আব্দুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন
আসিফ
প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০৩:৫৫ পিএম
আব্দুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন
প্রত্যেকের জীবনে কখনো কখনো এমন সময় আসে, হঠাৎ করে তার সামনে পৃথিবীটা খুলে যায়; জীবনকে মনে হয় অবারিত আনন্দের ডানা, কাশফুলের দোলায়মান ছন্দে দৌড়াতে ইচ্ছে করে। গাঙচিলের মতো আমিও উড়েছিলাম, ভেসে আসতো শীতলক্ষ্যার জলের শব্দ। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি হলো আমার কাছে এ রকম একটা সময়।
এ সময়, বসন্তের বাতাসে দুপুরে একটা খেলায় উন্মাতাল থাকতাম, আর তা হলো নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যার তীরে মেরিনের ওয়ার্কশপের সামনে কৃষ্ণচূড়া, শাল-গজারের পাশাপাশি চরকী হলুদ ফুল গাছ; মেরিন হোস্টেলের তিন তলার ছাদে উঠে গুচ্ছাকারে উড়িয়ে দিতাম। বাতাসে দারুণভাবে ঘুরতে ঘুরতে ভেসে বেড়াত, কিছুটা দূরে গিয়ে সেগুলো অদ্ভুত সব ঢেউয়ের বিন্যাসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ত; তারপর নিচে পড়তে থাকতো। আমরা বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকতাম। অথবা সন্ধ্যার আলো-ছায়ায় ফড়িংয়ের পেছনে দৌড়ে বেড়াতাম; সোনালি ফড়িংয়ের পেছনে দৌড়ানোর আনন্দ যেন জাগ্রত করত কৌতূহলের জগৎ উন্মোচনে। মেরিনের অডিটোরিয়ামে বিকেলে খেলার শেষে ডিস্কে প্যাঁচানো মিলিমিটার ফিল্ম রিলে থেকে দেখানো ছবি থেকে ভেসে আসতো সমুদ্রের নীল জলরাশিতে ছড়িয়ে পড়া তিমির প্রতিধ্বনিরত গম গম স্বর, আর মানুষের তিমি হত্যার উল্লাস কেমন যেন আনমনা করে দিত। কি যেন ভাবতে চাইতাম। তবে বুঝতাম জগৎটা ক্রমাগত সম্প্রসারিত হয়ে চলেছে।
আমার কাছে মনে হয় আব্দুল্লাহ আল মুতীর বইগুলোও যেন আমাদের সেই আহ্বান নিয়ে ডাকে, অনেকটা এ রকমই মনে হয়- কী বৈচিত্র্যময় প্রাণজগৎ কোলাহলে মুখরিত, কী বিপুল জলরাশি মেঘনা হয়ে সমুদ্রপানে ছুটে যাচ্ছে, দূরের ওই আকাশ কেমন ডাকছে, জোনাকির মতো নক্ষত্রগুলো কী রহস্যময়, মহাকাশের পর মহাকাশ কত না বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষারত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই কবিতাটাই মনে করিয়ে দেয়:
যদি কোন দিন একা তুমি যাও কাজল দীঘিতে
যখন বিকেল আসন্ন শীতে মন্থর বেগ
দেখবে কত না রহস্য আছে এই পৃথিবীতে
কত স্বল্পের অচেনা আকাশ ছায়াময় মেঘ
আব্দুল্লাহ আর মুতীর ‘আজকের বিজ্ঞান ও বাংলাদেশ’ (১৯৯৬) বইয়ের প্রারম্ভের দ্বিতীয় প্যারা পড়লেও তা মনে হয়,
আজকের দিনে মানুষ যে অবস্থানে পৌঁছেছে, এ অবস্থায় যে সে চিরকাল ছিল না তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয়ের অবকাশ নেই। সেই অতি আদিম নিয়ান্ডারথ্যাল, পিকিং মানুষ থেকে আজকের দিনের মানুষের মধ্যকার সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়- ইতিহাসের ধারা এগিয়ে চলেছে, পৃথিবী বদলে যাচ্ছে, সেইসঙ্গে বদলে যাচ্ছে মানুষও। গত বিশ ত্রিশ লাখ বছর ধরে অব্যহত ধারায় মানুষের বিবর্তন ঘটে চলেছে; মানুষ সমাজবদ্ধ হবার পর সে সমাজও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। দেশে দেশে মানুষের সমাজের যে বিচিত্ররূপ তা আমাদের আজও বিস্ময়ের উদ্রেক করে।
আবার অগ্রগতির ধারায় মারাত্মক আশঙ্কা ব্যক্ত করে সতর্ক করেছেন:
দুনিয়াজোড়া পরিবর্তনের ধারায় আজ যে দ্রুততা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তার একদিকে যেমন আছে সম্ভাবনার বিশাল খোলা দুয়ার; তেমনি আবার অন্যদিকে আছে সমস্যার বিপুল পাহাড়। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিষ্কার মানুষের জীবনের স্বাচ্ছ্যন্দ প্রকাশ করেছে, তার গড় আয়ু বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে, উৎপাদন শক্তির বিপুল বিকাশ ঘটিয়েছে, সারাটা পৃথিবীকে- এমনকি যেন সমগ্র সৌরজগৎকে- এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়। সেইসঙ্গে বিকাশমান সভ্যতার বিষাক্ত বর্জদ্রব্য সারা পৃথিবীতে বিষবাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে। নির্বিচারে বনভূমির বিনাশ, জলবায়ুর পরিবর্তন, আর দূষণের প্রভাবে অসংখ্য জীবপ্রজাতির জন্য মৃত্যুঘণ্টা বেজে উঠেছে। বলা হয়ে থাকে এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রতিবছর একটা করে প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত পৃথিবীর বুক থেকে; আজ প্রতি সপ্তাহে নিশ্চিহ্ন হচ্ছে একটি প্রজাতি। এখন থেকে সতর্ক না হলে ভবিষ্যতে জীবকুলের বিলুপ্তির হার দ্রুততর হবে; অবশেষে তা মানুষের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সত্যিই তা বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে জলবায়ু সম্মেলন তারই প্রতিরোধে আয়োজন করা হয়েছে।
বিশাল সময়ের ব্যাপ্তিকেও গতিশীল করে তুলেছে বইটির সূচিপত্র : পৃথিবী এগিয়ে চলেছে, বিজ্ঞান মানুষের জন্য, সবার কাছে নিয়ে যাওয়া, বিজ্ঞান বাংলাদেশ। তার গ্রন্থগুলোর মধ্যেও ছিল সে আহ্বান : এ যুগের বিজ্ঞান (১৯৮১), রহস্যের শেষ নেই (১৯৬৯), এসো বিজ্ঞানের রাজ্যে (১৯৫৫), অবাক পৃথিবী (১৯৫৫) আবিষ্কারের নেশায় (১৯৬৯), বিজ্ঞান ও মানুষ (১৯৭৫), পরিবেশের সংকট ঘনিয়ে আসছে (১৯৯৬), প্রাণলোক : নতুন দিগন্ত (১৯৮৬), মহাকাশে কী ঘটছে (১৯৯৭), তারার দেশের হাতছানি (১৯৮৪) ইত্যাদি।
এই আহ্বান কৈশোরকে আলোড়িত না করে পারে না; কিন্তু একটা দরজা দিয়ে প্রবেশ করার পর সেই জগতের বর্ণনা না- থাকলে এক ধরনের ধাক্কা খেতে হয়, এটা দুর্ভাবনার বিষয় বটে। তবে পাঠক তো এক ধরনের অভিযাত্রী, পথ খুঁজে নেয়, কেউ কেউ তা নেয়ও। এটা সত্যি আব্দুল্লাহ আল-মুতী সব বইয়ে অত্যন্ত মুক্তভাবে খোলা পৃথিবীর বৈচিত্র্যময় জগৎ অনুসন্ধানের আহ্বান জানিয়েছেন এ কথা অনস্বীকার্য। এই আহ্বানের বাণী নিয়ে তিনি তার বিজ্ঞান ও শিক্ষাবিষয়ক প্রায় ২৭টি মৌলিক গ্রন্থ লিখেছেন, ১০টি গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন, একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। এ ছাড়াও বেশকিছু লেখা অপ্রকাশিত রয়েছে। রেডিও এবং টিভিতে তার উপস্থাপিত অনুষ্ঠান বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনি লেখালেখি শুরু করেন ছাত্রজীবন থেকেই। ১৯৪৭ সালে মুকুল ফৌজ আন্দোলনে যোগ দিয়ে পরবর্তী বছরে ‘মুকুল’ নামে কিশোর পাক্ষিক পত্রিকা বের করেন। কেন্দ্রীয় কচি কাঁচার মেলার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বিজ্ঞানের জটিল বিষয়কে সর্বজনবোধ্য করে তোলার জন্য তাঁর দক্ষতা ও সাফল্য ছিল তুলনাহীন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য অঙ্গনে অজস্র সংগঠন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন আমৃত্যু।
পৃথিবীতে এক সময় প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা ছিল না। ক্রমশ অপ্রাতিষ্ঠানিক লোক ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা, এটা অর্জিত জ্ঞানকে কাঠামো দিয়েছিল, পদ্ধতিগত গতি দিয়েছিল। এটা ডকুমেন্টেশন ও সংরক্ষণের সুবিধা দিয়েছিল; কিন্তু নতুন নতুন চিন্তা ও ধারণার উদ্ভব ঘটাতে প্রাতিষ্ঠানিকতার পাশাপাশি অপ্রাতিষ্ঠানিক চর্চাকে বন্ধ করতে বলেনি। আমরা সন্দেহবাদী, কৌতূহল আর বারবার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সঠিক বর্ণনার পথে এগিয়ে সত্যকে উদ্ঘাটন করি। এটা কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা নিয়ম মেনে চলে না। তাই অপ্রাতিষ্ঠানিক চর্চা বন্ধ হলে প্রশ্ন করা বন্ধ হবে, কৌতূহল সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। নতুন পর্যায় নতুন চিন্তার উদ্ভব ও উত্তরণের পথ আমরা হারিয়ে ফেলব। তাই প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উচিত নিজস্বচর্চার পাশাপাশি অপ্রাতিষ্ঠানিক চর্চাগুলোর সঙ্গে সংযোগ সেতু তৈরি করে রাখা। এটা নমনীয়তা, সহনশীলতার পাশাপাশি বোঝাপড়ার বিস্তারও ঘটাবে।
বিশ্বাস করেছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক চৌহদ্দির মধ্যে নয় গণ মানুষের মধ্যেও বিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দেওয়া সাধারণ কাজ নয়, অতি প্রয়োজনীয়, বিজ্ঞানকর্মীর মতো মাঠ লেবেলেও কাজ করেছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় সম্মানসহ স্নাতক হন ১৯৫২ সালে। এর পর শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে শিক্ষায় এম এ এবং ১৯৬২ সালে পিএইচডি লাভ করেন। তার অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল Curriculum Changes in Pakistan with Special References to High School Science Education. শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্ল সাগানের সঙ্গে প্রায় একই সময় তিনি পড়াশুনা করেছেন। যদিও পড়াশুনার বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন, বিজ্ঞান শিক্ষা কারিকুলাম।
শিকাগো থেকে ফিরে এসে প্রথমে রাজশাহী কলেজে শিক্ষক হিসাবে আব্দুল্লাহ আল-মুতী কর্মজীবন শুরু করলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হিসেবে যোগ দেন ১৯৭৫ সালে। তারপর শিক্ষা প্রশাসন ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন ১৯৮৬ সালে। জড়িয়ে পড়েন জাতীয় শিশু-কিশোরসহ নানা ক্লাব ও বিজ্ঞান সংগঠনের সঙ্গে ওতপ্রতভাবে। বিজ্ঞান লেখক হিসেবে মানুষের মনে অনেকটাই জায়গা করে নেন। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে ভূমিকা রাখার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইউনেস্কো কলিঙ্গ পুরস্কার তিনি লাভ করেন। এ ছাড়াও তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক লাভ করেন।
আব্দুল্লাহ আল-মুতী সিরাজগঞ্জ জেলার ফুলবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা হালিমা শরফুদ্দীন এবং বাবা শেখ মইন শরফুদ্দীন। ৫ ভাই ৬ বোনের মধ্যে আব্দুল্লাহ আল-মুতী সবার বড়। ১৯৪৫ সালে ঢাকার মুসলিম হাই স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন (এখনকার এসএসসি পরীক্ষা) পরীক্ষায় কলকাতা বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। আব্দুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন (১ জানুয়ারি ১৯৩০-৩০ নভেম্বর ১৯৯৮) তার জীবত দশায় প্রভূত সম্মান অর্জন করেন। এমন কি বিজ্ঞান লেখালেখিকে অনুপ্রাণিত করতে তার মা ও বাবার নামে বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত হালিমা-শরফুদ্দীন বিজ্ঞান পুরস্কার চালু করেন।
এ ছাড়া তিনি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি (১৯৮৮-৯০), বাংলা একাডেমি, ঢাকা (১৯৮৬-৯০) ও বিজ্ঞান শিক্ষা সমিতিতে। প্রধান উপদেষ্টা, ঢাকা প্রস্তাবিত স্পেস সেন্টার, উপদেষ্টা, মেঘনাদ সাহা বিজ্ঞান তথ্যকেন্দ্র ও গ্রন্থাগার (১৯৯৭-৯৯)। জাতীয় পর্যায় শিক্ষা সংস্কার ও আধুনিকরণের কর্মকাণ্ডে তিনি প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থেকেছেন। শিক্ষা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (১৯৭৫), শিক্ষা ও বিজ্ঞান- নতুন দিগন্ত (১৯৯১), আমাদের শিক্ষা কোন পথে (১৯৯৬) তিনটি বইও লিখেছেন।
একটা প্রশ্ন জাগতেই পারে তার মতো একজন মানুষের বিজ্ঞান শিক্ষা সম্পর্কে এত পথনির্দেশনা থাকতে আমাদের বিজ্ঞান শিক্ষা এতো দুর্বল জায়গায় অবস্থা করছে কেন?
তার বইগুলো থেকেও বোঝা যায়, তিনি কত না ভেবেছেন! এই ভারতবর্ষ, পাকিস্তান, তারপর বাংলাদেশে শিক্ষা নিয়ে যে কার্যক্রম তিনি তার বিস্তারিত আলোচনায় তুলে এনেছেন। অসাধারণ সব তথ্য, বিশ্লেষণ এবং মতামত তুলে ধরেছেন; কিন্তু তার কোনো প্রতিফলন আমরা আমাদের শিক্ষায় দেখি না। আমাদের শিক্ষা কোন পথে (১৯৯৬) সালে লিখেছেন:
বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর থেকে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও সংস্কার ও নবায়নের জন্য ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্যোগ কিছু কম নেওয়া হয়নি। স্বাধীন দেশের জন্য একটি উপযুক্ত শিক্ষানীতির জরুরি প্রয়োজন স্বীকৃত হয়েছে একেবারে গোড়া থেকেই। আর এই লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের শিক্ষা কমিশন থেকে শুরু করে ডজন খানেক কমিশন, জাতীয় কমিটি ইত্যাদি গঠিত হয়েছে; কিন্তু সে সবের তেমন যে একটা ফল হয়েছে তা বলা যায় না।
যে সৃষ্টিতে ত্যাগ ও যন্ত্রণা যত বেশি, সেখানে মানুষের প্রত্যাশা ততবেশি বড় হয়ে ওঠে! বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। স্বাধীনতা অর্জন এদেশের মানুষের বিপুল প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল। এই নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে সেদিন মানুষের আশা ছিল অনেক; সীমাহীন বিকাশের সম্ভাবনা নিয়ে মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। ...এই উপলব্ধি থেকে ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নতুন রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি নির্ধারণ করার জন্য বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ খুদার নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন গঠন করেন।
তিনি লিখেছেন, দেড় বছর কঠোর পরিশ্রম করে, ব্যাপক জরিপ ও পর্যালোচনার ভিত্তিতে এদেশে দীর্ঘ মেয়াদি রূপরেখা প্রণয়ন করে। ১৯৭৪ সালের ৩০ মে তা দাখিল করেন। তারপরও শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে আরও বেশ কটি কমিশন, কমিটি ইত্যাদি গঠিত হয়েছে। দুঃখজনক হচ্ছে, এসব বিদ্বজনের পরামর্শ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন উদ্যোগ দেখা যায়নি। তাই এত বছর পরেও শিক্ষাক্ষেত্রে মানের অধোগতি, ব্যাপক অস্থিরতা ও অপচয় আজ সকলের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে এই হতাশা স্পষ্ট।
আমার সঙ্গে দেখা
১৯৯৮ সালের আগস্ট। প্রচণ্ড বর্ষণ শুরু হয়েছে। থামছে না। নিম্নাঞ্চল পানিতে প্লাবিত। অবশ্য বন্যার একটা পূর্বাভাসও দেখা দিচ্ছিল। এরই মধ্যে দিয়ে প্রবল ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। ডিসকাশন প্রজেক্ট ঢাকা পরমাণু শক্তি কমিশনের অডিটোরিয়ামে ১৬ আগস্ট বিকেল ৪টায় একটা বক্তৃতার আয়োজন করেছে। বিষয় : আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ‘সময়ের প্রহেলিকা’ শিরোনামে একটি বক্তৃতা। আরও বিশেষভাবে বললে আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের একটি ফলাফল টাইম ডাইলেশন তত্ত্বের ওপর। যদিও এটা একটা প্যারাডক্স তৈরি করে, যা টুইন প্যারাডক্স নামে পরিচিত। তবে আইনস্টাইন তার সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্বে মহাকর্ষজনিত ত্বরণ বা মন্দন দিয়ে এটাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
অনুষ্ঠানটিকে সফল করার জন্য বিজ্ঞান কর্মীরা পানিতে প্লাবিত নিম্নাঞ্চল পেরিয়ে পোস্টার লাগাচ্ছে, লিফলেট বিতরণ করছে, টিকিট বিক্রি করছে। সেই সময় আমার এক শুভানুধ্যায়ী বন্ধু শাহীন বললেন, এ রকম একটা অনুষ্ঠান করছেন, টিকিট কেটে দর্শক শ্রোতা ছাড়াও এমন কিছু মানুষের থাকা দরকার যাদের কারণে অনুষ্ঠানটার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। কী করা যায়, প্রশ্ন করলে বন্ধুটি বললেন, ‘বিজ্ঞান লেখক আব্দুল্লাহ আল-মুতীর সঙ্গে আমার কিছু যোগাযোগ রয়েছে, ওনার কাছে যাওয়া যায়। ওনাকে আমন্ত্রণ করা যায়।’ মনে মনে চিন্তা করেছিলাম আমরা যে ধরনের অনুষ্ঠান করি তাতে এখানে আমন্ত্রণের কিছু জটিলতা রয়েছে, দর্শকশ্রোতারাও আসে টিকিট কেটে। এ ধরনের মানুষকে মঞ্চে না উঠিয়ে শুধু দর্শক হিসেবে থেকে অনুষ্ঠান দেখানো একটু কঠিন ও জটিল বৈকি।
হাতিরপুলের কাছাকাছি বাসা খ্যাতনামা এই বিজ্ঞান লেখকের। এক দুপুরে গেলাম। তার বাসায় ঢুকলাম। আমি খুব সন্দিহান ছিলাম, যদিও তার অভ্যর্থনায় এক ধরনের আন্তরিকতা ছিল। সর্বোচ্চ সচিব পর্যায়ে চাকরি করার পরও তার রুমে কোনো আড়ম্বরতা চোখে পড়েনি। বই দিয়ে ঠাসা মাঝারি আকৃতির একটি রুম। সেখানেই বসার ব্যবস্থা। পড়াশুনা, সে-সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা নিয়ে থাকতেই ভালোবাসেন তা বোঝা যায়। কুশলাদি জানার সঙ্গে সঙ্গে তার নানান অভিজ্ঞতার কথা বলতে থাকলেন, বিশেষত পত্র-পত্রিকায় লেখা ও টিভি অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পাঠক শ্রোতাদের নানান প্রতিক্রিয়া। এ রকম একটা প্রাসঙ্গিক জায়গা ধরে বন্ধু মাহমুদ হোসেন শাহীন বলে উঠলেন, আচ্ছা স্যার তাহলে পাবলিক ফাংশনগুলোও খুব জরুরি? তিনি বললেন, অবশ্যই। তবে এটি অথেনটিক হতে হবে? কিন্তু এই অথেনটিকের বিচার করবে কে? বই পড়া, গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টারি দেখা এবং সে সম্পর্কে আলোচনা করাও তো এক ধরনের মুক্তভাবে জ্ঞানচর্চার একটা পথ। এটা শুধু কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা করবে- এমন তো কোনো কথা হতে পারে না। যে কেউ তা করতে পারে। না হলে বিস্তার ঘটবে কেমন করে, গণমুখী চর্চাই বা হয় কেমন করে?
শুধু এর দ্বারা খুব সহজেই আমরা অতীতে অবস্থান না করেও অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতের দিকে অগ্রগামী হতে পারি। দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত থেকেও কি কারও পক্ষে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়? জ্ঞান বিতরণ ব্যবস্থাটা কি হতে পারে? না আনন্দের ব্যাপার- একটি অনুষ্ঠান? ব্যক্তিগতভাবে জ্ঞান বিতরণ করে কেউ কি পারে না পেশাদারি হতে? যদি স্কুল, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের বক্তব্যের বিনিময়ে বেতন নিতে পারেন। তবে কেউ একজন এমনকি তিনি যদি কৃষক, শ্রমিকও হন এবং মুক্তভাবে জ্ঞান চর্চা করে অন্যকে জানাতে চান, তবে তিনি কেন পেশাদারি হতে পারবেন না?
আমি বললাম, কারণ তা যদি না হয় তাহলে মুক্তভাবে জ্ঞানচর্চা কেমনভাবে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কি শুধু শিক্ষার্থীদের পড়াবে এবং ডিগ্রি দেবে, সমাজের অন্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত হবে না এটা কেমন কথা? যেমন- আপনার লেখাগুলো বা কথাগুলো শুনে যদি আরও ১০ জনের সঙ্গে আলাপ হয় তাতে তো সে কথাগুলো একইরকমে ফর্মে থাকার কোনো নিশ্চয়তা নেই। লেখা বা কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, কৌতূহল জাগানো আর আলোচনার সূত্রপাত ঘটানো। সেটা কোন পথে যাবে তার বিস্তার ঘটাবে আলোচনার প্রকৃতি তা বলতে পারে; আর অন্যদের চর্চা যুক্ত হলে সেটা কতটা সংগতিপূর্ণ শুরু হবে তারও যাচাইকরণ প্রক্রিয়া। এর মধ্যে দিয়ে একে অপরের ভারসাম্য আনবে, এক ধরনের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা; আমরা সঠিক পথে এগিয়ে যেতে পারব। আব্দুল্লাহ আল-মুতী স্বগতোক্তি করলেন তা অবশ্য ঠিক।
আমার অবশ্য আগেই কেন যেন মনে হয়েছিল, বা কার্ল সাগানের মৃত্যুতে শ্রুদ্ধা নিবেদনে দৈনিক জনকণ্ঠে একটা লেখা দেখেও মনে হতে পারে, তিনি এই কথাগুলোর সঙ্গে একমত হতে পারেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন অনুষ্ঠানের আসবেন এবং মতামত দেবেন। ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও তিনি এসেছিলেন প্রায় পুরো বক্তৃতা অনুষ্ঠান দেখেছিলেন, উৎফুল্লচিত্তে বিদায় নিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার মাত্র ১৫ দিনে মাথায় তিনি মারা যান; এটা শুধু দেশ নয় ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য ছিল মারাত্মক ক্ষতি। কেননা যে দৃষ্টিভঙ্গি ও বিজ্ঞানচর্চার জন্য আমি ওয়াহিদুল হক, দ্বিজেন শর্মা, আব্দুলাহ আবু সায়ীদের মতো ব্যক্তিদের সহযোগিতা পেয়েছিলাম তা তার কাছ থেকেও পেতাম। যিনি সরকারের আমলা হয়েও বিজ্ঞানকে অন্তর দিয়ে ধারণ করেছিলেন।
তবুও মুতী তার গ্রন্থগুলোতে যে স্বপ্নজাল বুনেছেন, সেখানে অন্যদের সহ রবীন্দ্রনাথের চিন্তাগুলোকে খুব আন্তরিকতা সহকারে তুলে ধরেছেন।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শনের গোড়ার কথা হলো, শিক্ষা হলো মেধার বিকাশ সাধন নয়, হৃদয়ের বিকাশ সাধনও বটে। মানুষের সামগ্রিক সত্তার বিকাশ সাধনের সঙ্গে রয়েছে তার গভীর যোগ। শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো মানুষের ইচ্ছা শক্তিকে জাগিয়ে রাখা। সুদৃঢ় ইচ্ছাই মানুষের প্রাণ শক্তিকে জাগ্রত করে- তাকে শ্রয়োময় গৌরবের পথে চালিত করে। এই যে মানুষের মনে একটা সুমহান গৌরব বোধ এবং প্রবল আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টি, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- একমাত্র সুশিক্ষা দ্বারাই তা সম্ভব হতে পারে। তার মতে সুশিক্ষার লক্ষণ হলো, ‘তাহা মানুষকে অভিভূত করে না, তাহা মানুষকে মুক্তি দান করে। আমাদের যে শক্তি আছে তাহারই চরম বিকাশ হইবে, আমরা যাহা হইতে পারি, তাহা সম্পূর্ণভাবে হইবে- ইহাই শিক্ষার ফল। তবে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা দর্শনের সারমর্মটি এভাবে উপস্থাপন করা শ্রেয়, যা তার দ্য রিলিয়জন অব ম্যান (১৯৩১) গ্রন্থে এ পয়েট’স স্কুল শীর্ষক অধ্যায়ে : ‘তাকেই বলি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা, যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না, যা বিশ্বসত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।’
যদিও এ বিষয়টির সে সময় তেমন বিকাশ ঘটেনি। তবুও বিষয়টিকে কসমিক এভ্যুলেশন বা মহাজাগতিক বিবর্তনের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়, যা কার্ল সাগান মহাজাগতিক বর্ষপঞ্জির মাধ্যমে দেখিয়েছেন। আব্দুল্লাহ আল-মুতি অবশ্য, কার্ল সাগানের কসমস গ্রন্থটি বা ডকুমেন্টারি শিশুদের বিজ্ঞানের মধ্যে দিয়ে বড় হয়ে ওঠার উত্তম হাতিয়ার হিসেবে অভিহিত করেছেন। আর প্রাতিষ্ঠানিকতার দৃঢ় কাঠামোর বেড়াজালে, অপ্রাতিষ্ঠানিক তথা মানুষের মুক্তচর্চাকে অবহেলার দিকে ঠেলে দিতে না পারে তিনি তাই দৈনিক সংবাদে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিরোনামে বিজ্ঞানের দুটি পাতা সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এসব পাতাগুলো চালানোর জন্য কিছু ডেডিকেটেড মানুষও তৈরি হয়েছিল। বলা যায়, এরই পথ ধরে ভোরের কাগজে একুশ শতক পাতা, প্রথম আলোর বিজ্ঞান প্রজন্ম এবং সমকালের কালস্রোত পাতা বের হয়েছিল। পত্রিকাগুলো নিজেরা একটিভিস্ট হতে গিয়ে এসব পাতাগুলোর বলিদান হয় পরবর্তী সময়ে।
আব্দুল্লাহ আল-মুতী মাত্র ৬৮ বছর বয়সে মারা যান। তিনি আরও ১০টি বছর বেঁচে থাকলে অনেক কিছু দিয়ে যেতে পারতেন, তার শিক্ষা সংক্রান্ত বইগুলো দেখলে বুঝতে পারা যায়। সমগ্র জীবনব্যাপী বিজ্ঞানকে জীবনের প্রতিটি বাঁকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য রইল অসীম কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা।
লেখক : বিজ্ঞান বক্তা ও সম্পাদক- মহাবৃত্ত