স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২২, ০১:৫৮ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব তাঁকে চেনে আশাবাদ আর তার চিরচেনা প্রাণখোলা হাসির জন্য। সেই হাসি আজ কেবলই ইতিহাস। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী শাসনের অবসানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু বিদায় নিলেন। ৯০ বছর বয়সে ২৬ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
তার মৃত্যু মানে এক বর্ণাঢ্য সংগ্রামী আখ্যানের সমাপ্তি। তবে তার দেখানো সংগ্রামের পথ শেষ হয়ে যায়নি। কারণ আজও এ বিশ্বে বর্ণবাদ এক নির্মম বাস্তবতা। তাই এর বিপরীতে সংগ্রামও আরেক বাস্তবতা। আর সেখানেই তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
প্রস্টেট ক্যান্সারের সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে কেপটাউনে তাঁর মৃত্যু হয়। ১৯৯০ দশকের শেষের দিকে টুটুর প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়ে। গত কয়েক বছরে তাকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামফোসা তাঁকে একজন ‘কিংবদন্তিতুল্য আধ্যাত্মিক নেতা, বর্ণবাদ শাসনবিরোধী যোদ্ধা এবং বিশ্ব মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা’ বলে বর্ণনা করেন। নেলসন মান্ডেলা ফাউন্ডেশনও তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বলেছে, ‘অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তিনি স্থানীয়ভাবে এবং বিশ্ব পরিসরে যে অবদান রেখেছেন, তার তুল্য কেবল তিনি নিজেই। তিনি ছিলেন এক অসাধারণ মানুষ, একজন চিন্তাবিদ, একজন নেতা, একজন পথনির্দেশক।’ এ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।
ডেসমন্ড টুটু ১৯৩১ সালের ৭ অক্টোবর ট্রান্সভাল সোনার খনির শহর ক্লার্কসডর্পে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জাকারায়া ছিলেন শিক্ষক এবং মা আলেটা ছিলেন গৃহিণী। তিনি প্রাথমিকভাবে তার বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন; কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের জন্য স্কুলে পড়ালেখার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে শিক্ষকতা ছেড়ে দেন। টুটু বিশপ ট্রেভর হাডলস্টন এবং অন্য বর্ণবাদবিরোধী শ্বেতাঙ্গ পাদরিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ১৯৬১ সালে একটি গির্জার যাজক নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালে জোহানেসবার্গের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাংলিকান ডিন নির্বাচিত হন। ১৯৭৬-৭৮ সময়কালে তিনি লেসোথোতে বিশপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি জোহানেসবার্গের বিশপ নিযুক্ত হন। পরের বছর তিনি কেপটাউনের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ বিশপ হন। তার উচ্চ-পদমর্যাদা ব্যবহার করে তিনি নিজ দেশে কৃষ্ণাঙ্গরা যে নিপীড়নের শিকার হন, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তিনি অবশ্য সবসময় বলেছেন, তার প্রতিবাদ ধর্মীয় অবস্থান থেকে, রাজনৈতিক নয়। তবে শেষ বিচারে ধর্মীয় বা সামাজিক আন্দোলন বা প্রতিবাদগুলোরও যে রাজনৈতিক বাস্তবতা রয়েছে, সেটিও টুটুর বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামেই প্রকাশ পেয়েছে।
তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনবিরোধী সংগ্রামের প্রধান নায়ক নেলসন ম্যান্ডেলার সমসাময়িক। ১৯৪৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ শাসকরা যে বর্ণবাদী শাসন চালিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক শক্তি। ম্যান্ডেলা কারাগারে থাকাকালে তাঁর আন্দোলন এগিয়ে নেন টুটুসহ অন্যরা।
বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটাতে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের সংগ্রামে তিনি যে অবদান রাখেন, সে জন্য তাঁকে ১৯৮৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালে সিডনি শান্তি পুরস্কারসহ ২০০৭ সালে গান্ধী শান্তি পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটুকে ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার দীর্ঘ এবং যন্ত্রণাময় স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা কল্পনা করা কঠিন। যখন এই সংগ্রামের অন্য নেতারা নিহত হন, নির্বাসনে বা কারাগারে বন্দি ছিলেন, তখন এই বিদ্রোহী যাজককেই সবখানে বক্তব্য রাখতে দেখা গেছে। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন বর্ণবাদী শাসন কাঠামোকে বিশ্বের সামনে উন্মোচিত করেছেন। সেইসঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামকেও জবাবদিহিতার মুখোমুখি করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী শাসকদের হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাদের একঘরে করার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন।
১৯৯৪ সালে যখন নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হন, তখন তিনি ডেসমন্ড টুটুকে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ স্থাপনের দায়িত্ব দেন। বর্ণবাদী শাসনের সময় শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ- উভয় সম্প্রদায় পরস্পরের বিরুদ্ধে যেসব অপরাধ করেছিল, সেগুলো তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এই কমিশনকে। আবার পরবর্তীকালে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার এবং দেশটির স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ব্যর্থতার বিরুদ্ধেও তাঁকে একই রকম বলিষ্ঠ ভূমিকায় দেখা গেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের অবসানের পর বহু বর্ণ এবং জাতির এই দেশটিকে যে ‘রেইনবো ন্যাশন’ বলে বর্ণনা করা হয়, সেই শব্দগুচ্ছ তারই দেওয়া। তবে তিনি পরবর্তী জীবনে এই বলে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন যে, যেভাবে তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় সব কিছু সেভাবে ঘটেনি।
ডেসমন্ড টুটু তাঁর প্রতিবাদ দক্ষিণ আফ্রিকার সীমানা ছাড়িয়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। টুটু তার গির্জায় ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের বর্ণবাদী আচরণ, ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসন এবং এর সমর্থকদের নিন্দা জানিয়েছেন। শান্তির সন্ধানে তাঁর সাধনা তাঁকে সাইপ্রাস, উত্তর আয়ারল্যান্ড, এমনকি কেনিয়া পর্যন্ত নিয়ে গেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের কাছে ডেসমন্ড টুটুর ব্যক্তিগত সাহস এবং তাঁর নৈতিক অবস্থান এক শিক্ষণীয় বাস্তবতা। তাদের কাছে তিনি ছিলেন বরাবরই এক আশাবাদী কণ্ঠস্বর। আর বাকি বিশ্বের কাছে তিনি পরিচিত সংগ্রামী চেতনা এবং তার সেই চিরচেনা হাসির জন্য। ওই অমলিন হাসির মতোই সংগ্রামী চেতনায় ডেসমন্ড টুটু থাকবেন অমলিন।