বিচার বিভাগ বিতর্কিত হলে, মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২১, ১২:৫৫ পিএম

আমীন আল রশীদ

আমীন আল রশীদ

দুর্নীতি মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে আদালত যেদিন ১১ বছরের কারাদণ্ড দেন, সেদিন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, তার মন খারাপ। কারণ তিনি নিজেও একজন আইনজীবী। পেশাগত কারণে সিনহার সঙ্গে তারও যোগাযোগ ছিল এবং দুর্নীতি মামলায় একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির দণ্ডিত হওয়াটা খুবই দুঃখজনক বলে তিনি মনে করেন।

অনেকে মনে করেন, কেউই যে আইনের ঊর্ধ্বে নন, এস কে সিনহার দণ্ডিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সেটিই প্রমাণিত হয়েছে। তবে এ প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একজন বিচারপতির বিচারের দাবি ওঠে; তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংসদে প্রস্তাব গৃহীত হয়; কোন পরিস্থিতিতে একজন প্রধান বিচারপতিকে দেশছাড়া করা হয় বা তাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয় এবং কেন তাকে বিদেশ গিয়ে ‘ব্রোকেন ড্রিম’ নামে একটি বই লিখতে হলো- যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর সম্পর্কে অত্যন্ত স্পর্শকাতর কথাও রয়েছে। এখানে অপরাধ, আইন ও বিচার বিভাগীয় ইস্যুর বাইরে রাজনীতির ভূমিকাও কি কম? অভিযোগ উঠেছিল, সরকারবিরোধী শক্তিগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে এস কে সিনহা দেশে ‘জুডিসিয়াল ক্যু’ করতে চেয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো, এটিই কি তাহলে তাকে বিচারের মুখোমুখি করার মূল কারণ? একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ শুধু ব্যক্তি কিংবা একজন প্রধান বিচারপতিকেই নয়, পুরো বিচারব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

তবে এটিও অস্বীকার করা যাবে না, দেশে বিচার বিভাগের লোকজন যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি বিতর্কিত ও সমালোচিত হয়েছেন রাজনীতিবিদরা। যারা বিচার বিভাগকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে ক্ষমতাকে আনচ্যালেঞ্জ বা নিরঙ্কুশ রাখতে চান। সামরিক শাসকরাও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে তাদের এই প্রক্রিয়াকে বৈধ করেছেন বিচার বিভাগের কাঁধে বন্দুক রেখেই।

রাজনৈতিক সরকারও বিচার বিভাগকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছে। প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করতে ২০০৪ সালে সংবিধান সংশোধন (চতুর্দশ সংশোধন) করে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা পঁয়ষট্টি থেকে সাতষট্টি বছর করা হয়। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপির উদ্দেশ্য ছিল, ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কে এম হাসানকে নিয়োগ করা হবে এবং তার অধীনে নির্বাচন করে বিএনপি পুনরায় ক্ষমতায় আসবে; কিন্তু তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের বিরোধিতার মুখে বিএনপির সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।

সুতরাং একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির দণ্ডিত হওয়ায় আইনমন্ত্রীর যে মন খারাপ হয়েছে, সেই মন খারাপ আসলে সবারই হয়েছে বা হওয়ার কথা। কারণ মানুষের সবশেষ ভরসার জায়গায় বিচার বিভাগই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাজনীতির মারপ্যাঁচ এবং নানারকম অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। বিচারকদের নিরপেক্ষতা নিয়ে মানুষের মনে সংশয় তৈরি হয়েছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা যে বিচার বিভাগের, সেই প্রতিষ্ঠানটি বার বার এভাবে বিতর্ক বা প্রশ্নের মুখে পড়লে মানুষের দাঁড়ানোর কোনো জায়গা থাকে না। থাকে না বলেই ঘটনা ঘটার ৭২ ঘণ্টা পরে ধর্ষণের মামলা না নেওয়ার বিষয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারক যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, সেটি নিয়ে সারাদেশেই সমালোচনার ঝড় শুরু হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ওই বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়।

যদিও এখানেও কিছু প্রশ্ন সামনে এসেছে যে, কোন প্রক্রিয়ায় একজন বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহার করা হলো? রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলায় যে রায় এবং পর্যবেক্ষণ তিনি দিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্ট সেটি জানলেন কী করে? রায়ের কপি কি তাৎক্ষণিকভাবে সুপ্রিম কোর্টের কাছে পৌঁছেছিল? না-কি সুপ্রিম কোর্ট গণমাধ্যমে প্রচারিত-প্রকাশিত রিপোর্ট দেখে ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? না-কি এই রায় পর্যবেক্ষণের পরে গণমাধ্যম ও সোস্যাল মিডিয়ার প্রতিক্রিয়াগুলো সর্বোচ্চ আদালতের নজরে আনা হয়েছে?

দ্বিতীয়ত, যে যুক্তিতে বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহার করা হলো, সেই একই যুক্তিতে তার রায়টিও বাতিল হওয়া উচিত কি-না? একই যুক্তিতে তার অতীতের সমস্ত রায়ও নতুন করে পর্যালোচনা করার অবকাশ রয়েছে কি-না? বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হলে তিনি আর বিচারক থাকেন কি-না? তাকে বিচারিক কাজের বাইরে অন্য কোনো প্রশাসনিক কাজ দিলেও, সেটি যৌক্তিক হবে কি-না? কারণ প্রধান বিচারপতি তার বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন মানে হলো তিনি যেই কাজের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন, সেটির জন্য যোগ্য নন। তাহলে এখন তাকে অন্য কোনো দায়িত্ব দেওয়া হলে সেটি কীভাবে করবেন?

স্মরণ করা যেতে পারে, কিছু দিন আগে পরীমণিকে পর পর তিন দফায় রিমান্ড দিয়ে সমালোচিত হন ঢাকার মেট্রোপলিটন আদালতের দুই বিচারক। একজন নারীকে পর পর তিন দফায় রিমান্ডে দেওয়ার ঘটনা নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে, এর ব্যাখ্যা দিতে তাদের তলব করেন হাইকোর্ট। নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে দুই বিচারক তাদের ব্যাখ্যায় বলেন, যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে তারা এরকম ভুল করেছেন। তবে ভবিষ্যতে আর এ রকম ভুল তারা আর করবেন না বলে জানান। যদিও প্রথমবারের ব্যাখ্যায় তারা এই ভুলকে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ’ বলে দাবি করেছিলেন; কিন্তু উচ্চ আদালত এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না হয়ে তাদের আবারও ব্যাখ্যা দিতে বলেন। কারণ বিচারকের ভুল সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ বলে গণ্য করার সুযোগ নেই। ভবিষ্যতেও এ রকম আদেশ বা রায় দিয়ে যদি বিচারকরা উচ্চ আদালতে গিয়ে বলেন যে, তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নেই। তাহলে তো সেটা খুব ভয়াবহ ব্যাপার হবে। পক্ষান্তরে, নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পরে আসলেই যদি বিচারকরা যথাযথ প্রশিক্ষণ না পান বা সেই ব্যবস্থাটি যদি পর্যাপ্ত না হয়, তাহলে প্রশ্ন হলো, একজন আইনের ছাত্র যে প্রক্রিয়ায় বিচারকের এজলাসে গিয়ে বসেন, সেই প্রক্রিয়ার কোথাও কোনো গলদ বা ঘাটতি রয়ে গেছে কি-না? যদি থাকে তাহলে সেই গলদ ও ঘাটতি পূরণে রাষ্ট্রের উদ্যোগসমূহ যথাযথ কি-না?

তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, বিচারক এমন কাজ কেন করবেন, যে তাকে ক্ষমা চাইতে হবে কিংবা তার বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নিতে হবে? রিমান্ড কখন, কাকে এবং কোন পরিস্থিতিতে দেওয়া যায় কিংবা ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পরে ধর্ষণ মামলা নেওয়া যাবে না। এই পর্যবেক্ষণ যে আইন, সংবিধান, মানবাধিকার ও নৈতিকতার পরিপন্থি- সেটি না জেনেই তারা কী করে বিচারক হলেন?

আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠানই যেন বিতর্ক বা সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকছে না। রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অঙ্গ আইন বিভাগ বা জাতীয় সংসদে কারা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছেন; তাদের যোগ্যতা কী; তাদের কতজন আসলেই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন; সংসদে তারা দেশ ও মানুষের স্বার্থে কতটুকু সময় ব্যয় করেন আর কতটুকু সময় ব্যক্তিগত ব্যবসা এবং দলের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত থাকেন- তা নিয়ে তো প্রশ্নের শেষ নেই।

তাহলে এর থেকে উত্তরণের উপায় কী? উপায় একটাই, আর তা হলো- নতুন প্রজন্মের হাতে ভবিষ্যৎকে ছেড়ে দেওয়া। তারা বর্তমানের আস্থাহীনতার জায়গাগুলো চিহ্নিত করে সৎ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সত্যিকারের জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলবেন, সেই প্রত্যাশা তো করাই যায়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh