শিক্ষাঙ্গন-২০২১
এম ডি হোসাইন
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২২, ১১:২৮ এএম
ছবি: সংগৃহীত
করোনাভাইরাস মহামারিতে সবচেয়ে বেশি দিন বন্ধ ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ ৫৪৩ দিন বন্ধ থাকার পরে গত ১২ সেপ্টেম্বর সরাসরি ক্লাস শুরু হয়। তবে ২০২১ সাল অটোপাস দিয়ে শুরু হলেও বছরটি শুধু পরীক্ষা দিয়েই শেষ হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের বিষণ্ণতা কাজ করছে।
২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রকাশ করা হয় ২০২০ সালের এইচএসসি অটোপাসের ফল। আর এ বছর ২ ডিসেম্বর শুরু হয় এইচএসসি পরীক্ষা। ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ৬৯০ শিক্ষার্থী এতে অংশ নেন। এ ছাড়া করোনাকালে নানা প্রতিকূলতার মাঝেও হয়েছে শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও এমপিওভুক্তি। বছরজুড়ে বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনসহ নানা দাবিতে আলোচনার ছিল ২০২১ সাল। এখন করোনার নতুন ধরন ‘অমিক্রন’এর শঙ্কা নিয়ে বছর শেষ হচ্ছে। তাই নতুন বছরের শুরুতেও শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক হচ্ছে না।
ইতিমধ্যে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি মার্চ পর্যন্ত চলমান থাকবে। এর মধ্যে সংক্রমণ না বাড়লে তারপর শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে পারে। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দীর্ঘ সময় ধরে ঠিকমতো শ্রেণি কার্যক্রম না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের শিখন দক্ষতায় ঘাটতি রয়ে গেছে; কিন্তু শিক্ষা প্রশাসনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল- দ্রুত পরীক্ষা নিয়ে বা না নিয়ে শিক্ষার্থীদের কীভাবে ওপরের শ্রেণিতে ওঠানো যায়, তা নিয়ে। শিক্ষার্থীদের ঘাটতি পূরণে জোর কম ছিল। তবে ভবিষ্যতে দেশের শিক্ষায় আমূল পরিবর্তনের ঘোষণা এসেছে এ বছর। গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ রূপরেখার বিষয়ে সম্মতি দেন, যা বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আসবে।
এ বছরের শিক্ষা কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ক্ষতি পোষাতে দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা নিতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ক্ষতি পোষাতে আগের বছর (মার্চ ও এপ্রিল, ২০২০) থেকে অনলাইন, টিভি, রেডিওতে ক্লাস নেওয়া, অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সচল রাখাসহ কয়েকটি বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও, তা পর্যাপ্ত ছিল না। আর ডিজিটাল মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের সুবিধা সব শিক্ষার্থী সমানভাবে পায়নি। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা যাতে সংক্রমিত না হয়, সেই চেষ্টাও ছিল। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের করোনার টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। যদিও এ টিকাদানের হার সন্তোষজনক নয়।
শিক্ষাবিদদের পরামর্শ ছিল দীর্ঘ বন্ধে শিক্ষার্থীদের যে শিখন ঘাটতি হয়েছে, তা পূরণের জন্য চলমান শিক্ষাবর্ষ কিছু দিন বাড়ানো উচিত ছিল; কিন্তু সেটা হয়নি, উল্টো মাধ্যমিকের বার্ষিক পরীক্ষা এগিয়ে এনে নভেম্বরের শেষ করে এখন শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ করে রাখা হয়েছে। অথচ এই পরীক্ষা সব সময় হতো ডিসেম্বরে।
ফল ঘোষণা পরীক্ষা ছাড়াই : ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর কথা ছিল গত বছরের এপ্রিলে; কিন্তু করোনার সংক্রমণে দীর্ঘ বন্ধে এ পরীক্ষা আর নেওয়া যায়নি। এরপর সিদ্ধান্ত হয়, পরীক্ষা ছাড়াই আগের জেএসসি ও এসএসসি এবং সমমানের পরীক্ষার গড় ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে এ বছরের জানুয়ারিতে পরীক্ষা ছাড়াই এইচএসসির ফল প্রকাশ করা হয়। তাতে নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন প্রায় সাড়ে ১১ লাখ পরীক্ষার্থীর সবাই পাস করেন। এ ছাড়া আগের বছরের মতো এ বছরও পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা হয়নি। শর্ত সাপেক্ষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন বর্ষে পরীক্ষা ছাড়াই ওপরের শ্রেণিতে ওঠার সুযোগ দেওয়া হয়। বছরের শুরুতে পরীক্ষা ছাড়াই এইচএসসির ফল প্রকাশ হলেও বছরের শেষে এসে ভিন্নভাবে এইচএসসি পরীক্ষা হচ্ছে। তার আগে নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি পরীক্ষা।
ভিন্নতা ছিল ভর্তি পরীক্ষায় : সাত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর এ বছর প্রথমবারের মতো দেশের সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মিলিয়ে ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং তিনটি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। যদিও কিছু কিছু অভিযোগ ছিল এ পরীক্ষা নিয়ে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, যেসব ভুলত্রুটি ছিল, সেগুলো দূর করে ভবিষ্যতে এ ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও সুন্দর করলে এর সুবিধা আরও বাড়বে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রথম ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরেও ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছে। শুধু উচ্চশিক্ষায় নয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ভর্তির পদ্ধতিতেও বড় পরিবর্তন এসেছে। এবার কেন্দ্রীয়ভাবে ডিজিটাল লটারির মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী পরীক্ষার ঘোষণা : নবম ও দশম শ্রেণির কারিকুলাম অনুযায়ী, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ২০২৩ সাল থেকে পরিমার্জিত কারিকুলাম অনুযায়ী, শুধু দশম শ্রেণির কারিকুলামেই এ পরীক্ষা হবে। এ ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না। নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্যের মতো বিভাজন থাকবে না। সমন্বিত শিক্ষাক্রম হবে। পুরো শিক্ষাক্রম ২০২৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে।
শিক্ষকদের পদোন্নতি : দীর্ঘ অপেক্ষার পর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো ৫ হাজার ৪৫২ জন সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারের ১ হাজার ৮৪ জন সহকারী অধ্যাপককে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রভাষকদের পদোন্নতি : মূল্যায়নের মাধ্যমে বেসরকারি কলেজের প্রভাষকদের পদোন্নতি দেওয়া হবে। এ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রভাষকদের পদোন্নতির ১০০ নম্বরের মূল্যায়ন পরীক্ষা থাকবে। এর মধ্যে ১০ নম্বর অনলাইন ক্লাসের দক্ষতার ওপর রাখা হয়েছে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষক নিয়োগে বৃহৎ গণবিজ্ঞপ্তি : দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ৫৪ হাজার ৩০৪ জন শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ৩১ হাজার ১০১; মাদ্রাসা, কারিগরি ও ব্যবসায়ী ব্যবস্থাপনা ২০ হাজার ৯৯৬ এবং সংরক্ষিত পদে ২ হাজার ২০৭ জন নিয়োগ দেওয়া হবে। এখন ভেরিফিকেশন চলছে।
এমপিও নীতিমালা-২০২১ জারি : বেসরকারি স্কুল-কলেজের সংশোধিত এমপিও নীতিমালা-২০২১ ও জনবল কাঠামো জারি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রায় দেড় বছর সংযোজন-বিয়োজন করার পর নীতিমালাটি জারি করা হয়।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হল খোলা, পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ, স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের বিচার, বদরুন্নেসা মহিলা কলেজে শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের হুমকির বিচার, বাসে হাফ ভাড়া চালু, সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী হত্যার বিচারসহ নানা দাবিতে কয়েক দফায় রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা।
ডিজিটাল লটারি সিস্টেমে ভর্তি : স্কুল ভর্তির ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত তদবির বন্ধ করতে ডিজিটাল লটারির মাধ্যমে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
নানা দাবি নিয়ে মাঠে শিক্ষকরা : ৪ হাজারের বেশি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, মাধ্যমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের দাবিতে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ২৫ শতাংশের পরিবর্তে পূর্ণাঙ্গ ঈদ বোনাস, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড প্রদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবি, বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের বেতনও গ্রেড-৬ করাসহ নানা দাবিতে বছর ধরে নানা কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষকরা।