ওমিক্রনের আতঙ্ক বাংলাদেশে

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৩৩ এএম

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে ওমিক্রনের আতঙ্ক শুরু হয়েছে। তবে প্রচলিত টিকাগুলো এর বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে। ইতিমধ্যে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সরকার ১১ দফা বিধি-নিষেধ জারি করেছে। করোনাভাইরাসের এই ধরনটি খুব বেশি সংক্রামক; কিন্তু ডেল্টা ধরনের তুলনায় কম মারাত্মক।

বাংলাদেশে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে হঠাৎ করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেছে। সরকারিভাবে জিনোম সিকোয়েন্স করে এ পর্যন্ত ২৪টি ওমিক্রনের কেস ধরা পড়লেও, ধারণা করা হচ্ছে বর্তমানে ওমিক্রনের কমিউনিটি সংক্রমণ হচ্ছে। এসব কারণেই ভাইরাসটি বেশি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে ১১ দফা বিধিনিষেধ জারি করেছে এবং তা কার্যকর হবে ১৩ জানুয়ারি থেকে।

অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে লাখলাখ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন। যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশে হাসপাতালে ভর্তির হারও বেড়ে চলেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের গবেষণায় দেখা গেছে, আগের ধরনগুলোর মতো ওমিক্রনের কারণে মানুষ খুব বেশি অসুস্থ হয় না। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের ১২৮টি দেশে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতেও এই ওমিক্রনের সংক্রমণ বাড়ছে। গত সপ্তাহে ওমিক্রনে শনাক্ত একজনের মৃত্যু হয়েছে দেশটিতে। 

ওমিক্রনের লক্ষণ : অনেক মানুষের কাছে ওমিক্রন সাধারণ ঠান্ডার মতো। অনেকে বলেছেন, ওমিক্রনে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের গলা শুকিয়ে যাওয়া, সর্দি লাগা, শরীরের জয়েন্টে ব্যথা বা মাথাব্যথা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘সাধারণ সর্দি-কাশির ও জ্বরের মতোই ওমিক্রনের লক্ষণ। ডেল্টা বা অন্য ধরনগুলোর মতো অতটা প্রকট নয়। অনেকের ফুসফুসের ওপরের দিকে ব্যথা হতে পারে। লক্ষ্মণ ডেল্টার মতো না হলেও, অনেকটা হালকা ধরনের হলেও করোনাভাইরাসের লক্ষ্মণের মতো হলেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।’

সরকারি তরফ থেকে যেসব সতর্ক বার্তা নেওয়ার কথা কথা বলা হয়েছে, সেগুলো নিতে হবে। করোনাভাইরাসের আদি ধরনে (চীনের উহান ভাইরাস) বা ডেল্টা ধরনে আক্রান্ত হলে স্বাদ বা গন্ধ চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটতো, কাশি এবং উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর হতো। এখনো করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এই তিনটি প্রধান লক্ষণই দেখা যাচ্ছে। 

চিকিৎসকরা বলছেন, ওমিক্রনে আক্রান্ত হলে অনেক সময় হালকা ঠান্ডা বা সাধারণ অসুস্থতার মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। এ ছাড়া আরও কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে। সেগুলো হলো- বুকের ওপরের অংশে ব্যথা, মাথাব্যথা, জ্বর আসার পর ক্লান্ত লাগা, শরীরে ব্যথা এবং গলা শুকিয়ে যাওয়ার অনুভূতি হতে পারে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, আগে অনেক কিছু বলা হলেও, এখন বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বলছেন, প্রচলিত যে করোনার টিকাগুলো রয়েছে, সেগুলো নিলে কিছুটা সুরক্ষা পাওয়া যায়। বয়স্কদের বুস্টার ডোজ দেওয়া হলে তারা আরও বেশি সুরক্ষা পেতে পারেন। তবে জার্মানির বায়োএনটেকের সিইও ওগোর শাহীন যুকবত ফাইজারের সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছেন যে, খুব শিগগিরই তারা ওমিক্রনের বিরুদ্ধে কার্যকর টিকা নিয়ে আসবেন। গত বছরের নভেম্বর মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম ওমিক্রন শনাক্ত হয়। সেখানে রোগটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। 

ওমিক্রনের সঙ্গে অন্য ধরনগুলোর পার্থক্য : সব ধরনের ভাইরাস দ্রুত অভিযোজিত হয় বা নিজেকে বিস্তার করে। প্রকৃতিতে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য ভাইরাস নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনে। দেখা যায়, পরিবর্তন হওয়ার পর বেশির ভাগ ভাইরাসই আর প্রকৃতিতে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারে না, দুর্বল হয়ে যায়। করোনাভাইরাসের নিজের মধ্যে যেসব পরিবর্তন এনেছে, এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ছিল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট; কিন্তু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টও অনেকটা দুর্বল হয়ে গেছে নানা কারণে।

প্রথমত, একটি ভ্যারিয়েন্ট দীর্ঘ দিন টিকে থাকে না। আবার এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষকে করোনার টিকা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও এ পর্যন্ত চার কোটির বেশি মানুষকে দুই ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও ডেল্টা ধরন দুর্বল হতে শুরু করেছে। বলা চলে অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই চলে এসেছিল। এর মধ্যেই হঠাৎ করে ওমিক্রন সংক্রমণ শুরু হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসের নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনতে গিয়ে অনেক ভ্যারিয়েন্ট ভাইরাসকে আরও বেশি ক্ষতিকর করে তুলতে পারে। আবার অনেকগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা অর্জন করে। এর মধ্যে ওমিক্রন এমনই এক প্রকার করোনাভাইরাসের ধরন। তবে করোনার ডেল্টাসহ অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ওমিক্রন খুব দ্রুত ছড়ায়; কিন্তু এটি ততটা প্রাণঘাতী নয়। বিশ্বব্যাপী দেখা গেছে, এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও অন্যগুলোর তুলনায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার হার কম। ব্রিটেনে ইতিমধ্যে সংক্রমণ ৬ শতাংশের নিচে চলে এসেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে ওমিক্রন মাত্র শুরু হয়েছে। ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ৮.৫৩ শতাংশ ছিল। 

ওমিক্রনে টিকা কতটা কার্যকর : করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের ভ্যারিয়েন্ট অমিক্রনের স্পাইক প্রোটিনে (করোনাভাইরাসের ওপরের অংশের কাটার মতো অংশ) ৫০টির বেশি পরিবর্তন হয়েছে। এত বেশি পরিবর্তন করোনাভাইরাসের অন্য কোনো ধরনের স্পাইক প্রোটিনে কখনো হয়নি। ফলে প্রথম বিজ্ঞানীরা বলছিলেন, এ কারণে হয়তো প্রচলিত টিকাগুলো ওমিক্রনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে না; কিন্তু এর মধ্যে বিজ্ঞানীরা ওমিক্রন ধরন নিয়ে নতুন গবেষণা করে বলেছেন, প্রচলিত টিকাগুলোতেই কাজ করবে বুস্টার ডোজ দেওয়া হলে।

যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সংস্থা গবেষণা করে দেখতে পেয়েছে, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হলেও বুস্টার ডোজ নিলে ৮৮ শতাংশ ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ঠেকানো যায়। আর ওমিক্রনে মৃত্যু খুব বেশি নেই। অন্য ধরনগুলোর সঙ্গে এর আরেকটি বড় পার্থক্য লক্ষণ প্রকাশের ক্ষেত্রে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বিস্তারের ধরন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের অন্য ধরনগুলোয় লক্ষণ প্রকাশে অনেক সময় সাত দিন সময় লাগলেও, এই ক্ষেত্রে সাধারণত তিন দিনের ভেতর লক্ষণ প্রকাশ হয়ে থাকে।

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেছেন, করোনা ভাইরাসের ওমিক্রন না-কি ডেল্টা ধরনে আক্রান্ত হয়েছেন, চিন্তা না করে করোনাভাইরাসে যাতে আক্রান্ত না হন, সেই চেষ্টা করতে হবে। সে জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আর কোনোভাবে আক্রান্ত হয়ে গেলে আইসোলেশনসহ চিকিৎসার যেসব পদ্ধতি আছে, সেগুলোই অনুসরণ করতে হবে। বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরে বের হতে হবে। এ সময়ে জনসমাগম হয়ে থাকে এমন কোথাও না যাওয়াই ভালো। গণপরিবহনে চলাফেরা করলে সতর্কতার সঙ্গে মাস্ক পরে চলাফেরা করতে হবে। তবে বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত গণপরিবহনে চলাফেরা না করাই ভালো।

ওমিক্রন শনাক্ত করতে পরীক্ষা : সন্দেহভাজন রোগীর ওমিক্রন হয়েছে কি-না, সেটা জানতে পুরো জেনেটিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন হয়। আরটি পিসিআর মেশিন বা অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় ওমিক্রন ধরা পড়বে না। করোনাভাইরাসের পিসিআর মেশিনে মুখের যে লালা পরীক্ষা করা হয়, সে লালায় ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেলে, পরে সেটা পাঠিয়ে দেওয়া হয় জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য। সে জন্য চার থেকে পাঁচ দিন সময় লেগে যায়। জেনেটিক তথ্য, উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, আক্রান্ত ব্যক্তি ওমিক্রন না-কি অন্য কোনো ধরনে আক্রান্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের পরীক্ষা হচ্ছে শুধু সরকারের রোগতত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh