ফ্রান্স কেন ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করছে?

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২২, ০২:৩৮ পিএম

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

গত ৫ জানুয়ারি ফ্রান্স একটি মহড়ার অংশ হিসেবে বিমান বাহিনীর দুটি অত্যাধুনিক ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমানকে দক্ষিণ ভারত মহাসাগরীয় উপনিবেশ লা রিউনিয়ন দ্বীপে পাঠিয়েছে।

ফরাসি সূত্রের বরাত দিয়ে ‘ডাচ এভিয়েশন সোসাইটি’র ম্যাগাজিন ‘স্ক্র্যাম্বল’ এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘অপারেশন ম্যারাথন’-এর মাধ্যমে ‘রাফাল’ বিমানগুলোর সঙ্গে ছিল আকাশ থেকে আকাশে জ্বালানি দেবার সক্ষমতার একটা ‘এয়ারবাস এ-৩৩০ এমআরটিটি’ ট্যাংকার বিমান। বিমানগুলো ফ্রান্স থেকে শুরু করে কোথাও না থেমে সরাসরি ৮ হাজার ৮০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে লা রিউনিয়ন দ্বীপে নামে। আকাশ পথে ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমানগুলো দুটি ট্যাংকার বিমান থেকে আকাশেই ৬ থেকে ৭ বার জ্বালানি নিয়েছে। ‘মিশন শিকরা’র অধীনে এই অপারেশন ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলার কথা রয়েছে; যার অধীনে পূর্ব আফ্রিকার উপকূলে অন্তত ৫টি ভিন্ন অপারেশন পরিচালিত হবে। এ ছাড়াও বিমানগুলো পরবর্তীতে পূর্ব আফ্রিকার জিবুতিতে ‘খামসিন’ নামের এক মহড়ায় অংশ নেবে; মিসরেও তারা যাত্রাবিরতি করবে।

ফরাসি বিমান বাহিনী প্রধান জেনারেল লাভিয়েনে বলেছেন, ফ্রান্স ২০২৩ সালে আরেকটা বড় মিশনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, যার উদ্দেশ্য হবে ৪৮ ঘণ্টার মাঝে ২০টি ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান এবং তার সঙ্গে কিছু ট্যাংকার বিমানকে ইন্দো প্যাসিফিকে মোতায়েন করা। ‘অপারেশন ম্যারাথন’ সেই মিশনেরই একটা প্রস্তুতি।

ফরাসি এভিয়েশন ম্যাগাজিন ‘০৬৩০ ডেল্টা’ বলেছে, এই অপারেশন পরিচালিত হচ্ছে, ফ্রান্সের ‘স্ট্র্যাটেজিক এয়ার ফোর্সেসে’র অধীনে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো- ফরাসি পারমাণবিক সক্ষমতাকে জিইয়ে রাখা। একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই ফ্রান্স তার মূল ভূখণ্ড থেকে এত দূরে এ রকম মিশন পরিচালনা করছে। 

বিশাল দূরত্বে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করার ফরাসি মিশন এটাই প্রথম নয়। ‘স্ক্র্যাম্বল’ বলছে যে, ২০২১ সালের জুন মাসে ফরাসিরা ‘অপারেশন হেইফারা ওয়াকেয়া’র অধীনে ৩টি ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমানকে ফ্রান্স থেকে ১৭ হাজার কিলোমিটার দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে ফরাসি উপনিবেশ ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়াতে উড়িয়ে নিয়ে যায়। সঙ্গে ছিল ৩টি ট্যাংকার বিমান এবং একটা পরিবহন বিমান। পথিমধ্যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে নামে একবার। মিশনের মাধ্যমে তারা ৪৮ ঘন্টার মাঝে পলিনেশিয়ায় বোমাবর্ষণ করার সক্ষমতার কথা জানান দেয়। এর আগে ২০২০ সালের আগস্টে ফরাসিরা গ্রিসে ২টি ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছিল। ‘বিবিসি’র মতে, এই মিশনের উদ্দেশ্য ছিল, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তেল গ্যাস আহরণকে কেন্দ্র করে গ্রিসের সঙ্গে তুরস্কের উত্তেজনার মধ্যে গ্রিসকে আস্বস্ত করা। 

এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ আমেরিকার ক্যারিবীয় উপকূলে ফরাসি উপনিবেশ ফ্রেঞ্চ গায়ানাতে ফ্রান্স যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে। সর্বশেষ সেটা ছিল ২০২১ সালের নভেম্বরে। এভিয়েশন ম্যাগাজিন ‘এরোটাইম হাব’ বলছে যে, ফরাসি উপনিবেশ থেকে মহাকাশে ইউরোপিয়ান রকেট উৎক্ষেপণ করা হয়। সেখান থেকে ফরাসি সামরিক স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানো হয়, তখন এর জন্য আলাদা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। গত নভেম্বরে ‘ভেগা’ স্পেসক্র্যাফটের মাধ্যমে ৩টি গোয়েন্দা স্যাটেলাইট মহাকাশে প্রেরণ করার সময় ৩টি ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান, একটা ‘সি-১৩৫’ রিফুয়েলিং বিমান এবং একটা ‘বোইং ই-৩-এফ’ এয়ারবোর্ন ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল বিমান সেখানে প্রেরণ করা হয়েছিল। এ ছাড়াও ২০১৮ সালে একটা মহড়ার অংশ হিসেবে তিনটা ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমানকে অস্ট্রেলিয়াতেও পাঠানো হয়; সঙ্গে ছিল একটা ট্যাংকার এবং একটা পরিবহন বিমান। 

ফ্রান্স তার নৌবাহিনীর ইউনিটগুলোকেও বিশ্বব্যাপী মোতায়েন রাখছে। ২০২১ সালের প্রথমভাগে ৪ মাসের জন্য ফরাসি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘শার্ল দ্য গল’কে মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করা হয়। ‘ক্লিমেনসিউ ২১’ নামের সেই মিশনের প্রধান রিয়ার এডমিরাল অসেডাট বলেন, ২০১৫ সালের পর থেকে প্রথমবারের মতো ফরাসি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজকে মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করা হয়। এছাড়াও একই বছর ফরাসি হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার ‘টোনেরে’র নেতৃত্বে ফরাসি যুদ্ধজাহাজের গ্রুপ ইন্দোপ্যাসিফিক ঘুরে আসে। ‘মিশন জঁ ডে আর্ক’ নামের ৫ মাসের সেই মিশনে ‘টোনেরে’ জাহাজের সঙ্গেছিল ফ্রিগেট ‘সুরকুফ’। তবে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করতে যেখানে বেশ কিছু দিন বা সপ্তাহ বা মাস সময় লাগে, বিমান বাহিনীর বিমানগুলো কয়েক ঘন্টার মাঝেই মোতায়েন করা যায়। দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিমান শক্তি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রান্স তার বৈশ্বিক অবস্থানকে নিরাপত্তা দিতেই বিমান শক্তিকে বিশ্বব্যাপী মোতায়েন করার সক্ষমতার উপর জোর দিচ্ছে এবং একইসঙ্গে বাকি বিশ্বকে তা জানান দিচ্ছে। 

ফ্রান্সের এই বিমান মোতায়েনের দূরপাল্লার মিশনগুলো এমন সময়ে আসছে, যখন আফ্রিকায় ফ্রান্সের অবস্থান ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। ‘আল জাজিরা’র মতে, গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি প্রায় ৯ বছর পর ফরাসি সেনারা পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির উত্তরের তিমবুকতু শহর ছেড়ে যায়। ফ্রান্সের ‘অপারেশন বারখেইন’এর কমান্ডার জেনারেল এতিয়েন দু’পেইরু বলেন, ফ্রান্স ‘অন্যভাবে’ মালিতে তার অবস্থান ধরে রাখবে। মালির অভ্যুত্থানকারী সামরিক অফিসার আসিমি গোইতার নেতৃত্বে থাকা মালি রাশিয়ার ‘ওয়াগনার গ্রুপ’-এর ভাড়াটে সেনাদেরকে মালির সৈন্যদের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য মোতায়েন করছে; যা কি-না ফ্রান্সের সঙ্গে তার প্রাক্তন উপনিবেশ মালির দূরত্ব বাড়িয়েছে। এ ছাড়াও মালিতে ফ্রান্সবিরোধী চিন্তা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক জনগণ মনে করছে যে, ফরাসিরা মালির সহিংসতাকে কমাতে পারেনি; বরং তারা নিজেদের গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। মালির সহিংসতা সাম্প্রতিক সময়ে পার্শ্ববর্তী দেশ বুরকিনা ফাসোতে ছড়িয়ে পড়েছে। 

শুধু পশ্চিম আফ্রিকার মালিতেই নয়, পুরো আফ্রিকাজুড়ে ফ্রান্সের প্রভাব হুমকির মধ্যে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মধ্য আফ্রিকার দেশ শাদ এবং পশ্চিম আফ্রিকার গিনিতে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। মাদাগাস্কারেও সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চলেছে। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে গৃহযুদ্ধের মধ্যে রুশ ভাড়াটে সেনারা সরকারের নিরাপত্তা দিচ্ছে। মোজাম্বিকেও ফরাসি বিনিয়োগ গৃহযুদ্ধের হুমকির মাঝে রয়েছে।

মোট কথা ফ্রান্সের বিশ্বব্যাপী সামরিক শক্তি প্রদর্শনের প্রচেষ্টাগুলো ফ্রান্সের শক্তি নয়, বরং দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে। ফ্রান্স বিশ্বব্যাপী তার উপনিবেশগুলো এবং তার প্রভাবে থাকা দেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার ব্যাপারে আগের মতো নিশ্চিত নয়; বিশেষ করে দূরবর্তী ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলোর নিরাপত্তা ফ্রান্সের কাছে পুরোপুরি নিশ্চিত নয় বলে, সেখানে হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মাঝেই ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করার মিশন পরিচালনা করা হচ্ছে। ফ্রান্সের প্রভাবের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অন্যান্য শক্তির মধ্যে চলছে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh