সংবাদপত্রের একাল-সেকাল এবং সাম্প্রতিক দেশকাল

শেখর দত্ত

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১:২৯ এএম

শেখর দত্ত

শেখর দত্ত

সংবাদপত্রের একাল আর সেকাল। সত্তর বছরের পার্থক্য বিবেচনায় নিলে মনে হয় আকাশ-পাতাল। পাকিস্তানের দেড় বছরের আগে আগে মফস্বলের মহকুমা শহর হবিগঞ্জে বোঝার বয়সের পরই দেখেছি, বাসা সংলগ্ন আমাদের দোকানে ইংরেজি স্টেটসম্যান কলকাতায় প্রকাশের একদিন পর আসতো। সন্ধ্যার পর তা পড়তে আসতেন হতে গোনা বাবার কয়েকজন বন্ধু। নানা বিষয়ে কথা বলতেন তারা। বোঝার বয়স হওয়ার পর দেখেছি, বাসাবাড়িতে সংবাদপত্র খুব একটা রাখা হতো না। অফিস, পাবলিক লাইব্রেরি, উকিলের চেম্বার ও কিছু কিছু দোকানেই কেবল পত্রিকা রাখা হতো। সংবাদপত্র রচনা লেখা যখন শুরু করি, তখন আজাদ ও ইত্তেফাক পত্রিকা কখনওবা পড়তাম। 

ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসর ও রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই ছিলেন আমাদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। আমাদের এক সহপাঠী বন্ধু সেখানে কবিতা লিখত। ছাপার অক্ষরে বন্ধুর নাম! কি যে শিহরণ! কেবল ওই পাতাটা নিয়েই ছিল আকর্ষণ। এর মধ্যেই আইয়ুবের সামরিক শাসনের মধ্যে রাজনীতি নেই, এমন পরিবেশে স্কুলজীবন শেষ হলো। খবরের টানে আমরা সহপাঠীরা কেউ প্রতিদিন পত্রিকা পড়ি নাই। তবে কাশ্মীর নিয়ে পাক-ভারত উত্তেজনা, সুয়েজ খাল নিয়ে মিশর বনাম ব্রিটেন-ফ্রান্সযুদ্ধ ( ১৯৫৬), কিংবা কিউবার মিসাইল ক্রাইসিস (১৯৬২) প্রভৃতি উত্তেজনাকর মুহূর্তে সংবাদপত্রের ছবি দেখেছি, কখনওবা খবর পড়েছি। ইংরেজি শেখার জন্য স্টেটসম্যান পত্রিকা পড়ার কথা মা-বাবা বললে কখনওবা খেলার খবর পড়তাম। 

আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন আর আমাদের কলেজ জীবনের শুরু একইসঙ্গে। প্রথম যেদিন কলেজে ক্লাস শুরু, সেদিনই ছিল ছাত্র ধর্মঘট। নটর ডেম কলেজে নবাগতদের প্রবেশ করতে দিল পিকেটিংরত ছাত্রনেতারা। রাজনীতি আর একইসঙ্গে সংবাদপত্র তখন বিন্দুমাত্র আকর্ষণের বিষয় ছিল না; কিন্তু বাষট্টিতে ষাটের দশকের গণজাগরণের জোয়ার শুরু হলে আঠার বছর বয়সে আমরা অনেকেই ওই জোয়ারে ভাসতে লাগলাম। এই বয়সের কবি সুকান্ত যেমন ভেবেছেন তেমন: ‘এ বয়সে জানে রক্তদানের পুণ্য/বাষ্পের বেগ স্টিমারের মতো চলে।’ রামকৃষ্ণ মিশনের বিবেকানন্দ ছাত্রাবাসে থাকতাম, ইত্তেফাক অফিসের সামনে। খুব সকালে পত্রিকা এসে যেত। মাটিতে বসে একজন পত্রিকায় আন্দোলনের সংবাদ পড়তো আর গোল বেঁধে সকলে শুনতো। 

সংবাদপত্র পড়ে তখন আমরা বেশ উজ্জীবিত। সামরিক আইন উঠে যাওয়ার পর শরিফ কমিশনের শিক্ষা রিপোর্ট নিয়ে আন্দোলনের শুরু, এনডিএফ গঠন, দাঙ্গা প্রভৃতির ভেতর দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে প্রবেশ করলাম। গণজাগরণের ঢেউ যেন আমাদের ডাকছিল। বন্ধুদের মধ্যে আমরা অনেকেই বাম ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়লাম। দৈনিক সংবাদ তখন আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের উজ্জীবিত করছে। আজ প্রায় ৬০ বছর আগের ওই দিনগুলোর স্মৃতি যখন স্মরণ করি, তখন মনে হয় প্রথমে সংবাদপত্রই আমাদের প্রজন্মকে গণতন্ত্র ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণার ভিত রচনা করে দিয়েছিল। 

একটু খেয়াল করলেই এটা সুস্পষ্ট হবে যে, তখন পত্রিকা ছিল রাজনৈতিক দলভিত্তিক। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর পূর্ব বাংলার প্রথম দৈনিক পয়গাম। একই সময়ে প্রকশিত হয় অর্ধ সাপ্তাহিক জিন্দেগী। এগুলো তেমন পাঠক পায় না। ১৯ অক্টোবর ১৯৪৮ কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসে দৈনিক আজাদ। ১৯৫১ সালের ১৭ মে সংবাদ, ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইত্তেফাক প্রকাশিত হয়। ২ আনা ছিল ছয় পৃষ্ঠার পত্রিকার দাম। দৈনিক আজাদ প্রথম থেকেই মুসলিম লীগের, ইত্তেফাক আওয়ামী লীগের এবং হাত ঘুরে সংবাদ হয়ে যায় বাম-কমিউনিস্টদের, পরে রুশপন্থিদের। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের প্রভাবের কারণে ইত্তেফাক ও সংবাদ ছিল দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা। রুশ-চীন ভাগ হলে চীনপন্থিরা বের করে সাপ্তাহিক জনতা। পরে সরকারি প্রেস ট্রাস্ট বের করে দৈনিক পাকিস্তান। আরো দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল; কিন্তু দল না হলে পত্রিকা চলতো না। 

সীসার একটি একটি হরফে পাতা সাজিয়ে মেশিনে তুলে সংবাদপত্রে ছাপানো হতো। বড় হোডিং থাকলে হতো কাঠের। সাংবাদিক, সংবাদপত্র কর্মীদের সে কি খাটুনি! বেতন আর কত! রাতে বাসায় যাবেই বা কীভাবে। রাতের খাবার! কম পয়সার হোটেলে কেউ কেউ খেয়ে নিতেন। বংশালের সংবাদ অফিসে নিজেই দেখেছি, গভীর রাতে কাজ শেষ করে পত্রিকা মাথায় দিয়ে যে টেবিলে লেখা বা প্রুফ কাটা হতো, সেখানেই কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়তেন। সংবাদপত্র অফিস তো ছিল অনেকটা রাজনৈতিক দলের অফিসের মতো। ১৯৬৪ সালের দাংগার শুরুর ৯ দিন পর ১৬ জানুয়ারি বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠক বসে ইত্তেফাক অফিসে। তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হন আহ্বায়ক। ‘পূর্ব বাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’- গণজাগরণের উত্থানপর্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের এটাই ছিল প্রথম স্লোগান। এই স্লোগানের আঁতুড়ঘর ইত্তেফাক। পরদিন ছাপা হয় অভিন্নভাবে সকল পত্রিকায়। 

দমন-পীড়নের কঠিন বাস্তবতার মধ্যে প্রকাশ্যে যখন কাজ করা যেতো না, দলীয় অফিস খোলা বা সেখানে যাওয়া যখন ছিল বিরাট সমস্যা; তখন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের যোগাযোগ কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াতো সংবাদপত্র অফিস। ঢাকার বাইরের প্রবীণ বাম-কমিউনিস্ট রাজবন্দিদের দেখেছি, মুক্তি পেয়ে প্রথমে সংবাদ অফিসে যেতেন। নিঃসন্দেহে ইত্তেফাকও একই রকমের যোগাযোগ কেন্দ্র ছিল। সংবাদপত্র সম্পাদক ও সাংবাদিকদের নামগুলো পাশাপাশি সাজালেই দেখা যাবে, ওই যুগটা কেন ছিল বাঙালি জাতির পুনর্জাগরণের সূচনা কাল। মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, কাজী ইদ্রিস, আবদুস সালাম, শহীদুল্লাহ কায়সার, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, সন্তোষ গুপ্ত, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, আহমেদুর রহমান, আব্দুল গফফার চৌধুরী, আলী আকসাদ, ফয়েজ আহমেদ, এ বি এম মুসা, কামাল লোহানী, বজলুর রহমান প্রভৃতি সকলেরই আছে রাজনৈতিক পরিচয়। ওই পরিচয় কেউ গোপন করতেন না। 

সেকাল আমাদের দেখিয়ে দেয়, পাকিস্তানিদের অস্ত্রের চাইতে সাংবাদিকদের কলম শক্তিশালী। যুক্তি-তর্কে না পারলে গায়ের জোরে দুর্বৃত্তরা সব তছনছ করতে চায়। এ জন্যই পঁচিশে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানিবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট শুরু করেই ধ্বংস করে ইত্তেফাক আর সংবাদ। শহীদ সাংবাদিকদের রক্তে ভেজে বাংলার মাটি। সিরাজউদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, খন্দকার আবু তালেব, নিজামউদ্দিন আহমেদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, শহীদ সাবের, আবুল বাশার, শিবসাধন চক্রবর্তী, চিশতি হেলালুর রহমান, মুহাম্মদ আখতার, সেলিনা পারভীন, এসএ মান্নান (লাড়ুভাই) প্রমুখ শহীদ সাংবাদিকরা রক্ত দিয়ে দেশকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন। 

স্বাধীন হয়েছে বলেই সংবাদপত্র জগৎ আজ এতটা বিকশিত, সব গেছে পাল্টে। বড় পরিবর্তন হচ্ছে রাজনৈতিকভিত্তিক পত্রিকা এখন আর নেই, সর্বত্র নিরপেক্ষতার জয়জয়কার। দেশ এখন রাজনৈতিক দিক থেকে দুই ভাগে বিভক্ত, তাই রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বাস্তবে প্রয়োগ করতে গিয়ে দুই বড় দলের সঙ্গে সমদূরত্বের নীতি নিয়ে চলতে হচ্ছে। যে দল ক্ষমতায় সেই দলের বিরুদ্ধে বেশি, বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কম, এমনটাই চলছে। সংবাদপত্রের নিরপেক্ষতার বাস্তব প্রয়োগ এবং অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ পরিণতি দেখে অনেক সময়েই মনে হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যা বলেছিলেন তা মিথ্যা নয়, পাগল আর শিশু ছাড়া দেশে কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তি নেই। ১/১১ সরকারের সময় দেখা গেছে, নিরপেক্ষতার দশা কী হয়! কিং মেকার, কিং দুটি হওয়ারই চালচিত্র দেশবাসী দেখেছে। 

সেকালে সংবাদপত্র যতটুকু ছিল ব্যবসা, তার চাইতে বেশি ছিল মূলধারার প্রধান রাজনৈতিক দল ও জাতীয় আন্দোলনের প্রচার মাধ্যম। এ যুগে বিরল ব্যতিক্রম বাদে সংবাদপত্র মূলে হয়ে উঠেছে ব্যবসা। বিজনেস হাউসগুলো পত্রিকা বের করছে। তারাই নিরপেক্ষতার বাহন হয়ে উঠেছে। জনকল্যাণের লক্ষ্যে পরিচালিত গণসংগ্রামের হাতিয়ার নয়, নিউজ হয়ে উঠেছে পণ্য। মানুষ নেতিবাচক দিক শুনতে পছন্দ করে, তাই পত্রিকা নেতিকেই বেছে নেয়। সেকালে মানুষের সমস্যা নিয়ে ইস্যু সৃষ্টি করত রাজনৈতিক দলও শক্তি। সংবাদপত্র তা প্রচার করে তাদের শক্তি জোগাত। এখন মূলে ইস্যু তৈরি করে সংবাদপত্র। রাজনৈতিক দল-শক্তি চলে পিছু পিছু। অনেক সময়েই মনে হয়, রাজনৈতিক দলের চাইতে সংবাদপত্রই রাজনীতি করে বেশি। একাল- সেকালের পরিবর্তনের আরো আরো দিকগুলো ক্ষুদ্র এ কলামে আলোচনা করার সুযোগ নেই। 

তবে বক্ষমান লেখায় লেখকের এমনটা বলার ইচ্ছে নেই যে, সংবাদপত্রের ভূমিকা আগে ভালো ছিল আর এখন খারাপ। এভাবে বিচার করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। যুগ পাল্টায়। উপনিবেশ যুগ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতন্ত্র- ধনতন্ত্রের ঠান্ডা যুদ্ধ যুগ এবং বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত বিপ্লবের পরের যুগ আলাদা হতে বাধ্য। মানব জাতির আগু-পিছু আছে সত্য; কিন্তু এগিয়ে চলে অবিরাম। প্রয়াত প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ পাল্টালে দেশ পাল্টাবে। আসলে কথাটার সার্বিক অর্থ হচ্ছে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল পাল্টালে দেশ পাল্টাবে। যুগোপযোগী রাজনীতি চায় দেশ। নিরপেক্ষতার নামে সমদূরত্ববাদী নীতি নিয়ে নয়, রাষ্ট্র ও সমাজের তৃতীয় নয়ন হিসেবে সংবাদপত্রের ভূমিকা যুগোপযোগী রাজনীতির পথকে প্রশস্ত করতে ভূমিকা রাখুক- এটাই সাম্প্রতিক দেশকাল সাপ্তাহিকের প্রতিষ্ঠাদিনের একান্ত কামনা।


শেখর দত্ত
কলাম লেখক, রাজনীতিক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh