যে দেশে মেয়াদ শেষ করতে পারেননি কোনো প্রধানমন্ত্রী

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২২, ১০:৩৯ এএম

অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারিয়েছেন ইমরান খান। ফাইল ছবি

অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারিয়েছেন ইমরান খান। ফাইল ছবি

বহু নাটকীয়তার পর পাকিস্তানের পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারিয়েছেন ইমরান খান। গতকাল শনিবার (৯ এপ্রিল) সারা দিন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন তিন-চার দফা মুলতুবি হবার পর মধ্যরাতের পর অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয়।

জাতীয় পরিষদের ৩৪২জন সদস্যের মধ্যে ১৭৪ জন সদস্য ইমরানের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে ভোট দেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম একজন প্রধানমন্ত্রীকে অনাস্থা ভোটে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হলো। 

পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে কোনো প্রধানমন্ত্রীই নিজেদের পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদ সমাপ্ত করেননি। কখনো খুন হয়ে, আবার কখনো প্রেসিডেন্টের সাথে বনিবনা না হওয়ায় গদি ছাড়তে হয়েছে দেশটির প্রধানমন্ত্রীদের। তবে ইমরানই প্রথম পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী, যিনি বিরোধীদের ডাকা অনাস্থা ভোটের মুখে পড়ে গদিচ্যুত হলেন।

স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলি খান। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট অর্থাৎ পাকিস্তানের স্বাধীনতার দিন তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেন। কিন্তু ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর এক জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। মোট চার বছর ৬৩ দিন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন।

লিয়াকতের পর পাক মসনদে বসেন খাওয়াজা নাজিমুদ্দিন। তিনি ১৯৫১ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ১৯৫৩ সালের ১৭ আগস্ট পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদে বহাল ছিলেন। তার সময়কালে বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে লাহোরে একাধিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ দেখিয়ে তাকে গদি ছাড়ার নির্দেশ দেন পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মালিক গোলাম। কিন্তু তিনি এই নির্দেশ না মেনে নিতে চাওয়ায় নিজের বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে নাজিমুদ্দিনকে ক্ষমতাচ্যূত করেন মালিক। নাজিমুদ্দিন মোট এক বছর ১৮২ দিন ক্ষমতায় ছিলেন।

এরপর প্রধানমন্ত্রী হন মোহাম্মদ আলি বোগরা। তিনি ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে মোট দুই বছর ১১৭ দিন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। নিয়োগের পরপরই, আঞ্চলিক বৈষম্য নিয়ে তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল ইসকান্দার মির্জার সাথে প্রধানমন্ত্রী বোগরার সমস্যা শুরু হয়। এর পরই বোগরাকে একপ্রকার ইস্তফা দিতে বাধ্য করেন ইসকান্দার।

পাকিস্তানের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরি মোহাম্মদ আলী। ১৯৫৫ সাল থেকে মোট এক বছরের কিছু বেশি সময় পাকিস্তানের মসনদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বহাল ছিলেন আলী। দলবিরোধী কাজকর্মের জন্য তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো হয়।

পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। তিনি ১৯৫৬ থেকে শুরু করে এক বছর ৩৫ দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে গভর্নর জেনারেল ইসকান্দারের চাপের মুখে পড়ে তিনিও গদি ছা়ড়তে বাধ্য হন।

পাকিস্তানের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হন ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দিরগার। মাত্র দুই মাস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চুন্দিরগার। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার কথা বলার পর তাকেও অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়।

এরপর প্রধানমন্ত্রী হন ফিরোজ খান নুন। তার শাসনকালের সময় ছিল ২৯৫ দিন। খুব কম সময়েয় ফিরোজের জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছায়। মনে করা হয়, পাকিস্তানের সম্পূর্ণ ক্ষমতা দখলের ইচ্ছায় ফিরোজ বাধ সাধতে পারেন, এই ভয়ে তাকেও গদিচ্যূত করেন ইসকান্দার।

অষ্টম পাক প্রধানমন্ত্রী হন নুরুল আমিন। তিনিই পাকিস্তানের ইতিহাসে সব থেকে স্বল্পমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী। মাত্র ১৩ দিনের জন্য ক্ষমতায় ছিলেন নুরুল। তিনি পাকিস্তানের শেষ বাঙালি নেতা হিসেবেও পরিচিত।

নুরুলের পর ক্ষমতায় আসেন পাকিস্তান পিপলস্‌ পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। ১৯৭৩ সাল থেকে তিনি তিন বছর ৩২৫ দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই জেনারেল মোহাম্মদ জিয়া-উল-হকের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যূত করে। তাকে এক মাসের জন্য আটকও করা হয়।

জুলফিকারকে সরিয়ে ক্ষমতায় আনা হয় মোহাম্মদ খান জুনেজোকে। তিনি তিন বছরের কিছু বেশি সময় পাক মসনদে ছিলেন। তবে তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার জন্য দায়ী করে পদ থেকে সরান রাষ্ট্রপতি পদে বসে থাকা জিয়া।

পাকিস্তানের একাদশ ও প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন জুলফিকারের মেয়ে বেনজির ভুট্টো। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় ছিলেন। বেনজিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ এনে ১৯৯০ সালে তাকে বরখাস্ত করা হয়।

১৯৯০ সালে দ্বাদশ পাক প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরিফ। ১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট ইসহাক পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার পর তিনি গদিচ্যূত হন এবং বিরোধী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

ত্রয়োদশ ও চর্তুদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবারো পাকিস্তান শাসনের ভার পান বেনজির ও নওয়াজ। ১৯৯৬ সাল থেকে বেনজির ৩ বছর ১৭ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বারেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, হত্যার চক্রান্তসহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়। প্রেসিডেন্ট ফারুক লেগহারি তার সরকার ভেঙে দেন। 

নওয়াজের দ্বিতীয় বারের শাসনকাল চলে দুই বছর ২৩৭ দিন। এরপর ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের ফলে তার শাসনকালের অবসান ঘটে।

এর পরে ক্ষমতায় আসেন মীর জাফারুল্লাহ খান জামিলি। তবে প্রায় দুই বছরের শাসনকালের পর হঠাৎই নিজের পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। ইস্তফা দেওয়ার আগে জামিলি প্রায় ৩ ঘণ্টা তৎকালীন সেনাপ্রধান পারভেজ মোশারফের সাথে বৈঠক করেন। 

ষষ্ঠদশ পাক প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরী সুজাত হোসেন। তার শাসনের সময়কাল ছিল মাত্র ৫৭ দিন। এরপর তিনি নিজেই শওকত আজিজকে নিজের পদ ছেড়ে দেন।

এরপর প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন শওকত আজিজ। মোশারফের ডান হাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন শওকত। তিনি তিন বছর ক্ষমতায় থাকার পর নিজে থেকেই সরে যান। তবে শওকতের আমলে পাক অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি হয় বলে মনে করা হয়।

শওকতের পর পাক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন ইউসুফ রাজা গিলানি। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি মোট চার বছর ৮৬ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী পদে গিলানিই সব থেকে বেশিদিন বহাল ছিলেন। তবে একাধিক দুর্নীতির মামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগে পাক সুপ্রিম কোর্ট তার প্রধানমন্ত্রী পদ খারিজ করে।

পাকিস্তানের ১৯তম প্রধানমন্ত্রী হন রাজা পারভেজ আশরাফ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার শাসনের সময়কালও এক বছর পার করেননি। আশরাফ মোট ২৭৫ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। 

এরপর ২০১৩ সালে ফের ক্ষমতায় ফেরেন আগে দুইবার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসা নওয়াজ। তবে তৃতীয় বারে চার বছর ৫৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। তবে ২০১৭ সালে পানামা পেপার দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাকে ক্ষমতাচ্যূত করেন সুপ্রিম কোর্ট। 

নওয়াজের পর ২১তম পাক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শহীদ খোকন আব্বাসি। তবে ২০১৮ সালে নির্বাচনের মুখে তাকে প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়তে হয়।

২০১৮ সালের নির্বাচনে জিতে ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন ইমরান। পাকিস্তানের ধারা বজায় রেখে ইমরানও মেয়াদ শেষ করতে পারলেন না। -আনন্দবাজার পত্রিকা

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh