আমি কী রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সাহায্য করছি

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২২, ১১:২৩ এএম | আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২২, ১২:৩৪ পিএম

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

রমজান মাসে বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে কে? এটা জানতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে কেন পণ্যের দাম বাড়ে। মৌলিক নিয়ম হলো দ্রব্যমূল্য বাড়বে চাহিদা বৃদ্ধির সাথে। কোনো পণ্যের সামগ্রিক সরবরাহ কমে গেলে দামও বাড়বে। উল্টো দিকে, চাহিদা হ্রাস ও সরবরাহ বাড়লে পণ্যের দাম কমে যাবে। 

ইসলামের প্রাথমিক যুগে মানুষ কিভাবে রোজার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন আমরা যদি সেই দিকে আলোকপাত করি তাহলে আমরা জানতে পারব যে  কিভাবে আমাদের উচিত রোজা পালন করা উচিত।

আজকের সৌদি আরবের মদিনা শহরের প্রথম মুসলমানরা নবী মুহাম্মদের (সা.) নির্দেশনায় রোজা রাখা শুরু করেছিল। ৬২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে, মদিনা শহরে প্রথম রমজান পালিত হয়েছিল। সময়টি মহানবী (সা.) হিযরতের দ্বিতীয় বছর। আর প্রথম রমজানটি হয়েছিল মার্চ মাসে, বসন্তকালে। এসময়ে মদিনাসহ আরব উপদ্বীপে তাপমাত্রা তুলনামূলক কম ছিল।

মদিনায় হিযরতের আগে মুসলমানদের জন্য রোজা ফরজ ছিল না। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমন করার পর শুধু আশুরার (মহররম মাসের ১০ তারিখের) রোজা রাখতেন।

মদিনায় দ্বিতীয় হিজরির ১০ শাবান মুমিন মুসলমানের ওপর রমজানের রোজা ফরজ হয়। আল্লাহ তাআলা সে কথা কুরআনে উল্লেখ করেছেন-

‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের আগের লোকেদের প্রতি ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)

এরপর আল্লাহ তাআলা আয়াত নাজিল করেন-

‘রমজান মাস, এ মাসেই নাজিল করা হয়েছে কুরআন। মানুষের জন্য হেদায়েত, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন এবং হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী।

অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসে রোজা পালন করে। তবে কেউ রোগাক্রান্ত হলে অথবা সফরে থাকলে এ সংখ্যা অন্য সময় পূরণ করবে। আল্লাহ চান তোমাদের জন্য যা সহজ তা, আর তিনি চান না তোমাদের জন্য যা কষ্টকর তা, যেন তোমরা সংখ্যা পূর্ণ করো এবং আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো, তোমাদের সৎপথে পরিচালিত করার জন্য এবং যেন তোমরা শুকরিয়া আদায় করতে পার।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)

এরপর থেকেই মুসলিম উম্মাহর প্রতি পুরো রমজান মাস রোজ ফরজ হয়ে যায়। সে থেকে মুমিন মুসলমান মাসব্যাপী রোজা পালন করে আসছেন।

এই আয়াত নাযিলের অল্প দিন আগে মুসলমানরা তাদের প্রার্থনার দিক (কিবলা) জেরুজালেম (কুরআনের কুদস) থেকে মক্কার কাবাতে পরিবর্তন করেছিলেন। সালাতের কিবলা পরিবর্তন করে এবং এক মাসের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে রোজা বেখে মুসলমানরা প্রথম গভীরভাবে অনুভব করেছিল যে তারা অন্যান্য একেশ্বরবাদী গোষ্ঠী, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের থেকে একটি আলাদা ধর্মীয় সম্প্রদায়।

রোজা হলো একজন মুসলিমের শারীরিক সহনশীলতার পাশাপাশি তার মানসিক শক্তির পরীক্ষা। সিয়াম পালনের ফজিলত সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ইখলাস নিয়ে অর্থাৎ একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে সন্তুষ্টি করার জন্য রমাদানে সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি : ২০১৪)

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত- আল্লাহর রসূল (সা.) বলেছেন,‘আদম সন্তানের প্রতিটি সৎকর্ম তার জন্যই। কিন্তু রোজা স্বতন্ত্র, তা আমার জন্য। আর আমি তার প্রতিদান দেবো। সে পানাহার এবং যৌনাচার ছেড়ে দেয় একমাত্র আমারই জন্য। রোজা ঢাল স্বরূপ। কাজেই তোমাদের কেউ যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং হৈ হট্টগোল না করে। আর যদি কেউ তাকে গালিগালাজ করে অথবা তার সাথে লড়াই-ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি রোজাদার। সেই মহান সত্তার শপথ, যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, নিঃসন্দেহে রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকটে মৃগনাভির সুগন্ধ অপেক্ষা অধিক উৎকৃষ্ট। রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দময় মুহূর্ত রয়েছে তখন সে আনন্দিত হয়। যখন সে ইফতার করে তখন সে আনন্দিত হয়। যখন আপন পালনকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন সে স্বীয় রোজার জন্য আনন্দিত হবে।’ সহীহ আল-বুখারী ১৮৯৪

ইসলামিক চিন্তাধারায়, রোজা মানে শুধু খাবার ও পানীয় থেকে নিজেকে নিষিদ্ধ করা নয় বরং আপনার অন্যায় থেকে নিজেকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করা।

আল্লাহর রসূল (সা.) রোজাকে একটি ঢাল হিসেবে দেখেন, যা মুসলমানদের মন্দ কাজ থেকে রক্ষা করে। মানুষের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরো ধৈর্যশীল হওয়া, খারাপ কথা এড়িয়ে চলা রোজাদারের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে।

রমজানের আধ্যাত্মিক দিকের উপর জোর দিয়ে  মুসলিম পণ্ডিত মুহাম্মাদ আল বুখারি দ্বারা লিপিবদ্ধ একটি হাদিস বলেছেন, আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত- ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কথা ও মন্দ কাজ পরিত্যাগ করে না, আল্লাহ তার খাদ্য ও পানীয়ের মুখাপেক্ষী নন (অর্থাৎ আল্লাহ তার রোজা কবুল করবেন না)।’ রেফারেন্স: সহীহ আল-বুখারী ১৯০৩ (ইন-বুক রেফারেন্স: বই ৩০, হাদিস ১৩)

ফলে রমজানে নবী ও তার সাহাবীরা অন্যান্য ইবাদত বাড়িয়ে দিতেন। প্রতিটি মানুষের ক্রিয়াকলাপও রমজানের আচার অনুসারে সাজানো হয়েছিল কারণ মুসলমানরা প্রথম রমজানকে তাদের আধ্যাত্মিক জীবনের ‘কেন্দ্রিক’ সময় হিসেবে দেখেছিলেন। রমজানে রোজা পালন ও ইবাদত করা মানে সব কাজ ও দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য অনুশীলন ছেড়ে দেওয়া নয়। 

‘আল্লাহর রসূল (সা.) রমজানে তার দৈনন্দিন জীবনে ব্যাঘাত না ঘটাতে চেষ্টা করতেন এবং যদি তাকে রোজা অবস্থায় কিছু করতে হয় তবে তিনি তা করতেন। তিনি রোজার অজুহাতে কোনো কাজ করতে দেরি করতেন না। বদরের যুদ্ধ রমজান মাসে হয়েছিল, তখন রসূল (সা.) রোজা রেখেই যুদ্ধ করেছিলেন। 

তাদের খাবার কি ছিল?

আজকের মুসলমান ও প্রথম মুসলমানদের মধ্যে শুধুমাত্র নৈতিকতার দিক থেকে নয়, তাদের দ্রুত ভঙ্গকারী মনোভাবের ক্ষেত্রেও কিছু দূরত্ব রয়েছে। রমজানের খাবারের ক্ষেত্রে আমাদের ও নবী-সাহাবীদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। প্রথম মুসলমানদের খাবারের বৈচিত্র্য ও পরিমাণের দিক থেকে এখনকার মতো খাবার পাওয়ার সুযোগ ছিল না। তাদের সেহেরি ও ইফতার ছিল খুবই সাধারণ। তখন তারা সেহেরিতে সম্ভবত পানি ও কয়েকটি খেজুর খেতেন। এ ধরনের সেহেরি এখন অনেক মুসলিম পরিবারের জন্য প্রায় অচিন্তনীয়। আমাদের নবী করীমের (সা.)  ইফতারের খাবার ছিল অত্যন্ত সাধারণ, বিলাসিতা ও অপচয় থেকে অনেক দূরে। বর্তমানে ইফতারের সময়, স্যুপ থেকে ভাত পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের খাবার ও অন্যান্য খাবার যেমন ফল ও মিষ্টান্ন যুক্ত করা হয়।

ওই সময়ে মদিনায় এমন কিছু লোকও ছিল যাদের কাছে এমন খাবারও ছিল না। ফলে, নবী মুহাম্মদ (সা.) আর্থিকভাবে অবস্থাসম্পন্ন মুসলমানদেরকে ইফতার গরীব মুসলমানদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য অনুরোধ করেছিলেন। সাধারণত ইফতারে তাদের খাবার ভাগ করে নেওয়ার জন্য বন্ধু, আত্মীয় ও দরিদ্রদের আমন্ত্রণ জানানো মুসলিম ঐতিহ্য।

বিশেষ করে আল-সুফ্ফা যারা ছিলেন, যারা গৃহহীন ও অবিবাহিত ছিলেন, মক্কা থেকে মদিনায় হিযরত করেছিলেন এবং নবীর কাছ থেকে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তারা খুব দরিদ্র ছিলেন। মুহাম্মদ (সা.) তাদের সাথে বসতেন, একসাথে আলাপ করতেন এবং তাদের খাবার খেতে ডেকে আনতেন এবং পানীয় একোথে ভাগ করে খেতেন। ফলে তাদেরকে তার উপর নির্ভরশীল হিসেবে গণ্য করা হত। সাহাবারা আসহাবে সুফফার দুই বা তিনজনকে নিজেদের ঘর থেকে খাবার খাওয়াতেন।। এছাড়াও সাহাবারা সর্বোত্তম খেজুর নির্বাচন করে আল-সুফফার ছাদে আসহাবে-সুফফাদের খাওয়ানোর জন্য ঝুলিয়ে রাখতেন।

 নবী করীম মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যিনি রমজানে অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি উদার ছিলেন, তিনি ইফতারের পাশাপাশি সেহেরিতে মুমিনদেরকে আমন্ত্রণ জানাতেন এবং তাদের সাথে খাবার ভাগ করে খেতেন।

সুতরাং আমাদেরকে বুঝতে হবে রমজানের আসল উদ্দেশ্য কি? 

রোজা হলো কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যম, রোজার সময় খাদ্য ও পানীয় এবং বাকি হালাল ইন্দ্রিয়গত কামনা-বাসনা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে, এই সব আশীর্বাদের পরিপূর্ণ পরিধি প্রকাশ পায়, যা একজন ব্যক্তিকে এই সব মহান ঐশী অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে দেয়া হয় এবং যার জন্য আল্লাহ প্রতিদান চায় না।

আল্লাহ তাআলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন- ‘রমাযান মাস- যার মধ্যে কুরআন নাযিল করা হয়েছে লোকেদের পথ প্রদর্শক এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট বর্ণনারূপে এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে, কাজেই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসে রোযা পালন করে আর যে পীড়িত কিংবা সফরে আছে, সে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে, আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান, যা কষ্টদায়ক তা চান না যেন তোমরা মেয়াদ পূর্ণ করতে পার, আর তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মাহাত্ম্য ঘোষণা কর, আর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার।’ [আল-বাকারা, আয়াত-১৮৫]

রোজা হলো ক্ষুধা ও তৃষ্ণা সহ্য করার ধৈর্য্য গড়ে তোলা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আকাঙ্ক্ষা থেকে বিরত থাকা এবং মানুষের অন্ধ আনন্দের অন্বেষণকে নিবৃত্ত করার মাধ্যমে শয়তানী প্ররোচনা থেকে রক্ষা করার একটি উপায়। একটি অবাধ্য আত্মা যা অবাধে আনন্দের পিছনে ছুটছে শয়তানের সহজ শিকার, আল্লাহর আশীর্বাদ উপভোগ করার জন্য সংযম ও নিয়মের প্রয়োজন। একইভাবে শয়তানী প্রলোভনকে প্রতিহত করার জন্য এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। 

এই অর্থ নবীর কথায় প্রমাণিত হয় যিনি বলেছেন, ‘হে যুবকগণ, যার সামর্থ্য আছে সে বিয়ে করবে কেননা তা দৃষ্টিকে অবনমিত করতে এবং সতীত্ব রক্ষায় সাহায্য করে। কিন্তু তোমাদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য নেই, তাদের রোজা রাখা উচিত। যৌন আকাঙ্ক্ষা দমন করার একটি উপায়।’ [বুখারি ও মুসলিম]।

রমজানের প্রস্তুতি মানে কি ? 

বর্তমানে এটা দেখা যায়, সমাজে যারা সামর্থ্যবান রয়েছে তাদের অনেকেই রমজান মাসে খাবার ও অন্যান্য অনেক কিছুতে অর্থের অহেতুক অপচয় করে থাকে। এ সুযোগে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্য ও পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট তৈরির সুযোগ পায়। এছাড়াও, বিত্তবানদের অনেকেই লোকদেখানো ইফতার পার্টি ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শুধুমাত্র সামাজিকভাবে নিজেকে জাঁকজমকপূর্ণভাবে প্রদর্শনের জন্য।  

অথচ, যাদের সামর্থ্য আছে তাদের উচিত, প্রতিটি ইফতার ও সেহেরিতে বিত্তহীন প্রতিবেশিদের সাথে খাবার ভাগ করে নেওয়া ও তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসা। আর এই মানসিকতার ভেতরেই নিহিত রয়েছে রমজানের মূল তাকওয়া।

অবশেষে আশা করি, রমজান পালনের মাধ্যমে আমরা যাতে সঠিকভাবে কোরআন ও হাদিসের আলোকে চিন্তাভাবনা করার মানসিকতা অর্জন করতে পারি। 

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পুরো রমজান মাসজুড়ে রোজা পালন, ফরজ ও নফল নামাজ, জিকির-আজকারের করার তাওফিক দান করুন। রমজানের রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh