কমিউনিটি ট্যুরিজম
উসিথোয়াই মারমা, বান্দরবান
প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২২, ০৯:৫৮ এএম | আপডেট: ০২ মার্চ ২০২২, ১০:০১ এএম
ছবি: সংগৃহীত
সবুজ বনভূমি, ঢেউ খেলানো মেঘ-পাহাড় এবং প্রাণবৈচিত্র্য সম্ভার নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি, ভিন্নরকম জীবনধারা ও নানারকম খাদ্যাভাস মিলে ছড়িয়ে রয়েছে জাতিগতবৈচিত্র্য। রয়েছে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়ি ঝিরি ঝরণাও। এখানে দেখা মেলবে মেঘে ঢাকা পাহাড়ের ওপর পাহাড়। যেখানে বারবার ছুটে আসেন ভ্রমণপ্রিয় পর্যটকরা।
বর্ষাকাল ছাড়া বছরের অধিকাংশ সময় পর্যটকের আগমনে মুখর হয়ে থাকে পার্বত্য জেলা বান্দরবান। পর্যটকরা জেলা শহরে সাজানো পর্যটন কেন্দ্র বাদ দিয়ে এখন ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন নানা জাতিগোষ্ঠীর পাড়া বা এলাকায়।
বান্দরবানের রুমা উপজেলার বম জনগোষ্ঠীর এলাকা দার্জিলিংপাড়া পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তুলনামূলক কম মূল্যে থাকা খাওয়া যায় সেখানে। পর্যটকদের থাকার জন্য বাঁশ ও কাঠের তৈরি কটেজ ও ছোট ছোট টংঘর গড়ে তুলেছেন তারা। এসব পাড়ায় থাকলে একদিকে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। অন্যদিকে পাহাড়ে গ্রামীণ পরিবেশে প্রাণ-প্রকৃতিকে উপভোগ করার সুযোগ হয় তাদের।
রুমা উপজেলার দার্জিলিং বম পাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বেড়াতে এসেছেন পর্যটকরা। কেউ চাকরিজীবী দল আবার কোনো কোনো দল বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। বগালেক থেকে দার্জিলিং পাড়া পর্যন্ত কেউ এসেছেন ১৩ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে। কেউবা এসেছেন গাড়িতে করে।
ঢাকা থেকে আসা চার পরিবার মিলে পনের জনের একটা দলের সদস্য শফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দলের সবারই বান্দরবানে প্রথম আসা। তাও একেবারে দুর্গম এলাকার কেওক্রাডং পাহাড়ের মতো জায়গায়। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য ও পরিবেশ এত সুন্দর এবং বাংলাদেশে এরকম চমৎকার জায়গা আছে না আসলে কেউ বুঝবে না।
বেশির ভাগ পর্যটক শুধু আলোচিত ও জনপ্রিয় কতগুলো জায়গা চেনে ও সেখানে বেড়াতে যায়; কিন্তু পাহাড়ে আসলে আলাদা একটা অন্যরকম অনুভূতি পাওয়া যায় এটা অনেকেই জানে না। পাহাড়ে আসলেই বুঝা যায় সবকিছু মিলে আমাদের দেশটা কত সুন্দর।
একই দলের সদস্য ফারজানা ইসলাম বলেন, পাহাড় ও প্রকৃতি দেখার আগ্রহ থেকেই পরিবার নিয়ে তারা দার্জিলিং পাড়া ও কেওক্রাডং পাহাড়ে এসেছেন। হাঁটার অভ্যাস না থাকায় গাড়িতে করে আসা হয়েছে। ছেলে-মেয়েরাও পাহাড়ে এসে অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। তবে এত দুর্গম এলাকায় কম বয়সী ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আসা একটু ঝুঁকি হয়েছে বলে জানান তিনি।
যশোর থেকে আসা পেশায় চিকিৎসক হাসান নামে এক পর্যটক জানান, ছয়জনের এ দলটি এর আগে থানচির রেমাক্রি ও নাফাকুম জলপ্রপাতে ঘুরেছেন। এবার কেওক্রাডং পাহাড়ে এসে দার্জিলিং পাড়ার একটা কটেজে উঠেছেন। পাহাড় ভ্রমণে আসলে পাহাড়ি পরিবেশটাই ভাল লাগে। শহরে পরিবেশের মত চাকচিক্য থাকলে আকৃষ্ট হয় না। এ জন্য দ্বিতীয়বারের মতো ঘুরতে এসেও পাহাড়ে গ্রামীণ পরিবেশকে বেছে নিয়েছেন তারা।
এত দুর্গম এলাকায় এসে পরিচ্ছন্ন ও গোছানো পাহাড়ি গ্রাম তার আগে দেখার সুযোগ হয়নি। শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়। পরিচ্ছন্ন দিক দিয়ে সবার জন্য দার্জিলিং পাড়া একটা ভালো উদাহরণ বলে জানালেন দলের আরেক পর্যটক মোজাম্মেল হক।
মোজাম্মেল হক জানান, পাহাড় মানেই কত রকম সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং সুন্দর ঝিরি ঝরণা জানতাম; কিন্তু পাহাড়ের ভেতর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার পাড়াগুলোও এত সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন গোছানো হয় জানতাম না। পাড়াবাসীরা সচেতনতার সঙ্গে সবাই মিলে যেভাবে দিনের পর পরিচ্ছন্ন করে রেখেছে এটা সবাইকে অবাক করবে।
বগালেক থেকে ১৩ কিলোমিটার পথ হেঁটে এসেছেন জানিয়ে একই দলের আরেক পর্যটক ইস্রাফিল বলেন, পথে পথে হেঁটে এসে বোঝার চেষ্টা করেছি, স্থানীয় লোকজন কী রকম কষ্ট সহ্য করে এখানে টিকে আছে। বিশেষ করে নারীরা মাথায় বোঝা বহন করে পাহাড়কে পাহাড় হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য খুব অবাক করেছে সবাইকে।
তবে দার্জিলিং পাড়ায় বেড়াতে আসা পর্যটকেরা বলেছেন, সুর্যোদয় ও সুর্যাস্তের মুহূর্ত এ পাড়ার সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। ভোরে সুর্যোদয়ের দৃশ্য দেখার সুযোগ না হলে এখানে আসাই বৃথা হবে। কেওক্রাডং পাহাড় ভেদ করে যখন সূর্যোদয় হবে, তখন যেন পাহাড়ের আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।
বান্দরবান জেলা শহর থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরে রুমা উপজেলা। বেড়াতে আসা পর্যটকরা প্রথমে রুমা সদর থেকে খোলা জিপ অথবা ল্যান্ড ক্রুজারে করে বগালেক পর্যন্ত চলে যায়। তবে অভিযানপ্রিয় পর্যটকদের অনেকেই বগালেক থেকে কেওক্রাডং পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পায়ে হেঁটে রওনা দেয়। কেওক্রাডং পাহাড়ে পাদদেশেই রয়েছে দার্জিংলিং পাড়া। অধিকাংশ পর্যটক কেওক্রাডং পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে এই দার্জিলিং পাড়ার বিভিন্ন কটেজেই রাত যাপন করে থাকেন।
দার্জিলিং পাড়ার কারবারি সাকসিং বম জানান, ১৯৬৫ সালে স্থাপন করা এ পাড়ায় মোট ৩৫টি বম সম্প্রদায়ের পরিবার রয়েছে। পাড়ার প্রত্যেক পরিবার প্রতিদিন যার যার ঘরের আঙ্গিনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখার নিয়ম রয়েছে। কোনো ময়লা আবর্জনা যত্রতত্র পড়ে থাকার সুযোগ নেই। অপ্রয়োজনীয় কাগজ ও প্যাকেট ফেলার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ডাস্টবিন ও ঝুরি রয়েছে।
পাড়াকে সবসময় পরিচ্ছন্ন অবস্থায় রাখতে সবাইকে নিয়ে মাসে দু’বার করে সভা করা হয় বলে জানান তিনি।
দার্জিলিং পাড়ার ক্লাউড হিল রিসোর্ট অ্যান্ড এগ্রো কমপ্লেক্সের কর্ণধার জোভিয়াল বম মেঘলা বলেন, কেওক্রাডং পাহাড়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদের আবাসন সুবিধার জন্য দার্জিলিং পাড়ায় চার-পাঁচ জনের মত কটেজ ও ছোট টংঘর গড়ে তুলেছেন। সেখানে সব মিলে ৩০০ জন পর্যটকের থাকার সুবিধা রয়েছে।
তারমধ্যে তার কটেজ ও ছোট টংঘরে ১৫০ জনের মত পর্যটক থাকার সুযোগ রয়েছে। বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার এই তিন দিন পর্যটকের সমাগম ঘটে। এ ছাড়া ইংরেজি নববর্ষ ও ঈদের সময় আবাসনের সংকট পড়ে যায়। তখন খোলা মাঠে তাবু খাটিয়ে পর্যটকরা রাত কাটান।
লালরাম জো বম নামে কটেজের এক মালিক বলেন, পর্যটকদের কাছ থেকে কক্ষ হিসেবে নয়, মাথাপিছু প্রতি রাতে ২৫০ টাকা করে ভাড়া নেওয়া হয়। দোকানে বাংলা খাবারের পাশাপাশি অর্ডার করেও স্থানীয় বিভিন্ন রকমের খাবার রয়েছে। কোনো সময় একটানা তিন দিনের ছুটি থাকলে শুধু দার্জিলিং পাড়ায় একদিনে চার শতাধিক পর্যটকের আগমন ঘটে জানান রুমা পর্যটক গাইড সমিতির সহসভাপতি সাপুল বডুয়া।
রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন শিবলি জানান, স্থানীয়রা নিজেদের উদ্যোগেই সেখানকার ঐতিহ্য বজায় রেখে ছোট ছোট কটেজ গড়ে তুলেছে। বেড়াতে আসা পর্যটকদের এগুলো আকৃষ্ট করে। তাই সেখানকার প্রকৃতি ও পরিবেশের কারণে পর্যটকদের সমাগম ঘটে।