মনজুরুল হক
প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৫৬ এএম | আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:৫৬ এএম
ছবি: সংগৃহীত
করোনা মহামারি নিয়ে আবারও তোলপাড় শুরু হয়েছে। গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে মনে হচ্ছিল, এবার শীতে বুঝি আর আক্রমণ হবে না; কিন্তু না, ঠিকই সংক্রমণ বাড়ছে। শুধু বাড়ছে না, নতুন স্ট্রেইন ওমিক্রনও ব্যাপকভাবে বিস্তার করছে। এ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে ১৪টি বাধ্যবাধকতা জারি করা হয়েছে। তার অন্যতম জনসমাগম করা চলবে না। তারই আলোকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা হবে কী হবে না, সংশয়ের দোলাচলে শেষ পর্যন্ত ঘোষণা এসেছে, মেলা ১৫ দিন পিছিয়ে আরম্ভ হবে। মনে হচ্ছে, বইমেলা শেষ পর্যন্ত হবে কি-না, নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
এখন প্রশ্ন হলো, করোনাভাইরাস কি মোটিভ দেখে দেখে আক্রমণ করে? তা না হলে বিপুল জনসমাগমের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা হচ্ছে কী করে? সেখানে যে পরিমাণ জনসমাগম হয়, তা কোনো অংশেই বইমেলার চেয়ে কম নয় বরং বেশি। আর সেখানে স্বল্প পরিসরেই মানুষজনকে গাদাগাদি করে চলাফেরা করতে হয়। একইসঙ্গে ধর্মীয় ওয়াজ-মাহফিল বন্ধ করতে বলা হয়েছিল। তাও বন্ধ হয়নি। সেসব যে বন্ধ হয়নি, তা দেখারও যেন কেউ নেই। এই প্রশ্ন তুললে বলা হবে-মনিটরিং করার যথেষ্ট পরিমাণ লোকবল নেই! প্রায় সাড়ে চার কোটি বেকারের দেশে এত এত উন্নয়নের পরও কেন এতো মানুষ বেকার সেই- প্রশ্নের সদুত্তর নেই। আবার ওই পরিমাণ বেকার মানুষ থাকার পরও ‘লোকবল নেই’ অজুহাত কেন? সেই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর নেই।
সরকারি ঘোষণা মতে, এবারের অমর একুশে বইমেলা ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। চলমান করোনা পরিস্থিতির কারণে দুই সপ্তাহ পিছিয়েছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি থেকে মেলা আরম্ভ হবে। তবে মেলা কতদিন স্থায়ী হবে তা বলা হয়নি। যদি ধরে নেওয়া যায়, অমর একুশে গ্রন্থ মেলার ঐতিহ্য অনুযায়ী ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিজুড়েই মেলা হবে। তাহলে মেলার সাকুল্য সময় দাঁড়াচ্ছে মোটে ১৩ দিন। কেন এমন সিদ্ধান্ত, তা নিয়ে অবশ্যি প্রকাশক গিল্ডের কোনো পক্ষই প্রশ্ন তোলেননি।
মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেছেন, ‘অফিসিয়াল চিঠি আমরা এখনো হাতে পাইনি। তবে দুই সপ্তাহ পিছিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে মেলা শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে শুনেছি। অফিসিয়াল চিঠি হাতে পাওয়ার পর এই বিষয়ে সবাইকে আমাদের বক্তব্য জানাবো। আমাদের মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি চলমান রাখতে বলা হয়েছে। আমরা সেভাবে প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছি।’
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে গত বছরও একুশে বইমেলা নির্ধারিত সময়ে শুরু হয়নি। ওই সময় আয়োজন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। প্রথমে বইমেলা ভার্চুয়াল বা অনলাইনে করার পরিকল্পনা জানানো হয়। পরে বিধিনিষেধের মাঝে ১৮ মার্চ শুরু হয় মেলা। গতবারও প্রকাশকদের বিপুল লোকসান গুণতে হয়েছিল। এবারও সেই ঘটনার পুনারাবৃত্তি হতে চলেছে।
বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বেঁচে থাকাকালীন এক সংবাদ সম্মেলনে বইমেলায় প্রকাশকদের ‘উস্কানিমূলক’ বই না প্রকাশ করার জন্য প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়েছিলেন, যা এখনো বলবত আছে। মহাপরিচালক বদলেছে; কিন্তু ধারা বদলায়নি। এবারও সেই একই হুমকি এবং সতর্কবাণী বর্ষিত হচ্ছে। এর আগে বই মেলাতে রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ‘বিতর্কিত’ বই প্রকাশের কারণে! প্রকাশ্য জনসমাগমের মধ্যে টিএসসিতে সন্ত্রাসীদের চাপাতির আঘাতে খুন হয়েছিলেন প্রবাসী বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়। এর আগে এখানেই ২০০৪ সালে আক্রান্ত হয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপন খুন হলেন আজিজ মার্কেটে নিজ অফিসে বই প্রকাশের অপরাধে। এই হত্যাকারীরা কেউই গ্রেফতার হয়নি। ভবিষ্যতে হবে তার কোনো নিশ্চিত সম্ভাবনাই নেই। এ রকম পরিস্থিতিতে একাডেমির বড় কর্তা যখন প্রকাশকদের ‘উস্কানিমূলক’ বই না প্রকাশ করার ব্যাপারে সতর্ক করেন, তখন যে সত্যটা আরও একবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো- এ দেশে খুনি-সন্ত্রাসীরাই হলো তাদের অপরাধের ক্ষেত্রে প্রকৃত স্বাধীন, লেখক-প্রকাশকরা মতামত চর্চা এবং বই প্রকাশের ক্ষেত্রে পরাধীন।
এই হলো এখনকার বইমেলার চালচিত্র। যে মেলাকে এক সময় ‘প্রাণের মেলা’, ‘অমর একুশের স্মৃতিবিজড়িত বইমেলা’, ‘বাঙালির সাংস্কৃতির মিলনমেলা’ বলা হতো, এখন সেই বই মেলাই পুলিশি খানা তল্লাসি আর রঙবেরঙের নিষেধাজ্ঞার জালে আবদ্ধ। সৃজনশীল লেখক-প্রকাশক- লেখক ও রচনাসংস্কৃতি সব যেন এখন সোনার হরিণ।
যদি ব্যবসায়িক লাভালাভির কথা বাদ দেওয়া যায়, তাহলেও শিল্প-সংস্কৃতির ব্যাপার উবে যায় না। সেই শিল্প-সংস্কৃতির খোলা দুয়ার বন্ধ করেই যেন কর্তাব্যক্তিরা বই মেলার ঐতিহ্য বজায় রাখতে চান। বাংলাদেশে একুশে গ্রন্থমেলা জমজমাট হয়ে ওঠার পর সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি হয়েছে, তা হলো এখন আর সারাবছর তেমন একটা বই প্রকাশ হয় না। প্রায় সব প্রকাশকই অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে সামনে রেখে বই প্রকাশ করেন। এই যে তারা লাখ লাখ টাকা লগ্নি করে এই মহা কর্মযজ্ঞ চালান, তার পুরোটা বিক্রিবাট্টা করে তুলতে না পারলে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত ক্ষতির শিকার হন এই মুদ্রণ শিল্পের শ্রমিকরা। লেখকরা রয়্যালিটি পান না সেটা তো নির্মম সত্য। মেলা এক মাস ধরে হলেও পান না, মেলা অর্ধেক মাস হলে তা পানই না। এবারও সেই একই দুশ্চিন্তার বলিরেখা প্রকাশক- লেখক-মুদ্রণ সংশ্লিষ্ট সবার কপালে। যদিও আমলানির্ভর প্রশাসনের এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো ফুরসত নেই। অথচ আত্মপ্রচারের বেলায় তাদের উল্লম্ফন সবার আগে এবং সে এক দেখার মতো ব্যাপার।
জনসাধারণ সচেতন হবে, কি হবে না, তার চেয়ে বড় কথা জনসাধারণ করোনার বিপদের মধ্যে সব ধরনের কাজই করছেন। শুধু শুধু বইমেলা নিয়ে তারাই বা ভীত হয়ে মেলা বয়কট করবেন কেন? তাই সরকারের নীতিনির্ধারকরা ভেবে দেখতে পারেন-আবেগ বাদেও এই মেলায় কয়েকশ কোটি টাকার লেনদেন হয়, যার মধ্যে সরকারের কোষাগারেও টাকা জমা হয়।