কনকচাঁপা ও মইনুল ইসলাম খান

প্রেমের তাজমহলের মমতাজ ও শাজাহান

রাফিউজ্জামান রাফি

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১:৪২ এএম

কনকচাঁপা

কনকচাঁপা

ঘটনাটি বেশ আগের। সেবার নতুন কুড়ি প্রতিযোগিতা চলছিল। মেয়েটি ছিল সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী একজন প্রতিযোগী আর ছেলেটি ছিল তাদের দলীয় গানের সংগীত পরিচালক। তখন থেকেই তাদের চেনা পরিচয় ও ভালো লাগা। পরবর্তীতে মেয়েটি সংগীতাঙ্গনে পদার্পণ করেন ছেলেটির সুর করা গানে কণ্ঠ দিয়েই। এরপর দ্বিতীয় জীবন তথা বিবাহিত জীবনেও মেয়েটির হাত ধরে সেই ছেলেটি। ১৯৮৪ সালে দুই পরিবারের সম্মতিতে ছেলেটি ও মেয়েটির চার হাত এক করে দেওয়া হয়। বলছিলাম উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী, বাংলাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি গায়িকা একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত গুণী সংগীতশিল্পী রোমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা এবং তার স্বামী বিশিষ্ট সুরকার ও সংগীত পরিচালক মইনুল ইসলাম খানের কথা। মিডিয়ার জনপ্রিয় দু’জন শিল্পী দম্পতিকে নিয়ে লিখেছেন রাফিউজ্জামান রাফি।

কনকচাঁপার পৈতৃক বাড়ি সিরাজগঞ্জে। ১৯৬৯ সালে কনকচাঁপা ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। পিতার নাম আজিজুল হক মোর্শেদ। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তার সংগীত শিক্ষার শুরুটা ছিল ঘরে থেকেই। বাবা আজিজুল হক মোর্শেদের হাত ধরেই সংগীতে হাতেখড়ি। পরবর্তীতে সংগীতে তালিম নেন বশির আহমেদের কাছে। গুণী এই কণ্ঠশিল্পী সেজান মাহমুদের লেখা মইনুল ইসলাম খানের সুরে ‘এলোমেলো চুলে ললাটের ভাঁজ’ গানটির মাধ্যমে পা রাখেন এদেশের সংগীত ভুবনে। এর পরের গল্পতো সবারই জানা। সে গল্প শুধুই জয়ের, সে গল্প সুরের ডানায় ভর করে মানুষের হৃদয়ে আসন নেওয়ার, সে গল্প সংগীতে অবদান রাখার কারণে একাধিকবার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভের। আর যিনি নেপথ্য কারিগর, যার যত্ন, শ্রম ও মনোযোগে রচিত হয়েছে এই গল্প - তিনি আর কেউ নন। বরেণ্য সুরকার ও সংগীত পরিচালক, কনকচাঁপার ঘরের মানুষ মইনুল ইসলাম খান। 

সুর ছাড়া কথা যেমন গান হয়ে ওঠে না; তেমনই কথা ছাড়াও সুর পায় না তার পরিপূর্র্ণতা। প্রেম ও ভালোবাসার মিহি সুতায় বাঁধা দীর্ঘ দাম্পত্যজীবনে কনকচাঁপা ও মইনুল ইসলাম খানও যেন ঠিক তেমনই। একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে ভালোবাসায় প্রেমে কনকচাঁপা ও মইনুল ইসলাম খান গড়ে তুলেছেন এক সুখের সংসার। দু’জনে পেরিয়েছেন দীর্ঘ ৩৮ বছর। তবুও ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমেনি। তাদের এই ভালোবাসার কথা বলতে গেলে মনে পড়ে যায় কনকচাঁপার গাওয়া সেই বিখ্যাত গানটি। ‘এ বুকে বইছে যমুনা, নীল অথৈ প্রেমের জল। তার তীরে গড়ব আমি, আমার প্রেমের তাজমহল। ’ গানে গানে এমন আশা পোষণ করলেও কনকচাঁপা বাস্তবে গানটি কণ্ঠে তোলার অনেক আগেই গড়েছেন প্রেমের সেই তাজমহল। যে তাজমহলের মমতাজ কিংবদন্তি এই গায়িকা স্বয়ং, আর সে তাজমহলে তার শাহজাহানরূপে আছেন বিশিষ্ট সুরকার ও সংগীত পরিচালক মইনুল ইসলাম খান। 

শুরুতেই কথা হয় মইনুল ইসলাম খানের সঙ্গে। কেননা কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপার সঙ্গে কথা বলা অত সোজা না। তার সঙ্গে কথা বলতে হলে আগে পেরিয়ে যেতে হয় একটি সিংহদ্বার। আর সেই সিংহদ্বারে রয়েছেন মইনুল ইসলাম খান। সেখানে পরীক্ষা দিয়ে তবেই সুযোগ মেলে কিংবদন্তি এই কণ্ঠশিল্পীর সঙ্গে কথা বলার। 

সংগীতশিল্পী হিসেবে কনকচাঁপার ক্যারিয়ার শুরুর আগে থেকেই মইনুল ইসলাম সুরকার হিসেবে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। পরবর্তীতে সংগীতশিল্পী কনকচাঁপার ক্যারিয়ার শুরু হলে যে সময়টুকু তিনি ব্যস্ত থাকতেন নতুন গানে সুর দিতে কিংবা নতুন কোনো সুর নিয়ে ভাবতে, সে সময়টুকু তিনি ছায়ার মতো কনকচাঁপার পাশে থাকা শুরু করেন। কনকচাঁপার ক্যারিয়ার সামনের দিকে এগিয়ে নিতে গিয়ে নিজের কাজ কমিয়ে দেন তিনি। স্বার্থের এই যুগে স্বার্থে ঘা লাগলে স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই যেখানে অচেনা হয়ে যায়; সেখানে নিঃস্বার্থভাবে নিজের ভবিষ্যতের চাকা থামিয়ে স্ত্রীর পথকে মসৃণ করতে নিবেদিতপ্রাণ সহচর বনে যান স্বামী মইনুল ইসলাম খান। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম স্ত্রীর পাশে থাকতে গিয়ে নিজের এই স্যাক্রিফাইসের কথা। তবে বিষয়টি এভাবে দেখেন না তিনি। তিনি মনে করেন স্বামী-স্ত্রী হলো একে অন্যের পরিপূরক। এখানে একজন আরেকজনের পাশে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। এখানে আমি বা আমার বলে কিছু নেই। এক ছাতার নিচে বাস করতে গেলে ভাবনাটা হতে হবে আমাদেরকেন্দ্রিক। আর সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি স্ত্রীর এগিয়ে চলার পথে পাশে থেকেছেন মাত্র। কেননা তার মনে হয়েছে সেই মুহূর্তে কনকচাঁপার পাশে থেকে সময় দেয়াটাই বেশি প্রয়োজন ছিল। স্ত্রীকে সময় দিতে গিয়ে হয়তো এ সময় তার নিজের কাজের কিছু ঘাটতি হয়েছে; কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই স্ত্রী অন্তঃপ্রাণ এই মানুষটির। বরং স্ত্রীর সাফল্যের পথ সুগম করে দেওয়াটাই মুখ্য ছিল বলে মনে করেন তিনি। তবে কনকচাঁপা বিষয়টিকে একেবারেই অন্যভাবে দেখেন। তিনি বলেন, যে সোনালি সময়টা মইনুল ইসলাম খান তার জন্য ব্যয় করেছেন, সেই সময়টাতে তিনি চাইলেই নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারতেন। নিজেকে সময় দিয়ে নিজের ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধ করতে পারতেন। তার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো তাই করত; কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি নিজের সেই সোনালি সময়টাতে ব্যস্ত ছিলেন আমাকে নিয়ে। বলা চলে তিনি নিজের ক্যারিয়ারটা আমার জন্য উৎসর্গ করেছেন। আর এ জন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ বললেও কম বলা হয়ে যাবে। আমার ক্যারিয়ারে তার এই অবদানের কথা বলতে গেলে কৃতজ্ঞতা শব্দটির চেয়েও বড় কোনো শব্দ থাকা উচিত। দু’জনের কথা শুনে বোঝা যায় পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কোনো কমতি নেই তাদের মাঝে। তারা দু’জন মিলে যেন একটি সত্তা। 

দুটি মন আজ নেই দু’জনার 

কনকচাঁপা ও মইনুল ইসলাম খানের ভালোবাসার বন্ধন দেখে মনে পড়ে যায় সেই গানটির প্রথম লাইন। ‘দুটি মন আজ নেই দু’জনার’। কনকচাঁপা ও মইনুল ইসলাম খানও যেন ঠিক তাই। তাদের দুটি মন যেন আর দু’জনার নেই। দুটি মন মিলে হয়েছে একটি মন। আর তাইতো একে অপরের কোনো বিশেষ গুণকে তাদের সবচেয়ে প্রিয় মনে হওয়ার বদলে একে অন্যের সবকিছুই তাদের সবচেয়ে ভালো লাগে। বিষয়টি প্রথমে বুঝতে পারি মইনুল ইসলাম খানের কথায়। তার কাছে প্রথমে জানতে চেয়েছিলাম সহধর্মিণী কনকচাঁপার কোন গুণটি তার সবচেয়ে ভালো লাগে। প্রশ্নটি শুনে রাশভারী মানুষটি কেমন যেন নরম হয়ে গেলেন! আস্তে আস্তে জানালেন কোন গুণের কথা বলবেন তিনি? কনকচাঁপার সব গুণই যে তার সমান প্রিয়, সবকিছুই তার অতি পছন্দের। বুঝতে পারি মইনুল ইসলামের কাছে হাজার ফুলের মাঝে একটি গোলাপ হলেন কনকচাঁপা। যে গোলাপের সব পাপড়িই তার সর্বাধিক প্রিয়। এর মাঝে আলাদা করে কোনোটা বেছে নিতে পারেন না তিনি। তিনি অবাক হয়ে যান বিচিত্র গুণাবলি বিশিষ্ট তাঁর এই ভালোবাসার মানুষটির কথা ভেবে। কী অসাধারণ কণ্ঠে গান করেন তিনি! যে কণ্ঠে পাতা আছে সুরের মায়াজাল। আর সেই জালে বন্দি সারা বাংলাদেশ। ওই মানুষটিই আবার কি দারুণ লিখেন! নিয়মিত লেখালেখির কারণে সোশ্যাল মিডিয়াতেও তার একটি ভক্ত গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। এই গুণও তাকে অবাক করে। তবে এখানেই গুণের শেষ নয়। তার প্রিয় সহধর্মিণী অসাধারণ ছবিও আঁকেন। আবার রাঁধুনিও পাকা। এক হাতে আচার থেকে শুরু সকল পদের খাবার রান্না করতে পটু এই কণ্ঠশিল্পী। এসব কিছু মইনুল ইসলামকে অবাক করে, মুগ্ধ করে। এবার জানতে চাই কনকচাঁপার অজস্র জনপ্রিয় গান দখল করে আছে এদেশের শহর নগর গ্রাম ও গ্রামের আলপথ। এদেশের সংগীত অনুরাগী মানুষের মনে ও মননে বাসা বেধেছে গানগুলো। একেকজনের কাছে একেক গান প্রিয়। তবে মইনুল ইসলাম খানের কাছে কনকচাঁপার কোন গানটি সবচেয়ে বেশি প্রিয়? গুণের মতো গান থেকেও আলাদা করে কোনো গান বেছে নিতে পারেন না তিনি। কেননা স্ত্রীর গাওয়া প্রতিটি গানই যে ভীষণ মুগ্ধ করে তাকে। 

তার প্রিয় গানের তালিকায় রাজত্ব করছে কনকচাঁপার গাওয়া সমস্ত গানই। একই প্রশ্নের একই উত্তর আসে শিল্পীর কাছ থেকেও। কনকচাঁপার ভাষ্যমতে, জীবনসঙ্গী মইনুল ইসলাম খান একজন সুরস্রষ্টা। গানের কথার পরতে পরতে সুর ঢেলে দিয়ে গানকে জীবন্ত করে তোলেন তিনি। এই সুরস্রষ্টার সুরেই প্রথম ডানা মেলেছিল তার কণ্ঠ। জানতে চেয়েছিলাম স্বামীর সুর করা কোন গান তার সবচেয়ে পছন্দের। মইনুল ইসলাম খানের মতো কনকচাঁপাও একবাক্যে বলে দেন, মইনুলের সুর করা সব গানই আমার ভীষণ প্রিয়। 

মইনুল ইসলাম খান যেমন স্ত্রীর কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ, তেমনই কনকচাঁপাও স্বামীর সুরের জাদুতে মুগ্ধ। এই মুগ্ধতার আরেকটি কারণ হলো মইনুল ইসলাম খানের সুর করা সব গানেরই জন্ম হয় কনকচাঁপার ঘরে। তাই জন্মলগ্ন থেকেই এই গানগুলোর সঙ্গে কনকচাঁপার সখ্য গড়ে ওঠে ভীষণভাবে। এ কারণে গানগুলোর প্রতি ভালো লাগাটা এতই গভীর যে, তার সুরারোপিত যে গানগুলো কনকচাঁপা নিজে গেয়েছেন সেগুলোই শুধু নয়, মইনুল ইসলাম সুরারোপিত যে গানগুলো অন্যরা গেয়েছেন সেগুলোও তার সমান পছন্দের। সেই ভালোবাসা থেকেই স্বামীর সুর করা গানগুলোর একটি আর্কাইভ করেছেন জনপ্রিয় এই কণ্ঠশিল্পী। 

নিজের চেয়েও বেশি মনযোগী স্ত্রীর প্রতি

কনকচাঁপার সব গান এর প্রথম ও প্রধান সমালোচক মইনুল ইসলাম খান। তার ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এ যাবত যত গান গেয়েছেন তার সবগুলো গানই কণ্ঠে তোলার সময় যে মানুষটির অনুপস্থিতি কখনোই ছিল না, তিনি মইনুল ইসলাম খান। এসব গানগুলোতে কণ্ঠ দেওয়ার সময় সংগীত পরিচালক ও সংশ্লিষ্টরা যতটা না গায়িকার গায়কী খেয়াল করতেন, তার চেয়ে বেশি নজর রাখতেন মইনুল ইসলাম। কনকচাঁপার গাওয়া কোথায় ভালো হলো, কোথায় খারাপ হলো আর কোথায় আরও ভালো হতে পারত, এ সবই অক্ষরে অক্ষরে মনে রাখেন তিনি। আর গান গেয়ে ফেরার সময় মইনুল ইসলাম সেগুলোই বারবার মনে করিয়ে দেন তাঁকে। তবে শুধু মনে করিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হন না। কনকচাঁপার মতে, এমন অনেক দিন গেছে- গান গেয়ে ফেরার সময় রাশভারী মানুষটার বকা খেতে খেতেই তাকে বাসায় ফিরতে হয়েছে। কথাগুলো বলার সময় কনকচাঁপার কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারি এই বকার নেপথ্য রহস্য। তাঁর জীবনসঙ্গী চান সবসময়ই ভালো গান উপহার দিক এই গায়িকা। কেননা তিনি বিশ্বাস করেন যে কণ্ঠের জাদুতে গোটা দেশটাই বুঁদ হয়ে আছে, সেই কণ্ঠ চাইলেই আরও ভালো গাইতে পারে। সে কারণেই কোথাও অনিচ্ছাকৃতভাবে গাওয়াটা ঠিকমতো না হলেই মনক্ষুণ্ণ হন তিনি। এ যেন মধুর ভালোবাসা! এই ভালোবাসাই বলে দেয় মইনুল ইসলাম খান নিজের চেয়েও বেশি মনযোগী প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রতি, নিজের চেয়েও বেশি যত্নশীল প্রিয় জীবন সঙ্গীনির প্রতি। আর সে কারণেই একটু ভুলে এতটা উতলা হয়ে যান তিনি। 

মান অভিমান রাগ সামলানোর একমাত্র জায়গা 

কনকচাঁপার হাসিমাখা মিষ্টি মুখ দেখে পৃথিবীর কেউই বিশ্বাস করবেন না এই মানুষটি রাগতে জানেন। তবে কেউ বিশ্বাস না করলেও কনকচাঁপা জানান, তাঁর নাকি ভীষণ রাগ। তবে তার চেয়েও বেশি অভিমান। হুম, ভীষণ অভিমানী কনকচাঁপা। তবে তাঁর এই রাগ অভিমান সবই সামাল দিতে হয় ওই একজন মানুষকেই। তিনি আর কেউ নন। বিয়ের সময় বাবা-মা যার হাতে সঁপে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন আগলে রাখতে- সেই মইনুল ইসলাম খানই সামাল দেন তাঁর রাগ-অভিমান হাসি-কান্না সব। সে রাগ যার সঙ্গেই হোক। একসঙ্গে পথচলার দীর্ঘ তিন যুগ পেরিয়ে গেলেও আজও কনকচাঁপা তাঁর কাছে সেদিনের সেই ছোট্ট কনকটিই যেন আছেন। একসঙ্গে পথ চলায় মনোমালিন্য ঝগড়াঝাঁটি হবে এটাই স্বাভাবিক। বরং না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতা আছে কনকচাঁপা ও মইনুল ইসলাম খানের সম্পর্কেও। তাঁদের মধ্যেও মনোমালিন্য হয়, হয় ঝগড়াঝাঁটি। তবে তা কখনোই ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছায় না, তেমনই থাকে না রাগ ভাঙানোর কোনো মেকি আদিখ্যেতা। মইনুল ইসলাম জানান, ঝগড়াঝাঁটি হলে দেখা যায় একবেলা কথা হলো না; কিন্তু পরের বেলাতেই আবার সব ঠিকঠাক। মিলে যায় দুটি মন। আগের মতোই, মিশে যান একাকার হয়ে। 

প্রিয় বেলীফুল ও মান অভিমান 

সংগীতশিল্পী কনকচাঁপা গান গেয়ে সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মন জয় করেছেন আপন কণ্ঠশক্তিতে। আর তাঁর মন জয় করেছে বেলীফুল। জনপ্রিয় এই গায়িকার প্রিয় ফুল বেলী। ফুল পেলে তিনি খুব খুশি হন। আর তা যদি হয় বেলীফুল তাহলেতো আর কোনো কথাই নেই। তবে এই বেলীফুল যার থেকে পেলে তিনি সবেচেয়ে খুশি হতেন, সেই মইনুল ইসলাম খানের কাছ থেকেই কখনো তিনি এই ফুলটি পান না। একটা সময় বয়স যখন কম ছিল, সংসারে নতুন ছিলেন, তখন এ নিয়ে বেশ অভিমান হতো। সেই অভিমানে অশ্রুও গড়াতো দু’চোখ দিয়ে। তবে এখন আর তা হয় না। অভিমানও হয় না এ জন্য। কেননা তিনি বুঝতে পেরেছেন এই মানুষটা আর দশটা মানুষের মতো না। মেকি ভালোবাসা কিংবা ফুল দিয়ে আমি তোমাকে ভালোবাসি বলে আদিখ্যেতা করে ভালোবাসা প্রকাশ করার মাঝে কিছু খুঁজে পান না তিনি। এরকম আরও অনেক কিছুইতে অমিল রয়েছে প্রেমের তাজমহলে বসবাসরত এই দুটি মানুষের। কনকচাঁপা প্রকৃতিপ্রেমী। সারা দিন ফুল-পাখি ও গাছ গাছালির সান্নিধ্য পেতে ভালোবাসেন। আর মইনুল ইসলাম খানের এসব স্বভাব বিরুদ্ধ। ফুল-পাখি-গাছ নিয়ে মেতে থাকা হয়ে ওঠে না তাঁর; কিন্তু তাই বলে প্রিয় স্ত্রীর ভালোলাগায় রুষ্ট বা বিরক্ত নন তিনি। বরং স্ত্রীর প্রকৃতি নিয়ে মেতে থাকায় যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সেদিকে রয়েছে মনোযোগী নজর। কনকচাঁপা যেন নির্বিঘ্নে এসব নিয়ে সময় কাটাতে পারেন তার সর্বোচ্চ সাহায্য করে যান তিনি। 

অভিভাবক ও পরামর্শক

আজকাল অনেকেই ভেবে থাকেন স্বামী মানেই ইয়ার দোস্ত বা শুধুই লাইফ পার্টনার। তবে কনকচাঁপা ভাবেন অন্যরকম। তাঁর কাছে স্বামী মানে অভিভাবক, নির্দেশক, পরামর্শক। হ্যাঁ, সংসার এবং শিল্পী জীবনের শুরু থেকেই মইনুল ইসলাম খান যেমন তাঁর অভিভাবক এবং নির্দেশক হিসেবে ছিলেন এখনো তেমনই আছেন। আজ কনকচাঁপার যে আকাশচুম্বী সাফল্যমণ্ডিত ক্যারিয়ার, তার পুরোটার কৃতিত্বই মইনুল ইসলাম খানকে অবলীলায় দিয়ে থাকেন তিনি। মইনুলের সুরারোপিত গান কণ্ঠে তোলার মাধ্যমে সংগীতাঙ্গনে পা রাখা কনকচাঁপা পরবর্তীতে কাজ করেছেন আলাউদ্দিন আলী, আলম খান, আতাউর রহমানের মতো বাঘা বাঘা সংগীত পরিচালকদের সঙ্গে। এরপরে তাঁর ক্যারিয়ারে যোগ হন আরেক কিংবদন্তি সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কাজের পরিমাণ এতটাই বেড়ে যায় যে, নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় ছিল না এমন অবস্থা। তবে এত ব্যস্ত ক্যারিয়ারেও জীবনসঙ্গী মইনুল ইসলাম খানের সবুজ সংকেত না পাওয়া পর্যন্ত এক পাও ফেলেননি এই গুণী কণ্ঠশিল্পী। কনকচাঁপার জন্য তৈরি গানগুলোকে তাঁর কণ্ঠে ডানা মেলার আগে হাজির হতে হতো মইনুল ইসলাম খানের কাছে। তিনি সবুজ সংকেত দিলে তবেই গানগুলো কণ্ঠে তুলতেন কনকচাঁপা। এ জন্য আলাউদ্দিন আলী, আলম খানদের মতো বাঘা বাঘা সংগীত পরিচালকরাও কনকচাঁপার জন্য গান তৈরি করে মইনুল ইসলামকে শুনিয়ে নিতেন। তিনি সায় দিলে তবেই কনকচাঁপা গানগুলো আদর করে কণ্ঠে তুলে নিতেন। 

অধিকাংশ কণ্ঠশিল্পীরই প্রধান ও প্রথম ভালোলাগার জায়গা মঞ্চ। কনকচাঁপাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। আর এদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীদের গান পরিবেশনের আরেকটি বড় মঞ্চ হচ্ছে দেশের বাইরে বসবাসরত বাঙালিদের আমন্ত্রণে বিদেশের মাটিতে বাংলা গান পরিবেশন। কনকচাঁপা যখন সংগীতাঙ্গনে জনপ্রিয়তার আকাশে ডানা মেলেছেন, তখন থেকেই নিয়মিত প্রবাসীদের আমন্ত্রণ কড়া নাড়ছিল তার দুয়ারে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে দীর্ঘদিন এই গুণী শিল্পী প্রবাসীদের এই আমন্ত্রণে সাড়া দেননি। এর পেছনেও রয়েছে সেই নেপথ্য কারিগর মইনুল ইসলাম খানের পরামর্শ। 

কনকচাঁপা যখন জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, সেই আশির দশকে মেয়েদের একলা চলার পথ এতটা সুগম ছিল না। আর রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ের জন্যতো আরও না। আর তাই বিদেশের মাটিতে স্ত্রীকে একা ছাড়তে মন সায় দিত না মইনুল ইসলামের; কিন্তু প্রবাসীরা শিল্পীর সঙ্গে অভিভাবককে নিতে অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে ছিলেন নারাজ। তাই বিদেশের মাটিতে এত লোভনীয় আমন্ত্রণগুলো রক্ষা করা হতো না কনকচাঁপার। কেননা যে ক্যারিয়ারে তাঁর ছায়া ও অভিভাবক হিসেবে পরিচিত মইনুল ইসলাম খান, তাঁকে ছাড়া একাকী বিদেশ বিভূঁইয়ে গান শোনাতে কনকচাঁপারও মন সায় দেয়নি। সে কারণেই প্রবাসীদের ভালোবাসা মাখা আমন্ত্রণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন তিনি। তবে এ মুখ ফিরিয়ে নেয়া স্বামীর বাধায় ছিল না। কেননা মইনুল ইসলাম কনকচাঁপাকে একা যেতে কখনোই বাঁধা দেননি। তবে বলেছিলেন, ধৈর্য ধারণ করতে। বলেছিলেন আজ যারা কনকচাঁপার সঙ্গে কাউকে বিদেশ বিভুঁইয়ে নিয়ে যেতে নারাজ, সেই তাঁরাই একসময় শুধু একজন নয় কনকচাঁপার পরিবারের সবাইকে সাদরে নিয়ে যাবে গান শুনতে। কনকচাঁপা স্বামীর এই পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন সম্মানের সঙ্গে, ধরেছিলেন ধৈর্য। হয়েছেও তাই। কনকচাঁপার এখন বিদেশ ভ্রমণ নিত্ত নৈমিত্তিক ঘটনা যেন! আর এখন তিনি বিদেশে গান শোনাতে যাওয়ার সময় সঙ্গে যান তাঁর প্রিয় অভিভাবক ও নির্দেশক মইনুল ইসলাম এবং কখনো-সখনো সঙ্গে যায় গোটা পরিবার। 

কনকচাঁপাকে নিয়ে যত চিন্তা মইনুল ইসলাম খানের

নিজেকে কণ্ঠশ্রমিক দাবিদার জননন্দিত কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপার সংগীতের ক্যারিয়ার যতটা দীর্ঘ, ঠিক ততটাই উজ্জ্বল। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গুণী এই শিল্পী অডিও ও সিনেমার তিন হাজারের অধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তবে এর সবটাই সামলেছেন তার স্বামী মইনুল ইসলাম খান। কনকচাঁপা কখন কোন গানে কণ্ঠ দেবেন, সে গানে কণ্ঠ দিতে তাকে কোথায় যেতে হবে, গানের কথা কী, সুর কেমন- এর সবটাই দেখেছেন মইনুল ইসলাম খান নিজে। কনকচাঁপা শুধু কণ্ঠ দিয়ে গেছেন। এভাবেই কেটে গেছে দীর্ঘ তিন যুগ। আজও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এখনো স্ত্রী কি করছেন না করছেন তা নিয়ে ভাবনা সব মইনুল ইসলামের। আজকাল মাঝে মাঝেই কনকচাঁপার লেখালেখি নিয়ে চিন্তা হয় মইনুল ইসলামের। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিয়মিত সরব সমসাময়িক ইস্যু এবং সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে। মাঝে মাঝেই এসবের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর জোরালো মত প্রকাশ করে থাকেন। আর এতে করে যেন স্ত্রীকে কোনো প্রতিশোধ পরায়ণ গোষ্ঠীর আক্রোশের স্বীকার হতে না হয় তা নিয়ে সদা সতর্ক থাকেন। মাঝে মাঝেই তিনি সতর্ক করে থাকেন স্ত্রীকে। 

আজও সেভাবেই আছেন 

কনকচাঁপা কোন গান গাইবেন, কোন অনুষ্ঠানে যাবেন তার সব ঠিক করেন মইনুল ইসলাম খান। আর এ জন্যই মইনুল ইসলাম খান নামক এই মানুষটির ওপর রুষ্ট ছিলেন সংগীতাঙ্গনের বোদ্ধাসহ অনেকেই। এ নিয়ে তাদের ছিল বেশ গোস্বা। সামনা-সামনি কিছু না বললেও আড়ালে আবডালে যে কথাটি কানাঘুষা করে বেড়াতেন তা হলো, এই লোকটির জন্যই এই মেয়েটির কিছু হবে না; কিন্তু নিন্দুকের মুখে ছাই পড়েছে। এই লোকটির পাশে থেকেই কনকচাঁপার ক্যারিয়ার সমৃদ্ধশালী হয়েছে, তিনি পৌঁছেছেন সাফল্যের শিখরে। 

যারে এক জনমে ভালোবেসে ভরবে নাতো মন

মইনুল ইসলাম খানের প্রতি ভালো লাগাটা অনেক আগে জন্মালেও কনকচাঁপা তখনো উপলব্ধি করতে পারেননি সেই ভালোবাসার পরিধিটা কত। তবে আজকাল উপলব্ধি করতে পারেন এই ভালোবাসার পরিধিটা আকাশের মতো সীমাহীন। যার কোনো শেষ নেই। দিন দিন বেড়েই চলেছে পুনঃপুনিক হারে। যাকে ভালোবেসে মন কখনোই ভরবে না। তবে মন না ভরলেও কনকচাঁপা ও মইনুল ইসলাম খানের ভালোবাসার ফসলে ভরে গিয়েছে তাঁদের ঘর দুয়ার। আর এই ভালোবাসার ফসল হচ্ছে তাঁদের ছেলে-মেয়ে, ছেলের বৌ, মেয়েজামাই ও তাদের সন্তান সন্ততি। ব্যস্ততার মাঝে অবসর যেন সবারই প্রাণের চাওয়া। কনকচাঁপা ও মইনুল ইসলাম খানও তার ব্যতিক্রম না। আর আজকাল তাঁদের এই অবসরে যেন চাঁদের হাট বসে। আর সেই চাঁদের হাটে তাঁদের সময় কাটে ভালোবাসার ফসলগুলো নিয়ে। ছেলে, ছেলের বৌ, মেয়ে, মেয়েজামাই ও চার নাতি-নাতনি নিয়ে। তাদের সঙ্গে হাসি আনন্দেই রঙিন হয়ে ওঠে এই শিল্পী দম্পতির অবসর মুহূর্তগুলো। 

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh