নাজিম হিকমত
সুদেষ্ণা ঘোষ
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২২, ১২:১৭ পিএম
নাজিম হিকমত
১৯৫০ সালে যৌথভাবে নাজিম হিকমতের সঙ্গে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া পাবলো নেরুদা তাঁর কবিতায় লেখেন- ‘সদ্য মুক্তি পাওয়া/বন্দিদের একজন নাজিম হিকমত/তাঁর কবিতার মতো/লাল রঙ সোনার সুতায়/বোনা জামা উপহার দিয়েছে আমায়।’ তিনি আরও লেখেন কমিউনিস্ট বিপ্লবী, জেলখানার এই কবি হিকমত সম্পর্কে- ‘আমরা হেঁটেছি একসাথে/বরফে মোড়ানো স্তেপে;/রাত ছিল প্রজ্বলিত/ আমাদের নিজস্ব আলোয়।’
সরকার সমগ্র তুরস্কে যখন হিকমতের কবিতাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করল, ঠিক সেই সময়ে নাজিমের কবিতার অনুবাদ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়তে লাগল বহির্বিশ্বে। অথচ এই নিষিদ্ধ কবি নাজিম হিকমতকেই প্রথম আধুনিক তুর্কি কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ১৫ জানুয়ারি ১৯০২ সালে অটোমান তুরস্কের সালোনিকায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন পররাষ্ট্র প্তরের কর্মচারী। নাজিমের মা ছিলেন একজন শিল্পী আর পিতামহ ছিলেন কবি। এই দু’জনের সান্নিধ্য নাজিমকে প্রভাবিত করেছিল অনেক বেশি কবিতায় এবং শিল্পে। ধনী পরিবারের ছেলে হয়েও আমোদপ্রিয় জীবন কখনোই বেছে নেননি নাজিম। তিনি দেশের মানুষ এবং সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের নিকট যেন তাই হয়ে ওঠেন মুখপাত্র। তিনি স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীন রাষ্ট্রের। মাত্র ১৭ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতা।
মাতৃভূমিতে থাকার সুযোগ খুব বেশিদিন তিনি পাননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মিত্র রাষ্ট্রগুলো যখন তাঁর মাতৃভূমি ইস্তানবুলকে খল করে রেখেছিল। ঠিক তখনই তাঁকে শিক্ষা লাভের জন্য যেতে হয়েছিল মস্কোতে। আর সেখানে তিনি খো পেলেন সারা বিশ্ব থেকে আসা প্রচুর লেখক এবং শিল্পীর। পেলেন তাঁদের সংস্পর্শ। তাঁর পরিচয় হলো বামপন্থি আদর্শে বিশ্বাসী মায়াকোভস্কির সঙ্গেও। এই সুবাদে সারা পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হলেন তিনি। মেলবন্ধন ঘটল শিক্ষারও। ফলে তাঁর নিকট মস্কোর এই ভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধন নাজিমের ভাবনাকে দিলো এক নতুন দিশা। ১৯২৪ সালে স্বাধীনতার পর নাজিম তুরস্কে ফিরে এলেন; কিন্তু তাঁর বামপন্থি মতাদর্শই সমস্যার কারণ হয়ে উঠল। নাজিম সরকারের রোষানলে পড়তে শুরু করলেন। নাজিম ছিলেন কবিতা জগতের তাঁর সময়ের তুরস্কের একজন প্রতিভাবান কবি। এ সময়ে তিনি যোগ দিলেন নৌ বাহিনীতে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি রাশিয়ায় চলে এলেন। পরবর্তীকালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি সরব হলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। বামপন্থি পত্রিকায় স্বতন্ত্রভাবে লেখালেখি করার জন্য তিনি পুনরায় সরকারের বিরাগভাজন, এ সময়ে তিনি গ্রেফতারও হন। এবারে মাতৃভূমি ছাড়লেন। চলে গেলেন রাশিয়ায়। ১৯২৮ সালে মাতৃভূমিতে ফেরার জন্য তাঁর মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। ফলে দেশের কাছে ক্ষমা চেয়ে তিনি ওই বছরেই মাতৃভূমিতে ফিরে এলেন। এর পরবর্তী শ বছর ধরে নাজিমের নয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে পাঁচটি গ্রন্থ কবিতার সংকলন আকারে এবং বাকি চারটি গ্রন্থীর্ঘ কবিতা আকারে আত্মপ্রকাশ করে। এ সময়ে তিনি পাঁচবার জেলে গেছেন।
সে সময়ে মূলত তুরস্ক সরকারের সন্দেহ এবং বিরোধিতাই নাজিমকে সাধারণ মানুষের কাছে নায়ক করে তুলেছিল। করে তুলেছিল সাধারণ মানুষের মুক্তির দূত। ‘হিউম্যান ল্যান্ডস্কেপ ফ্রম মাই কান্ট্রি’ ছিল তাঁর দেশের শহর এবং গ্রামের নারী-পুরুষের জীবন সম্পর্কিত শোত্মবোধক কাজ, যা তৎকালীন সাহিত্য জগতে এক অনন্য সৃষ্টি। এদিকে তিনি আরও একবার রাজনৈতিক চাপের শিকার হলেন। তাঁর প্রগতিশীল ভাবনাকে তুরস্ক গ্রহণ করতে নারাজ হলো। কারণ তিনি ‘রোমান্টিক কমিউনিস্ট’ বা ‘রোমান্টিক বিপ্লবী’ নামে পরিচিতি পাচ্ছিলেন। তবুও যেন নাজিম মবার পাত্র ছিলেন না। লেখার কাজ তিনি সমানতালে চালিয়ে গেছেন। তিনি ‘স্বাধীনতার করুণ অবস্থা’ কবিতায় লিখেছেন- ‘তুমি তোমার শেকে ভালোবাসো/যেমন কাছের মানুষেরা-তোমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান।/কিন্তু উদাহরণ স্বরূপ-একদিন/তারা সমর্থন করবে আমেরিকাকে,/এমনকি তুমিও,স্বাধীনভাবেই/তোমার স্বাধীনতা আছে-/বিমানঘাঁটি তৈরি করার।’
গত শতকের চারের শকে নাজিম হিকমতের মুক্তির জন্য একটি আন্তর্জাতিক কমিটির মাধ্যমে চিলির বিখ্যাত কবি পাবলো নেরুা, দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্র, সংগীতশিল্পী পল রবসনের মতো কিপালেরা তাঁর মুক্তির উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি আঠারো দিনের জন্য অনশনে যান এবং এ বছরেই তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। নাজিম ছিলেন অত্যন্ত সাহসী এবং কোমল হৃদয়ের মানুষ। যিনি তাঁর জীবন অতিবাহিত করেছিলেন দুঃসাহসিকতার সঙ্গে।
শেষবার ১৯৫১ সালে তিনি মাতৃভূমি ত্যাগ করেছিলেন তারপর আর কোনোনি তিনি সেখানে পা রাখেননি মৃত্যুর আগে। এ সময়ে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইউরোপের বিভিন্ন অংশে বাস করেছেন। তিনি বামপন্থি মতাদর্শের একনিষ্ঠ অনুগামী, সর্বদা এ আদর্শের পথেই ছিল তাঁর চলা। তিনি দেশাত্মবোধক কবিতা লিখতেন প্রচলিত নিয়মেই; কিন্তু রুশ বিপ্লবের পর মাধ্যমে তাঁর কবিতার ঢং বদলে নেন, লেখার চিরাচরিত ধারা বর্জন করে বেছে নিলেন কাব্যগুণহীন ধারা।
নাজিম হিকমত তুর্কি ভাষায় কবিতা চর্চা করলেও তাঁর সৃষ্টি ভাষান্তরিত হয়ছে ইংরেজিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়, আর তা পৌঁছেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মেহনতি মানুষ ও কবিতাপ্রেমীদের নিকট। ১৯৬৩ সালের ৩ জুন নাজিম হৃদরোগে মারা যান। এর সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী থেকে চিরকালীন বিদায় নেন তুরস্কের প্রেমিক এই কবি, যিনি ছিলেন সারাপৃথিবীর নিকট এক আদর্শ।