রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির শঙ্কায় সাধারণ মানুষ

হাসান হামিদ

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২২, ১২:০৫ পিএম

দফায় দফায় দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে। এমন কোনো পণ্য নেই, যার দাম বাড়েনি। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন খেটে খাওয়া ও নিম্নআয়ের শ্রমজীবী মানুষ। পাশাপাশি মধ্যবিত্ত শ্রেণিও কষ্টে পড়েছেন। সবকিছুর দাম কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে। আর এমন পরিস্থিতিতে আসছে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে রমজান মাস। সাধারণ মানুষজন দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির আশঙ্কায় রয়েছেন। পরিস্থিতি আরও প্রকট হবার আশঙ্কা করছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থাও।

সে পরিপ্রেক্ষিতে নিত্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে নির্দেশ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। যদিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, তাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। এরই মধ্যে গঠন করা হয়েছে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি। সরকারের বিপণন সংস্থা টিসিবির দাবি, আগের চেয়ে তিন থেকে চারগুণ মজুদ বাড়িয়েছে তারা।

বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দীন বলেন, ‘সর্বকালের শ্রেষ্ঠ প্রস্তুতি রয়েছে আমাদের। রমজানে মানুষের যাতে কষ্ট না হয়, সে জন্য প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অনুশাসন রয়েছে। সে আলোকেই আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান মনিটরিং করছে।’

মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অনুশাসন অনুসারে, প্রতিবেদনতৈরি করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। রমজানে কী পরিমাণ তেল, সোলা, চিনি, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণের চাহিদা রয়েছেÑ এসব তথ্য এবং সেই অনুসারে প্রস্তুতিও তুলে ধরা হয়েছে। এমনকি চাহিদা অনুসাওে, পণ্য আমদানির উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ ছাড়া অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি টিসিবির কার্যক্রম এবং বাজার পরিস্থিতি মনিটরিং করবে। এ ছাড়া নিয়মিত বাজার মনিটরিং এবং মজুদদারির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক, পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা বিক্রেতারাপণ্যের সংকটের অজুহাতে মূল্য বৃদ্ধি ঘটাতে না পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে প্রতিদিন মূল্য তালিকা টাঙিয়ে রাখা, তালিকা অনুসারে বিক্রি নিশ্চিত করা, ভ্রম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অসৎ ব্যবসায়ীদের তাৎক্ষণিক শাস্তিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে সারা বছর ছোলার চাহিদা ১ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রমজানেই খাওয়া হয় ৮০ হাজার টন ছোলা। সারাবছর ২৪ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা থাকলেও, রমজানে লাগে ৫ লাখ মেট্রিক টন। মুসলিমদের সিয়াম সাধনার এ মাসে ভোজ্যতেলের চাহিদাও বেশি থাকে। সারা বছর যেখানে ১৮ লাখ ৬২ হাজার টন চাহিদা, সেখানে রমজানেই প্রয়োজন হয় ৩ লাখ টন। এ ছাড়া সারাবছর ১৮ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে দেশে। এর মধ্যে শুধু রমজানেই ৩ লাখ টন খাওয়া হয়। ৫ লাখ টন মসুর ডালের চাহিদা থাকলেও, রমজানে ৮০ হাজার টন বিক্রি হয়। সারা বছর ৬ লাখ ৪ হাজার টন রসুনের চাহিদা থাকে। এর মধ্যে রমজানে লাগে ৮০ হাজার টন। সব মিলিয়ে ভোক্তাদের ওপর যাতে বাড়তি চাপ বা কষ্ট করতে না হয়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছে মন্ত্রণালয়। আর বাজারে যাতে সিন্ডিকেট কোনো ধরনের কারসাজি করতে না পারে, সে জন্য মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

তবে সরকারের প্রস্তুতির কথাকে বিশ্বাস করতে পারছে না সাধারণ জনগন। কারণ সরকার যতই প্রস্তুতি নিক এর আড়ালে একটি সিন্ডিকেট সবাইকে জিম্মি করে ফেলে বলে অনেকেই মনে করেন। কয়েক মাস ধরে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন এই ঊর্ধ্বগতি মানুষকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাচ্ছে, তা নিয়ে ভাবার যেন কেউ নেই। ফলে মানুষ ভাবছে, রমজানে মুনাফাখোর সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ, লবণ, চিনির দাম আরও যদি বাড়িয়ে দেয়, তবে ভয়ানক কষ্টে পড়বেন অনেকে।

করোনাকালে দেশের অনেক মানুষের আয় কমেছে। আয় কমার সঙ্গে সঙ্গে এদিকে জিনিসের দাম বেড়েছে। এতে করে বাড়তি চাপে পড়েছে নিম্নআয়ের মানুষ। এই করোনা সংকট পুঁজি করে ভোগ্যপণ্যের অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে কোনো কারসাজির সুযোগ না পায়, সে জন্য এবার শবেবরাতের পর থেকে সরকারি সংস্থাগুলো নিয়মিত বাজার তদারকি করবে বলে জানা গেছে। দেশের মানুষের আয় কমার পাশাপাশি করোনাকালে কমেছে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ। টাকার মান ধরে রাখতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে পণ্য ও সেবামূল্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে রাখা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই দাম বৃদ্ধি নিয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, সবার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। নাভিশ্বাস উঠেছে স্বল্প আয়ের মানুষের। ভোক্তাদের সোচ্চার হতে হবে। নয়তো সরকার শুনবে না। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কয় দিন পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দাবি তুলবেন তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য। সরকারও হয়তো মেনে নেবে; কিন্তু সরকারি চাকরির বাইরে সাধারণ মানুষের তো আয় বাড়ছে না। কষ্টটা তাদেরই বেশি হবে। সে জন্য নিত্যপণ্যের বাজারে এখনই লাগাম টানতে হবে। 

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে এখানে তো বাড়বেই; কিন্তু অনেকের অভিযোগ, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়লে দেশের বাজারেও কিছু পণ্যের দাম বাড়বে, এটা সত্যি; কিন্তু যেসব পণ্য দেশে উৎপাদন হয়, বাজারে কোনো ঘাটতি নেই সেটার দাম কেন বাড়বে? যেমন একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ধান উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ কোটি ৯৫ লাখ টন। আমন ও আউশ মৌসুমে বেশ ভালো ফলন হয়েছে। বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে আমদানিও করা হয়েছে চাল। খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চালের মজুদও রয়েছে রেকর্ড পরিমাণে এরপরও চালের দাম কেন বাড়ছে?

এদিকে সাধারণ মানুষ বলছে, জিনিসের দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় এবং অনেকের আয় কমে যাওয়াতে টিসিবির পণ্য কিনতে ভিড় জমাচ্ছেন জনগণ। ট্রাকের পেছনে লাইন বড় হচ্ছে। অনেকে মনে করেন, প্রতি বছর সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলে; কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না।


সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh