বাংলা ভাষার নীতি ও পরিকল্পনা কেন জরুরি?

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১:০৩ এএম | আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০১:৪১ পিএম

আমীন আল রশীদ

আমীন আল রশীদ

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি চলে যাচ্ছে। এই মাসকে আমরা ‘ভাষার মাস’ কেন বলি। মাতৃভাষা বাংলার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এই নামকরণ; বস্তুত ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আত্মোৎসর্গকারীদের স্মরণ এবং রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্যই বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় এই মাসে ভাষা নিয়ে বেশি কথাবার্তা, আলোচনা ও তর্ক হয়। যে কারণে আমরা ফেব্রুয়ারিকে বলি ‘ভাষার মাস’।

১৯৮৭ সালে প্রণয়ন করা হয় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন। এই আইনের বলে দেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান (বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত) তাদের সব নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের প্রশ্নোত্তর এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলি বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক। যদিও উচ্চ আদালতে বাংলার ব্যবহার এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি।

গত বছর ‘আমার ভাষা’ নামের একটি সফটওয়্যার উদ্বোধন করা হয়। এই অনুবাদ সফটওয়্যার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ ও রায়গুলো ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে সক্ষম হয়। সফটওয়্যারটি তৈরি করেছে একস্টেপ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া, যাদের মূল ‘অনুবাদ’ সফটওয়্যারটি ভারতে একইভাবে ইংরেজি থেকে বাংলাসহ অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। ব্যবহারকারী নিজের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে এই সফটওয়্যারে প্রবেশ করতে পারবেন। অনুবাদের জন্য ইংরেজিতে দেওয়া রায় বা আদেশ প্রথমে পিডিএফ ভার্সনে কনভার্ট করে নিতে হবে। এরপর সেই পিডিএফ ফাইল আপলোড করতে হবে সফটওয়্যারে। আপলোডের পর কমান্ড দিলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলায় অনুবাদ হয়ে যাবে ইংরেজিতে দেওয়া রায়টি।

সন্দেহ নেই, এই সফটওয়্যারটি দেশের উচ্চ আদালতের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে এর ব্যবহার কতটা হচ্ছে এবং এটি আসলেই কতটা কার্যকর এবং বিচারব্যবস্থার উন্নয়নে এটি কতটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছে, তা বুঝতে হয়তো আরও কিছুটা সময় লাগবে।

আদালতের কার্যক্রম, রায় ও আদেশ ইংরেজিতে হলে মূলত সাধারণ বিচার প্রার্থীদেরই ভুক্তভোগী হতে হয়। কারণ অধিকাংশ বিচারপ্রার্থীর পক্ষেই তা বোঝা সম্ভব নয়। বরং তাদের তাদের আইনজীবীরা যা বুঝান, তা-ই বুঝতে হয়। এতে করে আইনজীবী ও অনুবাদকদেরই পয়সা বাড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের ভুলভাল বুঝিয়ে হয়রানি করা হয়। এর পেছনে একটি বড় কারণ, দেশের সব আইন ও আইনের পরিভাষা এখনো পুরোপুরি বাংলায় নেই বা সবকিছুর বাংলা করা কঠিন। আরও যে যুক্তি দেওয়া হয়, তা হলো- বাংলা ভাষা ব্যবহার করলে বিদেশে এই দেশের আইন বা বিচারের রেফারেন্স দেওয়া যাবে না, বিচার আন্তর্জাতিক মানের হবে না ইত্যাদি; কিন্তু ধীরে ধীরে হলেও এই পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। দেশের আইনগুলো বাংলায় অনুবাদ করার কাজ চলছে এবং এই ইস্যুতে এরই মধ্যে ব্যাপক কাজ হয়েছে। 

সমস্যা হলো, সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোয় বাংলার ব্যবহার থাকলেও, সেখানে ভুলের ছড়াছড়ি। বাক্য গঠনে দুর্বলতার চেয়েও বড় বিষয় বানান ভুল। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের অফিসিয়াল চিঠিতে বেশ কয়েকটি বানান ভুল নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ সমালোচনা হয়। তবে এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ প্রমিত বাংলায় লিখতে পারা মানুষের সংখ্যা খুবই কম; তাতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হোন, লেখক কিংবা সাংবাদিক।

প্রশ্ন হলো, একজন মানুষ ২০-২২ বছর পড়ালেখা করেও নিজের মায়ের ভাষাটা কেন শুদ্ধভাবে লিখতে ও বলতে পারেন না? যে জাতীয় সংসদকে বলা হয় দেশ ও জাতির ভাগ্য নির্ধারণকেন্দ্র এবং সেখানে দাঁড়িয়ে যারা বক্তৃতা দেন, তাদেরকে বলা হয় আইনপ্রণেতা। সেই আইনপ্রণেতাদের কতজন প্রমিত বাংলায় বলতে ও লিখতে পারেন?

এটি নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে যে, যিনি যে এলাকার সংসদ সদস্য, তিনি সেই এলাকার ভাষায় যদি সংসদে দাঁড়িয়ে কথা বলেন, তাহলে সেটি তার এলাকার মানুষের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়। মানুষ মনে করে তারা সত্যিকারের লোককেই সংসদে পাঠিয়েছে; কিন্তু কথা শুধু আঞ্চলিক ভাষা কিংবা টোনের বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে, যখন যিনি কথা বলছেন, সেটি প্রমিত বাংলায় হোক কিংবা সেখানে আঞ্চলিকতার টান যতই থাকুক না কেন, তিন যা বলছেন সেটি কতটা বোধগম্য ও হৃদয়গ্রাহী হচ্ছে?

আঞ্চলিকতাও ভাষার সৌন্দর্য; কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার, গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে বসে যখন কেউ কথা বলেন, তখন তিনি নির্দিষ্ট একটি এলাকা বা একটি কমিউনিটির জন্য বলেন না। তিনি কথা বলেন, পুরো দেশ ও জাতির সামনে। সুতরাং তখন তিনি কী বলবেন, কীভাবে বলবেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন হলো, এ সব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের কি পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়?

এসব কারণেই আসে ভাষানীতি ও ভাষাপরিকল্পনার বিষয়টি। আমাদের শিক্ষার মাধ্যম বহুবিভক্ত এবং চরম বৈষম্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার কারণে ভালো ইংরেজি জানা লোকের চাকরির বাজার বড়। ফলে ভালো বাংলা জানা লোক যত মেধাবীই হোক, ইংরেজি জানা লোকের সঙ্গে সে প্রতিযোগিতায় টেকে না। এ জন্য অর্থনীতির বিশ্বায়নকে দায়ী করা হলেও, এটি স্পষ্টতই রফিক-সালাম-বরকতের রক্তের অবমাননা।

কোনো গণমাধ্যম নিজস্ব স্টাইলের নামে যা খুশি এবং যেভাবে ইচ্ছা বাংলা লেখার বা বলার অধিকার রাখে কি-না, সেটি রাষ্ট্রকেই ঠিক করতে হবে। আর এ জন্যই প্রয়োজন ভাষানীতি ও ভাষাপরিকল্পনা।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয়, বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের বাংলা অর্থাৎ মাতৃভাষা শেখানোর কী আয়োজন আছে? সব পড়লেখার চূড়ান্ত লক্ষ্য ভালো চাকরি। পড়ালেখা এখন আর জ্ঞান অর্জনের বিষয় নয়। এটা এখন প্রতিযোগিতার পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং এই বাজার অর্থনীতি আর চাকরি পাওয়ার প্রতিযোগিতায় ভাষাপরিকল্পনা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক এ কারণে যে, সার্টিফিকেটসর্বস্ব পড়ালেখার কারণে এখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনের পরও অধিকাংশ লোক তার নিজের ভাষায় অর্থাৎ বাংলায় পাঁচটি নির্ভুল বাক্য লিখতে পারে না। সেখানে তিনটি বানান ভুল থাকবে, দুটি বাক্য অসংলগ্ন থাকবে। সুতরাং শুধু গণমাধ্যমের ভাষাই নয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রমিত বাংলা শেখানোর জন্যও একটা বড় পরিকল্পনা নিতে হবে।

বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট-পিআইবির প্রয়াত মহাপরিচালক শাহ আলমগীর একবার বলেছিলেন, তারা গণমাধ্যমে বাংলা ভাষার ‘বিকৃতি’ ও ‘নৈরাজ্য’ ঠেকাতে একটি জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করবেন। যেখানে পিআইবি ছাড়াও থাকবে বাংলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দুদিনব্যাপী ওই সেমিনারে গণমাধ্যমের ভাষা নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ উপস্থাপিত হবে এবং পুরো আলোচনা রেকর্ড করা হবে। পরে সেগুলোর একটি সংকলন বের করবে পিআইবি।

এখানেই শেষ নয়, গণমাধ্যমে প্রমিত বাংলার চর্চা নিশ্চিত করতে ওই সেমিনার থেকে কিছু প্রস্তাব পেশ করা হবে এবং একটি কমিটি করে দেওয়া হবে, যারা বিষয়গুলো নজরদারি বা তদারক করবে। ওই কমিটি প্রতি মাসে একটি সংবাদপত্রের সব খবর ও লেখায় টানা এক মাস খেয়াল রাখবে, নোট করবে এবং যেসব বানান তারা ভুল করেছে বা বিকৃত করেছে, সেগুলো চিহ্নিত করে একটি চিঠি দেবে ওই পত্রিকার সম্পাদককে। যেখানে ভবিষ্যতে এসব বানান প্রমিত/শুদ্ধভাবে লেখার অনুরোধ থাকবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh