পুরস্কার বাতিল শোভনীয় নয়

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২২, ০২:৫০ পিএম

তীব্র সমালোচনার মুখে মুহাম্মদ আমির হামজার স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিল করেছে সরকার। চলতি বছর সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। আমির হামজাকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ, তিনি সাহিত্য জগতে খুব বেশি পরিচিত নন। পুরস্কার পাওয়ার পর তাকে এবং তাঁর রচিত সাহিত্য সম্পর্কে সকলের জানার আগ্রহ ও কৌতূহল দেখা দেয়। আমির হামজা একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি তাৎক্ষণিক গান রচনা করে তাতে সুরারোপ করে গাইতে পারতেন, পালাগান কিংবা গীতিকবি হিসেবে নিজ এলাকায় তার পরিচিত আছে। মৃত্যুবরণ করেন ২০১৯ সনে। তিনি মাত্র তিনটি বই লিখেছেন; বই তিনটির নাম হচ্ছে, ‘বাঘের থাবা’, ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি’ এবং ‘একুশের পাঁচালি’। সাহিত্য ক্যাটাগরিতে পুরস্কার বাতিলের আরেকটি ঘটনা ঘটে ২০২০ সনে; খুলনা বিভাগীয় সাবেক উপ-ভূমি সংস্কার কমিশনার এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদের নাম পুরস্কারের জন্য ঘোষণা করলেও তুমুল বিতর্কের একপর্যায়ে তাঁর পুরস্কারও বাতিল করা হয়।

আমির হামজার ছেলে খুলনা জেলা পরিষদের সচিব মো.আছাদুজ্জামান সরকারের নির্ধারিত ফরম পূরণ করে পুরস্কারের আবেদন করেন এবং তাতে সুপারিশ করেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। তপন কান্তি ঘোষ জাতীয় পুরস্কার দেওয়ার জন্য ১৬ জন সচিবের সমন্বয়ে গড়া ‘প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সদস্যও। দুঃখজনক হচ্ছে, তিনি আমির হামজা সম্পর্কে কিছু না জেনেই সুপারিশ করেছিলেন। জাতীয় পুরস্কারসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির প্রধান ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকও প্রায় একই কথা বলেছেন। ২০২০ সনেও ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীন ভূমি সংস্কার বোর্ডের পক্ষ থেকে রইজ উদ্দিনের নাম প্রস্তাব করা হয় এবং ভূমি সংস্কার বোর্ড কোনোরূপ যাচাই-বাছাই না করেই ভূমি মন্ত্রণালয়ে সেই নাম পাঠিয়ে দেয়। স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে, জাতীয় পুরস্কারের জন্য যোগ্য ব্যক্তির নির্বাচন এবং যাচাই-বাছাইয়ে সরকারের সচিবদের নিয়ে গঠিত কমিটি অথবা মন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অর্পিত দায়িত্ব পালনে যতœবান নয়। প্রকৃতপক্ষে সচিব বা মন্ত্রীদের বেশিরভাগ সাহিত্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন, সারাদিন দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং মিটিং করেই সময় পার করেন, তাদের পক্ষে সাহিত্য জগতের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক মন্ত্রণালয়, বিভাগ এবং পূর্বে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্তরা নির্ধারিত যে কোনো ক্ষেত্রে পুরস্কারের জন্য প্রস্তাব করে থাকেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত ১৬ সদস্যের ‘প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি’ প্রাপ্ত আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে ‘জাতীয় পুরস্কার সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি’র নিকট উপস্থাপন করে। ১২ সদস্যের মন্ত্রিসভা কমিটি পুনরায় তা যাচাই-বাছাই করে প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনা ও সিদ্ধান্তের জন্য উপস্থাপন করে। দেখা যাচ্ছে, উভয় কমিটিতে সরকারের সচিব এবং মন্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই। কিন্তু শুধু আমলা এবং মন্ত্রীদের নিয়ে জাতীয় পুরস্কার কমিটি গঠনের যুক্তসঙ্গত কোন কারণই থাকতে পারে না। সাহিত্যে পুরস্কার দেয়া হবে, অথচ সংশ্লিষ্ট কমিটিতে দেশের প্রথিতযশা কোনো সাহিত্যিক থাকবেন না, শুনতেই বিদঘুটে মনে হয়। কমিটিতে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তি জরুরি। নির্বাচন প্রক্রিয়ায়ও পরিবর্তন আনা দরকার। বর্তমানে পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হতে হলে নির্ধারিত আবেদন-ফরম পূরণ করে সংশ্লিষ্ট সচিব, মন্ত্রী বা আগের পুরস্কারপ্রাপ্তদের সুপারিশ নেয়া অপরিহার্য; কিন্তু পুরস্কারের জন্য আবেদন করতে হবে কেন? আবেদন করে কোনো আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি পুরস্কার নিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার কথা নয়। তাই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হলে তারাই উপযুক্ত ও যোগ্য ব্যক্তিকে খুঁজে নেবেন।

দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো বিদগ্ধ ব্যক্তি স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার সবই পাচ্ছেন; কেন একই ব্যক্তি সব পুরস্কারে ভূষিত হবেন? স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ার মতো অগণিত যোগ্য লোক এখনো জীবিত আছেন। সবাইকে একত্রে সম্ভব নয় বিধায় অবদানের অগ্রাধিকার বিবেচনায় স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া সমীচীন।

পদক-পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তিরা অগ্রাধিকার পান; কিন্তু মরণোত্তর পুরস্কার দেয়া অনেকটা অর্থহীন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার নিজের অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি সম্পর্কে জেনে যেতে পারল না, এটা ঠিক না। মরণোত্তর দেয়া গেলে জীবিত থাকাকালীনও দেয়া সম্ভব, যদি যোগ্য ব্যক্তিদের নিরপেক্ষভাবে বিচার করা হয়। কিন্তু সব সরকারের আমলে পুরস্কার দেয়ার জন্য নিজেদের লোক খোঁজা হয়। তবে দলীয় লোক গুণি হলে সমস্যা হয় না, এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নিরূপনে শুধু স্বজনপ্রীতি হয়। কিন্তু তাই বলে স্বাধীনতা বিরোধী ব্যক্তিকে যখন ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেয়া হয় তখন তা সকল বিবেচনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।

দেশ যেভাবে মতাদর্শে বিভাজিত তাতে দল-মত নির্বিশেষে যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচন সম্ভব বলে মনে হয় না। দলপ্রীতি থাকবেই। তবে অন্তত দলের যোগ্য ব্যক্তিকে পুরস্কারের জন্য বেছে নেয়া হলেও পুরস্কার ও পদকগুলোর সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুণ্য থাকবে।

উপযুক্ত ও যোগ্য ব্যক্তিকে পুরস্কার না দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য ব্যক্তিকে পুরস্কার দেয়া হলে পুরস্কারের মর্যাদা হ্রাস পায়। ইতঃপূর্বে সাহিত্য ক্যাটাগরিতে যারা স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন, কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীকবি জসীম উদদীন, কবি শামসুর রাহমান, জহির রায়হান, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, শওকত ওসমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, কবি ফররুখ আহমদ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। কিন্তু স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার মতো সাহিত্যকর্ম আমির হামজার নেই, তার কোনো বই সাহিত্য ও শিল্পের মানদ-ে উত্তীর্ণ নয়। এ ছাড়াও তিনি খুনের মামলায় যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত আসামি, বিএনপির শাসনামলে রাজনৈতিক বিবেচনায় সাধারণ ক্ষমার আওতায় তিনি ১৯৯১ সনে মুক্তি পান। এতদসত্বেও তাকে বাছাই করার অন্যতম কারণ সম্ভবত তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান রচনা করে কমিটির নজরে আসতে সমর্থ হয়েছেন; কিন্তু আমির হামজা যে জিয়াউর রহমানকে নিয়েও গান লিখেছেন তা সম্ভবত কমিটি জানতে পারেনি। যখন জানলেন তখন দেয়া পুরস্কার বাতিল করা ফরজ হয়ে গিয়েছিল।

পুরস্কার দিয়ে তা বাতিল করা পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য অসম্মান ও অপমানজনক। পুরস্কার পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনায় আঘাত করার অধিকার পুরস্কার প্রদান কমিটির নেই। রইজ উদ্দিন এবং আমির হামজা দু’জনই বীর মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পক্ষে পুরস্কারের জন্য আবেদন করে যে তথ্য দেয়া হয়েছে, তথ্যের উপযুক্ততা এবং সত্যাসত্য যাচাই করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কমিটির। কমিটিতে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ না থাকার দায় রইজ উদ্দিন বা আমির হামজা নেবেন কেন? স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের জন্য কারো নাম ঘোষণার পর সমালোচনার মুখে সেই নাম প্রত্যাহার করে নিলে পুরস্কারটিকেই অসম্মান ও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। তাই আমির হামজার পুরস্কার বাতিল করার সাথে সাথে সচিব ও মন্ত্রী পর্যায়ে গঠিত সংশ্লিষ্ট কমিটি দুটিও বাতিল করা অপরিহার্য।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh