প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরের ফারাক

গৌতম দাস

প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:১২ এএম

গৌতম দাস

গৌতম দাস

ইতিহাস পড়ার অনেক পদ্ধতি ইহতে পারে। এর মধ্যে একটা হলো, কোনো বিষয়ে আগে-পরের পার্থক্য জেনে পড়া। যেমন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে আর পরে এর মধ্যে পার্থক্য কী দেখা দিয়েছিল? আগে কী কী ছিল, পরে পরে যা আর থাকে নাই- এমনই বিষয়ে কিছু কথা বলব।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল ১৯১৪-১৮। সেসময়ের বাণিজ্য ব্যবস্থা কেমন ও তা কতদূর বিকশিত হয়েছিল; এ ছাড়া বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পড়ে এর হাল কী হয়েছিল? এ নিয়ে সবার আগের কথাটা হলো, ১৯১৪ সালের আগে পর্যন্ত গ্লোবাল আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্যের কথা যদি বলি, এটা নিজেই তেমন বিকশিত ছিল না। কেন? 

প্রথমত, এটা যুদ্ধের আগের পরিস্থিতিতেই সারা ইউরোপের সমস্যা। তাই এটা ঠিক বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরে বলে নয়। বরং আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য নিজেই ছিল অবিকশিত। এর পেছনের মূল কারণ ‘কলোনি ব্যবস্থা’। অর্থাৎ ইউরোপজুড়ে একটা ক্যাপিটালিজম বিকশিত হয়েছিল ঠিকই; কিন্তু তা ‘কলোনি ক্যাপিটালিজম’। এটা কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণভাবে বিকশিত ক্যাপিটালিজম নয়, এমন কি তা বিদেশের সঙ্গে ব্যবসা করেও নয়। এটা এশিয়া, আফ্রিকা বা ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোকে কলোনি দখল করে সেই বেপরোয়া লুটে আনা সম্পদ সংগ্রহে হাজির করা ‘কলোনি ক্যাপিটালিজম’। 

আমরা যদি ১৬০৭ সালের পর থেকে বিচার করি মানে যখন থেকে সংগঠিত কলোনি দখল ব্যবসা একেবারে কোম্পানি খুলে তাতে বিনিয়োগ ঢেলে অর্থনীতির প্রধান খাত হিসেবে শুরু হয়েছিল তখন থেকে পরের প্রায় তিনশ বছর এই সময়কালকে কলোনি যুগ বলতে পারি। 

তবু এ সময়ের শুরুতে ধরে নেওয়া যায় যে, কোয়ালিটি স্টিল ও যুদ্ধজাহাজ তৈরির জ্ঞানবুদ্ধি আবিষ্কার ততদিনে চালু ও সহজপ্রাপ্য হয়ে গেছে। এককথায় ততদিনে ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী বিনিয়োগের ব্যবস্থা দাঁড়িয়েও গেছে জাহাজ বহর কিনে চারদিকে কলোনি দখল করতে বেরিয়েপড়া।

পরের তিন-সাড়ে তিনশ’ বছর ইউরোপ এইভাবেই কলোনি দখল ব্যবসায় লিপ্ত থেকেই কাটিয়েছিল। তবে তাতে এমন দখলদার কোম্পানিগুলোর পরস্পরের মধ্যে লড়াই প্রতিযোগিতার ফলে কেবল যতটুকু যা পরিবর্তন এসেছিল। যেমন প্রথমত, কোম্পানিগুলোর লড়াই ও প্রতিযোগিতা আর শেষে তা আর কোম্পানিগুলোর মধ্যে না থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে লড়াই ও প্রতিযোগিতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর তাতে একেকটা দেশ একেকটা মহাদেশে শক্তিশালী ফোকাস করে নিজেকে গড়ে নিয়েছিল। যেমন প্রথমে কলোনি দখলদার দেশের সংখ্যা সীমিত হয়ে যায় কেবল ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, ডাচ, পর্তুগিজ ও স্প্যানিস এই পাঁচ রাষ্ট্রের মধ্যে। তাও আবার তাদের লড়াই ও প্রতিযোগিতায়ও মহাদেশে ভাগ হয়ে যায়। যেমন, পর্তুগিজ ও স্প্যানিস কলোনি দখলদার কোম্পানি নিজেদের নিবদ্ধ করে কেবল ল্যাটিন আমেরিকার মধ্যে। আর এদিকে এশিয়া ও আফ্রিকায় ব্রিটিশ আর ফরাসি কলোনি দখলদার কোম্পানিগুলো নিজেদের নিবদ্ধ করেছিল। আর ডাচ কোম্পানি নিজেদের জড়ো করেছিল ইস্ট এশিয়ায়।

কলোনি দখলদারী যুগ শুরু হবার আগে, মানে মোটামুটি ১৬০৭ সালের আগের দুনিয়ায় দেশ-রাষ্ট্রগুলো পরস্পর পরস্পরকে তেমন চিনত না। অন্য ভাষায় বললে, বিনিময় বাণিজ্য-সম্পর্ক অনেক দূরের কথা ছিল। ফলে কলোনি দখলদারী শুরু হলে এর মাধ্যমে এই প্রথম তাদের মধ্যে যোগাযোগ তবে সেটা এক কলোনি-সম্পর্ক, তৈরি হয়। কিন্তু আজকের দিনের মতো আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য বলতে যা বুঝায়, সেটা কখনই তৈরি হয়নি। কেন?

মূল কারণ, সম্পর্কটা যেখানে লুটের সেখানে দেশ-রাষ্ট্রের পরস্পরের মধ্যে কোনো আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য সম্পর্ক হতে পারে না। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটা এক পক্ষীয়। আর যেটা হলো, কলোনিকৃত দেশ থেকে সম্পদ ও পুঁজি-পণ্য পাচার (উদ্বৃত্ত সঞ্চয় বা সারপ্লাস পাচার)। ফলে এটা ঠিক বাণিজ্য না, তবে সম্পদ পাচারের সম্পর্ক।

এখানে একটা মজার অবজারভেশনের কথা বলা যায়। কোনো কমিউনিস্ট চোখ কখনো বাণিজ্য নিয়ে বুঝাবুঝিতে আগ্রহী নয়। বরং যা নিয়ে সে আগ্রহী তা হলো, উদ্বৃত্ত সঞ্চয় বা সারপ্লাস পাচার নিয়ে। আসলে সে নিশ্চিতভাবে বলতেও পারে না যে বাণিজ্য করা কী হারাম, না হালাল বলবে। ব্যবসা বা মুনাফা করা নিয়েও তাদের একই দ্বিধা। তবে মুনাফা নিয়ে সম্ভবত তারা প্রায় নিশ্চিত যে, এটা প্রায় সারপ্লাস চুরি করার মতো। তাই সামগ্রিকভাবে বাণিজ্য জিনিসটা তাদের চোখে অননুমোদিত বা অনাগ্রহের বিষয় হয়ে আজও থেকে গেছে। অথচ দেশ-রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য মানেই তো পণ্য বিনিময় লেনদেন এবং সব ধরনের বিনিময় ভাষা, ভাব-ভালোবাসাসহ সবকিছুর বিনিময়ের শুরু এখান থেকেই। আর সর্বোপরি এটাই সবচেয়ে দক্ষ, মানে কম শ্রম খাটিয়ে নানান পণ্য পাবার পথের উপযুক্ত ও একমাত্র উপায়; কিন্তু বাণিজ্য নিয়ে নিশ্চুপ থাকলে এর কোনো সম্ভাবনা নাই। তবে সার কথাটা হলো, কলোনি যুগের প্রায় ৩০০ বছরে আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য সম্পর্ক দুনিয়ায় তেমন বিস্তৃত হতে পারে নাই, মূলত সেটা কলোনি যুগ বা একপক্ষীয় সম্পর্কের কারণে। তবুও একটা খুবই সীমিত পণ্য-বিনিময় চালু ছিল। যদিও তা আবার কেবল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত কার্যকর ছিল।

কীভাবে তা বোঝা গেল? এর ভালো প্রমাণ আছে কী? হ্যাঁ আছে। ‘রথশিল্ড ব্যাংক’। এটা মূলত জার্মানির এক পারিবারিক মালিকানাধীন ব্যাংক, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ময়োর আমশেল রথশিল্ড (Mayer Amschel Rothschild) যার জীবনকাল (1744-1812)। তিনি ইউরোপের অন্তত পাঁচ বড় শহরে তার সন্তানদের দিয়ে ব্যাংকের শাখা পরিচালিত করতেন। আর জর্মানিতে নিজে বসে সেগুলোর সমন্বয় করে আসলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইউরোপের একমাত্র প্রধান মুদ্রাগুলোর মধ্যে এক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা; কিন্তু সীমিত পণ্য-বিনিময় বা সীমিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু থাকার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী?

মূল সম্পর্কটা হলো, মুদ্রা মানেই কোনো দেশ-রাষ্ট্রেরই মুদ্রা। দেশের ভেতরে বিনিময় ওই একই মুদ্রার মাধ্যমে ঘটে থাকে, আর তা সহজ; কিন্তু আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য বিনিময় হতে হলে তা কোনো এক দেশীয় মুদ্রায় সম্ভব না। সেক্ষেত্রে সবার আগে মুদ্রাগুলোর মধ্যে ‘বিনিময় যোগ্যতা’ থাকতে হয়। আর বিনিময় যোগ্য হওয়া মানে তাদের ‘বিনিময় হার’ জানতে হয়; বা বলা যায় সাব্যস্ত হতে হয়। যার সোজা মানে হলো, কেউ বিনিময় হার সাব্যস্ত করে দিতেই পারে, কিন্তু তিনি বিশ্বাসযোগ্য ও আস্থার হতে হবে।

ঠিক যেমন মুদ্রা মানেই আস্থা, বিশ্বাস। যেমন আমাকে কেউ একটা ১০০ টাকার নোট দিলে, যদি আমি নিশ্চিত হই সেই নোটটা অন্যকে দিলে অনায়াসে এটাকে ১০০ টাকার নোট বলে গ্রহণ করবে- তাহলে আমি তা নেব। ঠিক যেমন যদি রটে যায় যে একশ টাকার নোট ব্যাপক নকল হচ্ছে, তাহলে ব্যাংক থেকে আসা নয়া নোটও বাজারের কেউ আর নিতে চাইবে না।

সেকালে ইউরোপের এই আস্থাভাজন বিশ্বস্ত লোকটি ছিলেন আমশেল রথশিল্ড। প্রতিদিন সকালে তিনি ওই দিনের ইউরোপের প্রধান মুদ্রাগুলোর বিনিময় হার টানিয়ে দিতেন। সেটা কী কাজে লাগত? কেউ ধরা যাক জার্মানি থেকে ইংল্যান্ডে কোনো পণ্য কিনে তার দেশে গিয়ে বিক্রির ব্যবসায়ী। তাহলে তিনি বিনিময় হার জেনে সেই পণ্যের পাউন্ডে দামের তুল্য পরিমাণ জার্মান মার্ক পরিশোধ করে কিনতে পারতেন। বিনিময় হার জানা থাকাতে এই বিনিময় সহজেই সম্ভব হতো।

কিন্তু রথশিল্ড নিজে জানতেন কীভাবে যে আজকের বিনিময় হার কী হবে? তার পদ্ধতি ছিল সোজা। প্রতিদিন সকালে তিনি খবর নিতেন গত দিনে ধরা যাক পাউন্ডে মোট কেনার চেয়ে বিক্রি কত কম/বেশি হয়েছে। বিক্রি বেশি হওয়ার অর্থ হলো, তাহলে অন্য দেশের বেশি সোনা ইংল্যান্ডে এসে ঢুকেছে। তাই এটা পরদিন সমান করতে গেলে সেদিন পাউন্ডের রেট কমাতে হবে। যার অর্থ বিক্রি কমাতে হবে। অর্থাৎ পরদিন হার সমান করতে হবে। এখন কতটা কমাবেন বা বাড়াবেন এটা অভিজ্ঞতা দিয়ে নির্ধারণ করে নিতেন। আর তাঁর পাঁচ ছেলের কাজ ছিল ওসব দেশের মুদ্রার হার নিয়ে একই খবরা খবর পিতার সঙ্গে দেয়া-নেয়া করা। এভাবে একটা আস্থা-বিশ্বাসের ওপর মানে রথশিল্ডের ভরসায় সীমিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য সেকালে চালু ছিল।

কিন্তু ১৯১৪ এর পর থেকে এই ব্যবস্থাটাও আর টিকে থাকতে পারেনি। যদিও পেছনের কারণ যুদ্ধ-বিশৃঙ্খলা ঠিক তা নয়। মূল কারণ, মুদ্রাস্ফীতি। অর্থাৎ যুদ্ধে খরচ যোগাতে বা মিটাতে গিয়ে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করেছিল। যে কারণে, নিজ দেশেই সোনা ভল্টে রেখে সমপরিমাণ নোট ছাপানোর রেওয়াজ বজায় থাকেনি, এটাকেই ‘গোল্ড ব্যাকড কারেন্সি’ বলে তা বজায় থাকেনি। পরিণতিতে ‘গোল্ড ব্যাকড কারেন্সি’ ব্যবস্থার ওপর দাঁড়ানো মুদ্রা বিনিময় হার নির্ণয়ের রথশিল্ডের ব্যবস্থাটাও আস্থা-বিশ্বাস হারিয়ে অকেজো হয়ে গেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও পরে এটা আর কখনো কার্যকর হয়নি। বরং কলোনি ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ায় আর ইউরোপের প্রবল অনুরোধে আমেরিকার নেতৃত্বে রথশিল্ডের কাজটিই আরও ব্যাপকভাবে করতে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠান গড়ে নেওয়া হয় ব্রেটেনহুড সম্মেলনে ১৯৪৪ সালে। দুনিয়ায় গ্লোবাল আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্যের শুরু হয় তখন থেকে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংককে কেন্দ্র করে।


লেখক- রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh