একজন ভালো হলে বাকিদের ওপর চাপ পড়ে কি?

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২২, ০২:৫৮ পিএম

আমীন আল রশীদ

আমীন আল রশীদ

আমাদের এক ঘনিষ্ঠজনের মেয়ে পেশায় চিকিৎসক। সম্প্রতি চাঁদপুরের একটি উপজেলা হাসপাতালে বদলি হয়েছেন। চাকরির পরপরই তিনি কিছুদিন নাটোরের একটি উপজেলায় ছিলেন। এবার নিজের জেলায় বদলি হওয়ায় তিনি এবং তার বাবা যারপরনাই খুশি।

চিকিৎসকদের একটি বিরাট অংশ যেখানে রাজধানী ঢাকায়, নিদেনপক্ষে জেলা শহরে বদলির চেষ্টা করেন, যাতে সরকারি হাসপাতালের নির্ধারিত ডিউটির পরে রোগী দেখে বাড়তি পয়সা আয় করা যায়, সেখানে এই নারী চিকিৎসক একটি উপজেলা হাসপাতালে দায়িত্ব পেয়ে দারুণ খুশি। কারণ চিকিৎসক হয়ে পিছিয়েপড়া, সুবিধাবঞ্চিত বা প্রান্তিক মানুষকে সেবা দেওয়ার স্বপ্নই তিনি লালন করেছেন।

কথা হয় তাঁর বাবার সঙ্গে। তিনি জানান, মেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে ডাক্তার করাতে, তার ওই অর্থে কোনো পয়সাই খরচ হয়নি। ভালো ছাত্রী বলে বরাবরই বৃত্তি পেয়েছে আমার মেয়ে। সেই পয়সা দিয়েই সে নিজের পড়ালেখার খরচ চালিয়েছে। চাকরি হবার পরে ভেরিফিকেশনের সময় পুলিশকে একটি টাকাও দেননি। স্থির সিদ্ধান্তে ছিলেন, এক টাকাও ঘুষ দেবেন না। দেননি। মেয়ের চাকরি হয়েছে। এখন নিজের জেলার একটি উপজেলায় বদলি হয়ে পরিবারে আনন্দের বন্যা বইছে যেন।

শুরুতে নাটোরের একটি উপজেলায় কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তখন করোনায় জর্জরিত দেশ। ঘরে ঘরে করোনার রোগী। হাসপাতালে ঠাঁই হয়নি অনেকের। নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করে তখনো তিনি প্রান্তিক মানুষকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। দ্রুততম সময়ে তিনি সেসব মানুষের পরম আত্মীয় হয়ে যান। ফি নেননি বলে ভালোবেসে রোগীদের কেউ কেউ নিজের ক্ষেতের লাল শাক, লাউ বা নিজের হাঁস-মুরগির এক হালি ডিম নিয়ে এসেছেন ‘ডাক্তার আপা’র জন্য। কেউ হয়তো নিজের গাভীর এক বোতল দুধ নিয়ে এসেছেন। নিজের মেয়ের প্রতি প্রান্তিক মানুষের এই অকৃত্রিম ভালোবাসার গল্প বলার সময় এই ভদ্রলোকের মুখে স্পষ্ট হলো গর্বিত হওয়ার উজ্জ্বল আভা; এক ধরনের স্বর্গীয় প্রশান্তি।

ওই চিকিৎসকও তার বাবাকে জানিয়েছেন, তিনি সরকারি বেতনের বাইরে রোগী দেখে এক টাকাও বাড়তি আয় করতে চান না। রোগী দেখবেন বিনা মূল্যে। তবে এখানেই শেষ নয়। মেয়েকে তার বাবা শিখিয়েছেন কী করে ডাক্তারদের সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণা বদলে দিতে হবে। পরামর্শ দিয়েছেন, তিনি গ্রামের নারীদের স্বাস্থ্য সচেতন করার কথা শুধু মুখেই বলবেন না, বরং যখন কোনো গর্ভবতী নারী আসবেন চিকিৎসা বা পরামর্শের জন্য, তখন তাকে সীমিত সাধ্যের মধ্যে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি (চিকিৎসক) নিজেও একটা সেদ্ধ ডিম ওই গর্ভবতী নারীকে খাওয়াবেন। এ জন্য অনুমান করে কিছু ডিম সেদ্ধ করে রাখতে হবে। চিকিৎসককে এই ডিমের পয়সা তার বাবা দেবেন। বললেন, মাসে যদি ৬০ জন গর্ভবতী নারীকেও একটা করে ডিম খাওয়াতে হয়, কত টাকা লাগে!

তিনি যেদিন গ্রামের সাধারণ পরিবারের শিশুদের দেখবেন, সেদিন চেম্বারে কিছু চকলেট রাখবেন। তিনি মনে করেন, চকলেট পাওয়ার পরে শিশুটি যে হাসি দেবে এবং শিশুর মা-বাবার মনে যে প্রশান্তি তৈরি হবে, তাতে শিশুটি অর্ধেক ভালো হয়ে যাবে। ডাক্তারদের সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণা ধীরে ধীরে বদলে যাবে। কারণ এই মানুষেরাই যখন অন্য কোনো হাসপাতালে বা অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে গিয়ে খারাপ আচরণের শিকার হবেন, তখন তারা ওই ডাক্তারের রেফারেন্স দিতে পারবেন। তারা হয়তো বলবেন, অমুক ডাক্তার তো রোগীদের সঙ্গে ভালো আচরণ করেন। গেলে ডিম খাওয়ান। বাচ্চাকে চকলেট দেন। আপনে এরকম খারাপ আচরণ করছেন কেন?

বিষয়গুলো গল্পের মতো শোনাচ্ছে হয়তো; কিন্তু গল্প নয়। কাজগুলো যে কঠিন, তাও নয়। দরকার আসলে সদিচ্ছা এবং লোভ সংবরণ। একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কতটুকু সম্পদের প্রয়োজন বা তিনি কতটুকুতে সন্তুষ্ট থাকবেন সেই হিসাবটা তার কাছে স্পষ্ট থাকলে, অর্থাৎ চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে জীবনটা সহজ হয়। তখন সীমিত সম্পদ ও সাধ্য নিয়েই মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়।

অস্বীকার করা যাবে না, আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে জনমনে অনেক অসন্তোষ থাকলেও, চারপাশে অসংখ্য মানবিক চিকিৎসকও রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে এরকম একাধিক ডাক্তারকে চিনি, যারা নিজের এলাকার কোনো রোগী দেখলে ফি তো নেনই না, বরং গাড়ি ভাড়া আছে কি-না জিজ্ঞেস করেন? অনেক বড় প্রফেসর, কিন্তু এখনো তিনশ’ টাকা ফি নেন। গরিব রোগী হলে তাও নেন না। একাধিক চিকিৎসককে চিনি, যারা ওষুধ কোম্পানির কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেননি, যারা শুধু পার্সেন্টেজের লোভে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেন না। পারতপক্ষে ওষুধ দেন না। হয়রানি করেন না। এরকম চিকিৎসকের সংখ্যাও অনেক; কিন্তু এই ভালোর সংখ্যাটা এখনো খারাপের তুলনায় কম। ফলে খারাপ দিকটাই বেশি আলোচিত হয়।

সব পেশায়ই ভালো-মন্দ দুই ধরনের মানুষ থাকেন। তবে কিছু কিছু পেশার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লাটা ভারী। যেমন পুলিশ। অথচ এই পুলিশ বাহিনীতেই অসংখ্য মানবিক, সৎ, দুর্নীতিমুক্ত ও দেশপ্রেমিক সদস্য আছেন।

সম্প্রতি সুনামগঞ্জে গিয়ে ট্রাফিক পুলিশের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় হলো, যিনি একজন পুরোদস্তুর ‘কৃষক’। এক সময় যে জায়গাটিতে ডিসপিউটেড গাড়িগুলো ডাম্প করে রাখা হতো, সেই জায়গাটিকে তিনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে একটি দৃষ্টিনন্দন বাগানে পরিণত করেছেন। সেই বাগানে দেখা গেলো হরেক রকমের গোলাপ। শুধু বাহারি ফুল নয়, লেটুস, ধনে ও পুদিনাপাতার বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। 

তিনি জানালেন, রোজার মাসে ইফতারের আগ মুহূর্তে এই বাগানের পুদিনা পাতা নেওয়ার জন্য লোকজনের ভিড় লেগে যায়। তারা সবাই পাতা নেন বিনা পয়সায়। গাছ ও পরিবেশের প্রতি একজন পুলিশের এই যে মমত্ব, দরদ, প্রেম- তা সত্যিই প্রশংসনীয়। ভদ্রলোক জানালেন, এর আগে তিনি চট্টগ্রামে ছিলেন। সেখানেও কৃষির বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। 

তিনি আরও বলেন, প্রতিটি গাছকে তিনি সন্তানের মতো ভালোবাসেন। যে কারণে যখন চট্টগ্রাম থেকে তার বদলির আদেশ হলো, তখন পরম যত্নে লালিতগাছগুলো ছেড়ে যেতে হবে ভেবে একা একা কেঁদেছিলেন। হয়তো একই ঘটনা ঘটবে সুনামগঞ্জ থেকেও যখন তার বদলির আদেশ হবে। পুলিশ বাহিনীতে নিশ্চয়ই এরকম মানুষ আরও অনেক আছেন। আমরা ক’জনকেই বা চিনি? আলোচনায় আসেন শুধু খারাপ লোকেরা, যখন তাদের কোনো অপকর্ম ধরা পড়ে বা বড় কোনো অভিযোগ ওঠে।

ঘুষ ছাড়া পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট দেয় না এটাই স্বতিঃসিদ্ধ; কিন্তু ২০১৬ সালের নভেম্বওে একটি ঘটনা স্মরণ করা যেতে পারে। পাবনার সাত উপজেলায় বিসিএসে উত্তীর্ণ ৩৭ জনের ভেরিফিকেশন করতে গিয়ে তখন পুলিশ কোনো পয়সা নেওয়া তো দূরে থাক, উল্টো ফুল ও মিষ্টি নিয়ে গেছেন প্রার্থীদের বাসায়। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ভেরিফিকেশনের ভয় কাটাতে পাবনার তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শেখ সেলিম ৩৫তম বিসিএসে উত্তীর্ণ পাবনার ৩৭ জন প্রার্থীর বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন ফুলের তোড়া ও মিষ্টি। পাসপোর্ট, চাকরি, বিদেশ যাওয়াসহ যে কোনো বিষয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশন মানেই ঝামেলা। অধিকাংশ সময়ই প্রার্থীর পক্ষে ভালো কথা লেখার নামে পুলিশ টাকা দাবি করে। ফলে তাদের (পুলিশ) বিভিন্নভাবে খুশি করতে হয়; কিন্তু ২০১৬ সালের নভেম্বরে পাবনা পুলিশের এই উদ্যোগ সারা দেশেই আলোচিত হয়। পরিবর্তনের সূচনাগুলো এভাবেই হয়। তবে তা খুব সহজও নয়। 

এর মূল কারণ অনিয়ম ও দুর্নীতির দুষ্টুচক্র। একটি প্রতিষ্ঠানের একজন লোক ভালো হলেই, সেই প্রতিষ্ঠানটি বদলে যায় না। কারণ ওই প্রতিষ্ঠানের খারাপ লোকেরা তখন ওই একজন ভালো মানুষের পেছনে লাগে। আবার সৎ ও দক্ষ লোকেরা অনেক সময় সমাজের প্রভাবশালী অসৎ লোকদের চাহিদা মতো কাজ না করলে, তাদেরও চক্ষুশূল হন। নানারকম আর্থিক ও রাজনৈতিক শক্তির কাছে সৎ লোকেরা হেরে যান। কারণ খারাপ লোকেরা বরাবরই ঐক্যবদ্ধ। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় যে অনিময় ও দুর্নীতির দুষ্টুচক্র গড়ে ওঠে, তার সঙ্গে ওই প্রতিষ্ঠানের বাইরে আরও অনেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী জড়িত থাকে। দুর্নীতি ও লুটপাট একা করা যায় না। অনেককে সঙ্গে নিয়ে করতে হয়। ফলে অনেক সময় সৎ ও সাহসী কর্মকর্তাকে প্রভাবশালীদের চাপে বদলি করে দেওয়া হয়। অনেক সময় ওএসডি এমনকি চাকরিচ্যুতও করাও হয়।

দ্বিতীয়ত, প্রফেশনাল জেলাসি বা ঈর্ষা, সৎ ও যোগ্য লোকদের অনেক সময় কোণঠাসা বা প্রান্তিক করে ফেলে। তারা সকল লোকের মাঝে একা হয়ে যান। তাকে নিয়ে তার সহকর্মীরাই রসিকতা করেন। তাকে বোকা বা পাগল উপাধি দেন। এসব কারণে ভালো লোকের পক্ষে এই সমাজে টিকে থাকা বেশ কঠিন।

কিন্তু সেই কঠিনের মধ্যেই লড়াইটা চালিয়ে যাওয়া দরকার। একটি হাসপাতালে একজন মানবিক চিকিৎসক থাকা মানে, তার এই মানবিকতার খবর দ্রুতই ছড়িয়ে যাবে। মানুষ তার কাছেই যেতে চাইবে। এতে করে অমানবিক চিকিৎসকদের ওপরে চাপ তৈরি হয়। একজন সৎ পুলিশ অফিসারের কথা যখন মানুষ জেনে যায়, তখন আরও দশজনের ভালো হওয়ার দরজা খুলে যায়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh