নারী, অধিকারের যুদ্ধ এবং সমতা

ফরিদা আখতার

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২২, ১০:৩৩ এএম

ফরিদা আখতার

ফরিদা আখতার

আন্তর্জাতিক নারী দিবস নিয়ে যখন বিশ্বে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাবার্তা চলছে, তখন বাংলাদেশের নারীরা ধর্ষণ ও বিচারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। আমাদের জন্যে নারী দিবসের ভাবনা এখানেই এসে ঠেকে যায়। 

সর্বশেষ ঘটনা হচ্ছে, গোপালগঞ্জে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরপ্রবি) এক শিক্ষার্থীকে ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তারিখ রাত নয়টায় রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ ও তার সহপাঠীকে মারধোর করা হয়েছে। পত্রিকার খবরে জানা গেছে, ধর্ষণের শিকার ওই শিক্ষার্থী তার বন্ধুর সাথে গোপালগঞ্জ সদরের নবীনবাগ হেলিপ্যাডের সামনে থেকে হেঁটে মেসে যাচ্ছিলেন। পথে তাদের ৭/৮ জন মিলে গোপালগঞ্জ জেলা স্কুলের নির্মাণাধীন ভবনে নিয়ে যায় এবং শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে। 

স্বাভাবিকভাবেই এই খবর জানাজানি হবার পর প্রতিবাদ হচ্ছে এবং যারা প্রতিবাদ করছেন তারা প্রশ্ন তুলছেন বিচারহীনতার বিরুদ্ধে। আর কতো চলতে থাকবে এরকম? এই ধরণের ঘটনা তো নতুন নয় এবং সেটা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে অপরাধীদের বিচার না হওয়া। বেশি প্রতিবাদ হলে কিংবা ফেসবুক সরগরম হলে লোক দেখানো গ্রেফতার দেখানো হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো বিচার হয় না। উল্টো যে বিচার চায় তাকে ও তার পরিবারকে নানা ধরণের হুমকি দেয়া হয়। 

বশেমুরপ্রবির ঘটনার পাশাপাশি দেশের আরও অনেক জায়গায় নারীদের ওপর নানারকম নির্যাতন হচ্ছে। সব ঘটনার খবর আমাদের জানা থাকে না। কিন্তু এমন ঘটনা আমাদের ব্যথিত করে। 

জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের বিশেষ আয়োজন করে। নারীর সমধিকারের প্রশ্নটি মূখ্য রেখেও নানা বিষয়ে তারা প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে। আমাদের সরকারগুলো সেটাই মেনে তারাও দিবসটি উচ্চ পর্যায়ের অংশগ্রহণে সরকারিভাবে পালন করে। নারী সংগঠন ও এনজিওদের কর্মসূচি থাকে। আমরাও নারীগ্রন্থ প্রবর্তনায় কর্মসূচি নিয়ে থাকি।

কিন্তু লক্ষ্য করেছি, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাসের সাথে এই দিবস পালনের সম্পর্ক এখন অনেক দূরে চলে গেছে। বিশেষ করে শ্রমিক নারীর আন্দোলন সংগ্রামের কথা প্রায় সবাই ভুলতে বসেছে। বাংলাদেশে এখনো শ্রমিক নারী, বিশেষ করে গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিক, যাদের শ্রম ঘামে বৈদেশিক মুদ্রার পাহাড় গড়ে, গার্মেন্টস মালিকদের সম্পদ বাড়ে, তাদেরই বেতন দিতে গড়িমসি করা হয়। 

আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলন করে নিউইয়র্ক সুই কারখানার শ্রমিকরা ১৮৫৭ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করে সেই দাবি আদায় করেছে। এই আন্দোলনের কারণেই জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেৎকিন ১৯১০ সালে ডেনমার্কে অনুষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক নারীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মার্চের ৮ তারিখকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন।

কিন্তু আজও এই গার্মেন্ট শিল্পের নারী শ্রমিকরা ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা কাজ করেন, কখনো ওভার টাইম পান, কখনো পান না। ওভার টাইম খাটিয়ে নিয়েও তাদের সেই প্রাপ্য টাকাটুকু পেতে রাস্তায় নেমে দাবি তুলতে হয়। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মূল প্রেক্ষাপটকেই অস্বীকার করে নারীর সমতার দোহাই দেওয়া হচ্ছে।   

জাতিসংঘ ১৯৭৫ সালে দিবসটি ঘোষণা দেয়ার আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নারী দিবস সরকারিভাবে পালিত হোত না, এটা সীমাবদ্ধ্ ছিল সমাজতান্ত্রিক সংগঠনের নারীদের দিবস পালনের মধ্যেই। ক্লারা জেৎকিনের ঘোষণা বুর্জোয়া নারীরা পালন করবেন কেন? শ্রমিক নারীদের দাবি তো তাদের নয়। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নারীর অধিকারের সাথে বিশ্ব শান্তির প্রশ্ন যুক্ত করা হয়। ভাল কথা। কিন্তু নারী অধিকারের সাথে বিশ্ব শান্তির সম্পর্ক যদি থাকে, তাহলে নারী শ্রমিকদের অধিকার হরণ করে তাদেরকে বেতন নিতে হলে রাস্তায় নামতে হলে কি শান্তি রক্ষা হয়? নাকি এই শ্রমিকদের ওপর পুলিশের হামলা করে তাদের ঠান্ডা করলেই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়?

জাতিসংঘের একটি প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) থাকলেও তারাও আজ পর্যন্ত শ্রমিকদের ন্যায্য মুজুরি প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখতে পারেনি। এই ব্যর্থতা নিয়েই মধ্যবিত্তের আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হয়ে আসছে, বেগুনি শাড়ি ও জামা-কাপড় পরে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারীদের সমতার দাবিগুলো এখন প্রাধান্য পাচ্ছে, শ্রমিকদের দাবি অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। 

এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে উখরাইনে যুদ্ধ অবস্থার প্রেক্ষাপট আলোচনায় আসতেই হবে; জাতিসংঘ নারীর অধিকারের সাথে বিশ্ব শান্তির কথা বলে অথচ বিশ্বের যুদ্ধবাজদের যুদ্ধ থামাতে পারে না। যুদ্ধ মানে নারী, শিশু, বয়স্ক মানুষের কষ্ট। যুদ্ধ কখনো নারীদের পক্ষে যায় না। আমরা একই সাথে ফিলিস্তিনের নারীদের দেখছি সন্তান হারিয়ে, স্বামী হারিয়ে প্রায় সময় বোমাবাজির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। 

জাতিসংঘ শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এদের শান্তি দিতে পারছে না। কাশ্মীরের নারী, সিরিয়ার নারীসহ বিশ্বের অনেক দেশেই যুদ্ধ অবস্থা চলছে। এতে মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রির লাভ হচ্ছে- কিন্তু ক্ষতি হচ্ছে মানুষের, বিশেষ করে নারীর। নারী তাই যুদ্ধ চায় না।  

জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে সরকারগুলোর দিবস পালনকে খুব স্ববিরোধী মনে হয়। একদিকে সরকারগুলো নারীবিরোধী কাজ করে, নারীর নিরাপত্তা দিতে পারে না, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস বেশ আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করে। বাংলাদেশেই দেখছি- নারী ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতন, বৈষম্য, সব কিছু কোনোভাবে কমছে না। ক্ষমতাসীন দলের সাথে যুক্ত থাকলে অপরাধীরা সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে। বিচারপ্রার্থী নারী বিচার পায় না। এই বিষয়টা কি আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আলোচিত হবে? 

এখন বিশ্বের সামনে আর একটি সমস্যা হাজির হয়েছে সেটা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন বা জলবায়ু বিপর্যয়। সারা পৃথিবীর জন্যে আগামী দিনগুলো কেমন যাবে সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ জলবায়ু বিপর্যয়ের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপুর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রায় দুই কোটি মানুষ শুধু সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার কারণে নিজ এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হবে। তারা জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে যাবে। এটাও একরকম যুদ্ধ, আর এই অবস্থা সৃষ্টি করেছে বিশ্বের ধনী দেশগুলো। কারণ কার্বন নিঃসরণের টার্গেট তারা পূরণ করছে না। বড় বড় তেল কোম্পানি, কয়লা ও গ্যাস কোম্পানি এই না কমানোর জন্যে বিশেষ তৎপর, কারণ তাদের ব্যবসা শেষ হয়ে যাবে। জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর জীবন যাত্রা, খাদ্য উৎপাদন, প্রযুক্তির ব্যবহার জলবায়ূ মোকাবেলার ক্ষেত্রে বড় বাধার সৃষ্টি করেছে। 

এবারে জাতিসংঘ যে প্রতিপাদ্য দিয়েছে  ‘Gender equality today for a sustainable tomorrow’, অর্থাৎ ‘আগামীর জন্যে আজকের নারী-পুরুষ সমতা’। এই প্রতিপাদ্য অনুযায়ী ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন ও বিপর্যয় রোধ করতে ধনী-গরিবের ব্যবধান কমাতে হবে। নারীর যেসব কাজ প্রকৃতি রক্ষায় সহায়ক ভুমিকা পালন করে, সেই কাজগুলো এগিয়ে নিতে হবে।

আমরা কি শুধু খরা, বন্যা, ঝড়-তুফান, নদী ভাঙ্গন নারীকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে সেটাই বলবো, নাকি নারী প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় যে ভুমিকা রাখে সেই কাজ আরও শক্তিশালী করবো। দেখা যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যে এখন বড় বড় কোম্পানি নানা প্রযুক্তি নিয়ে আসছে। কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং কার্বন নিঃসরণ হলেও যেন তা ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে তেমন গাছ, প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রস্তাব আসছে। 

এখানে নারীর সমতা রক্ষার কোনো উপায় নেই, নারীকে ব্যবহার করে প্রযুক্তি প্রয়োগের চেষ্টা কারো উপকারে আসবে না। তবুও আমাদের আশা নারী এগিয়ে যাবে। শত প্রতিকুলতা ভেদ করে, মানুষ সৃষ্ট (বা পুরুষসৃষ্ট) এবং প্রকৃতি সৃষ্ট, এগিয়ে যাবে। অবশ্যই।

- নারীনেত্রী ও কলাম লেখক

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh