আনু মুহাম্মদ
প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০২:০৭ পিএম | আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০২:০৯ পিএম
প্রতীকী ছবি
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে শোষণ-পীড়ন-আধিপত্য থেকে মুক্তির লড়াইয়ে মানুষ বিভিন্ন সামাজিক গঠন, রাষ্ট্রের চরিত্র, ক্ষমতা সম্পর্ক, শত্রুমিত্র বিন্যাস, লড়াইয়ের ধরন এবং অগ্রাধিকার মোকাবেলা করেছে। সে অনুযায়ী মানুষের চিন্তা, তাত্ত্বিক কাঠামো, সংগঠনও গড়ে উঠেছে। পুঁজিবাদের বিকাশের মধ্য দিয়ে বিশ্ব আধুনিক রাষ্ট্র দেখেছে, বুর্জোয়া ও শ্রমিক নামের দুই শ্রেণি ও তাদের নিজ নিজ ভাষা তৈরি হয়েছে। এই সময়কালে মানব সমাজের সবচাইতে শক্তিশালী প্রতিনিধি কার্ল মার্কস তাঁর সময়ে বিকাশমান পুঁজিবাদের ব্যবচ্ছেদ করেছেন, এই নতুন ব্যবস্থার শক্তি ও অন্তর্নিহিত সংকটের ভেতর মানুষের মুক্তির পথ সন্ধান করেছেন, সর্বহারা শ্রেণিকে কেন্দ্রে রেখে মুক্তিকামী মানুষের ভাষা তৈরি করেছেন।
পুঁজিবাদী কেন্দ্র, ঔপনিবেশিক বিশ্ব পর্যালোচনার পাশাপাশি উপনিবেশগুলোতে জাতীয় স্বাধীনতার লড়াই নিয়েও মার্কস কাজ করেছেন, তবে পরিকল্পনামতো কাজ শেষ করতে পারেননি। তৎকালীন ব্রিটিশ উপবিবেশ ভারত নিয়ে তাঁর অসম্পূর্ণ বিশ্লেষণ আছে। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতে যে ব্যাপক সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল মার্কস তার নাম দিয়েছিলেন ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’।
বিশ্বজোড়া ইতিহাসের নতুন পর্যায়ে পরিস্থিতির কারণেই মার্কসের বিশ্লেষণ পদ্ধতি নিয়ে বিপ্লবী চিন্তা ও সংগঠন বিকাশে বহুমাত্রিক কাজ হয়েছে। রাশিয়ায় এই কাজে লেনিনের নেতৃত্বে সংগঠিত অক্টোবর বিপ্লব এই ধারার প্রথম সচেতন সংগঠিত জননির্মাণ। এই কাজ করতে গিয়ে রুশ বিপ্লবীরা কাজ করেছেন ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিপ্লবীদের সঙ্গে, দৃষ্টি দিয়েছেন বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের বিশেষত উপনিবেশগুলোর মানুষের ওপর ঔপনিবেশিক আধিপত্য এবং তার বিরুদ্ধে জাতীয় সংগ্রামের ধরনের ওপর। শ্রেণি সংগ্রাম, প্রলেতারিয়েতের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের সঙ্গে জাতীয় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও স্বাধীনতার লড়াইকে মানুষের মুক্তির লড়াই পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া বেশ জটিল। জটিল শুধু তাত্ত্বিক সূত্রায়ন নয়, বাস্তবে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন বাস্তবতায় এই লড়াই এগিয়ে নেবার পথনির্দেশনা যে খুবই জটিল তা পরবর্তীকালে বিশ্বের বহু স্থানে লড়াইয়ের নানা ওঠানামা থেকে স্পষ্ট।
জাতি সমস্যা নিয়ে রুশ বিপ্লবীদের কাজ
বিশ্বজুড়ে ঔপনিবেশিক শাসন বিস্তার, নতুন পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের ধরনের বিপরীতে বহু নিপীড়িত জাতি গোষ্ঠীর মুক্তির লড়াই কিংবা তার তাগিদ তৈরি করেছে। এই বিষয় উপেক্ষা করে সমাজতন্ত্রের লড়াই বেশিদূর যেতে পারে না। রাশিয়ার বিপ্লবী সংগ্রামে জাতি প্রশ্ন গুরুত্বের সঙ্গে প্রথম উত্থাপিত হয় জে ভি স্ট্যালিন-এর ‘মার্কসবাদ ও জাতিপ্রশ্ন’ রচনায়, এটি প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে। এই রচনায় প্রাথমিক ধারণাগুলো ব্যাখ্যা করে বিপ্লবীদের করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত নীতি নির্ধারণী আলোচনা ছিল। লেনিনসহ বলশেভিক পার্টির অন্য নেতৃবৃন্দ এই রচনার বক্তব্যের সঙ্গে একমত থাকলেও ইউরোপজুড়ে বিপ্লবীদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্কও হয়। বিতর্কের বিষয় ছিল নেতৃত্ব ও অগ্রাধিকার নিয়ে।
অনেকগুলো প্রশ্নের ফয়সালা করার ব্যাপার ছিল। যেমন- জাতি কী? একটি জনগোষ্ঠীকে কখন জাতি বলা যায়? জাতীয় চেতনা, জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় ঐক্য এগুলো কি প্রশ্নাতীত সর্বজনস্বীকৃত কোনো ধারণা? জাতীয়তাবাদ বলতে কী বোঝায়? জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম কি জাতীয়তাবাদী না বিপ্লবী আন্দোলন? এগুলো কি শাশ্বত কোনো ধারণা, কোনো গঠন না তা নির্দিষ্ট সামাজিক-ঐতিহাসিক পর্বেরই বিষয়? এসব বিষয়ে পরে লেনিন এবং আরও পরে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকে বহু আলোচনা হয়েছে।
‘জাতি’ সংজ্ঞা প্রশ্নে স্ট্যালিন তাঁর উপরোক্ত রচনায় বলেন, ‘একটি জাতি হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী। এটি নির্দিষ্ট বর্ণ (রেস) বা গোত্র (ট্রাইব) নয়। আধুনিক ইটালীয় জাতি গঠিত হয়েছিল রোমান, টিউটন, এত্রুস্কান, গ্রিক, আরব এবং আরও অনেকের সমন্বয়ে। ফরাসি জাতি গঠিত হয়েছিল গাওল, রোমান, ব্রিটনসহ আরও অনেককে সমন্বয় করে। একই কথা অবশ্যই ব্রিটিশ, জার্মান এবং আরও অন্যদের নিয়ে বলা যাবে যারা বিভিন্ন বর্ণ ও গোত্রের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। তাই একটি জাতি নির্দিষ্ট বর্ণ বা গোত্র নয়, বরং ঐতিহাসিকভাবে গঠিত একটি জনগোষ্ঠী।’
স্ট্যালিন আরও বলেন, তবে সব স্থিতিশীল জনগোষ্ঠীই জাতি নয়। অস্ট্রিয়া এবং রাশিয়া স্থিতিশীল জনগোষ্ঠী হলেও তা একক জাতি নয়। একটি জাতি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় জনগোষ্ঠীর তফাৎ কী? একটি জাতির কথা একটি অভিন্ন ভাষা ছাড়া চিন্তাই করা যায় না, কিন্তু একটি রাষ্ট্রে একক ভাষা প্রয়োজনীয় নয়। অস্ট্রিয়াতে চেক এবং রাশিয়াতে পোলিশরা এ কারণেই জাতি হিসেবে স্বতন্ত্র, যদিও একই রাষ্ট্রীয় সীমানায় সেখানে অনেক ভাষাভাষী মানুষের বাস এই দেশগুলোর অখণ্ডতা ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। তিনি অবশ্য পরিষ্কার করে নেন যে, তিনি তাঁর রচনায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মৌখিক ভাষার কথা বিবেচনা করেছেন, সরকারি ভাষা নয়।
লেখার এক পর্যায়ে স্ট্যালিন নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তাহলে কেন ইংলিশ এবং আমেরিকানরা অভিন্ন ভাষা সত্ত্বেও অভিন্ন জাতি গঠন করেনি?’ তাঁর উত্তর হলো- ‘কারণ প্রথমত, তারা একত্রে বসবাস করে না, বাস করে ভিন্ন ভিন্ন ভূখণ্ডে। জাতি তৈরি হয় দীর্ঘসময়ের প্রজন্মের পর প্রজন্ম মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।’ তাঁদের ইতিহাস ও ভূগোল দুটিই ভিন্ন।
স্ট্যালিন বলেছেন যে, সামন্তবাদের অবক্ষয় এবং পুঁজিবাদের উদীয়মান সময়েই বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ‘জাতি’ পরিচয় এবং জাতিরাষ্ট্রের জন্ম। পশ্চিম ইউরোপ, ব্রিটিশ, ফরাসি, জার্মান, ইটালির মতো দেশগুলো এই সময়েই পুঁজিবাদের বিকাশযাত্রার মধ্যে দিয়ে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
জাতি ও জাতি রাষ্ট্রের পাশাপাশি ‘জাতীয় চেতনা’ ও পুঁজিবাদের অভ্যুদয়ের সময়ই স্পষ্ট হতে থাকে। পুঁজিবাদের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে সমাজ অর্থনীতি গঠন, নতুন শ্রেণির উদ্ভব এবং সমাজ চেতনার মধ্যে যে পরিবর্তনগুলো আসে তার মধ্য দিয়ে জাতি, জাতি চেতনা এবং জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। জাতীয় সীমানা, রাষ্ট্র, বাজার, সরকার ইত্যাদির উদ্ভব যে সবদেশে একইভাবে হয়েছে তা নয়। কোথাও ভাষা, কোথাও রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে। ইউরোপে অষ্টাদশ শতকের প্রথম থেকেই পুরনো সাম্রাজ্যগুলোর ভাঙন স্পষ্ট হতে থাকে। দূর বাণিজ্য, উপনিবেশ বিস্তার, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে যে বণিক শ্রেণির উদ্ভব ও বিস্তার ঘটে তারাই পুঁজিপতি বা বুর্জোয়া শ্রেণি হিসেবে ক্রমে সামন্তবাদের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে সংগঠিত হয়। তার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির চেহারাও স্পষ্ট রূপ পেতে থাকে। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর সামন্ত রাজত্বের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া শ্রেণির রাজনৈতিক লড়াই বিস্তৃত হয়।
রুশ বিপ্লবের পর প্রথমে রাশিয়া, এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সর্বোপরি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নিপীড়িত মানুষের মুক্তি সংগ্রাম সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে গিয়ে রুশ বিপ্লবীদের জাতি প্রশ্ন নিয়ে আরও অনেক চিন্তা ভাবনা, তাত্ত্বিক সূত্রায়ন করতে হয়েছে। বিশ্বে তখন বেশিরভাগ অঞ্চল উপনিবেশ। ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে ব্রিটেন সবার ওপরে, এরপর অন্য আরও কয়েকটি ইউরোপীয় পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র যার মধ্যে ছিল স্পেন, ফ্রান্স ও বেলজিয়াম। দক্ষিণ এশিয়ায় ব্রিটেনই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিল। যখন রুশ বিপ্লব হয় তখন বহু দেশেই উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রাম হচ্ছিল। এসব সংগ্রামে নেতৃত্ব ছিল বহুরকম। তাকে কীভাবে মূল্যায়ন করা যায় তা ছিল বিপ্লবীদের বিশেষ বিতর্কের বিষয়।
বিভিন্ন পর্যায়ে লেনিনকে বিতর্কমূলক লেখাই লিখতে হয়েছে বেশি। ১৯১৪ সালে লেনিন জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নিয়ে লেখেন। এই লেখাতেও তিনি এ বিষয়ে বিভিন্ন মত ও বিতর্ক পর্যালোচনা করেন এবং সেই সঙ্গে ১৮৯৬ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করেন যেখানে বিভিন্ন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে বক্তব্য রাখা হয়েছিল। বুর্জোয়াদের জাতীয় আন্দোলন বা পরিচয়ের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করে লেনিন বলেন, ‘পণ্য উৎপাদনের পূর্ণ বিজয়ের জন্য বুর্জোয়াকে দেশীয় বাজার দখল করতেই হবে, রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ এমন একটি ভূখণ্ড থাকতে হবে যেখানে জনগোষ্ঠী অভিন্ন ভাষায় কথা বলবে যা জাতীয় আন্দোলনের জন্য অর্থনৈতিক ভিত্তি নির্মাণ করবে।...(বুর্জোয়াদের) সকল জাতীয় আন্দোলনেরই লক্ষ্য থাকে জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যার মাধ্যমে আধুনিক পুঁজিবাদের সকল প্রয়োজন সবচাইতে ভালোভাবে মেটানো যায়।’
লেনিন জাতীয়-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দুটি স্তরের উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রথম স্তর হিসেবে নির্দেশ করেছেন ১৭৮৯ থেকে ১৮৭১ সাল যেসময়ে আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো গঠিত হয়েছে। দ্বিতীয় স্তর হিসেবে তিনি নির্দেশ করেছেন ১৯০৫ থেকে পরবর্তী সময়কালকে।
জারের রাশিয়াকে লেনিন বলতেন ‘জাতিসমূহের কারাগার’। রাশিয়ায় শাসক জাতি রুশরা ছিল সেদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৮ ভাগ। বাকি জাতিসমূহ জার সাম্রাজ্যে জাতিগত নিপীড়নের শিকার ছিল। এই কারণে জাতি প্রশ্ন রুশ বিপ্লবের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বলশেভিক পার্টির অবস্থান ছিল জোরপূর্বক কোনো জাতিকে কোনো রাষ্ট্রে থাকতে বাধ্য করার বিরুদ্ধে। তবে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম বা জাতিগত নিপীড়ন বিরোধী সংগ্রাম নিয়ে, তার গুরুত্ব বিষয়ে পার্টির মধ্যে জোর বিতর্ক ছিল। আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে গুরুত্ব দেবার বিরোধিতাও ছিল। বুখারিন ও রোজা লুক্সেমবুর্গের মতো ছিল, পুঁজিবাদের অধীনে জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার একটি ইউটোপিয়া আর সমাজতন্ত্রের অধীনে এটি প্রতিক্রিয়াশীল। লেনিনের বক্তব্য ছিল, ‘বুর্জোয়ারা সবসময়ই তাদের জাতীয় দাবি সামনে রাখে। কিন্তু প্রলেতারিয়েতের কাছে এসব দাবি শ্রেণি সংগ্রামের দাবির অধীনস্ত।’
তিনি আরও বলেছেন, বিপ্লবীরা, ‘সকল জাতি রাষ্ট্রের সমতা ও সম অধিকারের স্বীকৃতির পাশাপাশি সকল জাতির প্রলেতারিয়েতের ঐক্যকেই সবার ওপরে গুরুত্ব দেবে এবং যে কোনো জাতীয় দাবি, যে কোনো জাতীয় বিচ্ছিন্নতাকে শ্রমিকদের শ্রেণি সংগ্রামের দৃষ্টিতেই বিচার করতে হবে।’
স্ট্যালিন ব্যাখ্যা করেছেন যে, জাতীয় আন্দোলনের মর্মবস্তু সর্বত্র একইরকম হয় না। আয়ারল্যান্ডে এই আন্দোলনের মূল বিষয়বস্তু ছিল কৃষি প্রশ্ন, বোহেমিয়াতে ছিল ভাষা প্রশ্ন। বুর্জোয়াদের ব্যানারে প্রলেতারিয়েত যাবে কিনা তা নির্ভর করে ওই নির্দিষ্ট সময়ে শ্রেণি দ্বন্দ্বের বিকাশ মাত্রা, শ্রেণি চেতনা এবং তাদের সংগঠনের শক্তির ওপর। শ্রেণি সচেতন প্রলেতারিয়েতের নিজস্ব ব্যানারই আছে, বুর্জোয়াদের ব্যানারের দরকার নেই তার।
যদি কোনো জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিপীড়ন পরিচালিত হয়, যদি জাতিগত পরিচয়ের কারণে চলাফেরা, ভোটাধিকার, স্কুল, ভাষার অধিকারের ওপর হামলা হয় তাহলে বুর্জোয়াদের চাইতে শ্রমিকরা কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তখনই বুর্জোয়াদের জন্য শ্রেণি স্বার্থের ওপর ‘সকলের স্বার্থ’ বসিয়ে প্রচারণার এবং শ্রমিকদের বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে শৃঙ্খলিত করবার অনুকূল ভূমি তৈরি হয়। এর মধ্য দিয়ে সকল জাতির শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করবার পথে কঠিন বাধা সৃষ্টি হয়। সে জন্য স্ট্যালিন বলছেন, জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের আন্দোলনে কমিউনিস্টদের দায়িত্ব হলো জাতিগত নিপীড়ন শেষ করবার লক্ষ নিয়ে অগ্রসর হওয়া যাতে বিভিন্ন জাতির মধ্যেকার বিরোধ থেকে মুক্তির পথ তৈরি হয়। এখানেই বুর্জোয়াদের সঙ্গে তার পার্থক্য, কারণ বুর্জোয়ারা চাইবে জাতিগত দ্বন্দ্ব সংঘাত জিইয়ে রেখে নিজেদের স্বার্থে তাদের কর্তৃত্বাধীন জাতীয় আন্দোলন দীর্ঘায়িত করতে।
কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের প্রস্তাব
বিপ্লবের পর এই প্রশ্নটি নিয়ে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট ফোরামেও অনেক আলোচনা হয়েছে। সেখানে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন উপনিবেশ ও প্রান্তস্থ দেশের প্রতিনিধিরাও। ১৯২০ সালে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে লেনিন ব্যাখ্যা করেন কেন জাতি প্রশ্নের একমাত্র সমাধান প্রলেতারিয়ান বিপ্লব। বুর্জোয়ারা আর এই সংগ্রাম এগিয়ে নিতে পারবে না কারণ তাদের হাত পা সাম্রাজ্যবাদের কাছে বাঁধা, এবং তারা এখন প্রতিবিপ্লবের শিবিরে। তাঁর বক্তব্যে তিনি আরও বিশদ আলোচনা করে বলেন, জাতি ও উপনিবেশ প্রশ্নে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের অবস্থান অবশ্যই হতে হবে জমিদার ও বুর্জোয়াদের উচ্ছেদের লক্ষ্যে সকল দেশ ও জাতির প্রলেতারিয়েত ও শ্রমজীবী মানুষের যৌথ লড়াইয়ের সহযোগী। এর মাধ্যমেই পুঁজিবাদের ওপর বিজয় অর্জন করা সম্ভব হবে, এছাড়া জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্য অবসানের আর কোনো পথ নেই। এই কংগ্রেসেই আগে ব্যবহৃত ‘বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক’ শব্দবন্ধকে ‘জাতীয়-বিপ্লবী’ দিয়ে পুনস্থাপন করা হয়। এর পেছনে কাজ করেছিল লেনিন-এম এন রায় বিতর্ক।
নিপীড়িত জাতিসমূহের লড়াইয়ের বিভিন্ন স্তর ব্যাখ্যা করে লেনিন আরও বলেন, ‘সকল উপনিবেশ ও পশ্চাৎপদ দেশে আমাদের শুধু স্বাধীন বিপ্লবীদের বাহিনী পার্টি সংগঠন গড়ে তুললে হবে না, আমাদের শুধু কৃষক সোভিয়েত গঠন এবং প্রাক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তাকে কার্যকর করার প্রচার কাজে নিয়োজিত হলেই চলবে না, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিককে এই বিষয়টি তাত্ত্বিক সূত্রায়ন দিয়ে আরও পরিষ্কার করতে হবে যে, অগ্রসর দেশগুলোর প্রলেতারিয়েতের সহযোগিতায় পশ্চাৎপদ দেশগুলো সোভিয়েত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে, পুঁজিবাদী স্তর অতিক্রম না করেও উন্নয়নের নির্দিষ্ট পর্যায় অতিক্রম করে কমিউনিজমে পৌঁছতে পারে।
লেনিনের এই বক্তব্যই অনেক পরে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্র’ ধারণা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল তখন, বহুল প্রচারিত ও অনুসৃত ‘অধনবাদী পথে সমাজতন্ত্র’ তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে যেখানে জনপ্রিয় পেটিবুর্জোয়া নেতৃত্ব স্বীকার করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। বলা বাহুল্য অনেক দেশে যথাযথ পর্যালোচনা ছাড়া এই তত্ত্ব অনুসরণ করে জনপ্রিয় বুর্জোয়া ধারার মধ্যে বিপ্লবী রাজনীতি প্রায় হারিয়ে গেছে বা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন প্রথম থেকেই এই দুর্বলতার মধ্যে ছিল। বাংলাদেশও এর কারণে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মধ্যে পড়েছে।
পুঁজিবাদের বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ বুর্জোয়া শ্রেণিকে নিজ ভূখণ্ডের বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে তাড়া করে নিয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে অসম বিকাশ ছাড়াও দুর্বল রাষ্ট্র বা জনগোষ্ঠীর ওপর বৃহৎ সংগঠিত বুর্জোয়া শ্রেণির দমন দখল আধিপত্য পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার বৈশিষ্ট হয়ে ওঠে, পুঁজিবাদ প্রবেশ করে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের পর্বে। এবিষয়ে লেনিন তাঁর ‘সাম্রাজ্যবাদ: পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ শীর্ষক গ্রন্থে বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন, বইটি প্রকাশিত হয়েছে রুশ বিপ্লবের ঠিক আগের বছর। এতে তিনি বলেছেন, ‘পুঁজিবাদ ঔপনিবেশিক নিপীড়নের এবং হাতেগোণা কয়েকটি ‘উন্নত’ দেশের হাতে বিশ্বের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে গলাটিপে শোষণ করবার এক বিশ্ব ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে।’
রুশ বিপ্লবীদের তাই প্রথম থেকেই নীতিগত অবস্থান ছিল নিপীড়িত জাতিসমূহের পক্ষে- তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানো, নিপীড়িত জাতিসমূহকে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করা। লেনিন ও স্ট্যালিনের লেখা এবং তাঁদের সময়ের বিপ্লবী আন্তর্জাতিকের জাতিসমস্যা নিয়ে বিভিন্ন লেখা, বক্তৃতা এবং সাংগঠনিক গৃহীত প্রস্তাবনায় তা স্পষ্টভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে। তবে বাস্তব সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নে পরবর্তী দশকগুলোর অভিজ্ঞতা কী?
অক্টোবর বিপ্লবের শক্তি ও তার ক্ষয়
বস্তুত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অক্টোবর বিপ্লব বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে এক নতুন এক জগত নির্মাণের উদ্দীপনা তৈরি করেছিল। বিভিন্ন জাতির সম্মতি ও বিপ্লবীদের অংশগ্রহণে গঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন, যেখানে সোভিয়েতভুক্ত প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের স্বাধীনভাবে বিচ্ছিন্ন হবার অধিকারের স্বীকৃতি ছিল। সেকারণেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার সময় সবাই শান্তিপূর্ণভাবে ভিন্ন রাষ্ট্রে পরিণত হতে পেরেছিল।
তাছাড়া অক্টোবর বিপ্লবের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বহু দেশে বা উপনিবেশগুলোতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে বিপ্লবী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। উদীয়মান বুর্জোয়াদের নানা দোদুল্যমান দ্বিধাভরা তৎপরতা অতিক্রম করে,বিশেষত বিশ ও ত্রিশ দশকের দিকে, এই বিপ্লবী ধারা উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনকে তীব্রতর করে। এশিয়া আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকার বহুস্থানে বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র আন্দোলন সংগঠিত বিপ্লবী ধারা হিসেবে আবির্ভূত হয়। শ্রমিক কৃষকসহ মেহনতি মানুষ, নিম্নবর্ণ, আদিবাসী, নারীদের ভেতর সংগঠনের ব্যাপ্তি ঘটে, বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষা ও সংগঠনের বিস্তৃতির কারণেই জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নতুন যাত্রা শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিভিন্ন উপনিবেশ অঞ্চলে বেশ কয়েকটি দেশে সমাজতন্ত্রীদের নেতৃত্বেই জাতীয় স্বাধীনতা অর্জিত হয় বা বিপ্লবী ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। চীন বিপ্লব সমাজতান্ত্রিক বিশ্বকে শক্তিশালী একটি পর্যায়ে নিয়ে যায়। কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কিউবা বিপ্লব বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এখনো বিপ্লবী নেতৃত্বে জাতি সমস্যা সমাধানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কিউবা। ৫০ দশক থেকে ৭০ দশক এশিয়া আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকায় অনেকগুলো দেশে বিপ্লবী অভ্যুদয় দেখা যায়, রাজতন্ত্র স্বৈরতন্ত্র এবং সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য উচ্ছেদ করবার চেষ্টা দেখা যায়, বহুজাতিক কোম্পানির দখল থেকে মুক্ত করে তেলগ্যাস সম্পদ জাতীয়করণ করবার ঘটনা ঘটে একে একে বেশ কয়েকটি দেশে। এই বিজয়ীদের কেউ কেউ অবশ্য পরে পরাজিত হয়, কোনো কোনো নেতৃত্ব নিজেরাই নব্য বুর্জোয়ায় অধপতিত হয়; কিন্তু তাতে এসব বিপ্লবী প্রচেষ্টার গুরুত্ব খর্ব হয় না।
যাই হোক, এসব লড়াইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের একক বা যৌথ সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে ৬০ দশকের মাঝামাঝি থেকে এই দুই দেশের বিরোধ, রুশ ও চীনপন্থীতে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভক্তি এবং পরে তাদের মতাদর্শিক অবক্ষয় শুধু বিশ্ব বিপ্লবী আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তির লড়াইকেও দুর্বল করেছে। জাতীয় মুক্তি বা জাতিগত নিপীড়ন বিরোধী আকাঙ্ক্ষার ওপর ভর করতে শুরু করেছে জনশত্রুরা।
পরের দশকগুলোতে বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন দেবার ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের ভূমিকায় বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদী অবস্থানেরও বিচ্যুতি দেখা যায়। চীনের ভূমিকা ছিল সবচাইতে অসুবিধাজনক। দেখা যায় চীন তার বাণিজ্যিক ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থের নিচে স্থাপন করে তার আন্তর্জাতিকতাবাদী দায়দায়িত্ব। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ যখন জাতিগত নিপীড়ন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করছেন তখন তারা পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে সহযোগিতা করেছিল। সর্বশেষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা পরিচালিত সরকারের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে চীন ও সোভিয়েত-উত্তর রাশিয়া। সেইসঙ্গে যোগ দিয়েছে ভারত। জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করে দেশ স্বাধীন করে নিজেরাই সংখ্যালঘু জাতির ওপর নব্য নিপীড়ক হিসেবে হাজির হবার ঘটনাও আছে। এর সাক্ষাৎ দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ।
রাষ্ট্র ও পুঁজির মুখোমুখি মানুষ
বিশ্ব পুঁজিবাদী কাঠামোতে, জাতিসংঘসহ বহুধরনের তৎপরতা সত্ত্বেও, যে জাতি সমস্যা টিকে থাকছে তা এর অন্তর্গত বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক ভিত্তির কারণে। সেজন্য শুধু প্যালেস্টাইন, কাশ্মীর, রোহিঙ্গাসহ বিশ্বের আরও বহু রক্তাক্ত অধ্যায় নয়, ইউরোপে উত্তর আমেরিকায় বর্ণবাদ, শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থী তৎপরতাও তৈরি করছে নতুন নতুন রক্তাক্ত অধ্যায়। দেশে দেশে খ্রিস্টান, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ সব ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই বাড়ছে ধর্মোন্মাদনা, চরমপন্থী অন্য ধর্মবিদ্বেষী সন্ত্রাসী তৎপরতা।
সাধারণভাবে একটি জাতি-রাষ্ট্র গঠনে একটি স্থিতিশীল জনগোষ্ঠী প্রয়োজন হয়, যারা অভিন্ন ভাষা, ভূখণ্ড, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিতে ঐক্যবদ্ধ থাকে। তবে এর ভিন্নতাও আছে। একাধিক ভাষাভাষীর মানুষ নিয়ে রাষ্ট্র আমরা অনেকই দেখি, যেমন ভারত। বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত বরাবরই ভারতীয় জাতি পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা করতে চায়; কিন্তু তাতে এর ভেতরের বহু জাতির কণ্ঠ চাপা পড়ে না। হিন্দি চলচ্চিত্র, গান আর হিন্দুত্ববাদ দিয়ে যখন ভারতীয় পরিচয় দাঁড় করানোর চেষ্টা হয় তখন অহিন্দী দক্ষিণ তা প্রত্যাখ্যান করে, মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মের বিক্ষোভ নানাভাবে প্রকাশিত হয়, উচ্চবর্ণের আধিপত্যের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণের কন্ঠস্বর প্রতিবাদ করে ওঠে। বৃহৎ পুঁজির জন্য তার স্বার্থে ‘জাতীয়’ ঐক্য অপরিহার্য, কিন্তু পুঁজিবাদ যে বৈষম্য ও নিপীড়নের ওপর ভিত্তি করে বিকশিত হয় তার কারণে স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্য সম্ভব হয় না। তখনই বুর্জোয়া রাষ্ট্রের জন্য বলপ্রয়োগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। ভারতের ক্রমবর্ধমান সামরিকীকরণ এবং অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের বিস্তার এরই ফলাফল। ভারতের মতো বহু দেশে পুঁজির স্বার্থে রাষ্ট্রই হয়ে দাঁড়াচ্ছে নিজ নাগরিকদের বিরুদ্ধে বড় সন্ত্রাসী শক্তি।
প্যালেস্টাইন আর কাশ্মীর সমস্যা সংঘাত গণহত্যার কথা আমরা শুনছি ছোটবেলা থেকেই। তার সমাধানের নানা লেফট রাইটের পর যথারীতি সমস্যা যেখানে ছিল সেখানেই আছে। এখন তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ মডেলে এদের ওপর হামলা জোরদার করবার অজুহাত আরও বেড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও বহু নতুন অঞ্চল। একে একে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইউরোপে শরণার্থী প্রবাহ এসবেরই পরিণতি। অন্যদিকে মুসলিম সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি ভারতে হিন্দুত্ববাদী, ইউরোপ আমেরিকাজুড়ে এখন খ্রিস্টান ও শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থীদের জোরদার বিস্তার দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স সবশেষ জার্মান নির্বাচনে এর প্রতিফলন খুব স্পষ্টভাবেই ঘটেছে।
অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ পরে, সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের ৩০ বছর পরের বর্তমান বিশ্ব তাই জাতিগত, ধর্মীয় ও আঞ্চলিক সংঘাত, ঘৃণা ও বিদ্বেষে জর্জরিত। জগৎ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ না দেখলেও এসব ঘিরে যুদ্ধ, সন্ত্রাস আর চরমপন্থার বিস্তার দেখছে। অসহিষ্ণুতা, সহিংসতায় প্রতিদিন মরছে মানুষ। হঠাৎ করেই যেন মানুষ অনেক ক্ষুদ্র হয়ে গেছে। হয়ে গেছে নিরাশ্রয়। তাই বৃহৎ কোনো স্বপ্ন দেখার বদলে সে এখন নিজেকেই খোঁজে, মানুষে মানুষে সংহতির সম্ভাবনা দেখা ভুলে গিয়ে জাতি ধর্ম বা অঞ্চলের পরিচয়ে নিজেকে সাজায় আর বাকি সবার বিরুদ্ধে। এখন যেন সবাই সবার শত্রু। এর বিপরীতে মুক্তির লড়াই-এর নানা প্রচেষ্টা দুনিয়াজুড়েই সংগঠিত হতে চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশের জন্য জাতীয় মুক্তির লড়াই এখনো খুবই জরুরি কাজ; কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, শাসকদের জাতীয়তাবাদী প্রহসন থেকে জাতীয় মুক্তির লড়াই গুণগতভাবেই ভিন্ন। ‘জাতীয় বুর্জোয়া’, ধনিক শ্রেণির ‘দেশপ্রেমিক দল’ কিংবা বাঙালি জাতির একক আধিপত্যের সূত্র দিয়ে এই লড়াই চালাতে গেলে তা শাসক শ্রেণির কাঠামো থেকে কখনোই বের হতে পারবে না। বর্তমান সময়ে জাতীয় মুক্তির প্রথম শর্ত এই রাষ্ট্রের কাঠামোতে বসবাসরত সকল জাতি ভাষা ও ধর্মের মানুষদের স্বীকৃতি, বৃহৎ ঐক্য এবং সকলের মুক্তির জন্য পথ নকশা; দ্বিতীয়ত, মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ; তৃতীয়ত, অবস্থানগত কারণে ভারতের বৃহৎ পুঁজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে ভারতের জনগণের সঙ্গে সংহতির ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়া; চতুর্থত, বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় নতুন শক্তি চীন ও রাশিয়ার কর্তৃত্বকে অস্বীকার করা; পঞ্চমত, সকল প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সর্বজনের মালিকানার লড়াই বিস্তৃত করা; এবং ষষ্ঠত, উন্নয়নের নতুন পথ নকশা এবং সামাজিক মালিকানার ভিত্তিতে সকল মানুষের মুক্তির লড়াইকে অগ্রসর করা। বলাইবাহুল্য এই জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে শ্রেণি, লিঙ্গ, ধর্মীয় ও জাতিগত বৈষম্য- নিপীড়ন বিরোধী বিপ্লবী রাজনীতির নেতৃত্ব যে অপরিহার্য তা বহু সাফল্য এবং ব্যর্থতা বারবার প্রমাণ করেছে।
অক্টোবর বিপ্লব দুনিয়ার মানুষকে ‘মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ’ গড়ার বৃহৎ স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা ও সুযোগ দিয়েছিল। পৃথিবীর সকল প্রান্তে সবরকম বৈষম্য ও নিপীড়ন বিরোধী লড়াইয়ে এই বিপ্লব দিয়েছিল পথের দিশা। এই শক্তি ও দিশা নিয়ে পৃথিবীর মানুষ বহু জিঞ্জির ভেঙেছেন। বহুরকম শোষণ নিপীড়নের পাশাপাশি জাতিগত নিপীড়ন ও দাসত্ব থেকে মুক্তির লড়াইয়ের শক্তি জুগিয়েছে এই বিপ্লব; কিন্তু ভেতর ও বাইরের বিভিন্ন কারণে এর দুর্বলতাপ্রাপ্তিই বর্তমান দুনিয়াকে ভয়ংকর পরিস্থিতির দিকে টেনে নিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সজাগ চিন্তা ও কাজ দিয়ে বিশ্বজুড়ে বিপ্লবী সংহতি এবং দেশে দেশে আরও বিকশিত বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি করা ছাড়া রাষ্ট্র ও পুঁজির ক্রমবর্ধমান বর্বরতা ও আগ্রাসন থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
তথ্যসূত্র
১. প্রথম প্রকাশ Prosveshcheniye(Enlightenment), Nos. 3-5, March-May 1913. এই পত্রিকা লেনিনের তত্ত্বাবধানে রাশিয়ার একটি সম্পাদনা পরিষদের পরিচালনায় নিয়মিত চিঠি চালাচালির মাধ্যমে সম্পাদিত ও প্রকাশিত হতো। এটি প্রাভদার সাথে সম্পর্কিত ছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ১৯১৪ সালে সরকার এটি নিষিদ্ধ করে। ১৯১৭ সালে বিপ্লবকালে এটি দুইসংখ্যা একসাথে প্রকাশিত হয়।
২. বিস্তারিত পর্যালোচনার জন্য দেখুন: Horace B Davis: Toward A Marxist Theory of Naationalism, MR, 1978
৩. The Right of Nations to Self-Determination, Progress Publishers.
৪. Preliminary Draft of Theses on the National and Colonial Questions, 5th June 1920
৫. The Report of the Commission on The National and Colonial Questions, 26th July 1920
৬. এই বিষয়ে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণের জন্য দেখতে পারেন- আনু মুহাম্মদ: পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ এবং অনুন্নত বিশ্ব। প্রথম প্রকাশ ১৯৯৩।
৭. এই বিষয়ে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণের জন্য দেখতে পারেন- আনু মুহাম্মদ: পুঁজির আন্তর্জাতিকীকরণ এবং অনুন্নত বিশ্ব। প্রথম প্রকাশ ১৯৯৩।
৮. অক্টোবর বিপ্লব, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিকাশ ও তার পতন নিয়ে বিশ্লেষণের জন্য দেখুন- আনু মুহাম্মদ: অনুন্নত দেশে সমাজতন্ত্র: সংগ্রাম ও অভিজ্ঞতা, প্রতীক, ১৯৯৩