পাভেল পার্থ
প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০:৩৪ এএম | আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৩:০৪ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সালে শেষে হওয়া ভাষাগত জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের ৪০টি মাতৃভাষা আছে। এর মধ্যে আছে- কন্দ, খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং এই ১৪টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মাতৃভাষা বিপন্ন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট হদিস পেলেও রাষ্ট্রীয় দলিলে ‘কোডা’ ও ‘সৌরা’ ভাষীরা নথিভুক্ত হননি। কোডাভাষী কডা জনগোষ্ঠী রাজশাহীর পুঠিয়া, মোহনপুর, পবা ও তানোরে বসবাস করেন। তাঁদের জনসংখ্যা হাজারের কাছাকাছি। আর সৌরাভাষী সৌরা জনগোষ্ঠী মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জে বসবাস করছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে নিজেদের ভীম পরিচয়দানকারী এদের জনসংখ্যা প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি। কডা ও সৌরাদের মতো এমন অনেক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এখনো রাষ্ট্রীয় দলিলে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। তাহলে দেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা জাতির সংখ্যা প্রশ্নে আমরা কোন নথিকে বিবেচনা করব?
‘মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভাষা জরিপ’ নাকি ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০’ এর তফশিল? উল্লিখিত আইনের ২ (১) এবং ধারা ১৯ এ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গা, বম, পাংখোয়া, চাক, খিয়াং, খুমি, লুসাই, কোচ, সাঁওতাল, ডালু, উসাই (উসুই), রাখাইন, মণিপুরী, গারো, হাজং, খাসিয়া, মং, ওরাও, বর্মণ, পাহাড়ি, মালপাহাড়ি, কোল ও বর্মণ নামে মোট ২৭ জনগোষ্ঠীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে কুর্মি মাহাতো, কন্দ, গঞ্জু, গড়াইত, মালো, তুরি, তেলী, পাত্র, বানাই, বাগদী, বেদিয়া, বড়াইক, ভূমিজ, মুসহর, মাহালী, রাজোয়ার, লোহার, শবর, হদি, হো ও কড়া এই ২১ ক্ষুদ্র জাতিসত্তা জাতির নাম ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০’ এ অন্তর্ভুক্তি হয়।
যাই হোক দেশের প্রান্তিক জাতিসমূহ কোথাও নথিভুক্ত হোক বা না হোক তাদের মাতৃভাষা আজ ক্ষয়িষ্ণু। এ সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বিশেষ করে প্রবীণরা এবং কিছু গোষ্ঠীর লোকজন পরিবার ও গ্রামে নিজেদের ভেতর মাতৃভাষায় মৌখিক যোগাযোগ করলেও, সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা ও বিকাশে মাতৃভাষাসমূহ জোরালোভাবে ব্যবহৃত হতে পারছে না। ভাষা বিকাশ ও সুরক্ষার এক মৌলিক মাধ্যম হলো মাতৃভাষায় সৃজনশীল, মননশীল সাহিত্য রচনা ও চর্চা। হতে পারে তা মৌখিক ও লিখিতভাবে। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সব সমাজেই সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সৃজনশীল সংস্কৃতির প্রাচুর্য থাকলেও, নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা সাহিত্যরচনায় নিজ নিজ মাতৃভাষা ও বর্ণমালা খুব একটা ব্যবহার করছে না। অথচ ২০১৯ সনে জাতিসংঘ ২০২২ থেকে ২০৩২ সময়কালকে ‘আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ভাষা দশক’ ঘোষণা করেছে। পৃথিবীর বিলুপ্তপ্রায়, বিপণ্ণ ভাষাসমূহের সুরক্ষা ও বিকাশের জন্য এই দশকটি কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে।
সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ১৯৯৪ সনে প্রকাশিত তাঁর ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও সংস্কৃতি’ বইতে লিখেছেন, ‘...চাকমা ও বাংলা হরফে লেখা তাত্ত্বিক শাস্ত্র, শাঙেচ ফুলু তারা, ত্রিপুদুরা, মালমতারা, ৫১টি চাকমা ছড়া, আঘরতারা, পুদুম ফুলু তারা, কদম ফুলু তারা, বুদ্ধ ফুলু তারা, সাঙচ ফুলু তারা, রাকেম ফুলু তারা, ছোট কুরুক তারা, বুদ্ধ ফুলু তারা, সাভাদিঝা তারা, জয়মঙ্গল তারা, আনিজা তারা, সানেকফুলু তারা, সামেং ফুলু তারা, উদাংপারেত তারা ও ঝারাসহ আরও বেশ কিছু বইয়ের পান্ডুলিপি রাঙ্গামাটিস্থ উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে সংরক্ষিত রয়েছে; কিন্তু চাঙমা, ককবরক, মারমা ভাষা বাদে পার্বত্য চট্টগ্রামের অপরাপর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সাহিত্য বিষয়ে খুব একটা বিবরণ বা মুদ্রিত কী লিখিত দলিল পাওয়া যায় না।
মারমাদের সাহিত্য বিষয়ে আলোচনায় (২০০৩) বলেছেন, ‘...পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত মারমারা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের দিক দিয়ে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় সমৃদ্ধ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের বর্তমান সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নাম তাজিনডং। এটি বান্দরবান জেলায় অবস্থিত। তাজিনডং একটি মারমা ভাষার শব্দের বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘গহীন অরণ্যের পাহাড়’; কিন্তু এই তাজিংডং শব্দটি তৎকালীন সরকার পরিবর্তন করে রাখেন বিজয়। আমার খুব খারাপ লেগেছিল, আমি চিন্তা করে পাই না মারমা ভাষার শব্দটি থাকলে কি হতে পারতো? বাংলাদেশের মানুষ ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন করেছিল। আর এই দেশেই নাকি তাজিনডং নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বিজয়। তাহলে কোথায় মারমা ভাষার স্বীকৃতি?’
পাংখোয়াদের মাঝে প্রচলিত রয়েছে- বিভিন্ন ধরনের রূপকথা, কিংবদন্তি, কিসসা, ছড়া, কবিতা, প্রবাদ, প্রবচন ইত্যাদি। এসব লোকসাহিত্যে তাদের অরণ্যচারী জীবনব্যবস্থা, জুমচাষ, শিকারজীবী সভ্যতা ইত্যাদির বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছে। পাংখোয়াদের ভাষায় প্রবাদ প্রবচনকে থৌংপিং, ধাঁধাকে সিং ইনতেন বা সিং মেথ্রেং বলে। তুইচং ও সুয়ানলু সুয়ানলা পাংখোয়াদের ঐতিহ্যময় লোককাহিনী। পাংখোয়া শিশুরা মুরগির বাচ্চাকে নিয়ে আদর করে ‘মুরগির বাচ্চার জন্যও ঘুমপাড়ানি গানের’ একটি খেলা করে। সেখানে বলে, ... আর তে উই লা/আর তে এই মু-মুদ/না-নু চাং চেল এক থাই কাল কাল না-পা-সা-বি/মে ফুর কাল কাল ইন চুং আন রামো আম, ইনথ খুয়াই আন/সা ঙার আম, নাং চিত, কেই চিত, আ-ই-ই’। এর বাংলা মানে হলো, ...মুরগির বাচ্চা ঘুমাও ঘুমাও/তোমার মা কেঁচোর গু আঁচড়াতে গেছে/তোমার বাবা হরিণের মাংস আনতে গেছে/তোমার ঘরের ওপর চিল, নিচে বনবিড়াল/তোমার ভয়, আমার ভয় আ ই ই’। বমদের কিছু ছড়া ও লোককাহিনী মুদ্রিত হয়েছে।
বান্দরবানে বসবাসরত চাকদের ভেতর কেউ মারা গেলে স্বজন প্রতিবেশীদের কমাঙ চিকহ্রান নামের একধরনের শোকগীতি গাওয়ার রেওয়াজ ছিল এক সময়। এ সব গানের ভেতর দিয়ে আত্মাকে আবার নিজ রক্ত বংশে জন্মের আহ্বান ও অনুরোধ জানানো হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা বাদে অপরাপর জাতিসত্তার মাতৃভাষায় মৌখিক সাহিত্যচর্চার চল থাকলে লিখিত বা মুদ্রিত দলিল কম। আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের ভাষায় লেখালেখি হলেও, নিজস্ব হরফে কম সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত। ২০০৪ সনে প্রথম দেবাশীষ চাকমার ফেবো উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে চাঙমা হরফ ও ভাষায়। এ ছাড়া ক্রামাদি ধর্মের প্রবক্তা মেনলে ম্রার মাধ্যমে ম্রো বর্ণমালা উদ্ভাবন এবং কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীতে ম্রো ভাষায় ইয়াঙান ম্রো ম্রো রূপকথাসহ বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন।
জয়সেন তঞ্চঙ্গ্যা (২০০৩) জানান, বিষুকে ঘিরে তঞ্চঙ্গ্যাদের রয়েছে সাহিত্য কর্মের বিশাল ভাণ্ডার। বিষুকে নিয়ে অনেকে লিখেছেন কবিতা, ছড়া, গান, গল্প, প্রবন্ধ আরও কত কি; কিন্তু নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালায় সাহিত্য চর্চার প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করতে গিয়ে কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা (২০০৩) একটি লেখায় জানান, তঞ্চঙ্গ্যাদের নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা থাকা সত্ত্বেও নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা কালের চর্চার অভাবে তারা বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করছেন। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা সাহিত্যকর্ম সংগ্রহ, সংবেদনশীলতার সঙ্গে নথিভুক্তকরণ, প্রকাশ এবং প্রচারণায় এখনো অবধি রাষ্ট্র এবং মূলধারার সক্রিয় তৎপরতা কম। ক্ষুদ্র জাতিসত্তারা নিজেরাই যতটুকু পারছেন মাতৃভাষার চর্চাকে প্রকাশ করেছেন।
সিলেটের ভারারহাট গ্রামে ১৯৬৩ সনে জন্মগ্রহণ করেন কবি জুলেন পাত্র। দিনমজুরি করে এবং গরু বিক্রির টাকায় ৩২টি গান কম্পোজ করে ফটোকপি করে বই প্রকশ করেন। লালেং ভাষায় এবং বাংলা হরফে লেখা এই গানগুলো বিভিন্ন পরবে গাওয়া হতো। জুলেন পাত্রের লেখা একটি গান এমন, ‘...নিকাং আরা রানি জনেক য়াংরা তুরলো/নিকাং তুরলো পচিম আবার পলংল/রানি জনেক কামল চইনকা/মাইরা পাল বাংফারাংকা’। উজ্জ্বল মাহাতো কুড়মালি ভাষায় বাংলাদেশে প্রথম ‘কারাম’ নামে একটি উপন্যাস লেখেন। সেই বই প্রকাশ করা নিয়ে খুব বেগ পেতে হয়েছিল তাকে। ২০১৩ সনে পাবনার রূপম প্রকাশনী থেকে পরে বইটি প্রকাশিত হয়।
‘বাংলাদেশের রাজবংশী সমাজ ও সংস্কৃতি’ শীর্ষক বইতে রাজবংশীদের ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অশোক বিশ্বাস (২০০৫) লিখেছেন, রাজবংশী সংগীতের মধ্যে রয়েছে জাগরনি ভাওয়াইয়া, জাগ, গাজন, হুদুমাগান প্রভৃতি। রাজবংশী সমাজে ছেলে ভুলানো ছড়া, খেলার ছড়া, পারিবারিক-সামাজিক, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছড়া, ঐন্দ্রজালিক-আচার অনুষ্ঠানমূলক ছড়া, ব্যঙ্গ বিদ্রুপাত্মক ছড়া প্রভৃতির প্রচলন রয়েছে; কিন্তু দুঃখজনকভাবে এসব সাহিত্যকর্মের কোনো মুদ্রিত দলিল নেই।
রাজশাহীর কডা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে চলমান এক গ্রামভিত্তিক গবেষণায় জেনেছি, মৌখিকভাবে কিছুটা প্রচলন থাকলেও, এখনো কডা ভাষায় কোনো সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয়নি। আলাপ হয়েছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের রাজঘাটের পরিমল ভীম, দীলিপ সৌরা ও মিন্টু সৌরার সঙ্গে। ভারত থেকে প্রকাশিত সৌরা জনগোষ্ঠীর সৌরা ভাষার বর্ণমালার একটি বই তাদের কয়েকজনের কাছে থাকলেও, চাবাগান থেকে তাদের কারও সাহিত্যকর্ম এখনো প্রকাশিত হয়নি।
আমরা যখন মাতৃভাষার অধিকার ও সুরক্ষার কথা বলি, তখন দেশের প্রান্তিক ভাষাগুলোর চর্চাকারীদের পাশে রাষ্ট্র ও মূলধারার তৎপরতা কীভাবে দাঁড়াচ্ছে, সেটি এক প্রধান বিবেচ্য বিষয়। কারণ দেশের প্রকাশনা শিল্প কী রাষ্ট্রীয় শিল্পসাহিত্য প্রতিষ্ঠান যদি এসব জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার চর্চা ও সাহিত্যকর্মকে উৎসাহিত ও প্রণোদিত না করে, তবে এ সব ভাষা কেবল ঘরবন্দি কিছু মানুষের মুখের ভাষায় সীমাবদ্ধ হতে হতে একসময় এর বিবর্তনমূলক টিকে থাকার সম্ভাবনাকে হারিয়ে ফেলবে।