ক্রিকেট ছাড়া একবিন্দুও ভাবতে পারি না : জাহানারা

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০২:১৮ পিএম | আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০২:২৭ পিএম

জাহানারা আলম

জাহানারা আলম

জাহানারা আলম। বাংলাদেশ মহিলা জাতীয় ক্রিকেটের দলনেতা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও খুব পরিচিত নাম। দেশমাতৃকার মুখ উজ্জ্বল করেছেন তার কাজের মধ্য দিয়ে। নিজস্ব অর্জনও কম নয়।

ডানহাতি এই মিডিয়াম ফাস্ট বোলার এবং ব্যাটসম্যান তার ব্যক্তিগত এবং ক্যারিয়ারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন মাহমুদ সালেহীন খানের সঙ্গে। 

করোনাকাল কীভাবে কাটছে?

আর ১০ জন মানুষের মতোই কাটছে। তবে আমি যেহেতু ক্রিকেট খেলোয়াড়, কিছু কিছু বিষয় আমার জন্য ভিন্ন; যদি লকডাউন থাকে তাহলে বাড়ির মধ্যেই কিছু ওয়ার্ক আউট করি। নিজের ফিটনেস ধরে রাখার জন্য বাসায় ব্যায়াম করি। করোনার মধ্যেও সাড়ে তিন মাস আমাদের ক্যাম্প হয়েছিল। লকডাউন না থাকলে মাঠে অনুশীলন করি এবং বাইরে গিয়ে জিম করি। যে কোনো মুহূর্তে খেলা হতে পারে। তাই নিজেকে সবসময় প্রস্তুত রাখার চেষ্টা করি। আমি মনে করি, ব্যায়াম করলে শরীর ও মন দুটিই ভালো থাকে। বাসার টুকটাক কাজ করি। এভাবেই কাটছে করোনাকাল।

গত দেড় বছরে আপনার অভিজ্ঞতা কী?

এই সময়টাতে আমি অনেক কিছু বুঝতে পেরেছি। সারাপৃথিবী বদলে গেছে। অনেক কিছুই ঘটছে, যার নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে নেই। এই সময়ে আমাদের সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করলে দেখবেন, ভালো থাকা যায়। আমরা সচরাচর নানারকম ব্যস্ততায় পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারি না; কিন্তু এই সময়টিতে আমরা পরিবারকে সময় দিচ্ছি। এটি কিন্তু একটি ইতিবাচক দিক। গত দেড় বছরে আমি দুবাইতে দ্বিতীয়বারের মতো আইপিএল খেলেছি। এটি আমার জন্য একটি বড় সুযোগ ছিল। আমি ক্রিকেট ছাড়া একবিন্দুও ভাবতে পারি না। এখন খেলা নেই; কিন্তু এই লম্বা সময়ে নিজের সেরাটা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ক্রিকেট তো ধৈর্যের খেলা, মনোসংযোগের খেলা। সেক্ষেত্রে আমি বলব, করোনাকাল আমাকে ধৈর্য্য বাড়াতে দারুণভাবে সহায়তা করেছে। এখন পর্যন্ত আমি সুস্থ আছি। ভবিষ্যতেও সুস্থ থাকব আশা রাখি। এই দুঃসময়ে আরেকটা বিষয় উপলব্ধি হয়েছে, নিজের সামর্থ্যর মধ্যে যেন সবাইকে নিয়ে ভালো থাকা যায়, সেই চেষ্টাটি করতে হবে। 

আপনার ছেলেবেলার কথা শুনতে চাই

আর ১০ জন ছেলেমেয়ের মতো আমার কিশোরবেলা ছিল না। আমার সময়টা শুধু খেলার মধ্যেই কেটেছে। আমার যখন নয় বছর, তখন থেকেই আমি খেলাধুলার সঙ্গে জড়িয়ে যাই। হ্যান্ডবল ভলিবলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। আমি আন্তঃস্কুল, আন্তঃজেলা ও খুলনা বিভাগের হয়ে খেলি। পরে আমি ফুটবলও খেলি। ২০০৭ এ আমার ১৪ বছর বয়সে ক্রিকেট খেলায় যুক্ত হই। 

ছোটবেলায় কী স্বপ্ন দেখতেন?

সেভাবে কোনো স্বপ্ন দেখার কথা মনে নেই। আমার আত্মীয়দের বাচ্চাদের শুনি কেউ বলে আমি ডাক্তার হবো, ইঞ্জিনিয়ার হবো। আমার এমন কোনো স্বপ্ন ছিল না। তবে আমি এখন অনেক বড় স্বপ্ন দেখি। আর তা হলো বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে একটি উঁচু জায়গায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। অনেক বড় ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন দেখি। 

আপনার পরিবারের কেউ খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত ছিল কি?

আমার পরিবারের কেউ খেলাধুলায় যুক্ত ছিল না; কিন্তু আমি শুরু করার পর আমার ইমিডিয়েট ছোট বোন শুরু করেছিল। পরে সে লেখাপড়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। 

ক্যারিয়ারের এত কিছু থাকতে খেলার প্রতি আগ্রহ জন্মাল কেন?

ছোট থেকে কী হবো না হবো সে স্বপ্ন দেখিনি। আমি খুলনা পাইওনিয়ার গার্লস হাইস্কুলে পড়তাম। আমাদের স্কুল খেলার জন্য বিখ্যাত ছিল। টিফিনের সময় দেখতাম বড় আপুরা ভলিবল খেলত। আমি অনুমতি নিয়ে একটু খেলতাম। তখন স্পোর্টস টিচার আমার খেলা পছন্দ করলেন, আর বললেন- তুমি কাল থেকে প্র্যাকটিসে চলে এসো। এভাবেই খেলার জগতে পা রাখা। খেলতে খেলতে খেলার প্রতি আগ্রহ বাড়তে লাগল। এমনকি ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ, ভালোলাগাও জন্মাল একই কারণে। 

আপনার ক্রিকেটার হবার গল্প শুনতে চাই

আইসিসি থেকে সিদ্ধান্ত এলো প্রত্যেকটি টেস্ট ক্রিকেটে ওমেন দল থাকতে হবে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড প্রত্যেক বিভাগকে বলে দিল দল গঠন করার জন্য। আমি যখন স্কুলে যেতাম, ট্রাউজার পরে যেতাম। আমার বিভাগে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এর বিভাগীয় কোচ ছিলেন শেখ সালাহউদ্দিন। তিনি আমাকে নোটিস করেছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, ক্রিকেট খেলব কিনা। আমি রাজি হয়ে গেলাম। তখনো ক্রিকেট আমি বুঝতাম না। ২০০৬ এর দিকে বাংলাদেশ অনেক টেস্ট খেলত। আমি যখন ট্রায়াল দিলাম কিছু পারলাম না। তখন ক্রিকেট খেলা তেমন একটা দেখাও হতো না। আমার কাছে খুব কঠিন মনে হতো। ক্রিকেটের নিয়ম নীতি সম্পর্কে কোনো ধারণাও তখন ছিল না আমার। তারপর তিনি বললেন, তুমি ব্যাট করবে; কিন্তু একমাস পরে আমি পেস বোলার হয়ে গেলাম। যেহেতু আমি ভলিবল হ্যান্ডবল খেলতাম আমার হাতে জোর ছিল। নিজেকে বোলার হিসেবে পরিচিতি করালাম। এভাবেই আমার ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত হওয়া।

প্রথম আন্তর্জাতিক খেলার অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতি কেমন ছিল?

যখন ক্রিকেট খেলা শুরু করি, তখন আমাদের আনঅফিসিয়ালি কাউন্ট হতো। প্রথমে ২০০৮-এ আমি দলে যুক্ত হই এবং হংকংয়ের বিরুদ্ধে খেলি। ওডিআই ম্যাচ ছিল সেটি। এটিই প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ আমার জন্য। ৪৭তম ওভারে আমাকে বোলিংয়ে আনা হয়। আমি আনঅফিসিয়ালি হ্যাটট্রিক করি। বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় বড় করে আমার ছবি ছেপেছিল। দেখে খুব ভালো লেগেছিল। ২০১১ সালে যখন আমরা স্ট্যাটাস পাই, তখন আমাদের ১১ জনের ডেব্যু হয়েছিল। অন্যরকম একটা ভালোলাগা। অফিসিয়ালি সবকিছু কাউন্ট হবে। 

ক্রিকেটে আপনার আদর্শ কে?

মাশরাফি বিন মুর্তজা। 

ক্যারিয়ারে সফলতা ব্যর্থতা সবারই থাকে। সফলতার চাবিকাঠি কী, আর দুঃসময় কীভাবে মোকাবেলা করেন?

সফলতা ব্যর্থতা মিলিয়েই তো মানুষ। সফলতার চাবিকাঠি হচ্ছে, যতবার আমি সফল হয়েছি কঠোর পরিশ্রম ছিল; কিন্তু মনে রাখবেন কঠোর পরিশ্রম করলেও অনেক সময় ব্যর্থতা চলে আসে। এই সময়টিতে আমি মনোবল হারাইনি। পরিশ্রম বাড়িয়ে দিয়েছি। দুঃসময়কে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। এটি মোকাবেলা করে আমি আবার সাফল্যের স্পর্শ পেয়েছি। 

দেশে এবং বাইরে কার কার খেলা ভালো লাগে?

বাইরে তো অনেকের খেলা ভালো লাগে। শচীন টেন্ডুলকার, শোয়েব আখতার, বিরাট কোহলি, ব্রেটলি, গেইল আর অনেক ভালো লাগার নাম রয়েছে। বাংলাদেশে তামিম ভাই, মুশফিক ভাই, রিয়াদ ভাই, সাকিব ভাইয়ের খেলা ভালো লাগে। মাশরাফি ভাইয়ের তো তুলনা নেই। আমাদের ক্রিকেটে যে পাঁচ নক্ষত্র তাদের সবার খেলাই আমার ভালো লাগে। 

আপনি তো আইপিএলও খেলেছেন, ওদের সঙ্গে আমাদের ক্রিকেটের কাঠামোগত কী পার্থক্য রয়েছে?

আইপিএল একটি বড় মাধ্যম। বিশ্বকাপ ক্রিকেট থেকেও ভিন্ন বড় একটি আসর। এখানে শুধু একটি দেশের খেলা নয়; একটি দল বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়দের নিয়ে টিম গঠন করে। খুব বেশি প্রফেশনাল ওরা। ওখান থেকে জাতীয় দলে খেলার জন্য পাইপলাইনে অনেক খেলোয়াড় থাকে। এক বছরে একটি ক্যালেন্ডার থাকে, যা আমাদের দেশে নেই। 

আইপিএলে আরও একটি বড় দিক হচ্ছে, তারা বিদেশি খেলোয়াড়দের সঙ্গে দেশিদের একটি মেলবন্ধন তৈরি করে। বিদেশি খেলোয়াড়দের খেলার অভিজ্ঞতা শেয়ারিং করতে পারে স্থানীয়দের সঙ্গে।

আমাদের দেশের মহিলা ক্রিকেট দলের কোন কোন জায়গায় আরও উন্নতি করতে হবে বলে আপনি মনে করেন?

উন্নতির জায়গা অনেক। সবচেয়ে বড় জায়গা আমি মনে করি আর্থিক দিকটা উন্নতি করা প্রয়োজন। নারী ক্রিকেটারের সংখ্যা অনেক কম। বাবা-মা চান তার মেয়ের একটি নিরাপদ ক্যারিয়ার তৈরি হোক। তার মেয়ে পড়াশোনা করুক, ভালো চাকরি করুক। ভালো জায়গাতে বিয়ে হবে। ক্রিকেটে দিলে তার ভবিষ্যৎ কী হবে না হবে। আর্থিক নিরাপত্তা থাকলে মেয়েদের নিয়ে এসব ভাবনা আর থাকবে না। আমরা আরও অনেকদূর যেতে পারব। 

ক্রিকেটে আপনার সবচেয়ে সুখের এবং কষ্টের কথা জানতে চাই?

২০১৮ সালের এশিয়া কাপ জয় ভারতের বিপক্ষে। এটি আমার কাছে অনেক সুখের একটা স্মৃতি। কারণ এই ম্যাচে শেষে দুই রানের দরকার ছিল, যেটা আমার ব্যাট থেকে এসেছে। আমরা এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। ভারতকে এর আগে আমরা কখনো হারাতে পারিনি। আরও একটি সুখের স্মৃতি হচ্ছে ২০১৮ সালে টোয়েন্টি-২০ ওয়ার্ল্ড কাপ, যেটি ওয়েস্ট ইন্ডিজে হয়েছিল। সেখানে সেরা ১২ তে ছিলাম আমি। কষ্ট লেগেছিল ২০১৪ সালে এশিয়ান গেমস হয়েছিল, সেখানে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে জয় পেয়েছিলাম; কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষে আমরা চার রানে হেরেছি। আমি ননস্ট্রাইকে দাঁড়িয়েছিলাম। রান নিতে পারিনি। ম্যাচ শেষে খুব কেঁদেছিলাম; বাংলাদেশের জন্য স্বর্ণ আনার সুযোগ হাতছাড়া হয়েছিল বলে।

নতুন প্রজন্মের যারা ক্রিকেটার হতে চায় তাদের প্রতি আপনার বার্তা কী থাকবে?

ক্রিকেটার হলে ক্রিকেটকে ভালোবাসতে হবে। প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। টার্গেট রাখতে হবে। টার্গেট ছাড়া কোনো কিছু করা ঠিক না। 

প্রিয় শখ কী? অবসর সময় কীভাবে কাটান?

ছোটবেলায় আমার প্রিয় শখ ছিল মাছ ধরা। এখন বই পড়তে ভালোবাসি। ঘুরতে খুব পছন্দ করি। সিলেট এবং কক্সবাজার আমার খুব প্রিয় জায়গা। আর যতটুকু সময় অবসর পাই, বাসায় থাকি। রান্না করতেও খুব ভালো লাগে। 

পরিবারে কে কে আছেন? খেলাধুলায় পরিবার থেকে কোনো বাধা এসেছিল কি?

আমার বাবা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম আর মা গৃহিণী সালমা বেগম। পাঁচ ভাই বোন মিলে আমাদের পরিবার। আমি সবার বড়।

না, পরিবার থেকে কখনো কোনো বাধা আসেনি। বরং সব সময় উৎসাহ পেয়ে এসেছি। ২০০৮ সালে এসএসসি পরীক্ষার আগে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দল শ্রীলঙ্কায় যাচ্ছিল এশিয়া কাপ খেলতে। বাবার প্রশ্রয়েই সেবার জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়ে পরীক্ষা না দিয়েই দলের সঙ্গে শ্রীলঙ্কায় যাওয়ার সাহস পেয়েছিলাম।

আপনাকে ছোটপর্দায় দেখা গেছে, নিয়মিত হবেন কী?

আমি ক্রিকেট নিয়েই থাকতে চাই। আগেও বলেছি ক্রিকেট ছাড়া একবিন্দু ভাবতে পারি না আমি। নিজের এন্টারটেইনমেন্টের জন্য ছোটপর্দায় কাজ করেছি; কিন্তু সেটি শখের বশে, নিয়মিত হবার জন্য নয়। 

আপনার জীবন দর্শন কী?

যখন যে কাজটি করছি মনোযোগ দিয়ে করা। কাজের ভেতরে ঢুকে যাওয়া। যখন আমি ক্রিকেটার তখন আমার শতভাগ মনোযোগ থাকে ক্রিকেটের প্রতি। যখন আমি রান্না করি, তখন রান্নাটাই আমার মূল কেন্দ্রবিন্দু। আবার যখন আমি ফটোশুট করি তখন চেষ্টা করি, পুরো ধ্যানজ্ঞান এখানে দেওয়ার।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh