আমি বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসি: কনক চাঁপা চাকমা

অলকানন্দা রায়

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২২, ০৩:০৪ পিএম

কনক চাঁপা চাকমা। ছবি: সংগৃহীত

কনক চাঁপা চাকমা। ছবি: সংগৃহীত

কনক চাঁপা চাকমা, জন্ম- ৬ মে, ১৯৬৩। একজন বাংলাদেশি চাকমা শিল্পী। চিত্রকলায় তিনি সাফল্যের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংখ্যালঘুদের জীবনকে চিত্রকর্মের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। তাঁর আঁকায় নারী জীবন বিশেষভাবে উঠে এসেছে। তিনি আমাদের দৈনন্দিন মানুষের জীবন- বাস্তবসম্মত এবং বিমূর্ত এ দুইয়ের মিশ্রিত রূপ আঁকতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি গুণী এই চিত্রশিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছেন অলকানন্দা রায়।

বর্তমান সময়ে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, নারীর প্রতি সহিংসতা বা সংস্কৃতির প্রতি আগ্রাসন, এইগুলো আপনার শিল্পে বা আঁকায় কীভাবে ছাপ ফেলে? একজন শিল্পী হিসেবে কী আপনার শিল্পে এসব তুলে ধরার দায় আছে? 

বর্তমান যে অবস্থা, যে সহিংসতা দেখা দিয়েছে সেটি কেবল আমাদের নয়, এটা কিন্তু পৃথিবীর বহু দেশেই হচ্ছে, এটা খুব দুঃখজনক আমরা এসব প্রতিনিয়তই দেখতে পাচ্ছি এবং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এটা ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলছে এবং সত্যিকার অর্থে মনে খুবই কষ্ট হয়। এইসব যখন ভাবিয়ে তোলে, তখন ছবি আঁকার মধ্যে একটা স্থবিরতা চলে আসে, প্রাণ খুলে মন খুলে তখন আর ছবি আঁকা হয় না, তখন একটা কষ্ট, ভিতরে একটা যন্ত্রণা হতে থাকে, এরকম হলে ছবি আঁকব কীভাবে? এক সময় সেটার বহিঃপ্রকাশ হয় ছবিতে। 

আর অনেক শিল্পী তাঁর দেখা বিভিন্ন বিষয় সরাসরি আঁকে, মারামারি, রক্ত, সহিংসতা নানান বিষয়; কিন্তু আমি সরাসরি কখনো আঁকি না। আমার চিত্রে সবসময় তা প্রতীকীভাবে এসেছে। আমি লাল রং ব্যবহার করেছি প্রতিবাদ হিসেবে, কালো রং ব্যবহার করেছি একদম দুঃখ যন্ত্রণায় ভরা জীবন বোঝাতে। সেখানে আমি দেখিয়েছি মানুষ, বেদনাহত মুখ, কালোর ভিতর থেকে এগিয়ে যাচ্ছে আলোর দিকে। আমি আবার বুড্ডিস্ট স্টাইলের ছবি নিয়েও কাজ করি, যেমন ঘণ্টা হলো শান্তির প্রতীক, যখন একটা ঘণ্টা অনেক ঘন ঘন করে বাজতে থাকে, সেটায় কখনো লাল রং, কখনো কালো রং দিয়ে বোঝাই যে সেটা অনেক রাগান্বিত, বিক্ষিপ্ত।

আপনার সাম্প্রতিক সময়ের ছবি আঁকার ভাবনাগুলো কী কেন্দ্রিক?

সাম্প্রতিক সময়ে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া পাহাড়ধসের ওপরে কাজ করছি, জলাবদ্ধ গ্রাম, পাহাড়ধসে এতসংখ্যক মানুষের মৃত্যু, বনের গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে, নদী ভাঙন, বৃষ্টি, বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া ঘরবাড়ি, এখন আমি এইসব বিষয় নিয়েই কাজ করছি। মানুষ কষ্ট পাচ্ছে, দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে, রিফিউজি হয়ে পড়ছে, তারা আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছে, তাদের দুঃখগুলো, যন্ত্রনাগুলো ক্যানভাসে ফোটানোর চেষ্টা করছি। 

পূর্বে আপনার যে ভাবনাগুলো কাজ করত আঁকার ক্ষেত্রে, এখন কি ওই ভাবনার সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের ভাবনাগুলোয় কোনো পরিবর্তন এসেছে?

সাবজেক্ট তো ঘুরে ফিরে সবগুলোই চলে আসে, আমার আঁকায় বুড্ডিস্ট ফিলসফি আছে, পাহাড়ের জীবন, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সবকিছুই তো চলে আসে। বর্তমানে যেটা আমি ফেস করছি ওটাই ক্যানভাসে আমার সাবজেক্ট হয়ে ধরা দেয়। ওটা নিয়েই আমি কাজ করি। সব সময় যে একই সাবজেক্ট নিয়ে কাজ করি এমন না। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে কাজ করতেই অধিক ভালোবাসি। 

ক্যানভাসের আপনি আর ব্যক্তি আপনি দুইয়ের মধ্যে কোনটি আপনার কাছে বেশি ভালো লাগার?

আসলে দুটি সত্তা মিলিয়েই একজন। মানুষ যে খুব বেশি আলাদা তা কিন্তু না, আর ব্যক্তিজীবনের ভাবনাকে কেন্দ্র করেই কিন্তু সেগুলোর বহিঃপ্রকাশ হয় ক্যানভাসে। যে ভাবনাগুলো আসে, যে অনুভূতিগুলো হয় ভালো লাগার খারাপ লাগার সেগুলো তখন ক্যানভাসে বহিঃপ্রকাশ হয়। তবে আমি বলব যে, ব্যক্তি হিসেবে আমি একজন সৎ মানুষ। সততার মূল্য আমার কাছে অনেক বেশি এবং সেটা আমার কাজের ক্ষেত্রে ছাপ ফেলে। আমার কাজের সঙ্গে আমি অনেক সৎ, কারণ মনে করি সততা না থাকলে জীবন কখনো সুন্দর হয় না। স্বস্তি আসে না, সুন্দরভাবে জীবন পরিকল্পনা করা যায় না, আর ছবি আঁকার ক্ষেত্রেও যদি সৎ প্রচেষ্টা না থাকে সেটা কিন্তু একটা ভালো ছবি হয়ে ধরা দেবে না। সেই ছবি স্নিগ্ধ হবে না, ভালো হবে না, তখন নিজের কাছে নিজের প্রতারণা বলে মনে হবে। আমি এমনিতেও খুব অপটিমিস্টিক মানুষ, আমার কাছে নেগেটিভ কোনো কিছু ধরা দেয় না। আমি সব জিনিসকে সুন্দরভাবে দেখে রাখার চেষ্টা করি। 

অনেকেই বলেন যে, যাদের জন্য আঁকছি তারা বুঝতে পারছেন না। মানুষের শিল্পের প্রতি আগ্রহ নেই এবং শিল্পের প্রতি যে নান্দনিক বোধ থাকা দরকার সেটা নেই। আপনার কী মনে হয়? 

এটা আসলে, অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট যারা করে, বিমূর্ত শিল্প যারা করে তাদের ছবি দেখে দর্শকরা একটু দ্বন্দ্বে পড়ে যায়, বুঝতে পারে না, তখন কিন্তু যেহেতু আমাদের দেশে ছোটবেলা থেকেই চিত্রকলার চর্চা হয় এবং ছোটবেলা থেকেই চিত্রকলার ওপরে একটা ধারণা দেওয়া হয় এবং মূর্ত বিমূর্ত ছবি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। তাহলে না বোঝার সমস্যাটা আর থাকবে না। 

আমার ছবি খুব সরল, খুব সহজ, আমি যা ভাবি, আমি যেখানে বড় হয়েছি, আমার যে জীবনধারা, আমার যে সংস্কৃতি, এটাকেই কিন্তু আমি সরাসরি আঁকছি। হয়তো অনেক আধুনিকভাবে সেটা উপস্থাপন করছি। যেটাকে শিল্পের ভাষায় বলে সহজীকরণ, এ মাধ্যমটাকেই আমি গ্রহণ করেছি। কাজেই আমার ছবি না বোঝার কোনো কারণ নেই। 

অনেকেই তো অনেক ফর্মে ছবি আঁকেন। শিল্পের ক্ষেত্রে ফর্ম বিষয়টা তো থাকেই। আপনার ফর্মগুলো কেমন?

ছবিতে শুধু পাহাড়গুলোকেই আমি ফর্মের মধ্যে নিয়ে আসি। যেমন- পাহাড়ি মেয়েদের পিঠে বহন করার ঝুড়ি, ঘরবাড়ি, ঢেউ খেলানো পাহাড় আধুনিক একটা ফর্মে নিয়ে আসি। লাইন কিংবা সরু রেখার মাধ্যমে ফর্ম তৈরি করি বা কালারগুলো দিয়ে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে সেটা বাস্তবসম্মত নয়, তবে সরে যাই না আমার সহজীকরণ থেকেও।

শিল্পানুরাগী বা সাধারণ দর্শকদের উদ্দেশ্যে আপনার কিছু বলার আছে? 

শিল্পানুরাগী বা দর্শকদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। তাঁদের কাছে প্রত্যাশা তাঁরা যেন আমার ছবিটা বোঝার চেষ্টা করে, আমি যেভাবে আঁকি, যে দৃষ্টিকোণ থেকে আঁকি তারা যেন সেগুলো মন দিয়ে দেখে এবং ছবিগুলোকে বোঝার চেষ্টা করে। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে, আমার অনুভব থেকে যদি বোঝার চেষ্টা করে তাহলেই আমার ছবি আঁকার স্বার্থকতা।  

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh