অর্থনৈতিক সংকটে শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাত

অরুন্ধতী বসু

প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২২, ০৩:২৬ পিএম

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

শ্রীলঙ্কায় এখন ঘোর সংকট। সরকারের কাছে ডলার নেই। এই সংকটের প্রভাব পড়ছে দেশটির পর্যটন খাতে। ডলার সংগ্রহে শ্রীলঙ্কা এ খাতের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তিন বছর আগে, ২০১৯ সালের এপ্রিলে ইস্টার সানডের দিন বোমা হামলার পর এমনিতেই পর্যটকের সংখ্যা কমে গিয়েছিল ১৮ শতাংশ। এরপর কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এ খাত পুনরুদ্ধারের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।

এমনকি গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দেশটির পর্যটন খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। পর্যটক বাড়াতে সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার সরকার কোয়ারেন্টিনের সব শর্ত তুলে নেয়। সেইসাথে দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে ভ্যাকসিনেটেড পর্যটক আকর্ষণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তা সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ক্রমান্বয় অবনতিতে পর্যটন খাত এক ধাপ এগিয়ে আবার পিছিয়েছে দুই ধাপ। 

শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের তৃতীয় বৃহত্তম উৎস হলো পর্যটন খাত। এক্ষেত্রে প্রবাসী আয় ও পোশাক শিল্পের পরই এ খাতের অবস্থান। পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল বহু শ্রীলঙ্কান পরিবার। এখান থেকে অর্জিত ডলারে দেশ চালায় সরকার; কিন্তু এখন শ্রীলঙ্কা এ যাবতকালের সবচেয়ে খারাপ আর্থিক সংকটের সম্মুখীন। প্রতিদিনই দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকতে হচ্ছে দেশটির জনগণকে। জ্বালানি ও রান্নার গ্যাস কিনতে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন শ্রীলঙ্কানরা। ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আমদানিতে বিধিনিষেধ আরো কঠোর করে পণ্য সরবরাহে ঘাটতি বাড়িয়েছে সরকার। এ সবই পর্যটকদের দূরে রাখছে শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ থেকে। অথচ সরকারের মাথায় বড় অংকের ঋণের বোঝা। এই ঋণ পরিশোধে অনেক ডলার প্রয়োজন।   

৪ ফেব্রুয়ারি ছিল শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতা দিবস। সেদিন স্বাধীতা দিবস উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে বলেছিলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পর্যটন খাতের সমস্যা সমাধান করতে হবে আমাদের। এ খাত নতুন করে সাজানোর কথাও বলেন তিনি। শ্রীলঙ্কার মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পর্যটন খাতের অবদান ৫ শতাংশ।  

অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি : গত কয়েক মাসে চমৎকার ব্যবসা হয়েছে বলছিলেন বিদেশি নাগরিক কেট হপকিনসন। শ্রীলঙ্কার ওয়েলিগামায় রেস্তোরাঁ ব্যবসা রয়েছে তার। দেশটির দক্ষিণের একটি জনপ্রিয় উপকূলীয় শহর এই ওয়েলিগামা। বিদ্যামান অর্থনৈতিক সংকটে ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে হপকিনসনের জন্য। তার ভাষ্য, ঘাটতির কারণে কালোবাজার থেকে গ্যাস কিনতে হয়। খাবারের দাম আকাশ ছোঁয়া। ময়দা এবং আমদানি পণ্য পাওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। তারা ইতালীয় রেস্তোরাঁ চালান। প্রতিদিনই পনির প্রয়োজন হয়; কিন্তু আমদানিতে কঠোর বিধিনিষেধের কারণে পণ্যটির সরবরাহ কম। দুধ সরবরাহে ঘাটতি থাকায় স্থানীয় বাজারেও পনির বা এর বিকল্প উপকরণের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। হপকিনসন শুধু একা ভুক্তভোগী নন, রেস্তোরাঁ মালিক রাসিকা লাকমাল, লাইফ স্টাইল ও ট্র্যাভেল অ্যাম্বাসেডর পালোমা মোনাপ্পার মতো ব্যবসায়ীরাও। পালোমা মোনাপ্পার পর্যটন ব্যবসা রয়েছে জনপ্রিয় উপকূলীয় শহর গালে ও উনাওয়াতুনায়। 

তিনি বলেন, দিনে চার থেকে সাত ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকতে হয় আমাদের। জ্বালানি সংকটের কারণে জেলেরা মাছ ধরা বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকারের কাছে অর্থ নেই। তাই প্রয়োজনীয় পণ্যবোঝাই শিপিং কন্টেইনারগুলো বন্দরে আটকে আছে। প্রতিবারই যে কোনো সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান ভেবে এগোতে গেলে নতুন জটিলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। জেনারেটর কিনলেও তা চালানোর জন্য ডিজেল মিলছে না। আমরা পর্যটকদের জন্য মরিয়া; কিন্তু তাদের চাহিদা পূরণ করব কীভাবে? প্রশ্ন তুলে মোনাপ্পা জানান, আমার শ্রীলঙ্কান বন্ধুরা বলেন, যুদ্ধের সময়ও পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল না। কিছু রেস্তোরাঁ কলম্বো ও মাতারার মতো অন্য শহর থেকে গ্যাস কেনে। 

লাকমাল জানান, এই বিকল্প তার জন্য নয়। কারণ এতে খরচ পড়বে প্রায় ১০ হাজার শ্রীলঙ্কান রুপি (৩৫ ডলার), যা স্বাভাবিক দামের দ্বিগুণেরও বেশি। এই ব্যয়ভার বহন করার সামর্থ্য নেই তার। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব : শ্রীলঙ্কা ভ্রমণে বেশি আসেন ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির পর্যটকরা; কিন্তু পর্যটন পুনরায় চালু হওয়ার পর পূর্বাঞ্চল থেকেও অনেক পর্যটক আসছেন দেশটিতে। জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে এসেছেন ২৫ শতাংশ পর্যটক। রাশিয়ার আন্তর্জাতিক পেমেন্টে সিস্টেম সুইফট থেকে বাদ পড়ার মতো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পড়ছে শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাতের ওপর। পর্যটকদের থাকার জন্য ভিলার ব্যবস্থা করে দেন দিমিত্রা ফার্নান্দো। 

তিনি আলজাজিরাকে বলেন, আমাদের কাছে অনেক রুশ অতিথি ছিলেন; কিন্তু ভাড়া দেওয়ার মতো অর্থ তাদের কাছে ছিল না। তাই তারা বুকিং বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ নিষেধাজ্ঞার কারণে কার্ড ব্যবহার করে টাকা তুলতেও পারছিলেন না। তবে মূল সমস্যাটি শ্রীলঙ্কার নিজস্ব অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে তৈরি হয়েছে। 

ফার্নান্দো বলেন, শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ সংক্রান্ত পরামর্শ আপডেট করেছে যুক্তরাজ্য সরকার। সেখানে পর্যটকদের খাদ্য সংকট ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। আটটি ভিলা পরিচালনা করেন ফার্নান্দো; কিন্তু এখন এগুলোর একটিতেও বুকিং নেই। কানাডাও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণের বিষয়ে সতর্ক করেছে নাগরিকদের। শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলার অংশ হিসেবে দুগ্ধজাত পণ্য, ফল এবং মাছের মতো ৩৬৭  পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করার পরে এই সতর্কতাগুলো এসেছে। জ্বালানির লাইনে পর্যটন যানবাহনগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে নিশ্চিত করেছেন শ্রীলঙ্কান কর্তৃপক্ষ; কিন্তু এটি নিয়ে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে। জ্বালানির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পর্যটন যানবাহনগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে নারাজ তারা। 

কর্মী ঘাটতি : শ্রীলঙ্কান অর্থনীতির জন্য পর্যটন তাৎপর্যপূর্ণ হলেও, মহামারির আগে থেকেই এ খাতে রয়েছে কর্মী ঘাটতি। করোনার পর এ ঘাটতি আরো প্রকট হয়েছে। ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার ট্যুরিজম স্কিলস কমিটির প্রধান মালিক ফার্নান্দো ঘর ভর্তি ট্যুরিজম স্টেকহোল্ডারদের জানিয়েছিলেন, আগামী তিন বছরে দেশের পর্যটন খাত পরিচালনায় আরো এক লাখ কর্মী প্রয়োজন হবে; কিন্তু এখন বছরে ১০ হাজারের মতো কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh