ভোগবিলাসে মত্ত ধনী, মাশুল গুনছেন দরিদ্র

কে এম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২২, ০৯:২২ এএম

রমজান যেন সারাবছরের ব্যবসা করে নেওয়ার মাস। ফাইল ছবি

রমজান যেন সারাবছরের ব্যবসা করে নেওয়ার মাস। ফাইল ছবি

সংযমের মাস রমজানে ত্যাগ ও আত্মশুদ্ধির পরীক্ষা দিতে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে চলে মূল্য ছাড়ের প্রতিযোগিতা। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যবসায়ীদের আচরণে মনে হয়- রমজান যেন সারাবছরের ব্যবসা করে নেওয়ার মাস! এবারো তার ব্যতিক্রম নয়; রমজাননির্ভর প্রতিটি পণ্যমূল্যেই ক্রেতার হাত পোড়ার অবস্থা। অথচ বাজারে বাজারে পণ্যে ঠাঁসা সব দোকান, যা চাহিদার তুলনায় ঢের বেশি। 

স্থানীয় উৎপাদন, আমদানি ও মজুদ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সরকারি সংস্থাগুলো অবশ্য বলছে, রমজানে যেসব পণ্যের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়, সেগুলোর মজুদ পরিস্থিতিতে কোনো সংকট নেই। সাপ্লাই চেইনও স্বাভাবিক রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দাম বৃদ্ধিরও কোনো কারণ নেই। তাছাড়া রমজানে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় ৪০ পণ্যের যৌক্তিক দাম। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে গঠিত হয়েছে উচ্চ পর্যায়ের টাস্কফোর্স। পাশাপাশি একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজার তদারকি জোরদার করেছে; কিন্তু এতসব উদ্যোগেও বাজারে স্বস্তি মিলছে না। 

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, রমজান এলেই বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে, বিশেষ করে বেশকিছু পণ্যের দামে অস্থিরতা দেখা দেয়। এ সমস্যা পুরনো হলেও, এর সমাধান করা যায়নি। বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা লুটছেন। এমন পরিস্থিতির জন্য সামর্থ্যবান ভোক্তাদের বেশি দুষছেন অর্থনীতিবিদরা। রমজান মাসে বাড়তি খরচের চাপে দিশেহারা স্বল্প ও নিম্নআয়ের সবাই। ইফতার ও সেহরিসহ রোজায় খাবারের তালিকা ছোট করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

অথচ বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অল্প সময়ে অতিরিক্ত মুনাফা করছে। প্রতি বছর রোজায় এমনটা হয়ে এলেও, এ থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছেন না ভোক্তারা। জিনিসপত্রের দাম নিয়ে যে কারসাজি হচ্ছে, সেগুলো বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতারই উপসর্গ। উন্নয়নশীল দেশের বাজারব্যবস্থার সাথে এসব সঙ্গতিপূর্ণ নয়, বরং সাংঘর্ষিক। এতে ভোক্তা ও উৎপাদক কারও স্বার্থই রক্ষা হচ্ছে না।

উল্টে যাওয়া সূত্র : রমজান ঘিরে নিত্যপণ্যের যে চাহিদা তৈরি হয়, তার চেয়ে বেশি এবার মজুদ করা হয়েছিল। তারপরও যেন অর্থনীতির সূত্রটাই বদলে গেছে। অর্থনীতির নিয়মে- সরবরাহ বেশি থাকলে দাম কমার কথা; কিন্তু বাজার চিত্র তার বিপরীত। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট আমদানি হয়েছে ২১ লাখ ৭১ হাজার টন ভোজ্যতেল। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১৮ লাখ টন। এর সাথে স্থানীয় উৎপাদন সরিষাসহ অন্য তেলবীজ থেকে আরো উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার টন। সব মিলিয়ে গত বছরের উদ্বৃত্তসহ এবার মজুদ দাঁড়ায় ২ লাখ টনের বেশি ভোজ্যতেল। এছাড়া প্রায় ২ লাখ ৩২ হাজার টন তেল আসার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এরপরও সংকট দেখিয়ে তেলের বাজারকে অস্থিতিশীল করে রেখেছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। 

টিসিবির তথ্য বলছে, গত এক বছরে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে ১৬ থেকে ২২ শতাংশ। আগের বছর সয়াবিন তেলের এক লিটারের বোতল বিক্রি হয়েছে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। পাঁচ লিটারের সয়াবিন বিক্রি হয়েছে ৬৩০ থেকে ৬৫০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বোতলজাত ৫ লিটার সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ৭৯০ থেকে ৮০০ টাকা এবং এক লিটার বিক্রি হচ্ছে ১৬৫ থেকে ১৬৮ টাকা। আর খোলা সয়াবিন তেলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৭৮ টাকা দরে।  

ইফতারির অন্যতম অনুষঙ্গ ছোলা। গত বছর মানভেদে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছিল ৬৫ টাকা। এ বছর ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে বেসন বিক্রি হচ্ছে ১৩০ টাকা কেজি, যা কিছু দিন আগেও ছিল ৮০ থেকে ৯০ টাকার মধ্যে। গত বছর প্রতি কেজি সাদা ও লাল চিনি ৬৫ থেকে ৭০ টাকাতে বিক্রি হলেও, এ বছর ৮০ থেকে ৯০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। দেশে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টন চালের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন ৩ কোটি ৭৬ লাখ টন। গত বছরের তুলনায় প্রতিটি সবজি প্রকারভেদে ২০ থেকে ৭০ টাকা বেড়েছে। 

নিত্যপণ্যের দাম বাড়া প্রসঙ্গে টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির বলেন, ‘রমজানে যেসব নিত্যপণ্যের চাহিদা বেশি; বিশেষ করে- সয়াবিন তেল, মসুর ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, খেজুর ও ছোলা ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। তবে দেশে এসব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। বাজারে দাম বাড়ার কথা নয়।’

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘রোজায় বাজারে অস্থিরতা অতীতেও দেখেছি, এখনো দেখছি। সুতরাং অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল। মাত্র কয়েকজনের সিন্ডিকেটের কব্জায় বাজার। সরকারের উচিত এদের নিয়ন্ত্রণ করা।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া কিংবা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলে কাজে আসবে না। তাছাড়া কৃষি বিপণন অধিদপ্তর যে আইনের ওপর ভিত্তি করে মূল্য বেঁধে দিচ্ছে, সেখানেও ত্রুটি রয়েছে। খুচরা বাজারে নয়; মিলগেট, মজুতদার, চালকল ও আড়ৎগুলোতে নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বন্ধ করতে হবে কয়েক স্তরে চলা চাঁদাবাজি।’

অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘কিছু অতি লোভি অসাধু ব্যবসায়ী পণ্য মজুদ করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে জনজীবনে দুর্ভোগ তৈরি করছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য বৈশ্বিক পরিস্থিতিকে দায়ী করা হলেও, প্রকৃতপক্ষে সুশাসনের অভাব। সেইসাথে সরকারি সংস্থাগুলোর অদক্ষতা ও সমন্বয়হীনতা এর জন্য দায়ী।’

বছরের লাভ এক মাসেই! : অনেক ব্যবসায়ী বলছেন, এক মাসে লাভ করে চলতে হবে সারাবছর। আর এই লাভের যাতাকলে শ্রমজীবী মানুষ জন আজ দিশেহারা, যাদের পক্ষে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই দুষ্কর। অন্যদিকে গরিবের মেহনতের ফসল বিদেশে পাচার করে একটা শ্রেণি। এদেশের টাকা দিয়ে বিদেশে মার্কেটিং করে। অসুখ হলে তারা চিকিৎসাও করায় দেশের বাইরে। এটা যেমন অর্থনৈতিক বৈষম্য, তেমনি জীবনমানেরও। 

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো এসএম জুলফিকার আলী বলেন, ‘মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার সঠিকভাবে বাজার ব্যবস্থাপনা ও তদারকি করতে পারছে না। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ওপর থেকে কী সিগন্যাল দিচ্ছেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। ন্যূনতম জীবনমান বজায় রেখে যাতে দরিদ্র জনগণ চলতে পারে, সরকারকে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’

বাজার মনিটরিং নিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার অবশ্য বলেন, ‘রমজানে বেশি চাহিদা থাকে এমন পণ্যগুলোর বাজারে আমরা নজর রাখছি রাত-দিনে। পাশাপাশি পণ্যের ট্রাকগুলোতেও নজর রাখা হচ্ছে। এরপরও কারসাজির অভিযোগ। তবে কৃষি বিপণন আইনানুযায়ী পাইকাররা যাতে ২০ এবং খুচরা বিক্রেতারা ৩০ শতাংশের বেশি মুনাফা করতে না পারেন, সেদিকে আমাদের বিশেষ তদারকি রয়েছে।’

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

Design & Developed By Root Soft Bangladesh