজন নেশা করে করে কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে। আইরার মানুষদের মতো উচ্ছলতা এতটুকু নেই তাদের; কিন্তু তবু, আগের রাতের সেই আদরযত্নের কথা ভেবে সেইখানেই সে থেকে গেল কিছু দিনের জন্য। রমনডও রয়ে গেল তার সঙ্গে। উনাইয়ের রাত্রিবেলার আমোদের জীবন তার ভালো লেগে গিয়েছিল খুব। উনাইয়ের মানুষজনের মতো সে-ও তখন চুলে গোলাপের মালা জড়ায়। 

রাতে উনাইয়ের পথে পথে ইরানন মাঝেমাঝেই ফুর্তিবাজ লোকজনকে তার গান শোনাত। তার মাথায় পাহাড়ি লতার মুকুট, গানে আইরার মর্মর পাথরের পথ আর হায়ালিন নিথরার স্মৃতি। উনাইয়ের বর্ণময় রাজসভায় গান গেয়েছিল সে। রাজসভার আয়নায় মোড়া মেঝের ওপরে স্ফটিকে গড়া মঞ্চে দাঁড়িয়ে গানে গানে সে আইরার ছবি আঁকত। গান চলতে চলতে একসময় সেই আয়নার গায়ে মানুষজনের ছবি হারিয়ে গিয়ে ফুটে উঠত কত না পুরনো, প্রায় ভুলে যাওয়া ছায়াছবির দল। তখন সভার মানুষজন তার গায়ে ছুড়ে দিত কত না গোলাপের পাপড়ি। গান শুনে উনাইয়ের রাজা ইরাননের শরীরের ছেঁড়াখোঁড়া বেগুনি পোশাকের বদলে দিয়েছিলেন সোনার সুতোর কাজ করা সাটিনের নতুন পোশাক। সবুজ জেড পাথরের আঙটি আর গজদন্তের বালায় সাজিয়ে দিয়েছিলেন তাকে। ফুলকারি করা রেশমের ছাউনি দেওয়া একটা বাড়িতে থাকতেও দিয়েছিলেন। তার ভেতরে সোনার জলের নকশাকাটা খাটে সে ঘুমাত। 

এমনিভাবেই উনাইতে বেশ কিছুদিন ভারি আরামে কাটিয়ে দিল ইরানন। ঠিক কতদিন যে সেখানে থেকেছিল, সে খবর কেউ রাখে না; কিন্তু তরপর একদিন উনাইয়ের রাজা লিরানিয়ার মরুভূমি থেকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এলেন একদল নাচিয়েকে। তাদের সঙ্গে এল দ্রিনেনের গাঢ় চামড়ার একদল বাঁশিওয়ালা। আর তার পর থেকে উনাইয়ের মানুষজনের ছুড়ে দেওয়া গোলাপের নতুন ঠিকানা হলো সেই নাচিয়ে আর বাঁশিওয়ালাদের দল। ইরাননের গান আর তাদের টানে না। ওদিকে টেলোথের সেই ছোট্ট ছেলে রমনড তখন দিনে দিনে উনাইয়ের মানুষজনের মতোই ফুর্তিবাজ আর নেশাখোর হয়ে উঠছিল। তার বিরাট বুড়োটে শরীরে তখন বাসা বেঁধেছে কত না সুখের অসুখ। আর সে স্বপ্ন দেখে না, আর সে ইরাননের গান শুনে আগের মতো আনন্দ পায় না। 

বড় দুঃখ পেয়েছিল ইরানন; কিন্তু তবু, সে তার গান গাওয়া বন্ধ করেনি একদিনের জন্যও। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় সে গানে গানে আগের মতোই তার স্বপ্নের শহর আইরার গল্প শোনায়। 

তারপর একদিন রাতে রেশমি বিছানায় শুয়ে রমনডের বিরাট শরীরটা হঠাং হেঁচকি তুলে কাঁপতে কাঁপতে চিরকালের মতো স্থির হয়ে গেল। ইরানন, সেই আগের মতোই ফিনফিনের পাতলা শরীরটা নিয়ে তখন সেই ঘরের এক কোণে বসে আপনমনে তার গান গেয়ে যাচ্ছিল। 

পরদিন সকালে ইরানন রমনডকে কবর দিল। চোখের জলে ভেসে সে তার কবরকে সাজিয়ে দিল গাছপালার সদ্য কুঁড়ি ধরা ডালপালা দিয়ে। এককালে বড় ভালোবাসত রমনড অমন ডালপালাদের। তাকে কবরে শুইয়ে দিয়ে সে ফিরে এলো তার নকশি রেশমের ছাউনি দেওয়া ঘরে। তারপর শরীর থেকে রাজার দেওয়া সব পোশাক, গয়না খুলে রেখে ফের পরে নিল তার ছেঁড়াখোঁড়া বেগুনি রঙের রেশমি পোশাক। আর তারপর, মাথায় ফের একবার সোনালি লতার নতুন মুকুট পরে নিয়ে, সবার চোখের আড়ালে সে উনাই শহর ছেড়ে ফের পা বাড়াল পাহাড়ের অজানা রাস্তায়। 

অস্তে নামা সূর্যের দিকে মুখ করে হেঁটে চলল ইরানন। ফের একবার নিজের জন্মের সেই শহরের খোঁজে রওনা দিয়েছে সে। ফের একবার পথে নেমেছে সেই মানুষদের খোঁজে, যারা তার গান, তার স্বপ্নদের ভালোবেসে শুনবে কোনোদিন। সিডাথ্রিয়ার কত না শহরে ব্যাজিকের মরুভূমির ওপারের দেশের পথে পথে ধুলোমাখা ছেলেদের দল তার পুরনো দিনের গান আর ছেড়া পোশাক নিয়ে ঠাট্টা করল; কিন্তু তবু ইরানন চিরতরুণ রয়ে গেল। তবুও তার মাথায় সোনালি লতার মুকুট জ্‌বলজ্‌বল করে। তবুও তার গলায় আইরার চিরনতুন গান। সে গানের সুরে সুরে চলে উপচেপড়ে চলে যাওয়া জীবনের স্মৃতি আর আগামী দিনের আশা। 

এমনিভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন সন্ধ্যাবেলা ইরানন এসে হাজির হলো এক ভেড়াওয়ালার কুঁড়েতে। মানুষটা বুড়ো। তার কোঁচকানো চামড়ায় বহুযুগের ময়লা লেগে আছে। চোরাবালি ভরা একটা জলাজমির ওপরে এক টিলার গায়ে সে তার রোগাভোগা ভেড়াদের নিয়ে থাকে। তার কাছে এসে ইরানন ফের একবার জিজ্ঞাসা করল, ‘আইরা নামে মর্মর পাথরে গড়া এক শহর আছে। সেখানে হায়ালিন নিথরা নামের নদী বয়ে যায়। সেখানে ক্রা নদীর প্রপাতরা ইয়াথ গাছে সাজানো অরণ্য আর সবুজ মাঠদের গান শোনায়। সেই শহর কোথায় আছে তুমি জানো?’

তার কথা শুনে ভেড়াওয়ালা অবাক চোখে অনেক্ষণ তাকিয়ে রইল ইরাননের দিকে। যেন বহুদিন আগের প্রায় ভুলে যাওয়া কোনো কথা মনে করবার চেষ্টা করছে সে। ইরাননের মুখটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সে বারবার। ভালো করে চেয়ে দেখে তার মাথার সোনালি লতার উষ্ণীষটিকে। তারপর, অবশেষে মাথা নেড়ে সে বলল, ‘আইরার নাম তো আমি শুনেছি গো বিদেশি। আরও যা যা সব নাম বললে, সেই সবও শুনেছি বইকি। বহুকাল বাদে ফের একবার ওই নামদের শুনতে পেলাম আমি। যখন আমার বয়েস অনেক কম ছিল, সেই সময় এক খেলার সাথীর মুখে আমি শুনেছিলাম আইরার কথা। সে এক ছোট্ট ভিখিরি ছেলে। আশ্চর্য সব স্বপ্ন দেখত সে। চাঁদ, ফুল আর পশ্চিমা বাতাস নিয়ে কত না অদ্ভুত গল্প শোনাত আমায়। আর আমরা ওকে নিয়ে হাসতাম। কেন জানো? ওকে তো আমরা জন্ম থেকে দেখেছি! কিন্তু ওর ধারণা ছিল, ও হলো এক রাজার ছেলে। দেখতে সে তোমার মতোই সুন্দর ছিল; কিন্তু একেবারে ক্ষ্যাপা। তারপর একদিন সে আমাদের গ্রাম ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেল। বলেছিল, যারা তার স্বপ্ন আর গান শুনে খুশি হবে, তেমন মানুষজনের খোঁজে চলেছে সে। কতদিন যে সে আমায় একটা অসম্ভবের দেশের গল্প শুনিয়েছে! আইরা, নিথরা নদী, আর ক্রা নদীর প্রপাত, এমন সব গল্প। সে নাকি সেই দেশের রাজপুত্র ছিল একসময়। ভাবো দেখি! ওর জন্মই তো হলো আমাদের গ্রামে! কেমন করে সে কোনো অচিন শহরের রাজপুত্র হবে? ওসব আইরা, নিথরা ক্রা নদীর প্রপাত, এইসব কিচ্ছু আসলে কোত্থাও নেই। সে ছিল শুধু আমার ছেলেবেলার বন্ধু সেই ইরানন নামের ক্ষ্যাপা ছেলেটার স্বপ্নে। সেই দেশের খোঁজে বেরিয়ে সে যে কোথায় চলে গেছে, তাও কেউ জানে না।’

সেদিন সন্ধ্যাবেলা, ভেড়াওয়ালার কুঁড়ে ছেড়ে বের হয়ে, অন্ধকার টিলার ঢাল বেয়ে নেমে এসে, তার পায়ের নিচে দাঁড়ানো জলার চোরাবালির বুকে পায়ে পায়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল, ছেঁড়াখোঁড়া বেগুনি পোশাক পরা এক বুড়ো। তার মাথার লতাপাতার মুকুট কখন যেন শুকিয়ে গেছে। চোরাবালিতে ডুবে যেতে থাকে তার ঘষা কাচের মতো চোখ দুটি। যেখানে ফুটে ছিল কোনো এক অজানা শহরের অলৌকিক ছবি। যে শহরে স্বপ্নরাই আসলে বাস্তব। 

এবং সেদিন, পুরনো এই দুনিয়াটার অবশিষ্ট যৌবনের, তার অবশিষ্ট রূপের আরও একটা টুকরো মিলিয়ে গিয়েছিল নিরস্তিত্বের সমুদ্রে।  


মুল : এইচপি লাভক্র্যাফট 
ভাষান্তর : মিরন মহিউদ্দীন

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh