বিশ্ব আরেকটি যুদ্ধের মুখোমুখি!

মনজুরুল হক

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:৪২ এএম

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব এতটাই স্পর্শকাতর এবং অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে যে, মনে করা হচ্ছে- যে কোনো মুহূর্তে দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যাবে। আর সেই যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবীভাবে আশপাশের অন্যান্য দেশে তথা পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়বে।

এখন পর্যন্ত পরমাণু ক্ষমতাসম্পন্ন দেশসমূহ দূতিয়ালি করে যুদ্ধ ঠেকানোর আয়োজন করছে। ইতিমধ্যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাখয় রাশিয়া, ইউক্রেন, ব্রিটেন সফর করেছেন। জার্মানির চ্যান্সেলর ঝটিকা সফর দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। আর ইউরোপের ভেতরে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারপরও বড় বড় দেশগুলো ইউক্রেন থেকে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিচ্ছে, দূতাবাস বন্ধ করে দিচ্ছে দেখে মনে হতেই পারে যুদ্ধ আসন্ন!

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ‘ক্ষুদ্র’ ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইছে ‘বিশাল’ রাশিয়া। রাশিয়ার কথিত হুমকি সামলাতে ইউক্রেনের পাশে আছে পুরো ন্যাটো। তার মানে ৩০টি দেশ, যার প্রধান ৭টি দেশই কার্যত বিশ্ব শাসন করে। অপরদিকে রাশিয়া একা। তার পেছনে চীনের সমর্থন আছে বলে মনে করা হচ্ছে। রাশিয়ার মিত্র বলে পরিচিত ভারত, মিয়ানমার, সিরিয়া আর ইউরোপের ছোট ছোট আঞ্চলিক শক্তিসম্পন্ন প্রাক্তন সোভিয়েতের কয়েকটি দেশ আছে। এই শক্তিকেই ন্যাটো জোট মারাত্মক হুমকি মনে করছে। কেন? এর পেছনে রয়েছে পরিষ্কার সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি। আর রয়েছে বিশ্বজুড়ে প্যানডেমিকের ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিতে মারণাস্ত্র বিক্রির টাকার জোগান।

রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব কী নিয়ে? এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে ছোট করে ইউক্রেনের সোভিয়েতভুক্ত হওয়া এবং ১৯৯১ সালে স্বাধীন হওয়ার ঘটনাবলি দেখে নিতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যভুক্ত ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগ দেয় আরও ১৩টি দেশের মতো। ইউক্রেন সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়ার পরই সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারের অধিকাংশ অস্ত্র ইউক্রেনে তৈরি হতো। সে সময় থেকে ইউক্রেনেই মজুদ হতো। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ইউক্রেন আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার সময় ইউক্রেন ছিল বিশ্বের তৃতীয় পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদকারী দেশ। সে সময় ইউক্রেনের কাছে ১৩০টি ICBM বা ইন্টারন্যাশনাল ব্যালাস্টিক মিসাইল, ৪৬টি RT-23 Moldets বা পারমাণবিক ওয়ারহেড এবং ৩৩টি হেভি বম্বারস মজুদ ছিল, যার নিয়ন্ত্রণ ছিলো CIS বা কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটস-এর হাতে, অর্থাৎ রাশিয়ার হাতে। কারণ রাশিয়া সিআইএসের নিয়ন্ত্রক ছিলো।

যদিও ইউক্রেন দাবি করে এই বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার তারা ১৯৯৪ সালে ধ্বংস করে ফলে NPT বা টেরিটরি অন দ্য নন-প্রলিফিরেশন অব নিউক্লিয়ার ইউপন-এ যোগ দেয়; কিন্তু রাশিয়া মনে করে, এখনো ইউক্রেনের কাছে তাদের সোভিয়েত আমলের অস্ত্র এবং কারিগরি দক্ষতা মজুদ আছে। ইউক্রেন স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই রাশিয়া তার নিকটতম প্রতিবেশির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাইলেও ইউক্রেন বরাবরই পশ্চিমা মিত্রদের দিকে হেলে থাকে। গত সাড়ে সাত বছর ধরে তারা ন্যাটো জোটভুক্ত হওয়ার আবেদন করে আসছে। আর সেটাই রাশিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ। রাশিয়া কোনোভাবে চায় না তার ঘরের মধ্যে ন্যাটো এসে ঘাঁটি নির্মাণ করুক।

প্রসঙ্গত, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে গেলে তার পর পরই সোভিয়েত নেতৃত্বের ‘ওয়ারশ’ জোট ভেঙে যায়। ন্যাটোর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর অস্তিত্ব না থাকার পরও ন্যাটো থেকে যায়। শুধু তাই নয়, ন্যাটো ক্রমান্বয়ে সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০টি দেশের জোট করে ফেলে। ন্যাটোর এই ক্রমবর্ধমান শক্তিবৃদ্ধি রাশিয়ার জন্য স্পষ্টতই বিরাট হুমকি। আর তাই রাশিয়া ২০০০ সালের দিকে চেষ্টা করে যেন ইউক্রেনকে ভেঙে দিয়ে তার শক্তি ক্ষয় করা যায়। তারই ফলশ্রুতিতে ২০১৪ সালে দনেৎস্ক ও লুগানস্ক ইউক্রেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ওই একই বছরে ক্রিমিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার পর রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। ইউক্রেনের এই শক্তি ক্ষয়ের পর আবার ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের তিনটি রাজ্যে স্বাধীনতাকামীদের রাশিয়া সহায়তা করে। সেখানে গত এক দশক ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ইউক্রেনের পূর্বাংশের স্বাধীনতাকামীরা সরাসরি রাশিয়ার পক্ষে লড়বে।

এ রকম এক জটিল সমীকরণের মধ্যে আটকে আছে ইউক্রেন-রাশিয়ার বর্তমানের চাপান-উতোর। ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের দ্বিতীয় অস্ত্রের চালান ইউক্রেনে পাঠিয়েছে। মারাত্মক সব মারণাস্ত্র এসেছে ব্রিটেন, কানাডা, সুইডেন থেকেও। জার্মানি পাঠিয়েছে আত্মরক্ষা সরঞ্জাম। সব মিলিয়ে গোটা ইউরোপ এক রাশিয়ার হুমকিকে (ইউক্রেন ন্যাটো জোটে যোগ দিলে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করবে) ‘মারাত্মক আগ্রাসন’ বিবেচনা করে কার্যত ইউক্রেনকে উইপন হ্যাঙ্গার বানিয়ে ফেলতে চাইছে। খোদ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট এত সব অস্ত্র চাইছে না। তার দাবি, যুদ্ধাবস্থা বন্ধ হোক। শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হোক। কারণ তিনি ভালো করেই জানেন যে, রাশিয়া আক্রমণ করে যতটুকু ক্ষতি করবে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে পূর্বাঞ্চল হাত ছাড়া হয়ে গেলে এবং তা হওয়ার সম্ভবনাই প্রবল।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউস সতর্ক করে দিয়েছে যে, পুতিন ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ইউক্রেনের ওপর একটি বড় হামলা চালাতে পারেন। তিন দিকে স্থল, সমুদ্র এবং বিমানবাহিনী নিয়ে ইউক্রেনের ওপর চড়াও হবে। এর জবাবে রাশিয়া জানিয়েছিল, এটি একটি রাশিয়াবিরোধী বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা।

আমেরিকার মাথাব্যথার উপলক্ষ পুতিন না-কি ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। অর্থাৎ একটি বিস্তৃত, রাশিয়ান-আধিপত্যযুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করবেন, যা সোভিয়েত আমলের শক্তির মতো হবে। পুতিন সেই লক্ষে ইউক্রেনকে আবার দলে টানতে চান।

রুশ প্রেসিডেন্ট ইউক্রেন পর্যন্ত ন্যাটোর সম্প্রসারণকে হুমকি হিসেবে দেখছেন এবং ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের সম্ভাবনাকে তার দেশের জন্য একটি অস্তিত্বের হুমকি মনে করছেন। রাশিয়া যেহেতু সামরিকভাবে আরও দৃঢ় এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, ন্যাটো সম্পর্কে তার সন্দেহ আরও মজবুত হয়েছে। তিনি বার বার ইউক্রেনে আমেরিকান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং সেনাবাহিনীর অবাধ বিচরণ দেখছেন। যদিও মার্কিন, ইউক্রেনীয় এবং ন্যাটো কর্মকর্তারা জোর দিয়েছিলেন যে, সেখানে কেউ নেই।

এই প্রসঙ্গে পুতিন জোর দিয়ে বলেছেন, ‘ইউক্রেন ও বেলারুশ মৌলিকভাবে রাশিয়ার অংশ, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবেও। আমেরিকা আর তার ন্যাটো মিত্ররা মনে করে, আনুমানিক ১ লাখ ৩০ হাজার রাশিয়ান সৈন্য ইউক্রেনের উত্তর, পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকে অবস্থান করছে।

মার্কিন কর্মকর্তারা আরও বলছেন, রাশিয়ার যুদ্ধ পরিকল্পনার প্রমাণ রয়েছে, তারা ১ লাখ ৭৫ হাজার সৈন্য দিয়ে একটি শক্তিশালী আক্রমণ করবে, যার সামনে ইউক্রেনের দাঁড়ানোর ক্ষমতা খুব কম। এরই কাউন্টার হিসেবে প্রায় ৮ হাজার ৫শ’ আমেরিকান সৈন্য পূর্ব ইউরোপে সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে। এই প্রেক্ষিতে যুদ্ধ অনেকটাই অবসম্ভাবি হয়ে উঠেছে। এই যে গোটা ইউরোপজুড়ে সাজ সাজ রবে যুদ্ধ প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, তার পেছনে যতটা ইউক্রেনকে সহায়তা করার বিষয়, তার চেয়েও অনেক বেশি ইউরোপ আবার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ে ভীত হওয়া। আর এর পেছনের সবচেয়ে বড় কারণ অর্থনীতি। গোটা ইউরোপের ২০ শতাংশ জ্বালানি গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। যুদ্ধ বাঁধলে নিশ্চিতভাবেই সেই সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাবে। তখন এমন অনেক দেশ আছে, যেখানে রাস্তায় কোনো গ্যাসচালিত যানবাহন দেখা যাবে না। মুহূর্তে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। এই সব হিসাব-নিকাশ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন করে রেখেছেন। আর সে কারণে ন্যাটোর বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার মজুদের পরও তিনি দমিত হবেন না বা ন্যাটোকে ইউক্রেনে ঘাঁটি গড়তে দেবেন না।

যুদ্ধ বাঁধলে শুধু ইউরোপ নয়, এশিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির দেশগুলোও বিপদে পড়বে। হু হু করে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাবে। গমের সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাবে। তৈরি পোশাক রফতানি বন্ধ হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে ফিরে আসতে থাকবে প্রবাসী বাঙালিরা। সবকিছু মিলিয়ে এটা মোটেই ‘আ গ্রেম অব থ্রন’ টাইপ কোনো অ্যাডভেঞ্চার নয়। বিশ্বের জন্যও অশনি সংকেত।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh