স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২১, ১২:০৫ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় দুই সপ্তাহ ধরে ম্যারাথন আলোচনার পর মতৈক্যে পৌঁছেছেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। বেশ কিছু ছাড় দিয়ে গত ১৩ নভেম্বর যে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে, তাতে থাকছে না কাঙ্ক্ষিত কোনো সুরাহা। গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনের লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
একইসঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির প্রধান উৎস কয়লার ব্যবহার বন্ধ এবং এ খাতে সরকারের ভর্তুকি কমানো। খসড়া চুক্তিতে এগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হলেও, ভারত ও চীনের বিরোধিতার কারণে চূড়ান্ত চুক্তিতে রাখা সম্ভব হয়নি। শেষ সময়ে এসে এ চুক্তিতে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করার পরিবর্তে সীমিত করার কথা যুক্ত করতে হয়েছে। এতে চুক্তিটি আরও দুর্বল হয়েছে।
কয়লার ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ না করে ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমান প্রতিশ্রুতি পূরণ করা সম্ভব হলে বৈশ্বিক উষ্ণতা ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখা যেতে পারে বলে ধারণা পরিবেশবিদদের। ১৩ নভেম্বরের সম্মেলন শেষে আপসমূলক একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে ১৯৭টি দেশ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি বছর প্রায় ৪০ শতাংশ কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী কয়লা। ২০১৫ সালে গৃহীত প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য ছিল বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ শতাংশে কমিয়ে আনা। এ লক্ষ্য পূরণের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন ৪৫ শতাংশ কমাতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শূন্যে নামাতে হবে।
গ্লাসগো চুক্তিতে জরুরিভিত্তিতে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। একইসঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিযোজনের জন্য উন্নত দেশগুলোর প্রতি আরও আর্থিক সহায়তার আহ্বান জানানো হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ২০২৫ সালের মধ্যে অর্থ সহায়তা দ্বিগুণ করার কথা বলা হয়েছে। তবে তা প্রতিশ্রুত তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত করতে যথেষ্ট কি-না, এ নিয়ে সন্দিহান পরিবেশবিদরা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, যদি বৈশ্বিক তাপমাত্রা এর বেশি বৃদ্ধি পায়, তাহলে পৃথিবীতে আরও কয়েক মিলিয়ন মানুষ চরম উষ্ণতার সম্মুখীন হতে পারে।
ভারত ও চীন, দুই বৃহৎ রাষ্ট্রের বিরোধিতার পর শেষ পর্যন্ত দেশগুলো কয়লার ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করার পরিবর্তে পর্যায়ক্রমে ব্যবহার কমিয়ে আনতে সম্মত হয়েছে। তবে এ নিয়ে হতাশ পরিবেশবাদী ও বিশ্লেষকরা।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘আমাদের ভঙ্গুর গ্রহটি একটি সুতোয় ঝুলছে। আমরা এখনো জলবায়ু বিপর্যয়ের দরজায় কড়া নাড়ছি। এখনই জরুরি পদক্ষেপে যাওয়ার সময়। নতুবা বৈশ্বিক তাপমাত্রা শূন্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনা শূন্য হয়ে যাবে।’
সুইস পরিবেশ মন্ত্রী সিমোনেটা সোমারুগা হতাশার সুরে বলেন, ‘আমরা গভীর হতাশা প্রকাশ করছি। কয়লা এবং জীবাশ্ম জ্বালানি ভর্তুকিতে আমরা যে লক্ষ্যে একমত হয়েছিলাম, তা একটি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার ফলে আরও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই চুক্তি আমাদের ১.৫ ডিগ্রির কাছাকাছি নিয়ে আসবে না, বরং এ লক্ষ্য পূরণে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো আরও কঠিন হয়ে যাবে।’
পরিবেশবাদীদের মতে, ‘১.৫ ডিগ্রি’ শব্দটি বলা অর্থহীন, যদি চুক্তিতে এটি অর্জনের কোনো উপায় বা উপাদানের কথা না থাকে। কপ-২৬ দক্ষিণের দেশগুলোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর বলেও আখ্যায়িত করছেন কেউ কেউ।
তারা আরও বলেন, ‘আগামী বছরগুলোতে আরও বেশি কিছু করার আছে। আজকের চুক্তিটি একটি বড় পদক্ষেপ। কয়লার ব্যবহার পর্যায়ক্রমে কমানোর জন্য প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তি এটি এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ করার একটি রোডম্যাপ।’
নিউ ইয়ার্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার জায়গাটি শনাক্ত করলেই ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোনো দেশে মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের হার কত, তা শনাক্ত করা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চলতি বছর বিশ্বে যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়েছে, তার ৭ শতাংশ ভারত একাই নির্গত করেছে। একই পরিমাণ নিঃসরণ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আর যুক্তরাষ্ট্র করেছে ভারতের অর্ধেক নিঃসরণ; কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন অঞ্চল ও যুক্তরাষ্ট্রে যত মানুষ বাস করে, তার তুলনায় ভারতে অনেক বেশি মানুষের বাস এবং অপেক্ষাকৃত দরিদ্রও। ভারতের লাখো মানুষ এখনো নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের হার বিবেচনায় নিলে ভারতের মানুষেরা এখন মাথাপিছু কম কার্বন নিঃসরণ করে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান ও ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চলের একটি বড় অংশজুড়ে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশের বসবাস। অথচ এ দেশগুলোই বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের ৫০ শতাংশের জন্য দায়ী। সম্প্রতি ১৬টি গবেষণা সংস্থা ও পরিবেশগত গোষ্ঠীর তথ্যের ভিত্তিতে ‘দ্য ক্লাইমেট ট্রান্সপারেন্সি রিপোর্ট’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ধনী ও উন্নত দেশগুলোর জোট জি-২০-এর সদস্যদের মধ্যে এ বছর কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন ৪ শতাংশ বাড়বে। গত বছর করোনা মহামারির কারণে এই হার ৬ শতাংশ কমেছিল। ওই প্রতিবেদনে জি-২০ দেশগুলোতে কয়লার ব্যবহার এ বছর ৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। চীন, ভারত ও আর্জেন্টিনা তাদের ২০১৯ সালের কার্বন নির্গমন মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে। এ ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য দায়ী থাকবে চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতেও কয়লার ব্যবহার বাড়ছে। বেড়েছে কয়লার দামও। গত বছরের তুলনায় যা ২০০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জি-২০ দেশগুলোতে গ্যাসের ব্যবহার ১২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
করোনাকালের ধাক্কা সামলে উঠতে সবুজ অর্থনীতির (গ্রিন ইকোনমি) দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বিশ্বনেতারা; কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে তার উল্টো। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যে ১.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ৩০০ বিলিয়ন ডলার সবুজ প্রকল্পের জন্য রাখা হয়েছে। ১৭০ বছর ধরে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে দেশগুলো। এ সময়ের মধ্যে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে বেড়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। ফলে বিশ্বে ঘটছে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ, বন্যা, খরা ও দাবানলের ঘটনা।
সামনের দিনগুলোতে জলবায়ু সংকট আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হবে বলে আশঙ্কা বিজ্ঞানী ও পরিবেশবাদীদের।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে বিশ্বের প্রায় দুইশ’ দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের অংশ গ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় এই সম্মেলন। বিশ্বকে রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে সম্মেলন স্থলের সামনে জড়ো হন গ্রেটা থানবার্গসহ বহু পরিবেশবাদী ও সচেতন মানুষ। বিক্ষোভে অংশ নিয়ে গ্রেটা বলেন, ‘এখন এই বিষয়টি আর গোপন নেই যে, কপ-২৬ ব্যর্থ। এটা সত্য, যেভাবে আমরা সংকটে পড়েছি, সেভাবে এর সমাধান সম্ভব নয়। যত দ্রুত সম্ভব বার্ষিক নির্গমন এমন মাত্রায় নামানো প্রয়োজন, যা আগে কখনো হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবী সত্যিই অপ্রত্যাশিতভাবে জ্বলছে। আর এ সময়ে আমাদের ক্ষমতাসীন নেতারা নগ্ন হয়ে পড়েছেন।’