ভারতে কৃষক জাগরণের বিজয় বার্তা

সাইফুল হক

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২১, ০৩:০৮ পিএম

সাইফুল হক

সাইফুল হক

ভারতে এক বছর ধরে চলা অভূতপূর্ব কৃষক আন্দোলন- কৃষক জাগরণের প্রাথমিক বিজয় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আন্দোলনরত কৃষক ও ভারতের জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে কৃষি ও কৃষকবিরোধী বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেবার ঘোষণা দিয়েছেন। ভারত স্বাধীন হবার পর কৃষক-জনতার আন্দোলনের এটা গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য সন্দেহ নেই। মোদি আন্দোলনরত কৃষকদের এবার ঘরে ফিরে যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন। 

কিন্তু আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদানকারী সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃবৃন্দ ইতিমধ্যে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, ভারতের আইনসভায় কৃষকবিরোধী আইনসমূহ পুরোপুরি প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তারা তাদের অবস্থান-অবরোধ অব্যাহত রাখবেন। তারা মোদির ঘোষণায় আশ্বস্ত হতে পারছেন না। মোদি সরকার শেষ পর্যন্ত তাদের ওয়াদা রাখে কিনা তাও তারা দেখতে চান। কৃষি পণ্যের ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণসহ (এমএসপি) কৃষক আন্দোলনের আরও কিছু জরুরি দাবি সরকার তথা পার্লামেন্টের কাছে তারা তুলে ধরার পরিকল্পনা করছেন। এই আন্দোলনে যে ৭০০ মানুষ শহীদ হয়েছেন, জীবন বিসর্জন দিয়েছেন তাদের পরিবারসমূহের পুনর্বাসনের দায়ও তো সরকারের রয়েছে। এসব নিয়েও তারা নিশ্চয় কথা বলবেন। তেলেঙ্গানা রাজ্য সরকার এরই মধ্যে প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে তিন লাখ রুপি করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। দাবির মধ্যে রয়েছে উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর খেরীতে মন্ত্রীর গাড়িবহরের নিচে চাপা দিয়ে কৃষক হত্যার বিচার, প্রতিমন্ত্রীকে অপসারণসহ নানা জরুরি দাবি। 

গত বছর বিশেষ কোনো আলোচনা ছাড়া ভারতের লোকসভায় খানিকটা আকস্মিকভাবে হাত তুলে ও পরে তড়িঘড়ি করে রাজ্যসভায় কৃষি সংক্রান্ত তিন আইন পাস করে নেবার পর ২৬ নভেম্বর থেকে কৃষকরা, বিশেষ করে পাঞ্জাবের কৃষকদের এই প্রতিবাদী আন্দোলন-অবস্থানের সূত্রপাত। পর্যায়ক্রমে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় হরিয়ানা, হিমাচল, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রসহ প্রায় গোটা ভারতের কৃষকরা। প্রবল শীত, বৃষ্টি, করোনা মহামারি দুর্যোগ নানা বৈরী পরিবেশ মোকাবেলা করে জানবাজি এক লড়াইয়ে শামিল হয় লাখ লাখ কৃষক-জনতা; তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে যায় কোটি কোটি মানুষ। লাখো কৃষকের অভিযান দিল্লির লালকেল্লা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। রাজধানী দিল্লির চারপাশে তারা অবস্থান-অবরোধ গড়ে তোলে। সিংঘু, টিক্কর, গাজীপুরের মতো দিল্লির সীমান্তবর্তী এলাকাসমূহ হয়ে ওঠে কৃষকদের অবস্থান-অবরোধের বিরাট বিরাট ঘাঁটি।

শত শত তাঁবু গেড়ে এখানেই মাসের পর মাস থাকা-খাওয়া। পাঞ্জাব-হরিয়ানার মতো রাজ্যগুলোতে পুরুষেরা যখন আন্দোলনের কাফেলায়, নারীরা তখন ঘর-গৃহস্থালী আর ফসলের মাঠ সামাল দিয়েছে। আবার ফসল তোলার বিশেষ বিশেষ সময়ে পুরুষদের যখন বাড়ি যেতে হয়েছে, নারীরা তখন এসে আন্দোলনে, অবস্থান-অবরোধে শামিল হয়েছে। ভারতের কয়টি রাজ্যের প্রায় সমগ্র জনগোষ্ঠী, গোটা পরিবার ছিল আন্দোলনে সমর্পিত, ঘর আর বাহির ছিল একাকার। ভারতবর্ষ, গোটা দুনিয়া এরকম দৃশ্য বেশি দেখেনি। কৃষক আন্দোলনে এ এক বিরল ঘটনা।

শুরু থেকেই এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকার ছিল খড়গহস্ত। কৃষকদের দিল্লি অভিযানে সরকারি বাহিনী নির্যাতন-নিপীড়নের কমতি রাখেনি। লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস, জলকামান, অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা-কোনো কিছুই তারা বাদ রাখেনি। রাস্তা কেটে, রাস্তায় পেরেক বসিয়ে কৃষকদের শোভাযাত্রায় তারা নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। 

 বার কয়েক সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে তাদের আলাপ আলোচনা হয়েছে। আলোচনা চলাকালে আত্মমর্যাদা বজায় রেখে সরকারি খাবারও তারা স্পর্শ করেননি। আর আলোচনার পেছনে ছিল নানা ধরনের চাপ, হুমকি, প্রলোভন, প্রতারণার বহুরকম কৌশল। ছিল এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে বহুমাত্রিক অপপ্রচার। আন্দোলনকারীদের দেশদ্রোহী, স্বাধীন খালিস্থানপন্থী, জেহাদি, আন্দোলনকারীরা কৃষকবেশী পাকিস্তানি, আন্দোলনজীবী, নকশাল প্রভৃতি কত বিশেষণেই না অভিহিত করা হয়েছে! আন্দোলনে ভাগ-বিভাজন তৈরি করা, আন্দোলন সম্পর্কে হতাশা ছড়ানো, সাম্প্রদায়িক আর জাতিগত উস্কানি কোনো কিছুই বিজেপি আর মোদি সরকার বাকি রাখেনি। 

কিন্তু কিছুই কৃষকদের পরাভূত করতে পারেনি, তাদের বজ্রকঠিন ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারেনি। কারণ লড়াইটা তাদের অস্তিত্বের, তাদের জীবন-জীবিকা রক্ষার। এ জন্য প্রয়োজন ছিল তাদের মরিয়া লড়াইয়ের। কৃষকেরা বুঝেছেন, কৃষিপণ্য সরকার না কিনে যদি করপোরেটদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে ন্যূনতম মূল্য সহায়তা থেকে তারা বঞ্চিত হবেন; কৃষি বাণিজ্যে করপোরেট সংস্থাসমূহ ঢুকে গেলে খাদ্যশস্য মজুদের কোনো ঊর্ধ্বসীমা থাকবে না এবং খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা চলে যাবে ব্যবসায়ী করপোরেটদের কাছে এবং এই পরিস্থিতিতে ভারতের কৃষি ও কৃষক নানাভাবে বিপর্যস্ত হবে।

সন্দেহ নেই শিখ ধর্মগুরু নানকের জন্ম বার্ষিকীতে ভারতের কৃষিবিরোধী তিন আইন প্রত্যাহারের ঘোষণায় রাজনৈতিক সমীকরণটাও খুব অস্পষ্ট নয়। আগামী বছরের শুরুর দিক থেকে উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, উত্তরাখণ্ড, মণিপুর, গোয়ায় বিধান সভার যেসব গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন, তাতে বিজেপির সম্ভাব্য ধস ঠেকানো, বিশেষ করে উত্তরপ্রদেশ থেকে যাতে বিজেপিকে পাততাড়ি গুটাতে না হয়, সেজন্য মোদিকে তার দাম্ভিকতা ভুলে করজোড়ে নতি স্বীকার করতে হয়েছে। এই ঘটনার সমগ্র তাৎপর্য বুঝতে হয়তো আরও কিছু সময় লাগবে। 

কৃষক-জনতার এই প্রতিরোধ বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকারকে ইতিমধ্যে ভারতজুড়ে বিভিন্ন দিক থেকে কড়া বার্তা দিয়েছে, তাদের বেপরোয়া পদক্ষেপে অনেকটা লাগাম দিয়েছে। এখন বিভেদ আর বিভাজন সৃষ্টিকারী এন আর সি বা নাগরিকপঞ্জির মতো চরম অগণতান্ত্রিক, বৈষম্যমূলক, সাম্প্রদায়িক ও ভারতের সংবিধান পরিপন্থী আইনসমূহ প্রত্যাহার করে নেবার আন্দোলন নিশ্চয় নতুন গতি পাবে। 

কৃষক আন্দোলনের এই বিজয় ভারতের বামপন্থী প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিরও এক বড় বিজয়। এই আন্দোলনের শুরু থেকে শেষঅবধি তারা এই আন্দোলনে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের আপোষহীন ভূমিকাও এই বিজয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। 

ভারতের ট্রেড ইউনিয়নসহ শত ধরনের সংগঠন কৃষক-কৃষাণীর এই ঐতিহাসিক কাফেলায় নিজেদেরকে যুক্ত করেছিলেন। এই আন্দোলন যে এখন ভারতজুড়ে অসংখ্য শ্রেণি ও গণসংগ্রামের উৎসমুখ খুলে দেবে, মেহনতি জনগণের আত্মবিশ্বাস ও সাহস বাড়িয়ে দেবে তা অনুমান করা কঠিন নয়। কৃষক আন্দোলনের এই বিজয় গোটা ভারতজুড়ে চরম হিন্দুত্ববাদী আর নিষ্ঠুর বিজেপির শাসনের জয়রথকে পিছু হঠাতেও বরফভাঙার কাজ করবে। কৃষকেরা আরও একবার প্রমাণ করল রাষ্ট্রশক্তি আর শাসকদের দম্ভ আর অহমিকা নয়, জনগণ আর জনগণের আকাঙ্ক্ষা আর তাদের সম্মিলিত প্রতিরোধের শক্তিই হচ্ছে শেষ পর্যন্ত নির্ধারক শক্তি।


সাইফুল হক
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশের বিপ্লবী 
ওয়ার্কার্স পার্টি

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh