গৌতম দাস
প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২২, ১০:৫৪ এএম | আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২২, ১০:৫৬ এএম
গৌতম দাস
ইউরোপে এক লাগাতার গৃহযুদ্ধ চলেছিল ৩০ বছর ধরে, ১৬১৮-১৬৪৮ এই সময়কালে। এটা এমন এক সময় যখন ইউরোপজুড়ে কেবল রাজা আর সম্রাট, এর বাইরে অন্য কোনো শাসন নাই। অর্থাৎ রিপাবলিক ধারণার উন্মেষ ও চর্চা-ব্যবহারও শুরু হয়নি। তাই নাগরিক ধারণাও আসেনি।
ফ্যাকড়া বা ধর্মীয় বিভক্তির কথা আমরা জানি। অর্থাৎ ধর্মের কোনো অনুসৃত ব্যাখ্যা- ইন্টারপ্রিটেশন সঠিক এই বিতর্কে ভাগ হয়ে যাওয়া বুঝায়। যেমন খ্রিস্টান ধর্মের মূলধারা অর্থডক্স পরে ক্যাথলিক, প্রটেস্টান্ট ও আরো অনেক ধারা বা ফ্যাকড়ায় বিভক্ত হতে দেখা যায়।
আর এই বিভিন্ন খ্রিস্টান ধারা-ফ্যাকড়ার যুদ্ধ, এটারই ৩০ বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে তারা সমাধান যেভাবে করেছিল তা থেকেই স্যেকুলার ধারণার উৎপত্তি, সেটাকেই ‘ক্ল্যাসিক স্যেকুলারিজম’ বলছি। পরবর্তিতে স্যেকুলার ধারণায় বড় টুইস্ট আনা হয়েছে। তবে এই প্রথম ধারণাটিকে আলাদা করতে একে ‘ক্ল্যাসিক্যাল স্যেকুলারিজম’ বলে চিনব, চেনাবো এখানে।
গত ১৬১৮ সালে ওই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল মূলত বোহেমিয়ার রাজা [কিং অব বোহেমিয়া, বর্তমানে চেক রিপাবলিক] থেকে। তিনি তার পুরো রাজ্যজুড়ে ‘ক্যাথলিক’ খ্রিস্টান ধারা সবার ওপর বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। এতে প্রতিবাদ আপত্তিতে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয় প্রোটেস্টান্টরা। এক পর্যায়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে ক্রমশ তা সারা ইউরোপজুড়ে হাজির হয়। আর ১৬৩০ সালের মধ্যে দেখা যায়, তা ইউরোপের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে।
এ নিয়ে মোটা দাগে কয়েকটা কথা বলা যায়-
এক. রোম সাম্রাজ্যে প্রথম শতকের ইউরোপে সবচেয়ে বড় শাসন ব্যবস্থা; এতে প্রথম খ্রিস্টানিটি এসেছিল ৩১৩ খ্রিস্টাব্দে, রোম সম্রাট কনস্টানটাইন (Constantine) এর আমলে ও উদ্যোগে এবং ‘এডিক্ট অব মিলান’ চুক্তিতে।
দুই. ৩২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে কনস্টানটাইনের রোম আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থডক্স খ্রিস্ট-অনুসারী দেশ হয়।
তিন. যদিও তার আগের সম্রাট ডায়ক্লেসিয়ানের আমলে রোম সাম্রাজ্য প্রশাসনিক দিক থেকে বড় হয়ে যাচ্ছিল বলে একে দুই ভাগ করে কনস্টানটিনোপোল (পরে দামাস্কাস) ভিত্তিক ইস্টার্ণ রোম প্রশাসন চালু করেছিলেন।
চার. রোম বলে যেটা সবার কাছে পরিচিত এবং পুরনো, সেটাকেই এখন প্রাচীন রোম বলা হয়। এর আয়ুকাল ৭৫৩ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ, প্রায় ১২শ’ বছরেরও বেশি। তবে যেটা ওপরে বলেছি ইস্টার্ন রোমে আলাদা হয়ে যাওয়া, সে অংশ যদিও টিকে ছিল।
পাঁচ. পরে ৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ‘আরেক রোমান সাম্রাজ্যের’ পত্তন হয়েছিল, এটিকে ‘হলি রোমান সাম্রাজ্য’ নাম দিয়ে আলাদা করা হয়েছে; যা ১৮০৬ সালে আনুষ্ঠানিক বিলুপ্ত হয়। এ’দুই রোমান সাম্রাজ্য কোনোভাবেই সম্পর্কিত নয়; একমাত্র ভৌগোলিক অবস্থানে কিছু মিল ছাড়া।
মূল আলোচ্য প্রসঙ্গে
ইতিহাসের ১৬১৮-১৬৪৮ সাল যে গৃহযুদ্ধ চলেছিল সেটা মূলত ফ্যাকড়ার মধ্যে যুদ্ধ। আর বেশির ভাগ সময় রাজা (বা সম্রাট) নিজের পালনীয় ও অনুসৃত ধারার খ্রিস্টানিটি অনুসরণ করতে প্রজাদের বাধ্য করাকে কেন্দ্র করেই মূলত তৈরি হওয়া এই সংঘাত। এতে রাজার পক্ষ নেয়া গ্রুপ বনাম অন্য বিভিন্ন খ্রিস্টান ধারা-ফ্যাকড়া, এভাবে। অথবা রাজার ভূমিকা ছাড়াই নানা ফ্যাকড়াকে কেন্দ্র করে সরাসরি যেকোনো দুই খ্রিস্টান ধারার মুখোমুখি হয়ে যাওয়া লড়াই। এভাবে টানা ত্রিশ বছর ধরে চলা জনজীবনের চরম অশান্তি শেষে এক আপোষের পথ খুঁজে পেয়েছিল ১৬৪৮ সালে।
ইউরোপের ইতিহাসে ১৬৪৮ সাল
ইউরোপের ইতিহাসে ১৬৪৮ সাল প্রধানত যে কারণে বিখ্যাত তা হলো ‘ওয়েস্টফিলিয়া চুক্তি’। ওয়েস্টফিলিয়া এমনিতে বর্তমান জার্মানির উত্তর-পশ্চিমের এক শহর। ওয়েস্টফিলিয়া চুক্তিতে, বর্তমান ইউরোপের জার্মান, ফ্রান্স বা ইটালির মত প্রায় সব বড় শহর বা দেশ প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের শাসনাধীন ছিল। তবে কনস্টানটিনোপোল (বর্তমান তুরস্কে) কেন্দ্রিক ইস্টার্ন রোম গঠন হবার পরে, বিপরীতে রোমকেন্দ্রিক মূল অংশকে ‘পশ্চিম রোম সাম্রাজ্য’ বলা শুরু হয়েছিল। মোটামুটি এই অংশেই ৮০০ সাল থেকে এখনকার জার্মানির ফ্রাঙ্কস এথনিক জনগোষ্ঠীর লোকেরা প্রথম রাজ্য গঠন করেছিল, পরে তা অনেক ফ্রাঙ্কিস রাজ্য, রাজা পেরিয়ে ‘হলি রোমান সাম্রাজ্যের’ পত্তন হয়েছিল। কিন্তু মোটামুটি প্রায় ৯৬২ সালের পর থেকে এর দুর্বলতাগুলো ফুটে উঠতে থাকে। তাতে নানান যুদ্ধ জড়ানো ও বিজয়ের পরে এর জেনারেলরা একেক ছোট রাজ্য দখল করে, এর রাজা হয়ে শাসন চালাতে থাকে।
ওদিকে হলি রোমান এম্পায়ারও তখন বহাল হলেও নাম-কাওয়াস্তে ও কর্তৃত্বহীন হয়ে গেলেও টিকে আছে এমন ছিল। তখনকার দিনে রাজা-সম্রাটের হেডকোয়ার্টার কোথায় অর্থাৎ কোন শহরে বসেন বা কোথায় সিংহাসন গ্রহণের অভিষেক অনুষ্ঠান করেন সেসব শহর গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যদিও সাম্রাজ্যের সীমানা কতদূর সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বড়জোর কোথাও হয়তো মুখে বলা থাকত ওমুক নদী বা বন পর্যন্ত, এর চেয়ে বেশি কিছুই সুনির্দিষ্ট সীমানা নয়। এ কারণে সেকালে রোম গুরুত্বপূর্ণ, ইটালি নয়। বাগদাদ গুরুত্বপূর্ণ ইরাক নয়। ইরাক বলে কিছু ছিলও না- এরকম।
ফলে ইউরোপের আজকের বিভিন্ন শহর বা রাজ্য যা ইতোমধ্যে যুদ্ধ ফেরত জেনারেলরা কার্যত রাজা-সাম্রাজ্য বানিয়ে ফেলেছিল এদের মধ্যে কার সীমানা কতদূর এ নিয়ে বিতর্ক ওঠা শুরু হয়েছিল; কিন্তু সেসব বিতর্ক মিটাবে কী করে তারও কোনো সুরাহা ছিল না। কারণ কাগজ-কলমে সব রাজ্যই হলি রোমান এম্পায়ারের কর্তৃত্বহীন হলেও নিজে নামকাওয়াস্তে।
অর্থাৎ দীর্ঘদিন একভাবে ‘কার্যত’ সমাধান করে চলতে চলতে এরা ক্রমশ অসহনীয় অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছিল। এমনই আরেক ফ্যাকড়ার যুদ্ধের সমস্যার কথা আগেই বলেছি। তাই ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফিলিয়া ছিল সেসব বহু অমীমাংসিত বিরোধ বা সমস্যার জঞ্জাল সাফ করতে নানান ইস্যুতে আপোষনামা-রফা সূত্র-বের করে সমাধান করা। তাই, ওয়েস্টফিলিয়া চুক্তি ১৬৪৮কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট মনে করা হয়।
সভরেন ধারণার উৎপত্তি
সভরেন বা সার্বভৌমত্ব বা সার্বভৌম ধারণার উৎপত্তি কোথা থেকে। উপরে যা বলছিলাম, যুদ্ধফেরত জেনারেলরা পরবর্তিতে ডায়েনেস্টি গড়ে কার্যত রাজা-সাম্রাজ্য কায়েম করার পরে পারস্পরিক সীমানা বিতর্ক আপোষে কথা বলে সমাধান করে নিতে চাইছিল। তাতে শেষে চিহ্নিত করে ফেলা ভূখণ্ডের ওপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব ওই রাজা-সম্রাটের, এ কথা বলে তারা পরস্পর চুক্তি করে নিতে চাইছিল। আর তা থেকে সীমানাচিহ্নিত হবার পরে ভূখণ্ডের ওপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব একথাটারই এককথায় প্রকাশিত শব্দ হলো সভরেন রাইট। যার ভূখণ্ড সেই রাজা-সম্রাটের সভরেন রাইট। এটিই পরে মর্ডান রাষ্ট্রের নিজ ভূখণ্ডের ওপর সভরেন রাইট ধারণা হয়ে এসেছে।
ক্ল্যাসিক স্যেকুলারিজম
রাজা-প্রজার সম্পর্কটা এমন যে সেখানে রাজার অধীনস্ততা স্বীকার করা আছে। অনেক সময় যা দাস-সম্পর্ক বলেও প্রতিষ্ঠিত। এককথায়, রাজার ইচ্ছাই সুপ্রিম বা শেষ কথা। এছাড়া, প্রজার আবার ইচ্ছা কী? প্রত্যেক মানুষের ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ ধারণাটাই তখন অনুপস্থিত। তাই সহজেই রাজার অধীনস্ত প্রজা এই ধারণাটিই সেখানে আধিপত্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
এখন এই রাজা-প্রজার নির্ধারিত অধস্তন সম্পর্কের মধ্যেও প্রশ্ন এসেছে- একই খ্রিস্টানিটির কে কোন ধারা অনুসরণ করতে পারবে সেই প্রশ্নেও কী প্রজা অধস্তন! ফলে এখানে রাজা নিজের ধারার খ্রিস্টানিটির, প্রজার ওপর এনফোর্স মানে চাপিয়ে বাধ্য করতে চাইলে কী হবে?
সবকিছুই চাপিয়ে দিতে রাজা যেহেতু অভ্যস্ত তাহলে ধর্মের বেলাতেও তা হবে না কেন? আর প্রজা এক্ষেত্রে অধীনতার এতদূর পর্যন্ত হাত এটা মানবে না। কারণ মানুষ নিজ (ধারার) ধর্মের জন্য মরতে প্রস্তুত হবে এটাই তো স্বাভাবিক। এটা ন্যায়-অন্যায় বা সত্য-অসত্যের মামলা। এমনকি মজলুম-আর জুলুমবাজ ফারাকের মামলা! এই ইস্যুতে সে রাজার অধীনস্ততা দণ্ড মানবে না। এটাই প্রজার শেষ কথা।
অতএব, ৩০ বছর ভোগার পরে রাজার আপোষ রাস্তা। কিন্তু কী সেটা? খুব সহজ। রাজার খ্রিস্টানিটির ধারা-ফ্যাকরা অনুসরণ প্রজাকে করতে হবে না, এই হল নীতি। এর চেয়েও বড় কথা রাজার খ্রিস্টানিটির ধারা অনুসরণ করলে রাজা তেমন প্রজাকে বিশেষ কোনো সুবিধা দিবে, এমনটা বন্ধ করতে হবে। কাজেই সরাসরিভাবে বললে, এক. রাজার অনুসৃত ফ্যাকড়া মানতে প্রজা বাধ্য নয়। দুই, রাজার অনুসৃত ফ্যাকড়া প্রজা অনুসরণ করুক আর নাই করুক প্রজাদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করতে পারবে না, বৈষম্যের চোখে তাদের দেখতে পারবে না, এককথায় প্রজামাত্রই তারা সমান হকের দাবিদার হবে, এই হলো সেই নীতি।
এখান থেকেই মডার্ন রিপাবলিক কপি করে যেটাকে ‘রাজনৈতিক সাম্যের’ ধারণা বলে তারা নিয়েছে। তাই, এই ‘ক্ল্যাসিক স্যেকুলারিজম’ কথার আসল মানে হলো- বৈষম্যহীন রাজনৈতিক সাম্য।
এখন খেয়াল করলে দেখা যাবে, অর্থডক্স রাজা যদি ক্যাথলিক বা প্রটেস্টান্ট সব ধরনের প্রজার সাথেই বৈষম্যহীন রাজনৈতিক সাম্যের ভিত্তিতে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে তার দেশের প্রজা মুসলমান বা অন্য ধর্মের হলেও কিছু এসে যায় না। কারণ রাজা তো প্রজা মাত্রই সমান চোখে দেখতে বাধ্য।
অতএব, সেকালের রাজার প্রজা মানে, একালে রিপাবলিক রাষ্ট্রে নাগরিক সে কোন ধর্ম অথবা পরিচয়, নারীপুরুষ বা পাহাড়ি-সমতলী বা যে কোনো এথনিক গোষ্ঠী পরিচয়ের হোক, সবার বেলায় বৈষম্যহীন রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই সমাধান। এটাই ক্ল্যাসিক অর্থে স্যেকুলারিজম।
যদিও পরবর্তীতে ইউরোপ, বিশেষ করে ব্রিটেন ১৯২৩ সাল থেকে এখানে থাকেনি। আর সেখান থেকে স্যেকুলার মানেই ইসলাম বিরোধ, এই অর্থ করেছে তারা। ব্যতিক্রম কেবল আমেরিকান কনস্টিটিউশন যার ফাস্ট এমেন্ডমেন্ট (১৭৯১) উলটা ধর্ম পালনের স্বাধীনতা এবং ধর্মপালনকে বেসিক নাগরিক অধিকারের অংশ করে গৃহীত হয়েছে; কিন্তু তাতে কী? ২০০১ সাল থেকে ওয়ার অন টেররের আমলে প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ারের সাথে মিলে প্রেসিডেন্ট বুশ নিজ কনস্টিটিউশন লঙ্ঘন শুরু করেছে। দুনিয়াব্যাপী কেউ মুসলমান হলেই তার সাথে বৈষম্য করে যাচ্ছে। বুশ-ব্লেয়ারের এই অসততার কারণে, এখন স্যেকুলার শব্দটা বিতর্কিত ও পরিত্যাজ্য হয়ে গেছে।
গৌতম দাস
রাজনীতি বিশ্লেষক