রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বেশি ক্ষতি উন্নয়নশীল বিশ্বের

অরুন্ধতী বসু

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২২, ১২:৫৩ পিএম

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

ইউক্রেনে রাশিয়ার অযৌক্তিক ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে ‘কে’ বিজয়ী, তা বলা কঠিন। ধরে নেওয়া যাক, এই যুদ্ধে জয়ী হবে রাশিয়া। পরাজিতের তকমা ইউক্রেনের গায়ে লাগলেও, পরাজয়ের বিস্তৃতি এই দেশ ছাপিয়ে পৌঁছে গেছে বিশ্বজুড়ে। বাকি রইলেন রাশিয়ার জনগণ, তারা যুদ্ধ চান না। শাসকের যুদ্ধাভিলাষে সমর্থন না জোগালেও, এই যুদ্ধে রুশরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞায় ভঙুর অর্থনীতির বোঝা রাশিয়ার জনগণকেই বইতে হবে। 

কোভিড-১৯ মহামারির বিপর্যয় আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠছিল বিশ্ব অর্থনীতি; কিন্তু বিধিবাম! অর্থনীতির এই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় এখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন। ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতিবেশী দেশ আক্রমণের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। এতে পুরো বিশ্ব তো বটেই, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মহামারিতে ধুঁকতে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলো। 

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তাৎক্ষণিক প্রভাবের ফলে। প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম সম্প্রতি ২০ শতাংশ বেড়ে ১৩৯ ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা ২০০৮ সালের পর সর্বোচ্চ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্ররা রুশ তেলে নিষেধাজ্ঞা জারির বিষয়ে আলোচনা করছে। আলোচনা বাস্তবে রূপ নিতে পারে- সম্ভবত এই আশঙ্কা থেকেই বেড়ে গিয়েছিল পণ্যটির দাম। আশঙ্কা সত্যি করে যুক্তরাষ্ট্র গত ৮ মার্চ রাশিয়ার তেল-গ্যাস আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও, পশ্চিমারা এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যুক্তরাজ্য এই বছরের শেষ নাগাদ রুশ তেল-গ্যাসে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে; কিন্তু এই ঘোষণা বাস্তবায়ন হবে কি-না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তবে মহামারি চলাকালে নাটকীয় অস্থিরতার সময়ের পর বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম এখন বাড়ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে।

২০২০ সালের এপ্রিলে মহামারির প্রথম ঢেউ চলে বিশ্বজুড়ে। লকডাউনে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। থেমে গিয়েছিল গোটা পৃথিবী। ওই সময় চাহিদা সংকটে ব্রেন্ট অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি কমে যায় ৯ ডলার। চলতি বছরের জানুয়ারিতে একই পরিমাণ তেলের দাম ছাড়িয়ে যায় ৯০ ডলারের মাইলফলক। এরপর ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে আরও চাপে পড়ে তেল ও গ্যাসের বাজারে।

রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ইউরোপ। তাই ইউরোপে ক্রমবর্ধমান জ্বালানি তেলের দামের প্রভাবে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে পশ্চিমা গণমাধ্যম; কিন্তু বিশ্বের বেশিরভাগ তেল ও গ্যাস আমদানিকারকই ইউরোপের দেশগুলোর চেয়ে দরিদ্র। এসব দেশের অনেকে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য উন্নত অর্থনীতির মতো মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে অক্ষম এখনো। এখনো উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বেগ পোহাতে হচ্ছে এই দেশগুলোকে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিও ধীর। এ অবস্থায় তেলের দামের ঊর্ধ্বগতি তাদের সংকট আরও বাড়িয়ে তুলছে। 

মহামারির কারণে পুরো বিশ্ব ঝুঁকিতে চলছিল মূল্যস্ফীতির সঙ্গে। এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মূল্যস্ফীতির দাপট বাড়ছে। এতে উন্নয়নশীল বিশ্বের অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে উঠছে। তেল একটি সার্বজনীন মধ্যস্থতাকারী পণ্য, যা বিভিন্ন উপায়ে পণ্য ও পরিসেবার খরচের পাশাপাশি পরিবহন ব্যয়কে প্রভাবিত করে। 

কোনো দেশের অর্থনীতির সেরা সময়েও তেলের মূল্য বৃদ্ধি সেখানকার মূল্যস্ফীতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই ধনী দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি সেই পর্যায়েই ছিল। এই মূল্যস্ফীতিতে লাগাম টানতে সুদহার বৃদ্ধি, তারল্যে ঘাটতি তৈরির মতো অনেক পদক্ষেপও নিচ্ছিলেন নীতিনির্ধারকরা। বলা বাহুল্য এসব পদক্ষেপে অর্থনীতির তেমন উন্নতি হয়নি। বরং বাস্তবিক অর্থে অর্থনীতির গতি হয়ে গেছে মন্থর। 

উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল বিশ্বকে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তেলের সাম্প্রতিক অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব পড়ছে তেল-আমদানিকারক দেশগুলোতে। আর উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বাড়বে অন্য সব পণ্যের দাম।

বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে ইউক্রেন ট্র্যাজেডি, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব দেশে ক্ষুধার্তের সংখ্যা বেড়েছে মহামারি চলাকালেই।

যুদ্ধ শুরুর আগে বিশ্বের পঞ্চম গম রফতানিকারক ছিল ইউক্রেন। সূর্যমুখী তেল, ভুট্টা, বার্লির অন্য সরবরাহকারকও এই দেশ। বৈশ্বিক বাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। চলতি মাসের প্রথম ৫ দিনে শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের ফিউচার মার্কেটে গমের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ, যা ১৯৫৯ সালের পর সর্বোচ্চ সাপ্তাহিক দরবৃদ্ধি। সার ঘাটতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় শস্য উৎপাদনে। বিশ্বের শীর্ষ গম উৎপাদনকারীর সঙ্গে শীর্ষ সার উৎপাদক রাশিয়া। আর দেশটি থেকে সার রফতানি ব্যাহত হলে, স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়বে শস্য উৎপাদনে। ফলে আরও বাড়বে বৈশ্বিক খাদ্যমূল্য। 

যুদ্ধ শুরুর আগেও ঊর্ধ্বমুখী ছিল বৈশ্বিক খাদ্যবাজার। ফেব্রুয়ারির বিশ্ব খাদ্যমূল্য সূচক সম্প্রতি প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে বিশ্ব খাদ্যমূল্য সূচক রেকর্ড বেড়েছে। এই মাসে সূচক ২০ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৪০ দশমিক ৭ পয়েন্ট। শস্য, ভেজিটেবল অয়েল ও খামারপণ্যের দরবৃদ্ধিতেই বেড়েছে খাদ্যমূল্য সূচক। ভেজিটেবল অয়েল, শস্যদানা, খামারজাত পণ্য, চিনি ও মাংস- এই ৫ পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারদর পর্যবেক্ষণ করে বৈশ্বিক খাদ্য মূল্যসূচক নির্ণয় করে এফএও।

ফেব্রুয়ারিতে শস্যের মূল্যসূচক বেড়েছে ৩ শতাংশ। কৃষ্ণ সাগরীয় বন্দর থেকে সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কায় ভুট্টা ও গমের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৫ দশমিক ১ ও ২ দশমিক ১ শতাংশ। সরবরাহ ঘাটতিতে খামার পণ্যের মূল্যসূচক বেড়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে টানা ৬ মাস বাড়ল এ সূচক। মাংসের দাম বেড়েছে ১ দশমিক ১ শতাংশ। নির্ধারিত ৫ পণ্যের মধ্যে গত মাসে তুলনামূলক দাম কমেছে চিনির। শীর্ষ রফতানিকারক ভারত ও থাইল্যান্ডে পণ্যটির পর্যাপ্ত উৎপাদনের সম্ভাবনা থাকায় জানুয়ারির তুলনায় দাম কমেছে প্রায় ১ দশমিক ৯ শতাংশ।

বর্তমান গল্পের কিছু অংশ আগেও পরিলক্ষিত হয়েছে। ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার আগের সময়টা ভালোই ছিল; কিন্তু এর পেছনে রয়েছে অন্ধকার ও হতাশাময় একটি অবস্থা। আর্থিক বাজার নিয়ে জল্পনা-কল্পনার ফলে ২০০৭-০৮ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট দেখা দেয়। তখন ক্ষুধার্তের সংখ্যা বাড়ে। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় লাখো মানুষের মৃত্যু হয়েছিল শুধু খাবারের অভাবে। খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক সরবরাহ ও চাহিদায় পরিবর্তন না হলেও, মূল্যস্ফীতির কারণে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছিল সেই সময়; কিন্তু এবারের বাস্তবতা ভিন্ন।

এখন বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহে প্রকৃত ঘাটতি প্রায় অনিবার্য। মূল্য আরও বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে এবং এই পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। সব কিছু নিয়ে জল্পনা-কল্পনা বাড়লে ভঙুর অর্থনীতি আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ধনী দেশগুলোর জোট গ্রুপ সেভেন (জি-৭) এই বাস্তব ও বিপদ নিয়ে খুব বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করছে না, এটা আশ্চর্য হওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়। গ্রুপ অব সেভেনের দেশগুলো হচ্ছে- কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।

তবে বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোকে এই সংকটের সময় অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্ততপক্ষে ক্ষতিপূরণমূলক অর্থায়ন দিয়ে উন্নয়নশীল বিশ্বকে একাধিক সমস্যা মোকাবেলায় সহায়তা করা তাদের দায়িত্ব হয়ে উঠেছে। প্রয়োজনে জল্পনা-কল্পনা রোধ করার জন্যও পদক্ষেপ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সংস্থাগুলোর জন্য। এই ধরনের চেষ্টা ব্যতিত ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে উন্নয়নশীল বিশ্ব।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh