বাংলাদেশ কৃষির ৫০ বছর

ড. আবুল হোসেন

প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২২, ১২:৪১ পিএম

ড. আবুল হোসেন

ড. আবুল হোসেন

বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি কৃষি। জিডিপি বিচারে বর্তমানে শিল্পের অবদান বেশি হলেও কৃষির অবদানও ব্যাপক এবং কৃত্রিমতা বর্জিত, যা হোক জিডিপিতে কোন সেক্টর কত বেশি বা কম অবদান রাখছে, এটা এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। স্বাধীনতার ৫০ বছরে কৃষিতে আমাদের অর্জন, সংকট এবং সম্ভাবনার আলেখ্য এই নিবন্ধের আলোচ্য। সাদামাটাভাবে আমরা সবাই জানি কৃষিই বাংলাদেশের মেরুদণ্ড। 

‘ভাত’ আবহমান কাল ধরে বাঙালির প্রধান খাদ্য। খাদ্য নিরাপত্তা প্রশ্নে দৈনন্দিন জীবনে বাংলাদেশের মানুষের ভাতের জোগান থাকাটাই মুখ্য। তাই চাল-ধান উৎপাদনে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশের কৃষির অর্জন, সংকট এবং সম্ভাবনার নানান দিক নিয়ে আমাদের আলোচনা আবর্তিত হবে এই নিবন্ধে।

৭০-এর দশক (১৯৭১-১৯৮০) বাংলাদেশের কৃষির হালচাল

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। আজ বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৮ কোটির কাছাকাছি। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ৭০-এর দশকে প্রকৃতিনির্ভর কৃষি এবং বলদ-হালের ওপর নির্ভরশীল চাষাবাদে ৮ কোটি মানুষের খাদ্য জোগান দেওয়া সম্ভব ছিল না। সদ্য স্বাধীন দেশে ৮০ শতাংশ মানুষই ছিল দরিদ্র। এ দারিদ্র্য ছিল উত্তরাধিকার সূত্রে। 

বিদেশ থেকে অন্তত ৩৫ শতাংশ খাদ্যশস্য আমদানি করতে হতো। ১৯৭৪ সালে ভয়াল দুর্ভিক্ষে ৫ লাখ মানুষ খাদ্যাভাবে মারা যায়। কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন ছাড়া দেশের মানুষকে বাঁচানো যাবে না- উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘সবুজ বিপ্লবের’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু। কৃষিতে ‘সবুজ বিপ্লবের’ ডাক কৃষি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের সূচনা করে। বাংলাদেশে বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদ কৌশল এবং টেকসই কৃষির যাত্রা শুরু হয় এই সবুজ বিপ্লব কর্মসূচির মাধ্যমেই। সবুজ বিপ্লবের ডাক ছিল প্রকৃতিনির্ভর আমন এবং আউশ ধানের স্বল্প উৎপাদনের বেড়াজাল ভাঙার ডাক। সবুজ বিপ্লব ব্যাপক জমি আবাদের এবং সেচের আওতায় নিয়ে আসে। ইরি-বোরো ধানের ফলন বেশি। তাই ধানের উৎপাদন বেড়ে যায়। 

১৯৭১-৭২ অর্থবছরে সেচের আওতায় জমি ছিল ১১৮৭৪ হেক্টর।

১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে সেচের আওতায় জমি বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭৭১৪ হেক্টর। 

চার বছরে ৪ গুণেরও বেশি জমি সেচের আওতাভুক্ত হয় সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচির কারণে।

৮০-র দশক এবং আজ অবধি, বাংলাদেশের পাঁচ দশকে, কৃষির অগ্রযাত্রা বহমান। সরকারি এবং বাংলার কৃষকের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় উত্তরোত্তর উন্নতি হচ্ছে, কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পাচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষি এখন অনেক শক্তিশালী। দেশে দরিদ্রতা কমেছে কৃষির উন্নতির কারণে। 

কৃষি গবেষণা ও প্রযুক্তি

১৯৭১-৭২ যে পরিমাণ চাল বাংলাদেশে উৎপন্ন হয়েছিল তার চেয়ে সাড়ে চারগুণ বেশি চাল উৎপন্ন হয় এখন। গত ৫০ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপক (১৮ কোটি এখন), ধানের উৎপাদন বেড়েছে। গম এবং আলুর উৎপাদনও বেড়েছে বহুগুণে। কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষিকেন্দ্রিক শিক্ষা এবং গবেষণার ফলশ্রুতিতে এত উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা ১২৯ জাতের উচ্চ ফলনশীল ধানের এবং ৩৭টি গমের জাত আবিষ্কার করেছে। জমি চাষ, ধান-গম মাড়াই যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। গত দুই দশকে শতভাগ জমি কলের লাঙল দিয়ে চাষ হচ্ছে। চাষাবাদ পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। 

কৃষকের উন্নতি কেমন হচ্ছে

বাংলাদেশে কৃষক পরিবারের সংখ্যা ১ কোটি ৬৭ লাখ। ধান, গম, ভুট্টা এবং আলু চাষ করে এই কৃষকরা। সার, কীটনাশক, ডিজেলসহ কৃষি উপকরণের উত্তরোত্তর দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা কাঙ্ক্ষিত লাভ পাচ্ছে না। উৎপাদিত ফসলের দাম কম, তাই লাভও কম। কখনো কখনো লোকসানও হচ্ছে কৃষকের। সরকার কৃষি সেক্টরকে অনেক গুরুত্ব দিচ্ছে; কিন্তু কৃষকের উৎপাদিত ফসলের সঠিক মূল্য নিশ্চিত করতে পারছে না। ফড়িয়ারা লাভবান হচ্ছে বেশি। 

বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসাবটা কি নড়বড়ে

খাতা-কলমে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সাড়ে ষোল কোটির কিছু বেশি (ডিসেম্বর ২০২১-এর হিসাবে)। জনসংখ্যার এই হিসাবটা ধরেই বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য চাহিদা, বিশেষত জনপ্রতি দৈনিক এবং বাৎসরিক চালের চাহিদা হিসেব করা হয় সরকারিভাবে। দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ চাল উৎপন্ন হয় তা দেশের মানুষের জন্য ভাতের চাহিদা পূরণ করলেই দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বলতে দ্বিধা নেই শহর-গ্রাম সর্বত্র ভাতই আমাদের প্রধান খাদ্য। প্রায় একযুগ ধরে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এ কথা আমরা বলে যাচ্ছি, বাংলাদেশ সরকার বলে যাচ্ছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ, এটা আমাদের গর্বের; কিন্তু কোথাও একটা গোলমাল আছে, যে কারণে গত দশ বছরে সরকারি হিসেবে এক কোটি টনেরও বেশি চাল আমদানি করতে হয়েছে। বেসরকারি হিসাবে চাল আমদানির পরিমাণ সরকারি হিসাবের অনেক বেশি। দ্বিগুণ তো হবেই। 

দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রতিজন মানুষের দৈনিক চালের চাহিদা ৫০০ গ্রাম এরও কম। গত দশ বছরে দেশে চাল উৎপাদিত হয়েছে ৩৫ কোটি ৬৪ লাখ টন। উপরোক্ত হিসাব থেকে দেখা যায় সাড়ে ষোল কোটি মানুষের চালের চাহিদা মিটিয়ে গত দশ বছরে ৬ কোটি টনেরও বেশি চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। এ চাল নেই, বরং কোটি কোটি টন চাল আমদানি করতে হয়েছে গত দশ বছরে। 

অন্য একটি গবেষণা বলছে, বিদেশ থেকে চাল আমদানির শূন্য শুল্কের সুযোগে ২০১৭-১৯- এ দু’বছরে ১০ লাখ টন চালের ঘাটতি মেটাতে ৬০ লাখ টন চাল আমদানি করেছিল ব্যবসায়ীরা। যে কারণে উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামও পায়নি কৃষক। প্রতিমণ ধান ৪০০-৫০০ টাকা দরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে কৃষক (ধানচাষি কৃষক-সংকটের নতুন ধারা, আবুল হোসেন ও আহসান হাবীব, ২০২০)।

তাহলে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা দেশ বলা যাচ্ছে কী? আর একযুগ ধরে আমরা যে বলে আসছি, বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ-এটা কি ঠিক নয়? ঠিক বা ঠিক নয়-এ বিতর্কে না জড়িয়ে আমি বলব কোথাও একটা গোলমাল আছে। দীর্ঘ দিনের গবেষণার অভিজ্ঞতা এবং কিছু নিবিড় পর্যবেক্ষণ থেকে দুটি কারণ খুঁজে পাই আমি-

এক. পেপার-পত্রিকা, রাজনৈতিক সভা-সর্বত্রই বলা হচ্ছে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সাড়ে-সতের বা আঠারো কোটি। আর সরকারি পরিসংখ্যান বলছে সাড়ে ষোল কোটি। এই সাড়ে ষোল কোটি মানুষের হিসাব ধরেই সরকারি পরিকল্পনা করা হয়ে থাকে; কিন্তু বাংলাদেশে প্রকৃত জনসংখ্যা ১৮ কোটির কাছাকাছি-এটাতো বাস্তবতা। তাই ১৮ কোটি মানুষের ভাতের চাহিদা বাংলাদেশে বাৎসরিক উৎপাদিত চাল পূরণ করতে পারছে কি না- এ হিসাবটার ভেতর লুকিয়ে আছে- বাংলাদেশ কতটা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। 

দুই. ইদানীং, ৮/১০ বছর ধরে ধানি জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করার প্রচলন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে। রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগে। এই দুই বিভাগের জেলাগুলোতে দেশের মোট উৎপাদিত ধান বা চালের ৩৩ শতাংশ উৎপন্ন হয়। প্রতি বছর ধানি জমিতে পুকুর খনন দুরন্ত গতিতে চলছে; কিন্তু জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হচ্ছে না। অর্থাৎ ধানি জমিতে পুকুর খনন করে মাছ চাষ করা হচ্ছে, তবুও উপজেলা কৃষি বা পরিসংখ্যান দপ্তরে হাজার হাজার হেক্টর পুকুর এখনো ধানি জমি হিসেবেই বিদ্যমান। আর এ কারণে উপজেলা কৃষি বা পরিসংখ্যান অফিস প্রতি মৌসুমে ধান উৎপাদনের যে হিসাব দিচ্ছে, তা সঠিক নয়। অর্থাৎ দেশে ধান বা চাল উৎপাদনের চিত্রটা গোলমেলে। প্রকৃত চাল উৎপাদনের পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ থাকে সরকারি হিসাবে।

এখন প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক পুকুর খনন করার পর জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হচ্ছে না কেন? কারণ, জমির শ্রেণি পরিবর্তনে আইনি কড়াকড়ি আছে। জমির শ্রেণি পরিবর্তন করতে হলে উপজেলা ভূমি অফিসের মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করতে হয়। জেলা প্রশাসক খুব সহজে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করতে দিতে চান না; বস্তুত আইনটা কৃষি জমি রক্ষার জন্যই করা হয়েছে। জমির শ্রেণি পরিবর্তন সহজ নয় জেনেই লোকজন ধানি জমি পুকুরে রূপান্তরিত করেও ওই জমিকে ধানি জমি হিসাবেই দেখাচ্ছে। কৃষি অফিসের খাতায় ওখানে ধান উৎপন্ন হচ্ছে; কিন্তু বাস্তবে সেখানে মাছ উৎপাদন হচ্ছে। বাস্তবের সঙ্গে খাতার হিসাবের ফারাক থাকলে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ কথাটা জোরে-সোরে বলা যাচ্ছে কি?


লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, গ্রিন ইউনিভার্সিটি

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh