জিগমুন্ট ব’ম্যান

সমাজ বিজ্ঞানীরা পরবর্তী প্রজন্মের সামনে একটি আয়না ধরে রেখেছেন

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:৫৭ এএম | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২১, ০১:০৩ এএম

জিগমুন্ট ব’ম্যান

জিগমুন্ট ব’ম্যান

জিগমুন্ট ব’ম্যান ইউরোপের একজন অন্যতম প্রভাবশালী সমাজতত্ত্ববিদ, এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের কোনো অবকাশ নেই। তার প্রগাঢ় সাহিত্যসম্ভার এবং সব মহাদেশ সম্পর্কে বিশদ জ্ঞানের প্রতিফলন মেলে প্রায় ৬০টি বইয়ে। এসব বই তিনি লিখেছেন ১৯৯০ সালে যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর। সেই সময়ে ব’ম্যানের লেখা একটির পর একটি বই ছাপাখানা থেকে বের হতে শুরু করে ত্বরিতগতিতে। 

‘লিকুইড মডারনিটি’ (ক্ষয়িষ্ণু আধুনিকতা) শব্দটির জনক জিগমুন্ট ব’ম্যান। এই দুটি শব্দ আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থা ও জীবনের সমস্ত দিকের রূপান্তরকে বোঝায়। অর্থাৎ, প্রেম, কর্ম, সমাজ, রাজনীতি ও ক্ষমতার নজিরবিহীন রূপান্তর। তার জ্ঞানের পরিধি নৈকট্য থেকে বিশ্বায়ন, রিয়েলিটি টেলিভিশন থেকে হলোকাস্ট এবং ভোক্তাবাদ থেকে সম্প্রদায় ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয়েছে দর্শন ও মনোবিজ্ঞানে।

পোল্যান্ডের পোজনান শহরে এক দরিদ্র ইহুদি পরিবারে ১৯২৫ সালে জন্ম জিগমুন্ট ব’ম্যানের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়। ওই সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ভয়াবহ রূপ নেয় পোল্যান্ডে। সোভিয়েত রাশিয়ার উদ্দেশ্যে ছাড়া শেষ ট্রেনটিতে চেপে দেশত্যাগ করেন ব’ম্যান পরিবার। এভাবেই নিজেদের ভাগ্যকে ভয়ংকর পরিণতি থেকে রক্ষা করেছিলেন তারা। তরুণ বয়সে জিগমুন্ট মার্ক্সবাদী হয়ে ওঠেন। লড়াই করেন রেড আর্মির হয়ে। পোল্যান্ড ফিরে আসার পর নিরাপত্তাবাহিনীতে রাজনৈতিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। সরকারবিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান। এরপর ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কাজ করেন সেনাবাহিনীর গুপ্তচর বিভাগের কর্মী হিসেবে। সময়ের পরিবর্তনে সোভিয়েত কমিউনিজমের প্রতি মোহভঙ্গ হলে পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করেন। ১৯৫৪ সালে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভালোই চলছিল সব কিছু; কিন্তু বিদ্বেষপূর্ণ ইহুদিবিরোধী ক্যাম্পেইনে অংশ নেওয়ায় ১৯৬৮ সালে ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরি হারাতে হয়। পাড়ি দেন ইসরায়েলে। যুক্তরাজ্যের অভিবাসী হওয়ার আগের দুই বছর সেখানকার তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করেন ব’ম্যান। 

‘শেয়াল অনেক কিছুই জানে; কিন্তু শজারু জানে কেবল একটি বিশাল জিনিস’- বলেছিলেন গ্রিক কবি আর্চিলোচাস। লাটভিয়ান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সামাজিক ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ইসাইয়া বার্লিনের ভাষ্যে, ব’ম্যান শেয়াল ও শজারু-দুটিই। তিনি বিশদ, পরিসংখ্যান, জরিপ, তথ্য এবং এক্সট্রাপোলেশনের মানুষ নন। বিশাল এক ক্যানভাসে বড় ব্রাশে ছবি আঁকেন ব’ম্যান। বিতর্ককে উসকে দিতে তার জুড়ি নেই। নতুন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় মশগুল থাকতেই অগাধ আনন্দ। মানবিক ও সমাজবিজ্ঞানের খুব কম ক্ষেত্রই আছে, যেখানে জিগমুন্টের কিছু বলার নেই। নিজেই একবার বলেছিলেন, ‘আমার জীবন কাটে তথ্য পুনর্ব্যবহার করে’। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সমালোচনার প্রতি তার আসক্তি বজায় ছিল। বর্তমান পরিস্থিতির ওপর ক্ষোভও আগের মতোই ছিল এ সমাজতাত্ত্বিকের। রসিক ছিলেন। তার সঙ্গে কেউ দেখা করতে বা অতিথি এলে হাস্যরসে মাতিয়ে দিতেন গল্পের আসর। তার লেখা বইগুলোয় এই ব’ম্যানের দেখা মেলে না। লেখক ব’ম্যান যেন অন্য জগতের কেউ। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যেত, বইয়ের বিশাল স্তূপের মধ্যিখানে একটি চেয়ারে বসে তিনি। সামনের কফি টেবিলটিতে অতিথি আপ্যায়নে সাজানো স্ট্রবেরি টার্ট, কুকিজ ও আঙুর। বারবার অতিথিকে বলছেন, পছন্দের খাবারটি তুলে নিতে। ২০১৭ সালের ৯ জানুয়ারি লিডসে নিজ বাাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন ৯২ বছর বয়সী এই প্রখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক। এর আগে ২০১৬ সালে ‘০৩২সি ইস্যু ২৯’ অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত হয় এই প্রাণচ্ছল প্রাজ্ঞ ব্যক্তিটির সাক্ষাৎকার। তার সঙ্গে কথা বলেন সুইস সাংবাদিক পিটার হেইফনার। পাইপ হাতে এক জীর্ণ উইংব্যাক চেয়ারে বসে বেশ সময় নিয়েই হেইফনারের প্রশ্নের উত্তর দেন ব’ম্যান। প্রশ্নগুলো বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জীবন সম্বন্ধে আমাদের সবার মনে রয়েছে অনেক প্রশ্ন। অসীম জীবনবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিটির কথা থেকে জীবন সম্পর্কিত না পাওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর অনুসন্ধান করা যেতেই পারে। 

প্রতিটি মানুষের কাছেই প্রেম এক অপার মহিমা। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশও বটে। খুব কম মানুষেরই সৌভাগ্য হয় ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে এক জীবন পার করে দেওয়ার। সাক্ষাৎকারের শুরুটা হয় প্রেম নিয়ে। 

আপনি বলছেন, কীভাবে ভালোবাসতে হয়, ভুলে যাচ্ছি আমরা। এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন কিসের ভিত্তিতে?

অনলাইন শপিংয়ের সঙ্গে ইন্টারনেটে সঙ্গী খোঁজার প্রবণতাও চলে আসে। ব্যক্তিগতভাবে দোকানে গিয়ে বাজারহাট করতে পছন্দ করি না আমি। অগত্যা বই, ফিল্মস, পোশাক-আশাক-বেশিরভাগ জিনিসই অনলাইনে কিনি। তুমি যদি নতুন জ্যাকেট কিনতে চাও, ভার্চুয়াল স্টোরের ওয়েবসাইট তোমাকে দেখাবে ক্যাটালগ। গ্রাহক ও পণ্যের সম্পর্কের ধরন পৃথক ব্যক্তির মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের ধরন নির্ধারণ করে দেয়।

আগের যুগে গ্রাম্য মেলা, উৎসবমুখর কোনো পরিবেশের মতো জায়গায় সঙ্গীর দেখা মিলত। অতীত ও বর্তমান যুগে সঙ্গী নির্বাচনে পার্থক্যটা ঠিক কোথায়?

অনলাইন ডেটিং সম্ভাব্য সঙ্গীর বৈশিষ্ট্যগুলো সংজ্ঞায়িত করার একটি চেষ্টা। এতে নিজের আকাঙ্ক্ষাগুলোর সর্বোত্তম প্রতিফলন ঘটে। সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় তার শারীরিক গড়ন, বয়স, আগ্রহের জায়গা, সখ, পছন্দ-অপছন্দের মতো বিষয়। অন্তর্নিহিত ধারণা হলো- অনেক পরিমাপযোগ্য শারীরিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে মিলে যেতে পারে ভালোবাসার কাঙ্ক্ষিত মানুষটি। এই প্রক্রিয়ায় সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বড় ভুল হয়ে যায়। ভুলে যাওয়া হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি, তা হলো মানব ব্যক্তিটিকে।

কিন্তু কোনো ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেলে অনেক ক্ষেত্রে সব কিছুই বদলে যায়। সেগুলো সমন্বিত বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলোর চেয়ে সম্পর্কে প্রভাব বেশি ফেলে।

আধুনিক যুগের সম্পর্কের গঠন বস্তুজগতের মতো হয়ে যাচ্ছে। এটাই বড় বিপদ। আমরা কখনোই একটি চেয়ারকে ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি দেব না। কেন আমি মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত এই চেয়ারে বসে থাকার প্রতিজ্ঞা করব? আমার এই চেয়ারটি আর ভালো না লাগলে, আরেকটি নতুন চেয়ার কিনে আনব। এটা সচেতনতামূলক কোনো বিষয় নয়; কিন্তু আমরা এখন পৃথিবী ও অন্য মানুষকে এভাবেই দেখতে শিখি।

আপনি বলতে চাইছেন, দম্পতি বা প্রেমিক-প্রেমিকা সময়ের আগেই (প্রি-ম্যাচিউরলি) আলাদা হয়ে যায়? 

সন্তুষ্টির প্রতিশ্রুতি পেলেই আমরা কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। একটি সম্পর্কে থাকাকালে অনেক সময় অন্য ব্যক্তির সঙ্গ বেশি সন্তোষজনক মনে হয়। সে সময় নতুন সম্পর্ক শুরুর জন্য পুরনোটি ছিন্ন করি। দুটি মানুষের সম্মতি, বোঝাপড়ার মাধ্যমে একটি সম্পর্কের সূচনা হয়; কিন্তু বিচ্ছেদ কেবল একজনের জন্যই হয়। তাই ফলস্বরূপ, উভয়ই অন্যের দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়ার, ফ্যাশনের বাইরে চলে যাওয়া জ্যাকেটের মতো একপাশে ফেলে দেওয়ার ভয়ে থাকে।

আর এই ভ্রান্ত ধারণাই আপনি বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক বিষয়ক ‘লিকুইড লাভ’ বইটিতে তুলে ধরেছেন?

এটা ‘লিকুইড লাভের’ সমস্যা। সবার জীবনেই সংকট আসে। এ সময় আমাদের বন্ধু ও সঙ্গী প্রয়োজন হয়, যারা আমাদের হতাশ করবে না। প্রয়োজনের সময় পাশে থাকবে। জীবনে স্থিতিশীলতার আকাঙ্ক্ষা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একাকীত্ব কাটানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি ১৬ বিলিয়ন ডলারের ফেসবুক। অন্যদিকে, আমরা কারও সঙ্গে সম্পর্ক বা বন্ধনে আবদ্ধ হতে ভয় পাই। জড়তা কাজ করে। আমরা হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত। একটি নিরাপদ আশ্রয়ের আকাঙ্ক্ষা মনে পুষে রাখলেও বন্ধনহীন থাকতে চাই।

আপনি একজন নারীকে বিয়ে করেছেন। তার সঙ্গেই কাটিয়ে দিলেন ৬০টি বছর। জ্যানিনাল লুইনসন। পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন ২০০৯ সালে। দীর্ঘ এই দাম্পত্যের কারণ কি প্রকৃত ভালোবাসা?

এটা পাওয়া কঠিন; কিন্তু ‘তুমি এবং আমি’ এক দুর্বার আনন্দ, একে অপরের জন্য সেখানে থাকা, এক হয়ে ওঠা। আপনি এমন কিছুতে একটি পার্থক্য তৈরি করেছেন, যা কেবল নিজের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এই সত্য থেকে আনন্দ। প্রয়োজন বা এমনকি অপরিবর্তনীয়, একটি আনন্দদায়ক অনুভূতি। এটা অর্জন করা কঠিন। 

স্বতন্ত্রতা এবং নেটওয়ার্ক

আপনি বলেন, ভোক্তা সমাজ সুখী হওয়ার প্রবণতাকে কঠিন করে তোলে। কারণ এটি আমাদের অসুখী হওয়ার ওপর নির্ভরশীল

এ প্রসঙ্গে ‘অসুখী’ শব্দটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সব বিপণন ব্যবস্থাপক জোর দিয়ে বলবেন, তাদের পণ্যগুলো সন্তোষজনক। তারা সত্যি হলে আমাদের ভোক্তা অর্থনীতি থাকত না। সন্তুষ্টি থাকলে একটি পণ্য বাদ দিয়ে নতুন কোনো পণ্য ব্যবহারের কারণ থাকবে না। 

আজকাল ভোক্তারাও বাজারের একটি অংশ। আপনার দাবি, তারাও এখন পণ্যে পরিণত হয়েছে

ভোগবাদের সংস্কৃতিতে নিজের স্বকীয়তা ভুলে অন্য কোনো ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার চাপ থাকে। বাজারে চাহিদা রয়েছে, এমন বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হয়। বিপণন নিয়ে উদ্বিগ্ন বা সচেতন হতে হবে। নিজেকে পণ্য হিসেবে প্রমোট করতে হবে, যা গ্রাহককে আকর্ষণ করতে পারে। বর্তমানের জীবনযাপনে বেশ কিছু বিষয়কে বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়েছে। আর এসব বিষয়ে নজরদারি করতে রয়েছে বাজারের বেতনভুক কিছু কর্মী। এটা আপাতদৃষ্টিতে আত্মবিরোধী। তবে নিজের ব্যক্তিত্ব বা পরিচয় পুর্নবিবেচনা করাকে বাইরের চাপ হিসেবে নয় বরং ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রকাশ মনে করা হয়।

এতে ব্যক্তিত্ব বা পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। ফ্রেঞ্চ সমাজতাত্ত্বিক ফাঁসোয়া দ্য সাংলির তথ্য অনুযায়ী, ব্যক্তিত্বের কোনো শিকড় নেই। এক্ষেত্রে রূপক হিসেবে তিনি ‘নোঙর’ ব্যবহার করেছেন। সামাজিক ও পৈতৃক শিকড় স্থায়ী একটি বিষয়; কিন্তু নোঙরের নির্দিষ্ট বা চূড়ান্ত কোনো অবস্থান নেই। বিষয়টিকে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?

আমরা তখনই অন্য কেউ হতে পারি, যখন আমরা আগে যা ছিলাম তা হওয়া বন্ধ করে দিতে পারব। চিরতরে আমাদের আগের ‘আমি’কে ত্যাগ করতে হবে। নতুন অপশনগুলোর ক্রমাগত সরবরাহের পরিপ্রেক্ষিতে, আমরা শিগগিরই আমাদের পূর্বের ‘আমি’কে পুরনো, সংকীর্ণ এবং অসন্তুষ্ট হিসেবে দেখতে পাব।

নিজ সত্তাকে রূপান্তরের মধ্যে নিজেকে মুক্তি দেওয়ার মতো কোনো বিষয় কি আছে?

সব কিছু যখন কঠিন হয়ে যায় বা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইর চলে যায়, তখন লেজ গুটিয়ে পালানোর কৌশল নতুন নয়। মানুষ যুগ যুগ ধরে এই চেষ্টাই করে আসছে। এর মধ্যে নতুন বিষয় হলো- ক্যাটালগ থেকে একটি নতুন ‘আমি’কে গ্রহণ করে নিজের কাছ থেকে পালানোর ইচ্ছেটি। যে আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে নতুন দিগন্তের খোঁজে পথ চলা শুরু হয়েছিল, তা পরবর্তীতে প্রাত্যহিক কাজে পরিণত হয়। নিজেকে নিজের কাছ থেকে মুক্তি দেওয়ার কাজটি শুরু হয় ‘তুমি অন্য কেউ হতে পার’ দিয়ে। পরে তা বাধ্যতামূলক হয়ে হয় ‘তোমাকে অন্য কেউ হতেই হবে’। এই বাধ্যতামূলক ‘করণীয়’র সঙ্গে স্বাধীনতার সম্বন্ধ খুব নগণ্য। আর শুধু এই কারণে অনেকে এর বিরুদ্ধে থাকে। 

মুক্ত থাকা বা স্বাধীনতার অর্থ কী?

মুক্ত বা স্বাধীন থাকার মানে, নিজের আকাক্সক্ষা, ইচ্ছে ও লক্ষ্যপূরণে সক্ষম হওয়া। লিকুইড মডারনিটির যুগে ভোক্তাভিত্তিক জীবনশিল্প এই মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিলেও তা পূরণ করতে ব্যর্থ।

স্প্যানিশ দার্শনিক জোসে ওর্তেগা ওয়াই জ্যাসেট বর্ণিত ‘প্রজন্ম’ ধারণাটি প্রায় এক শতক পুরনো। আজ এর অর্থ কী? 

ইউরোপীয়রা প্রজন্ম শব্দটি তৈরি করেছে। এই শব্দটি সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভাজন রেখা অনুসন্ধানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। একটি বস্তুনিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক ক্যাটাগরিতে এটি নির্ভর করে বিষয়গত এবং বৈচিত্র্যময় জীবনের অভিজ্ঞতার ওপর। আজ অন্যান্য কারণে একটি প্রজন্মকে সংজ্ঞায়িত করার অভিজ্ঞতা পরের প্রজন্মের ক্ষেত্রে খুবই ক্ষুদ্র ভূমিকা রাখে বা একেবারেই রাখে না। 

সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে শব্দটির অর্থ কী? 

সম্প্রদায়ের ধারণাটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে নেটওয়ার্ক ধারণা দিয়ে। সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এতে প্রবেশ করা কঠিন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সবার পক্ষে সুইস হওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। একইভাবে একটি সম্প্রদায় থেকে বেরিয়ে যাওয়াও বেশ কঠিন। কারণ সামাজিক বন্ধনগুলো ভাঙার জন্য যথেষ্ট চাতুর্যের প্রয়োজন। এর জন্য আপনাকে উদ্দেশ্য নিয়ে আসতে হবে। আপোস করতে হবে। এমনকি এক্ষেত্রে সফলতা এলেও আপনি জানেন না কখন, কী প্রতিক্রিয়া অন্যদের কাছ থেকে আসতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-ফেসবুক- এটা ভিন্ন গল্প। এতে যোগ দেওয়া ও অংশগ্রহণ খুবই সহজ। বর্জন করাও বেশ সহজ।

প্রযুক্তি

ইন্টারনেটের অনেক ইতিবাচক দিক আছে। আরব বসন্তের মতো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সফল ব্যবহার হয়েছে। এর নেতিবাচক দিক কী?

যখন কোনো কিছু ধ্বংসের কথা আসে, যেমন-একটি সরকারের পতন- এটি কার্যকর হতে পারে। তবে পরের দিনের অস্পষ্ট পরিকল্পনাই এ ধরনের আন্দোলনের জন্য দুর্বলতা। ধ্বংস করার জন্য বিক্ষুব্ধ নাগরিকরাই কার্যত সর্বশক্তিমান। তবে এই শক্তি নতুন কিছু গড়তে সক্ষম, সেটা তারা এখনো করে দেখাতে পারেনি।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সবসময় সমাজ পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। আজ আপনি বলেন, এর সংশ্লিষ্টতা এর চেয়েও বেশি। কেন?

কারণ আমরা প্রযুক্তির দ্বারা পরিচালিত হই। প্রযুক্তিকে আমরা পরিচালনা করি না। যা করতে চাই, তার জন্য আমরা প্রযুক্তির বিকাশ করি না। বরং প্রযুক্তি দ্বারা যা সম্ভব, আমরা তাই করি।

কিন্তু সবসময়ই কি এমন হয়নি? চাকা আবিষ্কার থেকে শুরু করে পরমাণুর বিভাজন- প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ভালো এবং খারাপ সব ধরনের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। 

এটা বিস্তারের প্রশ্ন। প্রযুক্তি সবসময়ই আমাদের জীবকে প্রভাবিত করে এবং এর মাধ্যমে হওয়া পরিবর্তনগুলো সমালোচনার সম্মুখীন হয়। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গুটেনবার্গ যখন প্রিন্টিং প্রেস উদ্ভাবন করেন তখন এমন ঘটনা ঘটেছিল। শিক্ষিত শ্রেণি ধারণা করেছিলেন, এ উদ্ভাবন নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাবে। তাদের অভিযোগ ছিল, তাহলে সবাই পড়তে শিখে যাবে। এই শিক্ষিত শ্রেণির অভিমত, নিম্নবর্গীয়দের শিক্ষিত করা উচিত নয়। কারণ এতে তাদের কাজ করার ইচ্ছেটা নষ্ট হয়ে যাবে।

কিন্তু ইন্টারনেটের ক্ষেত্রেও তাই। এটি বিশ্বের দরিদ্র অঞ্চলের অগণিত লাখ লাখ মানুষকে শিক্ষার সুযোগ দিয়েছে, যা আগে তাদের কাছে অসহজলভ্য ছিল। তাহলে অভিযোগ কেন?

ঐতিহাসিকভাবে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে ছোটো ছোটো ধাপে। যত্র তত্র নতুনত্বের প্রবর্তন হয়েছে; কিন্তু বৈশ্বিক মানদণ্ডে নয়, বিপ্লবী প্রভাবের সঙ্গে নয়। এমনভাবে নয়, যা পুরো সমাজ ব্যবস্থা ও জীবনধারায় পরিবর্তন এনেছে। একসময় উদ্ভাবনগুলো বিশোষিত ও অভিযোজিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে হয়ে উঠেছিল দৈনন্দিন দিনযাপনের অংশ। আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। প্রযুক্তির মাধ্যমে যে পরিবর্তনগুলো এসেছে, সেগুলোর ব্যাপ্তি অনেক বড়। আর সেগুলোর নির্দিষ্ট সর্বগ্রাসী প্রবণতা রয়েছে। রাশিয়ার অতি ধনী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক প্রভাবসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব দিমিত্রি ইটসকভ ‘২০৪৫ ইনিশিয়েটিভ’ নামে একটি গবেষণা প্রকল্প চালু করেছেন। এই প্রকল্পের লক্ষ্য, মানুষের মস্তিষ্ককে বাহুল্য করে তোলা। মানুষের মতো চিন্তা করতে সক্ষম, এমন নকশার একটি ইলেকট্রনিক মেশিন তৈরিতে অর্থায়ন করছেন দিমিত্রি। এটা প্রকৃত অর্থে বাস্তবিক কি-না, তা আমি বলতে পারছি না; কিন্তু বিষয়টি হচ্ছে, যে কেউই বলবে, এ ধারণাটিতে নতুনত্ব রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো আমাদের চিন্তা-চেতনা মেশিন দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হলো।

ইউটোপিয়া বা কল্পলোক

১৯৮৯ সালে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মুখোমুখি হয় বিশ্ব। সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতন- এ সময় ‘মতাদর্শের অবসান’ বিষয়টি বারবার আলোচনায় আসছিল। নিওলিবারেলিজম ও নিওকনজারভেশন ছাড়াও এক্ষেত্রে মতাদর্শের অবসান কম-বেশি প্রভাব ফেলেছিল। সামাজিক-কল্পরাজের ধারণাটি তাদের সময়েও ছিল।

এটা সত্যি; কিন্তু মতাদর্শের অবসান এখনো অনেক দূরের বিষয়। মানবশক্তি দিয়ে সব বিষয়ে পূর্ণতা অর্জন করা যায়। সেই সময় আধুনিকতা ছিল এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে। এর বিপরীতে রাজনীতির মন্ত্রের দাবি, ‘এখানে কোনো বিকল্প নেই।’ উচ্চ পর্যায়ের ক্ষমতাসীনদের দাবি, সাধারণ মানুষ একটি সুন্দর সামাজিক ব্যবস্থার প্রতিফলনকে সময়ের অপচয় হিসেবে বিবেচনা করে। বেসরকারিকরণের নতুন আদর্শ অনুযায়ী, এ জাতীয় জিনিসগুলো সুখের জীবনে কোনো অবদান রাখে না। প্রয়োজনের তালিকায় আছে, বেশি কাজ করা, বেশি উপার্জন করা, সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তা না করা অথবা সম্প্রদায়ের জন্য কিছু না করা। সমাজ বলে কিছু নেই- ঘোষণা করেছিলেন ‘লৌহ মানবী’ মার্গারেট থ্যাচার। তার ভাষ্যে, আছে শুধু স্বতন্ত্র পুরুষ, নারী ও পরিবার। 

গেমকিপার মালী ও শিকারির রূপক দিয়ে ইউটোপিয়ান চিন্তার ঐতিহাসিক বিকাশকে চিহ্নিত করেন আপনি। বিশ্বের প্রতি প্রাক-আধুনিক চালচলন ছিল একজন গেমকিপারের। আধুনিক মনোভাব ছিল একজন মালির। এখন উত্তর আধুনিক যুগে আধিপত্য বিস্তার করছে শিকারিরা। এই ইউটোপিয়া কীভাবে আধুনিকতার আগের কল্পনা থেকে আলাদা?

এটি এখন আর আগের মতো সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ বা সুন্দর বাগান তৈরির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, আগে যেমন ব্যবহার করা যেত। আজ সব মানুষ নিজের শিকারের থলিটি পরিপূর্ণ করতেই ব্যস্ত। সরবরাহের পরিমাণ না বুঝে বা এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন না হয়েই থলিটি কানায় কানায় পূর্ণ করছে। সামাজিক ঐতিহাসিকরা এই রূপান্তরকে ‘ব্যক্তিকরণ’ শিরোনাম দিয়ে আলোচনা করেন। আর রাজনীতিবিদরা এটিকে ‘নিয়ন্ত্রণহীনতা’ বলে প্রচার করেন। আগের ইউটোপিয়ানদের মতো বর্তমান শিকারীর ইউটোপিয়া জীবনকে বাস্তব বা কৃত্রিম কোনো অর্থ দিয়ে আচ্ছন্ন করে না। এটি কেবল মানুষের মনে জীবনের অর্থ সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো দূর করতে কাজ করে। 

এই ইউটোপিয়ার ভিত্তি কী?

আমরা এখন দুটি ইউটোপিয়াস নিয়ে কাজ করছি। এর একটি অন্যটির পরিপূরক। এর একটি হচ্ছে মুক্ত বাজারের বিস্ময়কর নিরাময় ক্ষমতা এবং অন্যটি প্রযুক্তিগত সমাধানের অসীম ক্ষমতা। দুটি ইউটোপিয়াসই কালবিরুদ্ধ। অধিকার নিয়ে একটি বিশ্ব কল্পনা করে; কিন্তু সেই পৃথিবীতে নেই কোনো কর্তব্য, সর্বোপরি নেই কোনো শাসক। তারা যে কোনো পরিকল্পনার বিরুদ্ধে। বিলম্বিত পরিতৃপ্তির বিরুদ্ধে। ভবিষ্যতের সুবিধের পক্ষে ত্যাগের বিরুদ্ধাচারণ করে। স্বতঃস্ফূর্ত বর্তমান বিশ্ব এখানে ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত উদ্বেগকে অর্থহীন করে তোলে। এ পরিস্থিতিতে থাকে শুধু ভবিষ্যতের সমস্ত উদ্বেগ থেকে মুক্ত থাকার উদ্বেগ। 

মানব বর্জ্য

আপনার মতে, ভোক্তা সমাজ আমাদের কী তৈরি করেছে, এর একটি দৃষ্টান্ত ফ্যাশন। 

আমরা যা কিনেছি, তা শিগগিরিই বাতিল করতে হবে- এই ধারণা ঘিরে আবর্তিত হয় ফ্যাশন। এমন অনেক পোশাক আছে, যা এখনো পরিধান করা যেতে পারে; কিন্তু পুরনো ফ্যাশনের হওয়ায় তা আমরা ব্যবহার করতে লজ্জা পাই। অফিসের বস আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আপনি কীভাবে এই পোশাক পরে অফিসে আসার সাহস করেন?’ কিংবা গত বছরের স্নিকার্স পায়ে যখন শিশুরা স্কুলে যায় তখন তাদের উপহাসের পাত্র হতে হয়। এই জটিলতা নিয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছানো চাপের বিষয়।

ফ্যাশন দিয়ে বোঝা যায়, ভোক্তা সমাজ কীভাবে আবর্জনা উৎপাদনে বিশেষায়িত। আরও গুরুতর বিষয় হলো, আপনি এটিকে ‘মানব বর্জ্য উৎপাদন’ বলছেন। আপনি বেকারদের আবর্জনা হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেন কেন?

কারণ সমাজের কাছে তাদের ব্যবহার করার মতো কিছু নেই। তাদের জীবনকে মূল্যহীন হিসেবে দেখা হয়, ঠিক শরণার্থীদের মতো। এটা বিশ্বায়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফল। পুঁজিবাদের বিজয়ী পদযাত্রার পরিপ্রেক্ষিতে চাকরি হারানো ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এ সংখ্যা শিগগিরিই পৃথিবীর সক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। পুঁজিবাজার অধ্যুষিত ঘাঁটিতে বাড়ছে কর্মসংস্থান, জমি ও সামাজিক নিরাপত্তা ছিনিয়ে নেওয়া পুরুষ ও নারীর সংখ্যা। এতে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন দরিদ্র ও বেকার সম্প্রদায়। তৈরি হচ্ছে এক ব্যর্থ ভোক্তা শ্রেণি। এই সমাজে তাদের কোনো স্থান নেই। স্থান সংকুলান না হওয়ায় আমরা জানি না, তাদের কোথায় রাখব। আর যেসব অঞ্চলে আমরা উদ্বৃত্ত শ্রমিক রফতানি করতাম, সে জায়গাগুলোও আর সহজলভ্য নেই। আমাদের গণতান্ত্রিক সামাজিক রাষ্ট্রগুলোর সাফল্য দীর্ঘদিন এই সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে ছিল। আজ আমাদের গ্রহের প্রতিটি কোণ দখল হয়ে গেছে। বর্তমান সংকটে এটিই নতুন।

আশ্রয় চাইতে আসা শরণার্থীদের কী হবে?

১৯৫০ সালে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তখন এক মিলিয়ন শরণার্থী ছিল। এই শরণার্থীদের বেশিরভাগই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তথাকথিত ‘বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি‘। আজ শরণার্থীর সংখ্যা ১২ মিলিয়ন বলে অনুমান করা হয়। ২০৫০ সাল নাগাদ ১ বিলিয়ন নির্বাসিত শরণার্থী পাব বলে ধারণা করতে পারি। তাদের ট্রানজিট ক্যাম্পের নো-ম্যানস ল্যান্ডে আটকে রাখা হবে। শরণার্থী, অভিবাসী, প্রান্তিক- এরাই সংখ্যায় সবসময় বেশি থাকে।

আমরা কীভাবে জানব যে, এটি কেবল একটি সাময়িক ঘটনা নয়?

শরণার্থী শিবিরের বন্দী হওয়ার অর্থ, মানবতা বেষ্টিত পৃথিবী থেকে উচ্ছেদ। শরণার্থীরা শুধু উদ্বৃত্ত নয়, অপ্রয়োজনীয়ও বটে। তাদের স্বদেশে ফেরার পথ চিরদিনের জন্য রুদ্ধ। শিবিরের অধিবাসীরা তাদের পরিচয় বা অস্তিত্বের সমস্ত বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। শুধু একটি বিষয়ই তাদের মাথায় থাকে, তারা শরণার্থী। তারা দেশছাড়া, গৃহহীন, কর্মহীন। তাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। স্থায়ীভাবে যারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তারাও আইনের বাইরে। ফরাসি নৃবিজ্ঞানী মিশেল আগিয়ার বিশ্বায়নের যুগে শরণার্থীদের বিষয়ে তার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, তারা কেবল দেশে বা অন্য কোথাও কোনো আইনের বাইরে নয়, বরং সম্পূর্ণভাবে আইনের বাইরে।

আপনি বলছেন, শরণার্থী শিবিরগুলো গবেষণাগারের মতো। যেখানে লিকুইডিটি মডারনিটির নতুন, স্থায়ী, অস্থায়ী জীবনযাপনের পদ্ধতি পরীক্ষা করা হয়।

বিশ্বায়িত বিশ্বে আশ্রয়প্রার্থী এবং তথাকথিত অর্থনৈতিক শরণার্থীরা হলো নতুন ক্ষমতাবানদের সম্মিলিত উপমা। এরা মূলত এই নাটকের প্রকৃত খলনায়ক। ঠিক এই এলিটদের মতো, তারা একটি নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ নয়। তারা লক্ষ্যভ্রষ্ট এবং তাদের বিষয়ে আগে থেকে কিছু অনুমান করা যায় না। সরকার শরণার্থীদের সহায়তা দেয়। বিদ্বেষ উসকে দেয়। কারণ সরকার ভোটারদের সমস্যার প্রকৃত উৎসগুলোর মুখোমুখি হতে চায় না। আশ্রয় প্রার্থীরা সেই ভূমিকা নেয়, যা আগে ডাইনি, লোককাহিনী এবং কিংবদন্তীর ভূতদের জন্য সংরক্ষিত ছিল।

উন্নয়নের এই সময়, আপনি বলছেন সামাজিক রাষ্ট্র একটি নিরাপত্তা রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কি দুটির মধ্যে পার্থক্য?

অন্তর্ভুক্তির ওপর ভিত্তি করে সামাজিক রাষ্ট্র একটি সম্প্রদায়কে তার মডেল হিসেবে গ্রহণ করে। ফৌজদারি বিচার রাষ্ট্র ঠিক এর বিপরীত কাজ করে। এটি শাস্তি এবং কারাবাসের মাধ্যমে সমাজচ্যুত করে দেয়। নিরাপত্তা শিল্প তখন বর্জ্য উৎপাদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখায় পরিণত হয়। এটি মানব বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী।

ইউরোপের প্রায় সব জায়গায় বিদ্যমান ডানপন্থী দলগুলো এই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে। তারা গণমাধ্যম দ্বারা সমর্থিত। গণমাধ্যমগুলো ভয় দেখায়, ‘অধিক জনসংখ্যা‘, ‘আশ্রয়‘ এবং ‘সন্ত্রাস‘ বিষয়ক সমস্যাগুলোর জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম দেয়।

উগ্র ডানপন্থী দলগুলোর সাফল্য দৃশ্যমান হয় একটি সত্যের ওপর ভিত্তি করে: অভিবাসন এবং সবকিছু চিহ্নিত হয় এটি লক্ষ্য করে। এখানে বেকারত্ব কেন? অভিবাসনের কারণে। আমাদের স্কুলের শিক্ষা ব্যবস্থা এত খারাপ কেন? অভিবাসীদের কারণে। অপরাধ কেন বাড়ছে? অভিবাসীদের কারণে। ‘তারা যেখান থেকে এসেছে, তাদের সেখানে ফেরত পাঠাতে পারলে আমাদের সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে।’ এটা একটা বিভ্রম। কয়েক হাজার বা কয়েক লাখ অভিবাসীদের চেয়ে ভয় পাওয়ার আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে; কিন্তু এক্ষেত্রে অভিবাসনের বিষয়টি কাজ করে। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক সান্ত্বনা: ‘আমি জানি আমার কী ক্ষতি হচ্ছে। আমার এমন কিছু আছে, যার সঙ্গে আমি আমার ভয়কে যুক্ত করতে পারি।’

ভয়

লিকুইড সার্ভেলিয়েন্স বইয়ে লিখেছেন, ভীতি আমাদের সময়ের একটি চিহ্ন। এই ভীতি থেকে রক্ষা করতে সমাজের চেষ্টাগুলো ভয় আরও বাড়িয়ে তোলে। অতীতের ভীতিগুলো কি আরও বেশি খারাপ ছিল - ঈশ্বর, দানব, নরক, দৈত্য ও প্রকৃতির ভয়? 

আমার মনে হয় না, আজ মানুষের ভয় আগের চেয়ে বেশি; কিন্তু তারা আরও ভিন্ন, স্বেচ্ছাচারী, বিস্তৃত ও নির্বোধ। আপনি ৩০ বছর ধরে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। আপনি উচ্চ পদ মর্যাদার অধিকারী। আকস্মিকভাবে একটি বড় করপোরেশন গ্রাস করল প্রতিষ্ঠানটিকে। এই ধাক্কায় প্রতিষ্ঠানটি ছিনতাই হলো, বিক্রি হয়ে গেল। আপনি নিজেকে খুঁজে পেলেন রাস্তায়। এই ৫০ বছর বয়সে নতুন চাকরি খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। অনেক মানুষ এই ধরনের আঘাত এবং প্রতিকূলতাকে ভয় পায়। সংকট ঠিক কোথা থেকে আসতে পারে, তা তারা জানে না। এই সংকট প্রতিরোধ করার জন্য কোনো সতর্কতা অবলম্বন করতে সক্ষম হয় না তারা।

এবং এটা কী অন্য রকম হতো ?

কংক্রিট জাতীয় কিছু নিয়ে মানুষের ভয় ছিল। ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মানুষ আকাশের দিকে চেয়ে থাকত। ‘বৃষ্টি কি শেষ পর্যন্ত আসবে, না-কি সবকিছুই শুষ্ক থাকবে এবং সব নির্জীব করে ফেলবে?’ শিশুরা স্কুলে গিয়েছিল। স্কুলে যেতে হয় একটি ছোট বনের মধ্য দিয়ে; কিন্তু সেখানে একটি নেকড়ের ঘুরে বেড়ানোর কথা শোনা যাওয়ায় তাদের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে স্কুলে যেতে হয়েছিল। এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধের সময় ভয় থাকলেও মানুষ বিশ্বাস করেছিল, তারা বাঙ্কার তৈরির মাধ্যমে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারবে। বলা বাহুল্য, বিষয়টি বোকামি। তারা ভেবেছিল, তারা কিছু করতে পারঙ্গম। মানুষ হতাশ হয়নি। তারা নিজেদের বলেছিল, ‘আমি বেশ আছি। আমি আমার পরিবারের জন্য বোম শেল্টার নির্মাণ করছি।’

বিশ্বের ধনী অংশে আগের যে কোনো সমাজের তুলনায় আমরা দীর্ঘ ও নিরাপদ জীবনযাপন করছি। ঝুঁকি অনেক কমে গেছে।

পার্থক্য বুঝতে আপনাকে ঝুঁকির ধারণার সঙ্গে বিপদের ধারণার তুলনা করতে হবে। বিপদ নির্দিষ্ট। আমরা জানি কী ভয় পাই এবং এর জন্য সতর্কতা অবলম্বন করতে পারি। ঝুঁকির ক্ষেত্রে এমনটা হয় না। আমাদের জীবন আজ আমাদের আগের যে কোনো প্রজন্মের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ। একইসঙ্গে, আমরা নিরাপত্তাহীনতার অপচ্ছায়ার মধ্যে বাস করছি। অনেক তাত্ত্বিক এই প্রচলিত মতবিরোধী অথচ সত্য বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন। বলা যেতে পারে, ভয়ের আধুনিক রূপটি মানুষের অসততা এবং মানুষের দুর্বৃত্ততার ভয় দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

যা থেকে একটি পুরো শিল্প উপকৃত হয়।

নিরাপত্তা শিল্প হলো চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্রমবর্ধমান শিল্প। এটিই একমাত্র শিল্প, যা অর্থনৈতিক সংকট থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ। পরিংখ্যান বা বর্তমান হুমকির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ নিরাপত্তা বাহিনীর সম্প্রসারণ এবং কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য খুব ভালো একটি অজুহাত। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যার তুলনায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা হাস্যকরভাবে কম। সড়কে অনেক মানুষ মারা গেছে। এমনকি মিডিয়াও এ সম্পর্কে কথা বলে না।

সিগারেটের প্যাকেটের মতো প্রতিটি গাড়িতে স্টিকার থাকা উচিত: ‘গাড়ি চালানো আপনার স্বাস্থ্য এবং আপনার আশপাশের মানুষের স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটায়।’

ঠিক তাই! অন্যদিকে, জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। আমাদের পৃথিবীর অংশে এখন আর রুটি-মাখন নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। একই সময়, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দা মানুষকে দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ার ভয় দেখিয়েছে। সমগ্র মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাজারের খামখেয়ালিপনার শিকার, এই আশঙ্কায় জীবনযাত্রার মান ক্রমাগত কমবে এবং কখনই তা পুনরুদ্ধার হবে না। চাকরি হারানো শ্রমিকদের কথা না বললেই নয়। জীবনযাত্রার মান আজ উনিশ শতকের তুলনায় নিশ্চিতভাবেই অনেক বেশি; কিন্তু কিছু কারণে এটি আর সুখের অনুভূতি সৃষ্টি করে না। এমনকি বেশ ভালো একটি দিন কাটানোর পরও অনেকে ঘুমাতে যান এবং দুঃস্বপ্ন দেখে গভীর রাতে হঠাৎ জেগে ওঠেন। শয়তানরা এ সময় বেরিয়ে আসে, যা দিনের বেলায় চাপা পড়েছিল। কারণ সে সময় লোকেরা তাদের কাজ নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত ছিল। তারপর রাতের নিস্তব্ধতায় ভয়, আশঙ্কাগুলো পৃষ্ঠতলে উঠে আসে।

আপনি বলেন, ভোক্তা সমাজের মানসিক ব্যাধি বিষণ্ণতা।

অতীতে, মানুষ নিষেধাজ্ঞার আধিক্যে ভুগত। বাধ্যবাধকতার ভীতি, নিয়ম লঙ্ঘনের পর অভিযোগের ভয় - এই সমস্ত বিষয় স্নায়ুবিক পীড়া সৃষ্টি করত। আজ আমরা সম্ভাবনার আধিক্য এবং অপর্যাপ্ততার সন্ত্রাসে ভুগছি, যা আমাদের বিষণ্ণতার দিকে ঠেলে দেয়।

রাজনীতি

ক্ষমতা এবং রাজনীতি আজ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এটি কীভাবে ঘটল এবং এর কী দরকার?

আমি অর্ধশতকেরও বেশি আগে যখন পড়শোনা করেছি, তখনো জাতি-রাষ্ট্র ছিল সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। এটি ছিল সার্বভৌম - অর্থনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে। এখন আর সেই অবস্থা নেই।

আমরা কেন আর রাষ্ট্রে বিশ্বাস করি না?

সত্তরের দশকে, রাষ্ট্র তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছিল না। তাই সেই সময় রাষ্ট্র অজনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে অটুট রাখা যায়নি। এর পর্যাপ্ত সম্পদ ছিল না এবং লোকেরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল এবং রাষ্ট্রের সব সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা বিরক্ত হচ্ছিল। রাষ্ট্র তাদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করেছিল; কিন্তু সেই সময় একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল: মুক্ত বাজার। ‘আসুন নিয়ন্ত্রণহীন করি, ব্যক্তিগতকরণ করি। আসুন বাজারের অদৃশ্য হাতকে বিশ্বাস করি, এবং সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’ এটাই ছিল ভাবনা।

এটি আগে থেকে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও সাম্প্রতিক আর্থিক মন্দার কারণে এই বিশ্বাসটি নিশ্চিতভাবে ভেঙে পড়েছিল।

২০০৭-০৮ সালের ক্রেডিট সিস্টেম এবং ব্যাংকের পতন ১৯৩০ ও ১৯৬০ সালের সংকট থেকে আলাদা এই অর্থে যে, আমরা আর রাষ্ট্র বা বাজারে বিশ্বাস করি না। ইতালীয় দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামসি দ্বারা নিযুক্ত শব্দের আধুনিক অর্থে আমি এই সময়টিকে একটি অন্তর্বর্তীকাল (ইন্ট্যারেগন্যাম) বলি। আন্তোনিও গ্রামসি ইন্ট্যারেগন্যামকে এমন একটি সময় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন, যেখানে কাজ করার বর্তমান উপায়গুলো আর সঠিকভাবে কাজ করে না। নতুন বিকল্পও আবিষ্কৃত হয়নি। আমরা আজ এমন একটি সময়ে বাস করছি।

আমরা কীভাবে এখন থেকে আমাদের উপায় খুঁজে পেতে পারি?

আমরা জানি, আমরা কী চাই না এবং আমরা এমন জিনিস থেকে পালিয়ে যাই, যা কাজ করে না। আমরা এখনো জানি না কোথায় ছুটে যাচ্ছি। সমাজবিজ্ঞানী বেঞ্জামিন বারবারের সম্প্রতি প্রকাশিত প্ররোচনাদায়ক বই ‘ইফ মেয়রস রুলড দ্য ওয়ার্ল্ড’ খুবই আকর্ষণীয়। বারবারের ধারণা সাধারণ। প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো রাষ্ট্র স্তর বা ‘জীবন রাজনীতির স্তরে‘ করা যাবে না। যখন জাতি-রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে, তখন এটি ছিল স্বাধীনতা অর্জনের একটি যন্ত্র; কিন্তু আজ আমাদের সমস্যা হলো, আমরা সবাই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল এবং সার্বভৌম আঞ্চলিক রাষ্ট্র আন্তঃনির্ভর সমস্যা মোকাবেলায় অক্ষম। এটি ‘জীবন রাজনীতির‘ ক্ষেত্রেও সত্য, যা ব্যক্তিকে সামাজিক সমস্যার জন্য দায়বদ্ধ করে। বিশ্বের স্তরের সমস্যাগুলো অবশ্যই এইভাবে সমাধান করা যাবে না, কারণ আপনি বা আমি - এমনকি অতি ধনীরও এটি করার জন্য পুঁজি নেই।

আমাদের ভেতরের খুনি

আপনি মডারনিটি অ্যান্ড দ্য হলোকাস্ট বইটিতে উসকানিমূলক গবেষণার পক্ষে কথা বলেছেন। বলেছেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে মানুষকে নির্মূল করার ধারণাটি আধুনিকতার একটি পণ্য- বিশেষত জার্মান জাতীয়তাবাদের নয়। তাহলে কি আজও Auschwitz সম্ভব হবে, এবং যদি হ্যাঁ হয়, কোন পরিস্থিতিতে?

আধুনিক যুগ গণহত্যার যুগ নয়। তবে এই ধরনের সুনির্দিষ্ট গণহত্যা চালানোর আধুনিক উপায়গুলো সহজ করতে সক্ষম হয়েছে। কারখানা প্রযুক্তি এবং আমলাতন্ত্রের মতো উদ্ভাবনের জন্য ধন্যবাদ। বিশেষ ধন্যবাদ উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য পৃথিবী পরিবর্তন করা যেতে পারে, এমনকি পৃথিবী উল্টে দেওয়াও যেতে পারে। কোনো কিছু পছন্দ না হলেও ঈশ্বরের সৃষ্টির প্রতি মানুষকে হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ আছে- মধ্যযুগীয় ইউরোপের এমন ধারণাটি আর গ্রহণ করতে হবে না। অতীতে আপনাকে কেবল এ ধরনের বিশ্বাস সহ্য করে নিতে হয়েছিল। 

আমরা ঠিক আমাদের ইচ্ছে মতো পৃথিবী পুনর্নির্মাণ করতে পারি।

একই কারণে, আধুনিক যুগও ছিল ধ্বংসের যুগ। উন্নতি এবং পরিপূর্ণতার প্রচেষ্টায় অসংখ্য মানুষকে নিখুঁতভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। যা নিখুঁত পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ধ্বংসই ছিল নতুনের মূল উপাদান। সব অসম্পূর্ণতার বিনাশ ছিল পূর্ণতা অর্জনের শর্ত। নাৎসি এবং কমিউনিস্ট পরিচালিত প্রকল্পগুলো এই বিষয়ে অন্যদের চেয়ে পৃথক হওয়ার চেষ্টা করেছে। উভয়ই অনিয়ন্ত্রিত, এলোমেলো, এবং নিয়ন্ত্রণ-প্রতিরোধকারী উপাদান বা শর্তের মানবিক দিকটি একেবারে নির্মূল করার চেষ্টা করেছিল।

কিন্তু আগের যুগে মানুষ, যেমন ক্রুসেডের (ধর্মীয় যুদ্ধ) সময়, ঈশ্বরের নামে হত্যা করেছিল? 

আধুনিক যুগের উচ্চাকাঙ্ক্ষা হলো, বিশ্বকে আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসা। এখন আমরাই পরিচালক, প্রকৃতি নয়, ঈশ্বর নয়। ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন; কিন্তু এখন যেহেতু তিনি অনুপস্থিত বা মৃত, সেহেতু আমাদের অবশ্যই এটি পরিচালনা করতে হবে, সব কিছু নতুন করতে হবে। ইউরোপীয় ইহুদিদের ধ্বংস বৃহত্তর প্রকল্পের একটি অংশ ছিল: একটি কেন্দ্রে জার্মানদের সঙ্গে সব মানুষের পুনর্বাসন - একটি ভয়াবহ উদ্যোগ। এটিকে বাস্তবে পরিণত করার গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান সৌভাগ্যবশত এখন অনুপস্থিত: মোট শক্তি (টোটাল পাওয়ার)। এ রকম কিছু কেবল কমিউনিস্ট রাশিয়া বা নাৎসি জার্মানিতেই করা যেতে পারে। মুসোলিনির অধীনে ইতালির মতো কম স্বৈরাচারী দেশ বা ফ্রাঙ্কোর অধীনস্ত স্পেনে, এটা সম্ভব ছিল না। এই উপাদানটির অভাব ছিল। ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন যে, এমনটাই থাকবে।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক প্রকল্পটি প্রায়শই এটি যা তার উল্টো বোঝা হয়। এটি দেখা হয়, বর্বরতার প্রত্যাবর্তন, আধুনিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে। ধরা হয় আধুনিক সমাজের মূল নীতির বিরুদ্ধে। এবং এর ফলস্বরূপ নয়।

এটা একটা ভুল বোঝাবুঝি। এটি এই সত্য থেকে উদ্ভূত যে, এগুলো ছিল এসব নীতির চরম প্রকাশ, নিরলসভাবে মৌলবাদী এবং যে কোনো ভুলভ্রান্তি দূর করতে সক্ষম। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্টরা সেই সময়ে অন্যরা যা করতে চেয়েছিল তা করেছিল - পরেরটি কেবল নির্ধারিত এবং যথেষ্ট নির্মম ছিল না - এবং যা আমরা আজও করি, যদিও কম দর্শনীয় এবং কম বিরক্তিকর উপায়ে।

এ কথা দিয়ে আপনি কী বোঝাতে চাইলেন?

মানুষের দূরত্ব এবং মানুষের মিথস্ক্রিয়ার স্বয়ংক্রিয়তার মধ্যে আমরা নিযুক্ত থাকি। দূরত্ব এবং স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির অগ্রগতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো প্রগতিশীলতা এবং সম্ভবত অপ্রতিরোধ্য, নৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে আমাদের কর্মের মুক্তি।

সুখ

দি আর্ট অব লাইফ বইটিতে আপনি সুখ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এতে রয়েছে প্রাচীনকালের জীবন দার্শনিকদের অনেক কথা। আধুনিক যুগে সুখ তাড়া করার মতো জিনিসে পরিণত হয়েছে

শুরুটা হয়েছিল ১৭৭৬ সালে আমেরিকান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে। এতে সরকারিভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়, ‘জীবন, স্বাধীনতা ও সুখের সাধনা‘ অবিচ্ছেদ্য। এটি ঈশ্বর প্রদত্ত মানবাধিকার। অবশ্যই, মানুষ সবসময় অসুখী না হয়ে সুখী হওয়ার দিকে ঝুঁকেছে। সুখের সাধনা আমাদের মধ্যে বিবর্তনের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়েছিল। যদি এমন না হতো, তাহলে আমরা এখনো এই আরামদায়ক আর্মচেয়ারের বদলে গুহায় বসে থাকতাম; কিন্তু এই ধারণা আমাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব উপায়ে অনুসরণ করার অধিকার রয়েছে। এটি কেবল আধুনিক যুগ থেকেই বিদ্যমান। ব্যক্তিগত সুখের জন্য একটি সাধারণ মানুষের অধিকারের ঘোষণা আধুনিক যুগের সূচনা করে।

কিন্তু রোমান আমলের তুলনায় আজ সুখ অর্জন করা কম কঠিন বলে মনে হয় না। রোমান আমল ছিল সেনেকা, লুক্রেটিয়াস, মার্কাস অরেলিয়াস এবং এপিকটেটাসের জীবন দর্শনের যুগ। ব্যক্তিগতভাবে আপনার জন্য সুখের অর্থ কী?

তখন গ্যেটে প্রায় আমার বয়সী ছিলেন। সেই সময় একদিন তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তার সুখী জীবন আছে কি না। তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি খুব সুখী জীবন পেয়েছি; কিন্তু আমি একটি সুখী এক সপ্তাহের কথা ভাবতে পারি না।’ এটি খুব বুদ্ধিদীপ্ত একটি উত্তর। আমি ঠিক এমনটাই অনুভব করছি। একটি কবিতায় গ্যেটে বলেছিলেন, দীর্ঘ দিনের রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের চেয়ে হতাশাজনক আর কিছু নেই। সুখ সংগ্রাম এবং জীবনের কষ্টের বিকল্প নয়। এর বিকল্প হলো একঘেয়েমি। যদি কোনো সমস্যার সমাধান না হয়, মাঝে মাঝে আমাদের সক্ষমতা অতিক্রম করে এমন কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে না হয়, তাহলে আমরা বিরক্ত হয়ে যাই। আর একঘেয়েমি হলো মানুষের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক ব্যধিগুলোর একটি। এখানে আমি সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সঙ্গে একমত- সুখ একটি রাষ্ট্র নয় বরং একটি মুহূর্ত, বর্তমান মুহূর্ত। প্রতিকূলতা ও দুর্ভাগ্য কাটিয়ে উঠতে পারলে আমরা আনন্দিত বোধ করি। আমাদের পা দুটোয় আটঁসাট জুতো। এই জুতোজোড়ায় পায়ে বড্ড ব্যথা হচ্ছে, জ্বালাপোড়া করছে। জুতোগুলো খুলে নিলেই খুশি এবং স্বস্তি বোধ করছি। একটানা সুখ বড় ভয়ঙ্কর, দুঃস্বপ্ন।

আপনি বলেন, আমরা সবাই জীবনের শিল্পী। জীবন যাপনের শিল্প কী?

অসম্ভব কোনো কিছু আয়ত্বের মধ্যে আনার চেষ্টা করা। আমরা নিজেরা নিজেদের সৃষ্টি ও নিজের তৈরি পণ্য, তা বোঝা। একজন চিত্রশিল্পী বা ভাস্করের মতো কাজ করা এবং যে কাজগুলো শেষ করা খুব কঠিন, সেগুলোর মুখোমুখি হওয়া। যা এখন আমাদের সক্ষমতার বাইরে এমন কিছু করার উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। আমাদের বর্তমান সক্ষমতার মধ্যে থাকা সব কাজ, যা আমরা করতে পারি, সেগুলোর মানোন্নয়ন করা। অনিশ্চয়তা আমাদের অস্তিত্বের প্রাকৃতিক বায়োটোপ। তার বিপরীতে রূপান্তরের আশা থাকলেও আমাদের সুখের সাধনার চালিকাশক্তি।

আপনি কেবল ‘সলিড‘ থেকে ‘লিকুইড‘ মডারনিটির রূপান্তর সম্পর্কে তত্ত্ব দেননি, এটি প্রথম অনুভব করেছেন। যখন যুবক ছিলেন তখন আপনি কী চেয়েছিলেন?

একজন যুবক হিসেবে, সমসাময়িক অনেকের মতো, আমি সার্ত্রের একটি প্রজেক্ট দে লা ভিয়ে’র ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলাম। জীবনের জন্য আপনার নিজস্ব প্রকল্প তৈরি করুন এবং এই আদর্শের দিকে এগিয়ে যান, সংক্ষিপ্ত এবং সবচেয়ে সরাসরি পথ গ্রহণ করুন। আপনি কোন ধরনের ব্যক্তি হতে চান তা ঠিক করুন এবং তারপরে আপনার কাছে এই ব্যক্তি হওয়ার সূত্র রয়েছে। প্রতিটি ধরনের জীবনের জন্য, আমাদের কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছেন, যা আমাদের অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে, বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হবে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, যেমন সার্ত্রের ধারণা ছিল, জীবন ধাপে ধাপে এগিয়ে যায়। যা আমাদের যাত্রা শুরু করার আগেই সম্পূর্ণভাবে নির্ধারিত হয়।

ভবিষ্যৎ

আপনি আমাদের সমকালীন সমাজের খুব বড় সমালোচক এবং সময়ে সময়ে মার্কসবাদ নিয়ে বেশ ইতিবাচক মনে হয় আপনাকে। 

আমি আন্তোনিও গ্রামসিকে আবিষ্কার করেছি। তার দর্শন আমাকে মার্কসবাদ থেকে সম্মানজনকভাবে মুক্তি দিয়েছে; কিন্তু আমি কখনোই অন্য অনেকের মতো মার্কসবাদ বিরোধী হইনি। আমি মার্ক্সের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি এবং আমি এখনো সমাজতান্ত্রিক ধারণার সঙ্গে একমত যে. একটি সমাজকে তার দুর্বল সদস্যদের জীবনমান দ্বারা পরিমাপ করা উচিত।

অন্যদিকে, আপনি একজন হতাশাবাদীও। নতুন পুঁজিবাদের শক্তি অনেক বড়। এর বিকল্প হিসেবে খুব কম জায়গা আছে। এটা কি হতাশার কারণ নয়?

আমার বক্তৃতা শোনার পর, অডিয়েন্সের সদস্যরা তাদের হাত তুলে জিজ্ঞাসা করেছেন যে, আমি কেন এত হতাশাবাদী। আমি যখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পর্কে কথা বলি তখন লোকেরা জিজ্ঞাসা করে, আমি কেন এত আশাবাদী। আশাবাদীরা বিশ্বাস করেন, সব শব্দের মধ্যে এই পৃথিবী সেরা এবং হতাশাবাদীদের আশঙ্কা, আশাবাদীরাই সঠিক। আমি এই দুটি দলের কোনোটিতেই নেই। একটি তৃতীয় ক্যাটাগরি আছে। সেখানেই আমি নিজেকে গণনা করি একটি আশা।

বর্তমানের সবচেয়ে হতাশাবাদী লেখক মিশেল হাউলেবেকের প্রশংসা করেন আপনি। এটা কেন?

আমি হাউলেবেককে পছন্দ করি। কারণ তার চোখ তীক্ষ্ণ। সুনির্দিষ্টভাবে সাধারণকে শনাক্ত করতে পারেন তিনি। সাধারণের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ সম্ভাবনা উন্মোচন এবং বহিপ্রকাশের ক্ষমতা রাখেন তিনি। যেন তার মধ্যে থাকা একটি দ্বীপ, যা লিকুইডিটি মডারনিটির একটি নিয়ন্ত্রিত, খণ্ডিত এবং স্বতন্ত্র সমাজের সবচেয়ে অন্ত:দৃষ্টিপূর্ণ ডিস্টোপিয়া। তিনি খুব সন্দেহবাদী এবং নিরাশাবাদী এবং তাকে মূল্যায়নের অনেক কারণ রয়েছে। তার অবস্থানের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নই; কিন্তু তার যুক্তি খণ্ডন করতে আমার খুব কষ্ট হয়। এই ডিস্টোপিয়া ওরওয়েলের ১৯৮৪’র সঙ্গে তুলনা করা যায়। ওরওয়েল বইটিতে লিখেছিলেন তার প্রজন্মের ভয় ভীতিগুলো নিয়ে। অন্যদিকে হাউলেবেক লিখেছেন, আমরা এই পরিস্থিতিতে পড়লে ঠিক কী হবে। 

একাকীত্ব, বিচ্ছেদ, জীবনের অর্থহীনতার শেষ পর্যায়।

আশা কোথায় থাকে?

হাউলেবেকের চিত্রায়ণে অসাধারণভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা নেই। বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গির অস্পষ্টতার জন্য কেবল রাজনীতি এবং ব্যক্তির ক্ষমতাহীনতাই দায়ী নয়। আর ঠিক এই কারণে, বর্তমান পরিস্থিতি বিপরীত কিছু হওয়ার সম্ভাবনাকে বাধা দেয় না। হতাশাবাদ - এটি নিষ্ক্রিয়তা, কিছুই করছে না। কারণ কিছুই পরিবর্তন করা যায় না; কিন্তু আমি নিষ্ক্রিয় নই। আমি বই লিখি এবং চিন্তা করি। কাজগুলোর সঙ্গে আমি মনে প্রাণে জড়িত। আমার ভূমিকা মানুষকে বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করা এবং এটি নিয়ে কিছু করা।


পাদটিকা
জঁ-পল সার্ত্রে : ফরাসি দার্শনিক, নাট্যকার, সাহিত্যিক এবং সমালোচক।
ইয়োহান ভল্ফগাং ফন গ্যেটে : জার্মান কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কূটনীতিবিদ ও প্রশাসনিক।
মিশেল হাউলেবেক : ফরাসি লেখক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং গায়ক। 


অনুবাদ : অরুন্ধতী বসু

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh